| 25 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: নদীভাঙন, সংকট ও সাহিত্য ।  অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

নদীভাঙন, সংকট ও সাহিত্য: একটি প্রান্তিক আখ্যান   

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

 

“ও নদীরে…

এ কূল ভেঙে ও কূল তুমি গড়ো
যার একূল ওকূল দুকূল গেল তার লাগি কি করো?

আমায় ভাবছো মিছেই পর, তোমার নেই কি অবসর
সুখ দুঃখের কথা কিছু কইলে না হয় আমারে …
বলো কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কি চলার শেষ
ও নদীরে…”

ওইখানে এখনও প্রতিদিন নতুন ভোর আসে। প্রতিদিন ঘাটজুড়ে নতুন দৃশ্যপটের জন্ম হয়। এই ঘাটেই প্রতিদিন জন্ম নেয় নতুন খবর, জানা যায় কীভাবে বদলাচ্ছে মানচিত্র; সেইসঙ্গে মানুষের যাযাবর জীবন। সে কিন্তু ইতিহাস ঘুরে বেছে নেয়নি এই যাযাবরত্ব, যেন নিয়তি এমন নিয়মই করে দিয়েছেন। নদী যেমন রেখেছিল, নদীই কেড়েছে সবকিছু। একবার না, বার বার। জন্ম ইস্তক ভাঙতে ভাঙতে সে শিকড় ছড়াতে পারে না। গাছ হয়ে ওঠে না। সেদিন পঞ্চানন্দপুরের পাগলাঘাটে দাঁড়িয়েছিল সে। ভরা গঙ্গার ওপারের দিকে চেয়েছিল। পুরোনো সেই পঞ্চানন্দপুর, কাকুবন্ধা ঝাউবোনা, তার ছেলেবেলা… সে-সব কবেই জলের তলায়, তীরের মাটি কেবল নামটিই বহন করে। এই নাম ছুটে চলেছে ফসলের খেত, বাগানবাড়ি, বসতি এলাকা, স্কুল, দরগা সবকিছু মাড়িয়ে। তার ছেলেবেলার ভগবানটোলা গ্রাম এখনও আছে; তবে পিছিয়ে এসেছে বহু পথ। চার দশক আগে তার চেনা গ্রামের চেহারার সঙ্গে এখনকার ছবির কোনো মিল নেই। ফটো ফোল্ডার খুলে পুরানো ছবির সঙ্গে এখনকার ছবি মিলায় সে। কোনো কিছুই মেলে না। সাহেববাড়ির লম্বা দরজার শেষ মাথায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব কবেই হারিয়েছে! সেই সাহেববাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল, বাজার, কিছুই নেই। সে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে চায়। জিজ্ঞাসা করে। চারিদিকে কোলাহলে মিশে থাকে হাহাকার। সে বোঝে। কোনো পরিবারের শেষ অস্তিত্বটুকু হয়তো আগের দিন বিলীন হয়ে গেছে। কারোটা হয়তো অপেক্ষা করছে পরের দিনের জন্য। মানুষজন একবুক আশা নিয়ে রাতে ঘুমোতে যায়; ভোরে হয়তো ভাঙন থামবে! কিন্তু না, থামে না। বরং বাড়ে। বিপন্ন মানুষের জীবনের হাজারও গল্প এখানে তৈরি হয় প্রতিদিন; সে-সব গল্পের কোনো শেষ থাকে না।

 

মনু বলেছেন, যে ব্যক্তি নদীর স্রোতকে বিপথগামী করবে, তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার কর।… মনুর নির্দেশ অমান্য করে মনুবাদীরা ফারাক্কায় বিশাল বাঁধ দিয়েছে, যারা মনুবাদী নয় তারাও সমর্থন দিয়েছে…’’ (নিম্নগতির নদী, অভিজিৎ সেন)

 

কথাগুলো একটা গল্পের চরিত্রের মুখে শোনা গেলেও বাস্তবের মাটিতে গল্পের আবরারেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গঙ্গা-ফুলহারের পাড়জুড়ে… দিয়ারাজুড়ে, ফারাক্কার উজানে। পরাণ এই সবেই মিলেমিশে থাকে।

“এই আর কয়েক মিটার এগোলেই গঙ্গা গিলে নেবে সবকিছু, বাড়ি ঘর, জমি… সবকিছু, দিশেহারা হয়ে বলছিলেন পবন রুইদাস। মালদার মানিকচক ব্লকের ভূতনি কেশবনগরের বাসিন্দা। আশেপাশে দাঁড়িয়ে এই কথাটারই প্রতিধ্বনি করছিল হীরানন্দপুরের হালতু মণ্ডল, বিপুল মণ্ডল, রিতা হালদাররা। গত এক দশকে জল বাড়ার মরশুমে এইভাবে বিঘার পর বিঘা জমিকে ভাঙনে তলিয়ে যেতে দেখেছে তারা। বার বার বাড়িঘর হারিয়ে সরে আসতে আসতে এখন তারা ক্লান্ত। ভাঙন তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, সুখ, শান্তি, ভালোবাসা, জীবিকা, যাপন… এখন বৃষ্টি হলেই ভয়ে আর ঘুম আসে না।

রাজিকুল ইসলাম পঞ্চানন্দপুরের কে বি ঝাউবনের বাসিন্দা। ২০০২ থেকে ২০০৫-এর ভয়াবহ ভাঙনে একদা সমৃদ্ধ জনপদ পঞ্চানন্দপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে গেছে গঙ্গার গর্ভে। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ এই সময়ে তিনবার ঠিকানা পালটেছে কে বি ঝাউবোনা, এখন বাঙ্গিটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা। নিজের চোখে রাজিকুল ২০০২ সালে তলিয়ে যেতে দেখেছিলেন পঞ্চানন্দপুরের গঙ্গাভবন। দেখেছেন কীভাবে মালদার কালিয়াচক এক ও দুই ব্লকের খাসকোল, ডোমহাট, বিরনগর, রাজনগর ও পঞ্চানন্দপুর এলাকায় নদী ভাঙনের ফলে রাতারাতি হাজার হাজার মানুষ উদ্‌বাস্তু হয়ে আশেপাশের বাধ, আমবাগান, শহরের বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অমানবিকভাবে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।

বেশিদিন না, এই স্বাধীনতার পরপরেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই পঞ্চানন্দপুর একটি সমৃদ্ধ নদী-বন্দর এবং বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। ব্যাবসায়ীরা রাজমহল, সাহেবগঞ্জ, ধুলিয়ান এবং অন্যান্য শহর থেকে বড়ো নৌকা নিয়ে আসতেন, সওদা হত আম, রেশমগুটি, কলাইয়ের। এলাকাটিও একটি সম্পন্ন জনপদ ছিল, হাইস্কুল, চিনিকল, ব্যাঙ্ক-সরাইখানা এবং একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক বাজার ছিল, একে কেন্দ্র করে মানুষের আসা যাওয়া ছিল, একটা নদীকেন্দ্রিক যাপন এলাকাকে গঞ্জের চেহারা দিয়েছিল। শুধু বানিজ্য নয়, পঞ্চানন্দপুরকে বিখ্যাত করেছিল তার সুপ্রাচীন বৈষ্ণব সত্রগুলোও। পঞ্চানন্দপুরের রাস উৎসবকে ঘিরে এখনও প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হয়। দামোদরটোলা, মেঘুটোলায় রাসের মেলার বয়স প্রায় আশি বছর। মোটের উপর অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দুইভাবেই অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছিল এই এলাকা। তারপর, সে এক ভাঙনের ইতিহাস। নদীভাঙনের ফলে পঞ্চানন্দপুরের বেশিরভাগটাই এখন গঙ্গার গর্ভে। বাকি এলাকা ভাঙনের পর চেৎরুমাহাজানতলা স্থানান্তরিত হয়। ২০১২ সালে গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটির জরিপে কালিয়াচক ও মানিকচকের ৭৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতি হয়েছে। হারিয়ে গেছে স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ঘরবাড়ি… ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত দুই প্রজন্ম।

মানিকচক, কালিয়াচক— দুই পার করে কালিয়াচক তিন। বৈষ্ণবনগর, বীরনগর। এও এক প্রাচীন জনপদ। গত কয়েক দশকে গঙ্গা ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে একটা বড়ো অংশ। যেমন দেওনাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পারদেওনাপুর-অনুপনগর গ্রাম। পাললালপুর, শোভাপুর এলাকায় অসংখ্য বাড়িঘর। কালিতলা থেকে চরসুজাপুরগামী রাস্তাও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। একই অবস্থা কালিয়াচক তিনের গঙ্গাপারের একের পর এক গ্রামের। কিছুদিন থেমে থাকার পর ২০১৭ থেকে আবার বেড়েছে ভাঙন। বেড়েছে ভাঙন উদ্‌বাস্তুর সংখ্যা। নিরন্ন মানুষের হাহাকার… ২০১৮-তেই বিলাইমারি, মহানন্দাটোলার বেশ কিছু গ্রাম তালিয়ে গেছে গঙ্গায়। নদী কেড়ে নিয়ে যায় সহায়-সম্বল-সহ বসতবাটি বা পদতলের মাটি। কিন্তু আজও নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি কোনো ক্ষেত্রেই খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। একইভাবে নদী-ভাঙনজনিত সমস্যাদি সম্পর্কে আশানুরুপ সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি, যে-কারণে দক্ষিণ মালদা জেলায় একাংশ আজ বড়োই বিপন্ন। তীব্র ভাঙনে সরকারের উদাসীনতায় ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মালদার রতুয়া এক, দুই, হরিশ্চন্দ্রপুর এক, মানিকচক, কালিয়াচকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষগুলো ফি বছর নদীতে বর্ষার জল পড়তেই আতঙ্কে ভোগেন। এবছরও কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।

গেল বছর ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে আবার নতুন করে ঘর বেঁধেছেন হাসিনা বেগম, এই নিয়ে তিনবার। হাত তুলে দেখালেন— “ওই যে, ওইখানে হামাদের বাড়ি ছিল, চার বিঘা জমিও ছিল। নদী হামাদের সব খ্যায়ে লিছেহ… বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে জল এলে, সব ভাসিয়ে নিয়ে গেলে ছোটদের ঘরের চালে তুলে দিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। আর ওরা ভয়ে কাঁপতে থাকে”— বলতে বলতে চোখ ভেঙে জল আসে হাসিনার।

“এ পার গঙ্গা ও পার যমুনা

বিচহি লাগাইলে ফুলবাড়ি

হো গঙ্গা মাঈঈ

বিচহি লাগাইলে ফুলবাড়ি…”

“ওই গঙ্গা আর যমুনার মাঝে আমার বিয়ের ফুলের বাসর বসবে, ও গঙ্গা মাই”… নদীপারের মানুষের জীবনে, বিয়ের আশীর্বাদপত্রে জায়গা করে নেয় নদী… দুই নদীর মধ্যেই সে ফুলের বাসর গড়তে চায়। ভাঙন আর বন্যার মারি পেরিয়ে এ এক নতুন জীবনের খোঁজ। বার বার। ভাঙন এখনও এলাকার মানুষগুলোর কাছে প্রকৃতির অভিশাপ মাত্র, আল্লাহ্‌র গজব। নিয়তি। তাই দুঃখ আছে, বিলাপ আছে, ক্ষোভও আছে, কিন্তু রাগ নাই। মালদার মানুষের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সে। তবুও ভাঙনকে জয় করেই সবাই চলতে চায়। চলেও।

পাগলাঘাটের কাছে গঙ্গা নদীতে প্রবল স্রোত। দুপুরবেলায় পাড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন। কিছু বলতে এগিয়ে এলেন তোফাজ্জেল আহমেদ। বয়স সত্তর ছুঁয়েছে। কেমন আছেন জানতে চাইলে কষ্ট জড়ানো গলায় উত্তর আসে— “একটা পশু জবাই করে ছেড়ে দিলে যে অবস্থায় থাকে, আমরা এখন ঠিক সেভাবেই আছি। এর চেয়ে এতটুকু কম নয়। স্যার আপনি বিশ্বাস করেন, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না।” কথাগুলো বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন— “৮-৯ বছর ধরে এই ভাঙনের কান্না। সব হারাইছি। বাপের কাইল্যা ভিটা, জমিজমা, বাপ-দাদা-মায়ের কবরস্থান কিছুই নাই।” পাশেই দাঁড়িয়ে পরান মণ্ডল বলছিল— “আমাদের কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন আর। মাত্র বছর দুয়েক আগেও বাবা কৃষিকাজ করতেন। শেষবার আবাদ করতে গিয়ে চল্লিশ হাজার টাকা লোকসান গুনেছেন। আবাদ ছেড়ে দিয়েছি। আয় রোজগারের জন্য একখানা দোকান করেছিলাম। সে দোকানটাও যে কতবার বদলাতে হল হিসেব নেই।” নতুন করে আর হিসাবও রাখেন না ওরা। গঙ্গা-ফুলহারের তীরে হাঁটলে শোনা যাবে এমন হাজারও গল্প। যে-গল্পের কোনো শেষ নেই। বহুবার বাড়ি হারানোর পরেও সেই মানুষগুলো নদীর মাঝে খুঁজে ফেরেন পুরানো মাটি। ফেলে আসা জীবন।

এভাবেই বন্যা আর ভাঙনকে নিয়ে ঘর করে মালদার মানুষ। মালদা-ঝাড়খন্ডের সীমানা বরাবর, মালদাকে দক্ষিণ পশ্চিম বরাবর (মূলত দিয়ারা আর চর এলাকা) আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে গঙ্গা আর ফুলহার। তারই মাঝে সন্তর্পনে প্রবাহিত পাগলা, কালিন্দী, মহানন্দা আর ছোটো ভাগিরথী। একচল্লিশ বছর আগে গঙ্গার উপর যখন ফারাক্কা বাধ চালু করা হয়, তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জলপ্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা, অথচ সে-বাধই হয়ে উঠেছে মালদা ও মুর্শিদাবাদের অস্তিত্বের প্রধান অন্তরায়। ১৯৬৯-১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে মালদা জেলায় গঙ্গার বাম তীরের ভাঙনের ফলে ৪.৫ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফারাক্কা ব্যারেজের প্রবাহের উজানে। ২০০৪ সালের মধ্যে কালিয়াচক, মানিকচক ও রতুয়ার ৬৪টা মৌজা জলের তলায় বিলীন হয়েছে, উদ্‌বাস্তু হয়েছে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি পরিবার। ২০০৬ থেকে গঙ্গার মিড চ্যানেল, যা মানিকচকের ঘাটের কাছে গঙ্গা থেকে ভাগ হয়ে গঙ্গার বাম প্রান্তে জেগে ওঠা চরের মাঝখান দিয়ে পঞ্চানন্দপুরের দক্ষিণে আবার গঙ্গায় এসে মিশেছে, সক্রিয় হয়ে পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ফারাক্কা ব্যারেজের শৃঙ্খল এড়িয়ে পাগলা ও ছোটোভাগিরথী হয়ে গঙ্গা আবার নতুন পথ করে নেবে, বিপন্ন হবে মালদা শহর। গঙ্গা নদীর ইতিহাস বলে, প্রতি পাঁচশো বছরে গঙ্গা ডান দিক থেকে বাঁ-দিক, আবার ডান দিকে তার গতিপথ পালটায়। অশীতিপর রোহিনী সরকার, কেদার মণ্ডল বা তরিকুল ইসলাম— গঙ্গাভাঙন নিয়ে কাজ করা স্থানীয় মানুষেরা তাই আশঙ্কিত গঙ্গার গতিপথ নিয়ে। নদীর অস্বাভাবিক ভাঙনের জন্য ফারাক্কা ব্যারেজকেই দায়ী করেন নদীপারের মানুষ। ফারাক্কা ব্যারেজের ফলে গঙ্গার গতির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, দক্ষিণ মালদা জেলাজুড়ে ভাঙন ও প্লাবন বেড়েছে, নদীর উজানে জমে গিয়েছে বিপুল পলি। মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী বিপর্যয়কবলিত মানুষ তাই ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। একইসঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণ, জমি ও পুনর্বাসন দাবি করে আসছে। অব্যাহত বন্যা ও নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকরব্যবস্থা গ্রহণেরও তারা দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু শুনছে কে? ফারাক্কা ব্যারেজের উজান-ভাটিতে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাঙন প্রতিরোধের দায়িত্ব ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের। বাকি অংশ জেলা পরিষদ ও সেচ দপ্তরের করার কথা। প্রতি বছর ভাঙন প্রতিরোধের নামে মালদা-মুর্শিদাবাদের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বোল্ডার দিয়ে নদীর পাড় বাঁধানো হয় বর্ষার শুরুতে। ভাঙন প্রতিহত করার জন্য পার থেকে নদীর মধ্যে কিছু দূর পর্যন্ত পাথরের দেয়াল বা স্পার তৈরি করা হয়। ভারী বর্ষণে সব ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যায়। জলে ফেলা-বোল্ডারের অপসারিত জল স্পারে ভাঙন তৈরি করে। সে ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম, বসতি উজাড় হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হল স্পারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে স্রোত প্রতিহত হলে উজানেও আবার নতুন করে ভাঙন শুরু হয়।

ভাঙার নেশায় ভাঙছে নদী, ভাঙছে গাঁয়ের বুক

ভাঙতে ভাঙতে পালটে যাচ্ছে তোমার দেশের মুখ’’

ভাঙন কেড়ে নেয় অনেক কিছুই। জীবনযাপন, নিরাপত্তা, স্বপ্ন, মেয়েবেলা, শৈশব সবকিছুই। কেড়ে নেয় সংস্কৃতি, জীবিকা, সমাজ। নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত মানুষ ভূমিহীনের হয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। গৃহহীন পরিবার উন্মুক্ত আকাশের নীচে, পথের পাশে, বাধ, আমবাগানে, খাসজমিতে এসে আশ্রয় নেয়। সেখানে কোনো ভেদ নাই, বিভেদ নাই। ধনী গরিব নেই। হিন্দু-মুসলমান নেই। বরকত মিঞা আর ভুবন হালদার পাশাপাশি ঘর বাঁধে। এই উঠোনে মনসাগানের আসর বসলে পাশের উঠোনেও ভিড় জমে। এইভাবে এক নতুন বসত তৈরি হয়… হঠাৎ কলোনি কিংবা নয়াটোলা… এইসব নাম হয়ে যায়। তারপর আবার একদিন সেই বসতও হারিয়ে যায় নদীতে। বসতভিটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমি, ভদ্রাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিরন্ন মানুষ আবার নতুন ঘর খোঁজে। এসব চলতেই থাকে। সব হারানো মানুষগুলো ক্রমশ জড়িয়ে পড়তে থাকে ঋণের জালে। কখনো বেশি কখনো কম। শরণার্থীতে রূপান্তরিত এই জনগোষ্ঠীর একটা বড়ো অংশই প্রজন্মের পেশা ছেড়ে দিনমজুরে পরিণত হয়। বাইরে কাজ করতে যায়। এমনকী পরিবারের অধিকাংশেরই মহিলারাই প্রধান উপার্জনকারী অভিভাবক হয়ে ওঠেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবনে বাসা বাঁধে নানান অসুখ।

ভাঙন শুধু সংসার ভাঙে না, সমাজ ভাঙে। স্রেফ বেঁচে থাকার তাগিদে খসে পড়ে যাবতীয় নিরাপত্তা। একচিলতে বসতে কাঁপতে কাঁপতে বড়ো হয় রেহানা, মালতিরা। বিয়ে আর সুখের আড়কাঠি টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারে, মেয়ে আর শিশুরা পাচার হয়ে যায় দূরে।

বৃদ্ধি পায় অপরাধপ্রবণতা। চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব। মালদার মানিকচক, খাসকোল ও পঞ্চানন্দপুর এলাকায় এ-চিত্র অত্যন্ত স্বাভাবিক। ভাঙনে তলিয়ে গেছে স্কুল, ফলে বহু ছেলেমেয়ে একবার স্কুল ছেড়ে গেলে আর স্কুলে ফিরে আসতে পারে না, জনসংখ্যায় স্কুল ছুটের হার বেড়ে যায়। সরকারি খাতা কলমে অবশ্য দেখা যায় না। নদী ভাঙনের ফলে হাজার হাজার মানুষ বাধ বা রাস্তার ধারে, শহরের বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অমানবিকভাবে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, আর তাদের শিশুরা প্রতিকূল পরিবেশ ও অনাকাঙ্ক্ষিত পারিপার্শ্বিকতার মাঝে প্রতি মুহূর্তে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। যেভাবেই হোক শুধু বেঁচে থাকতে শেখা… আর কিচ্ছু না। ক্রমশ বেড়ে চলেছে শিশু শ্রম ও শিশু নির্যাতন; ফলাফল গন দারিদ্র্য আর পুষ্টিহীনতা, বাল্যবিবাহ, অপরাধ।

“এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা/এই তো বিধির খেলা/সকাল বেলা আমির রে ভাই/ফকির সন্ধ্যা বেলা”৷

এই পার ভাঙে ওই পার গড়ে। গঙ্গার উজানে পলি জমে জেগে ওঠা চরগুলো পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায়। চরে বসবাসকারি অসংখ্য মানুষ আজ নেই রাজ্যের বাসিন্দা। অথচ তাদের না আছে কোনো স্বীকৃতি না আছে কোনো নাগরিক পরিচয়পত্র। আর যা কিছু কাগজ ছিল, সে-সবই নদীর গ্রাসে হারিয়ে গেছে। বসবাস এই বঙ্গে, অথচ ভোটার কার্ড ঝাড়খন্ডের। যেমন পলাশগাছি গ্রামের বাসিন্দা সেনাউল সেখ। ২০০১ সালের সেন্সাস অনুযায়ী পলাশগাছি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত, যদিও সেনাউলের ভোটার কার্ড অনুসারে সে এখন ঝাড়খন্ডের বাসিন্দা। স্পষ্টতই ভাঙনের ফলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন চরের জমি আর এই রাজ্যের হাতে নাই। সেই জমির পরিমাণ কত, রেকর্ড নেই তাও। হাজার আবেদন সত্ত্বেও রাষ্ট্র নির্বিকার। এর উপর ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ ভূমিসংস্কার আইনে আনা একটি সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্বের ১১ (খ) ধারাটি বাদ দিয়ে ১২ নং ধারাটি যোগ করা হয়, তার ফলে নদীর বুকে গড়ে ওঠা চর সরকারি খাসসম্পত্তি, সেখানে রায়তদারেরা কোনো মালিকানা সত্ত্ব দাবি করতে পারবে না। যা এই ভাঙন বিধ্বস্ত সব হারানো মানুষগুলোর জীবনে নতুন করে বিপর্যয় ডেকে আনে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি কোনো ক্ষেত্রেই খুব একটা অগ্রগতি হয় না। রাজ্যের শাসক বা কেন্দ্রের, প্রশাসন নির্বিকার। সরকারের ছোটো বড়ো মেজ নেতারা ভাঙনকে ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা করছেন, ভাঙনকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেটের দাপট প্রকাশ্য— বালির বস্তা, বোল্ডার, জিও-টেক্সটাইল শিট, লোহার জালি… সবেতেই পারসেন্টেজ আর কাট মানির অবাধ রাজত্ব, খোলাখুলি দূর্নীতির রমরমা। পোহ্লাদ মণ্ডল, জবা মণ্ডল, সেন্টু শেখরা জানান, আগে থেকে সেচের কাজ শুরু হলে হয়তো ভাঙন ঠেকানো যায়। কিন্তু তা করা হয় না, শুধুমাত্র বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধ করার চেষ্টা করেছে সরকার। যদি নদীপাড়গুলি বোল্ডার দিয়ে বাঁধা হত তাহলে তাদের এমন দুর্দশা দেখতে হত না। অথচ রাষ্ট্র তার চোখ-কান বন্ধ রাখে। টাকা আসে, টাকা যায়। নদীপারের অর্থনীতি মজবুত হয়, মানুষের জীবন পালটায় না। নদীপার তার মতো করেই ভাঙে। সে-ভাঙায় কোনো বিরাম নেই।

এইসব কথাগুলো নিয়েই খবরের কাগজের পাতা ভরে ওঠে ফি বছর। এই বর্ষার দুই তিন মাস। আবার পরের বছর। এর মধ্যেই উন্নয়ন হয় তার স্বাভাবিক গতিতে। টাকা আসে। বাধ সারাই হয়। বোল্ডার পড়ে। কাজ চলতে থাকে। নদীও ঘুমিয়ে পড়ে। আবার বৃষ্টির জল পেলেই তার ঘুম ভাঙে, খিদে পায়। নদী খেয়ে নেয় দুই পাশ, অনন্ত বসত। কথাকারেরা সেইসব টুকরো-টাকরা নিয়ে গল্প সাজান। কবিতা লেখা হয়। তাতে অবশ্য বদলায় না কিছুই… তবুও কিছু কিছু শক্তিশালী কলম কথাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে পারে। অভিজিৎ সেন, তৃপ্তি সান্ত্রা, জয়া মিত্র কিংবা সৈয়দ শামসুল হক-এর গল্পে, আল মাহমুদ-এর কবিতায় আমরা পেয়ে যাই ভাঙনের সাতকাহন।

“যেদিন নদী এসে আমাদের বাড়িটাকে ধরলো

সেদিনের কথা আমার চোখের ওপর স্থির হয়ে আছে।

বাক্সপেটরা থালা ঘটিবাটি নিয়ে আমরা

গাঁয়ের পেছনে বাপের কবরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

জায়গাটা ছিল উঁচু আর নিরাপদ। দেখতে

অনেকটা চরের মতোই। মা সেখানে বসে

হাঁপাতে লাগলেন। কাদলেন এমনভাবে যে

অভিযোগহীন এমন রোদনধ্বনি বহুকাল শুনিনি আমি।

তারপর ভাঙনের রেখা পেছনে রেখে

আমরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছিঁড়ে পড়লাম।

কেউ গেলাম মামুর বাড়িতে। কেউ ফুপুর। যেমন

বাবেল থেকে মানুষের ধারা

ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীত।।”

                                 (চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়, আল মাহমুদ)

‘অভিযোগহীন সেই রোদনধ্বনি’ সোজা একদম ভিতরে ঢুকে পড়ে। আসলেই তো, নদী ভাঙনের শিকার মানুষ কার কাছে অভিযোগ করবে? করেও না।

“তবে নদীর কথা। মইনুল হোসেন ওই যে-বার লাইব্রেরিতে বলে, কথা আর কিছুই নয়, সর্বনাশা নদীর কথা! আধকোশার কথা! আধকোশার ভাঙনের কথা! এই পাগলিকে শাসন করিবার কথা! আর তারে জন্যে মোর একখান প্রস্তাব আছে। বিশদ তবে খুলিয়া কই। সেই বিশদে যাবার আগে নদীর বিষয়ে কিছু কথা আর একবার শুনে নেওয়া যায়। নদীর কত না রূপ, এক তার বাহিরে, অপর তার মানুষের মনে। মইনুল হোসেনের ভিটা যখন আধকোশার গর্ভে দ্বিতীয়বারের মতো যায়, যখন সে বন্ধু মোক্তার দেবদত্তর বাড়িতে শরণার্থী হয়ে উঠেছে আর নতুন বাড়ি করার জন্যে জমি দেখে বেড়াচ্ছে, জমি একটা নদীর কাছেই শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, মইনুলও প্রায় রাজি— জমিটা সে কিনেই ফেলবে, দেবদত্তই তখন মইনুলকে সতর্ক করে বলেছিলো— নদীর এত কাছে ফির না ঘর তোলো! নদীর গতিক তো জানো! দুই-তিন বচ্ছরেই ফির আসি ছোবল দিবে। নদী নয়তো, গোক্ষুরা সাপ! বিষ ঢালিবেই!— আমরা এখানে একটু থেমে লই; নদীর তবে এ উপমাও হয়— সাপ!

আমাদের মনে পড়বে, সেই দুর্ভিক্ষের বছরে, পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরের কালেও নদীর বিরাম ছিল না, বরং সে-বছর যেন বাংলার মানুষের মতো আধকোশাও ছিলো দীর্ঘ এবং আশাহীন অনাহারে; সে-বছর আধকোশা এক লপ্তে পুরো একটা মহল্লাই গিলে খেয়েছিলো। মইনুল হোসেন মোক্তারের বাড়িটাও সে-বছর আধকোশার উদরে যায়। সে তার বসত সরিয়ে যেখানে নতুন বাড়ি করে, সে-বাড়িটাও বছর তিনেকের মাথায় নদীর গর্ভে বিলীন হয়। পঁয়তাল্লিশ সালের কথা; মইনুল হোসেন বর্ষার এক মাঝরাতে জেগে উঠে দ্যাখে, নদীর ছোবল তার ভিটের গোড়ায় প্রবল আঘাত হানছে। আমাদের আজকের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেন তখন মায়ের কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশুটি। তাকে কোলে নিয়ে মা ভীতস্বরে চিৎকার করে ওঠে— আল্লা গো! আর বিপরীতে মইনুল হোসেন তীব্রকণ্ঠে গাল দিয়ে ওঠে— হারামজাদি! না, স্ত্রীর প্রতি নয়, নদীর প্রতি, আধকোশার প্রতি।— হারামজাদি, ফির খেপি উঠিছে। এইবার তোরে একদিন কি মোরে একদিন! কত খাবু তুই মাটি! এইবার মুই দেখি নেমো! চোখের সমুখে নদীর গহবরে তলিয়ে যায় মইনুল হোসেনের ভিটা। টিনের বাড়ি, কোমরভাঙা হয়ে একবার থিরথির করে কাঁপে, নদীর বুকে নত হয়ে পড়ে উত্তর কোণ, যেন জলে মুখ দেখতে বড় সাধ তার, অনেকক্ষণ ওই অমন ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকে ঘরখানা, তারপর হুস করে ডুব দেয় ঘূর্ণিজলে, ঘূর্ণিটা গভীর হয়ে ওঠে মুহূর্তে, যেনবা জলের শরীরে বিপুল এক নাভি রচিত হয়, তারপর চক্কাস করে শব্দ ওঠে, লোলুপ জিহবায় গ্রাস টেনে নেবার শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বহুক্ষণ ধরে। নদীকে তখন উত্তর বাংলার চিরকালের মঙ্গাপীড়িত অনাহারীজন বলে মনে হতেই পারে আমাদের…।” (নদী কারো নয়, সৈয়দ সামসুল হক, কালি কলম)

কথায় বলে ‘নদীর পাড়ে বাস, চিন্তা বারোমাস’— নদী তীরবর্তী মানুষের অন্তর্গত হাহাকার ও মর্মবেদনা লেখার ভাষা হয়, ‘ছেলে নিলি স্বামী নিলি একটি মাত্র মেয়ে তাকেও নিলি—! কী আর করবি তুই বড়জোর আমাকেও নিবি।’ নদীর সঙ্গে এ-অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যও গভীরভাবে জড়িত, সে প্রশ্ন করে, ‘এইভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে…’। এইসবই লেখালেখির উপজীব্য হয়। আবার হয়ও না। ভাঙন এখনও প্রান্তিক কলমচিদের জায়গিরদারি। তৃপ্তি সান্ত্রা, উমাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা শুভ্র মৈত্রদের চোখে দেখা পরিসরের বাইরে বৃহৎ বাংলা সাহিত্যে নদীভাঙন যে সমান ঢেউ তোলেনি, তা খুব স্পষ্ট। তার কারণ-অকারণ চিন্তাভাবনার বিষয় বটে, অনুসন্ধান জরুরি।

গত দশকের শেষের পরে ভাঙন আপাত স্তিমিত হয়ে এলেও আবার শুরু হয়। বছর দুয়েক হল আবার মানিকচক ও কালিয়াচক তিনে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন শুরু হয়েছে মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ-ধুলিয়ানেও। প্রতি বছর বর্ষার ছোঁয়ায় আরও উত্তাল হয়ে উঠছে জেলার নদীগুলো। আবার ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে বহুফসলি জমি, মানুষের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট এমনকী জনপদও। “২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ধানঘরাকে গ্রাস করে রাক্ষসী গঙ্গা যখন গুটি গুটি পায়ে ধুসুরিপাড়ার দিকে এগিয়ে আসছিল ঠিক তখনই কিশোরী সিংহের হৃদকম্প শুরু হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটার তালে তালে সেই কম্পন থেকে শেষতক তার আর নিস্তার মেলেনি। দিবালোকে তিল তিল করে বহু কষ্টের দু কামরা বাড়িটা ভাঙনের গ্রাসে চলে যেতে দেখে নির্বাক হয়ে যান তিনি। স্বচক্ষে নিজের বাসস্থান ভাঙনের দুঃখ সহ্য করতে না পেরে বেঘোরে জীবনটাই হারালেন। এই দুঃখের কোনো হিসাব নেই…” লিখছেন মুর্শিদাবাদের গবেষক ও প্রাবন্ধিক হাসিবুর রহমান।

ভাঙন আজও একটি প্রান্তিক সমস্যা। একান্তই মালদা-মুর্শিদাবাদের সমস্যা। বাকি পৃথিবীর তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। মালদাকেও তাই লড়তে হয় নিজের মতো করেই। মাঝে মাঝে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন সুবোধ চৌধুরীর মতো মানুষ, সারাজীবন দিয়ে বুকে করে আগলে রেখেছিলেন তিনি ভাঙন পীড়িত মানুষগুলোকে। অভিজিৎ সেনের লেখার অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন, তাঁর উপন্যাসের চরিত্র হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন আবার য্যায় কি ত্যায়। মালদার নদীপারের মানুষেরা জানে নদী আছে, তাই ভাঙন থাকবেই। ভাঙনের হাত ধরে মানুষের যাযাবর হয়ে ওঠাও চলবে। এ এক অনন্ত গাথা, শেষ কোথায় কেউ জানে না। তবুও নদীপারের মানুষেরা নদীসুরক্ষা, বিজ্ঞানসম্মত নদী খনন ও নদী ব্যবস্থাপনার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। নদী সুরক্ষিত হলে নদীর ভাঙন কমে আসবে। রক্ষা পাবে তীরবর্তী জনপদ। নদী বাঁচবে, বাঁচবে মানুষ, সংস্কৃতি… সভ্যতা।

“এতো ভাঙনের শব্দ কেন?

আর কোনো ধ্বনি নেই পৃথিবীতে, ব্রহ্মাণ্ডে, নিখিলে?

কোথায় ভাঙছে এতো? কোনখানে? নাকি নিজেরই

গভীর মহলে আজ বিশ্বাসের গোপন ভাঙন!”

কৃতজ্ঞতা:

কল্লোল মজুমদার, কেদার মণ্ডল, ঋষি ঘোষ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত