| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: বিনয় মজুমদার, এক রহস্যমেঘের বজ্রপাত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
“আমি, মুগ্ধ, উড়ে গেছো, ফিরে এসো, ফিরে এসো চাকা” 
বিনয় মজুমদার, এক রহস্যমেঘের বজ্রপাত
গৌতম গুহ রায়
 
১১ ডিসেম্বর ২০০৬ সকালে পাঠানো মোবাইল বার্তা, বিনয় মজুমদার আর নেই । না চমকে উঠি নি এই খবরে, এমন একটা খবর শোনার প্রস্তুতি ছিলই, কিন্তু তবুও এই খবর একটা শূন্যতার ধাক্কা ছিলো । বিনয় মজুমদারের মৃত্যু অভিমুখী যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগেই, আমরা ক্রমশ সেই পরিণতির দিন গুনছিলাম । একজন কবি, গোটা জীবন জূড়ে যার অগ্নিপথ যাত্রা, একজন কবি যিনি হতে পারতেন অর্থের ও বৈভবের প্রাচুর্যে ভরপুর এক সফল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, গণিতজ্ঞ হিসাবে দেশ বিদেশের সাফল্য চকচকে মুকুট মাথায় ধরতে পারতেন। একজন কবি, যিনি তিন তিন বার ছিন্নমূল হয়ে শেষে শিমূলপুরের নিঃসঙ্গ বাড়ির এক তক্তপোষে দৃষ্টিশূন্য, স্মৃতিশূণ্য হয়ে মৃত্যুর দিকে হেঁটে গেলেন, উড়ে গেলেন তাঁর সারসের দিকে …
বিনয় মজুমদার এক প্রবহমান ক্রিয়েটিভ এনার্জি, তাঁর চারপাশের খোলা বাজার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, একা। ‘নিভৃতে মন্থনজাত একাকিত্বে তিনি এতটাই আলাদা যে বাস্তব সকাশে মানুষ তাঁর পাগলামি দেখতে পায়, অভ্যন্তরস্থ শূন্য প্রদেশের বোধতাড়িত নিঃশব্দ ঘুর্ণী অনুভব করতে পারে না।” বিনয়ের মতো কবিরা এরকম নিঃশব্দ আভ্যন্তরীণ ঘূর্ণি থেকেই সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন।
“আমি হতাশাবোধে, আব্যয়ে, ক্ষোভে ক্লান্ত হয়ে
মাটিতে শুয়েছি একা – কিটদষ্ট নষ্ট খোসা, শাস ।
হে ধিক্কার, আর্তঘৃণা, দ্যাখো, কি মলিন বর্ণ ফল ।
কিছুকাল আগে প্রাণে, ধাতুখন্ডে সুনির্মল জ্যোৎস্না পড়েছিল”
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
বিনয়ের মৃত্যুর পর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিনয়ের স্থায়িত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন যে বিনয় মজুমদার চলে যাবার পরে অনপনেয় শূন্যতার শামিল হলেও এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, সাহিত্যের সুযোগী ইতিহাস তাঁকে অদূর ভবিষ্যতের কোন অবস্থান উপহার দেবে, যে জায়গাটাই নির্দিষ্ট করে দিক না কেন কিছুই এসে যায় না, কেননা কবিতার ব্রহ্মস্বাদ পরিগ্রহণ করার দায় বর্তায় তো সংখ্যালঘু একটি এলিটের অবস্থিতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। ‘তিনি আজীবন সঠিকভাবে কবিজনিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে চলেছিলেন এবং সেই মর্মেই চালিয়ে গিয়েছিলেন ‘নৈয়ায়িক’ বাগবিতর্ক অনেক সময় নিজেরই সঙ্গে ।’
ঔপনিবেশিক বার্মার মাটিতে জন্ম নেনে বাংলা কবিতার চির অশান্ত, নিঃসঙ্গ কবি বিনয় মজুমদার । জন্ম, ১৯৩৪ এর ১৭ সেপ্টেম্বর, মৃত্যু ১০ ডিসেম্বর ২০০৬, এভাবে লেখা হলে সরলীকরণ হবে। আসলে বিনয় মজুমদারকে বারবার মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করতে হয়েছে, মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস যেন হয়ে উঠেছিল তাঁর প্যাশান। তাঁর প্রিয় মানুষদের মৃত্যু , তাঁর পেশা জীবনের মৃত্যু, তবুও তাঁর একটি কবি জন্মের মৃত্যু থেকে আবার জন্ম নিয়েছিল আর একটি কবি জন্ম।
৩১ মার্চ, ১৯৯৩। কলকাতা মেডিকেল কলেজের এজরা ওয়ার্ডের দৃষ্টি শক্তিহীন বিনয়, স্বজনেরা নিয়মিত তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছেন । সেই সময় কাগজে তার লেখা ছিন্ন-ভিন্ন পঙতির কবিতা । অমলেন্দু বিশ্বাসেরা যা এক পঙক্তির কবিতা নামে ছেপে প্রকাশ করে । সেই সময় তিনি একটি গদ্যও লিখেছিলেন, ‘সাহিত্যের গতি গণিতে’। লিখেছিলেন, “গণিত ও কবিতা একই জিনিস”। লিখেছিলেন, …” ছাব্বিশটা অক্ষরের ছাব্বিশটা সমীকরণ । এর ফলে অভিধানের সব শব্দই গণিত সমীকরণ হয়েছে । ফলে এই বিশ্বে সবকিছুওই গ্ণিত হয়ে গেছে ।” মনে পড়ে, ১৯৫৯এ মূল রূশ থেকে অনূদিত বই ‘মানুষ কি করে গুণতে শিখলো’ (বোরম্যান) –এর ভূমিকায় বিনয় এংগ্যালসের উধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘গণিত হচ্ছে বস্তুপুঞ্জে বাস্তব দেসগত এবং পরিমাণগত সম্বন্ধ, অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা সারবস্তু” ।Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

অংকের জটিল সমীকরণই গোটা জীবন মেলাতে চেয়েছেন বিনয় কবিতার সমীকরণ দিয়ে । সমীকরণ পাল্টেছেন, জটিল থেকে ক্রমশ সরলতম উচ্চারণে এসেছেন, অংকের নিয়মে । তিনি বলতেন, তোমার জীবন শুরু, তুমি বহুদিন থাকবে । এই ধর ষাট/সত্তর, হয়তো আরও বেশি। ধর ইনফিনিট এই ইনফিনিট সূত্র মাত্র । মানে একটা মানুষ ইনফিনিট বাঁচে না, এই সমীকরণও বটে । মানে অসীমতার সমীকরণ যখন ইনফিনিটের কথা উঠলো, তখন গণিতের অসীমতা নিয়ে বলা যায়, সাহিত্য বা কবিতা সৃষ্টি করতে কি কেবল ডিগ্রি বা মানের প্রয়োজন হয়, না নির্ভর করতে যে অসীমতার সন্ধানী ছিলেন, অঙ্ক হয় ? কিন্তু সবকিছুর লক্ষ্য অসীম, অসীমতার দিকে পৌঁছানো’ । বিনয় যে অসীমতার সন্ধানী ছিলেন, অংক বিলাসী সমাজ তাকে বারংবার খন্ডিত ও রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তবুও তিনি এই সীমা বা গণ্ডীকে ভেঙ্গেছেন কবিতায়, জীবনে এবং বাস্তবতায়ও । গণিত ও কবিতার মধ্যবর্তী এই মানুষটির প্রয়াণের পর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অভিমত তাই প্রণিধানযোগ্য ঃ ‘শুধু গণিতবিদই বিশ্ববাস্তবতাকে ধরতে পারে না । বিনয় গাণিতিক রহস্যের কেন্দ্রে ? ওর কবিতার আমি বরাবর মুগ্ধ পাঠক । ওর কবিতার অজস্র সংকেত আছে, যা অন্যরকম বোধ দিয়ে বোধগম্য হতে পারে বলে মনে হয় । সেমিটিক শাস্ত্রে জ্ঞানকে পাপ বলা হয়েছে কেন, সেতা যেন বিনয়ের জীবন এবং এর পরিণতি দেখলেই বোঝা যায় ।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Two poems by Binoy Majumdar translated into English


তাঁর কবিতারই মতো একদম ভিন্নতায় রঙ্গিন এক আশ্চর্য অভিযাত্রীর ট্রাভেলগ বিনয়ের জীবন। জন্মেছিলেন বার্মার মান্দালয় রেলস্টেশানের কাছাকাছি টোডো শহরতলিতে। বাবাও ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, চাকরির সূত্রে সেখানে যান, মা বিনোদিনী মজুমদার যার নামে ঠাকুরনগরের বিনোদিনী কুঠি। বিনয়ের জীবনের প্রথম আট বছর কাটে এই টোডোতে। ১৯৪২, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে বিদ্ধস্ত মান্দালয় থেকে আরো অনেক ভারতীয়ের সঙ্গে তাঁরাও পায়ে হেঁটে মাতৃভূমির উদ্দ্যেশ্যে রওনা হতে বাধ্য হন। বিনয়ের তখন আট বছর বয়স। তাঁর বয়ানে, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পায়ে হেঁটে নাগা পাহাড়ের উপর দিয়ে ভারতে ফিরতে হয়েছে – জাহাজে আসা যায় নি । ফ্যামিলি শুদ্ধু খুব কষ্ট । আড়াই মাস লেগেছিল হেঁটে আসতে।” কোহিমা হয়ে অসমের উপর দিয়ে তাঁরা এসে পৌঁছন তাঁদের আদিবাস ফরিদপুরে। ফরিদপুরের তড়াইল গ্রামে তাঁরা ছিলেন ১৯৪৮ পর্যন্ত , আবার দেশ ভাগ, ছিন্নমূল হয়ে ভিটের সন্ধান।
 
 
#
‘আমি মুগ্ধ, উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।”
১৯৫৯ নাগাদ তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ পর্ব। এর অনেক পরে ‘গায়ত্রীকে’। গায়ত্রী নিয়ে না। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত