উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: উমা আমার, গৌরী আমার
গাড়িটা হাইওয়ে ছেড়ে লোকাল রাস্তায় পড়তেই গান চালিয়ে দিল ধরিত্রী। সালতারিখ অনুযায়ী দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে আজ পাঁচদিন-তবে এই মার্কিন দেশে, কানাডার বর্ডারের কাছে আপস্টেট নিউইয়র্কে আবার দুর্গাপুজো! সবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। তাও বাতাসে এখনই যা হিমের ধার! কলকাতার লোক হলে এতেই অস্থির হয়ে যেত!
কলকাতার কথা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেল! কী হৈচৈ সেখানে, আর সে কী না ধূ ধূ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে চলেছে পড়াতে! যদিও চারদিক এখন রঙে রাঙানো, কিন্তু সে তো পাতাঝরার আগে শেষ কথাটি বলা! তবে শরতের আকাশ আজ একেবারে নীলিমায় নীল, মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা। অমন একটি ভেলায় চেপে যদি চলে যাওয়া যেত সেই ঘরটিতে…
মন হারিয়ে গেছিল কোন সুদূরে -ফিরে এল রামকুমারের মধু ঢালা সুরে,”জামাতা সহিতে আনিব দুহিতে, বৎসরান্তে আনতে যেতে হবে না..”
ধরিত্রীর কেমন মনে হল বাবাই যেন গাইছেন! সত্যি বড্ড ভালো করেনবাবা গানটা! কী যে করছেন এখন দুজনে!
নাহ! ফালতু ভাবনা চিন্তা না করে একটা ফোন করা যাক! গাড়ি ছুটবে এখন না হোক কম করে তিরিশ মাইল ফাঁকা রাস্তায় সিঙ্গল লেনে, তাই এই ফাঁকে একটু যদি দেশকে ছোঁয়া যায় মন্দ কী!
ফোন রিং হবার পরই ভেসে আসে বাবার উদাত্ত গলা!
“ওগো আমার আগমনী আলো…”
চোখে জল আসে ধরিত্রীর, ধরা গলাতেই কথা ঘোরাতে বলে ওঠে, “জানো বাবা, আমাদের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে আর যে দুই ভারতীয় আছেন, তাঁরা তো অবাক আমরা নবরাত্রিতে উপোস করি না বলে – তারপর যখন দিয়েছি পুজোর সময় আমাদের খ্যাঁটনের ফিরিস্তি – চোখ একেবারে তো কপালে!”
“বাঙালির মত কে আর দশপ্রহরণধারিণীকে ঘরের মেয়ে করে নিয়েছে বল!”
“সেই তো! মহালয়া হলেই বাঙালি গায় ঘরে ফেরার গান – জগজ্জননী দুর্গা হয়ে যান বাঙালির শাশ্বত কন্যা উমা!”
মায়ের গলা ভেসে এল।
“মা, মা গো! বাড়ি ফিরে ভিডিও কল করব মা!”
এবার রাশ টানার পালা মায়ের! নাঃ! চোখে জল আনা যাবে না – কতদূরে আছে মেয়েটা -মন খারাপ হলে সামলাবে কে! জামাইও তো আর স্বয়ম্ভূ মহাদেব নন! তারও পুজোতে দেশ ঘরবাড়ি টানে! তাই মনখারাপ আনা একেবারে নৈব নৈব চ!
“আচ্ছা তোর অবাক লাগে না তোর প্রতিবেশীদের প্রশ্নে? মেনকার উমা আর আমার ধরিত্রী কেনএই শরৎকালে মিলেমিশে একাকার!”
“হ্যাঁ মা, সত্যিই তো! ভেবে দেখিনি এমন করে! কবে থেকে এমনটা হল বলো তো! জানো গো তুমি?”
বাবা মা দুজনেই সাহিত্য সংস্কৃতি লোকাচার গুলে খেয়েছেন! ইসস শেখাহয়নিতেমন কিছুই! নাঃ, এই সময়েই যতটা পারা যায় জেনে নেওয়া হোক!
বাবার উত্তর এল।
“ঠিক মত তো সাল তারিখ জানা যায় না, তবে এইটুকু বলতে পারি বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবেই কঠিন ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীরা কোমল রূপে এলেন বাঙালি মানসে। মহাভারতের কূট রাজনীতিবিদ কৃষ্ণ হলেন জয়দেবের গোবিন্দ! প্রেমিকার পদপল্লব ধারণেই যাঁর প্রেমের প্রকাশ! বা ধর আমাদের কানু বা কানাই! সে তো আমাদের ঘরের ছোঁড়া! তেমন করেই মা জগদম্বা কবে যেন হয়ে গেছেন আমাদের উমা, আমাদের গৌরী!”
“কিন্তু দুর্গাই বা কেন বাবা! দেবীর তো অভাব ছিল না! বিশেষ করে লক্ষ্মী!”
“ভালো প্রশ্ন করেছিস!”
মায়ের গলা দূরভাষে!
“আসলে কী জানিস পনেরশ আর ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে বাঙালির দেবীপুজোর একটা বিশাল পরিবর্তন হয়েছিল। মুঘল আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলার আরাধ্য দেবী হয়ে উঠেছিলেন চন্ডী! অধ্যাপিকা কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ের এই বিষয়ে রিসার্চ পেপার আছে, নেটেও পাবি খুঁজলে-মুঘলরাই হয়ে উঠেছিল বাঙালির কাছে ডেমন বা অসুর! তাই কবিকঙ্কণের চন্ডীর সৃষ্টি! মঙ্গলকাব্য সৃষ্টি হয়েছিল অত্যাচারিত রাজা, জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়! আর মঙ্গলকাব্যের প্রভাব তো জনমানসে কেমনভাবে ছিল সেটা তো সবার জানা!
“কিন্তু চন্ডী বললেই মনে হয় রণচন্ডী! তেজি, দৃপ্ত! তাকে কি ঘরের নরম মেয়ে বলে ধরা যায় মা!” দ্বিধাগ্রস্ত গলা ধরিত্রীর!
“কেন রে, ঘরের মেয়েরা কি শুধু নরমই হয়? এই তো তুই একটু আগে প্রায় কেঁদে ফেলছিলি, অথচ গাড়ি চালাচ্ছিস, সাহেব মেম পড়াচ্ছিস – সেরকম দশভুজা মহামায়াই আবার ঘরের উমা!” পাশ থেকে ফুট কাটেন বাবা!
পরক্ষনেই আবার গভীর সুর গলায়, “আরে শোন! লৌকিক দেবদেবী বরাবরই ছিলেন। বৈদিক দেবদেবী ছিলেন উচ্চবর্ণের জন্যে, তেনাদের নাগাল সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ পেত না কোনকালেই- তাই তারা তাদের মত করে দেবী আরাধনা করত!তবে দুর্গাকে ঘরের মেয়ে উমা করে নেওয়া – এই ধারণার জন্যে প্রথম কৃতিত্ব পাবেন রামপ্রসাদ!”
“সে আবার কী? উনি তো ছিলেন শ্যামা বা কালীর সাধক! জানি উনি মা কালীকে কন্যারূপে দেখতেন, তাঁকে দিয়ে বেড়াও বাঁধিয়েছিলেন, মানে দেবীকে মানবীরূপে কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু দুর্গা..!”
তীব্র সংশয়ে দোলা ধরিত্রীর!
মা এবার আসরে, “কালীভক্ত রামপ্রসাদকে বিখ্যাত করে দিয়ে গেছেন পান্নালাল ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয়বাবু বা হীরালাল সরখেল মশাই!কিন্তু জানিস কি আসলে রামপ্রসাদ দুধরণের গান বেঁধেছিলেন, উমা সঙ্গীত আর শ্যামাসঙ্গীত? দীনেশচন্দ্র সেন এ নিয়ে ভারি সুন্দর প্রবন্ধ লিখেছেন! পিডিএফটা নামিয়ে পড়ে নিস, আমি লিংক দিয়ে দেব!”
“ওমা! দারুন ইন্টারেস্টিং তো! পড়তেই হবে! ওমা, মনে আছে তোমার কোনো উমা সঙ্গীত! বলো না গো!”
“সে গান তোরও জানা! শুনলেই বলবি, ওমা এইটা!”
গুনগুন করেন মা, “গিরি এবার উমা এলে আর উমা পাঠাবো না!”
“ওমা! এতো আগমনী গান! তবে যে তুমি বললে উমা সঙ্গীত!”
“আসলে পরবর্তীকালে উমার বাপের বাড়ি আসা নিয়ে অনেক গান বাঁধা হয়, সেগুলো আগমনী গান হিসেবেই বেশিপ্রচলিত! সেদিক থেকে বলতে গেলে প্রথম আগমনী গানটি কবিরঞ্জনই বেঁধেছিলেন!”
“সত্যিই অসাধারণ! আজও কী আবেদন এই গানের!”
“হ্যাঁ রে মা, আসলে রামপ্রসাদী গান আর রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলই সিংহবাহিনী রণরঙ্গিনী দুর্গাকে ঘরের মানুষ বানিয়ে দিয়েছিল, ভেবে দেখ অন্নদার কথা, ঈশ্বরী পাটনীকে বলছেন,’কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ!’; সারাক্ষন একথা তো তোর মা আজও বলে চলেছে!”
ধরিত্রী প্রমাদ গণল। এই রে এই বুঝি আবার কর্তা গিন্নির লড়াই বাধে!তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,”আর সেই লাইনটা,’আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’-ওদের দুধভাত জোগাড়ের জন্যেই তো এতদূরে পড়ে আছি গো!”
“এই রে বাতাসে এখন ভূরি ভূরি জলীয় বাষ্প!” বাবা হেসে পরিস্থিতি সামাল দেন!
মা ফিরে আসে্ন আবার আলোচনায়, “সত্যি বলতে কী, পরবর্তীকালে শাক্ত পদাবলীই দুর্গাকে একেবারে ঘরের মেয়ে উমা করে দিল। বৈষ্ণব পদাবলীর একটু কঠিন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে শাক্ত পদাবলী হয়ে উঠল আমজনতার মনের একেবারে কাছের!”
যোগ দেন বাবা।
“শুধু আগমনী গান নয়, রামপ্রসাদ বিজয়ার গানও বেঁধেছিলেন, ‘তনয়া পরের ধন, বুঝিয়া না বুঝে মন, হায় হায়, এ কী বিড়ম্বনা বিধাতার!’ এর পর বহু পদকার আগমনী আর বিজয়ার গান বেঁধেছেন, দাশরথি রায়, রাম বসু, নবীনচন্দ্র সেন, এমনকি আমাদের ডি এল রায়ও! সেই ধারা বজায় রাখলেন নজরুলও তাঁর গানে, গেয়ে ওঠেন বাবা, “আমার আনন্দিনী উমাআজো এলো না তার মায়ের কাছে!”
গাইতে গাইতেই বাবার গলা যেন একটু কেঁপে যায়!
সামলাতে মা কাজের কথা পাড়েন, “হ্যাঁরে, নতুন জামাকাপড় কিনেছিস তো তোরা! আমাদের তো পাঠাতে বারণ করলি! বেয়াইবেয়ানও দুঃখ করছিলেন!”
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ কিনেছি!”
পাশ থেকে বাবা গেয়ে ওঠেন, “ওরা কি তোর সতীন পো মা, কোন গেঞ্জি দুটো কিনে দিলি!”
হেসে উঠল মা মেয়ে!
“সত্যি গো বাবা, এমন করে দেবতাকে ঘরের মেয়ে করতে বোধহয় বাঙালি ছাড়া শআর কেউ পারেনি! মনে পড়ছে সোনার তরীর সেই বিখ্যাত লাইন,”দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা!”
“দেবদেবী নিয়ে এমন গান আমাদের মাঠে ঘাটে পথে বাউল, লোকগায়করা গেয়েছেন – দেবীকে করেছেন কন্যা!” মায়ের কথায় আবেগ!
“এই তো আমাদের কন্যাই দেবী হয়ে এতো কিছু সামলাচ্ছে!শক্তিরূপিণী কন্যাদের জয় হোক! ভালো থাকে তোরা দেশে বিদেশে!”গর্বের সুর বাবার গলায়।
“আশীর্বাদ করো তোমরা, যেন সব সামলাতে পারি!”
“কল্যাণ হোক!”
ফোন কেটে দিল ধরিত্রী! দূর থেকে কলেজের চূড়া দেখা যাচ্ছে -এক্ষুনি চলে যেতে হবে আর এক দুনিয়ায়! গাড়ি থেকে নামতেই শরতের সোনাঝরা মিঠে রোদ এসে গায়ে লুটিয়ে পড়ল। যেন হাত বুলিয়ে বলে ওঠে, “গৌরী এলি?”