উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: কবি জারিফা জান এক বিস্ময়
সোনার ঘটে সূর্য তারা নিচ্ছে তুলে আলোর ধারা, / অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে…
পৃথিবীতে বিস্ময়ের শেষ নেই। আমাদের বরণীয় লেখক আশাপূর্ণা দেবী উল্টোদিক থেকে হরফ শিখেছিলেন। আরেক বিস্ময় জারিফা জান, কাশ্মীরী কবি। ভারতের উত্তর কাশ্মীরের বান্দিপোরা জেলার বসবাসকারী ৬৫ বছর বয়সী সুফি কবি কখনওই স্কুলে যান নি। সুফিবাদ হলো ইসলামের আধ্যাত্মিকতাবাদ।
জারিফার কবিতায় দীক্ষা শুরু হয় বিবাহের কয়েক বছর পরে, তাঁর ত্রিশ-পরবর্তী বয়সে। তাঁর বক্তব্য-অনুযায়ী, তিনি একটি ঝর্ণা থেকে জল আনতে গিয়ে তাঁর জাগতিক অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিলেন, যখন ফিরে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গের কলসিটিও ছিল না তাঁর সঙ্গে, এমন কী তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। যখন তাঁর চৈতন্য এলো, তাঁর মুখ থেকে নাকি একটি গজল বার হইয়েছিল। যদিও সেই সময়ে কবিতা সম্বন্ধে তাঁর সম্যক কোনও ধারণা ছিল না।
জারিফা যখন বুঝতে পারলেন তাঁর কবিতা আসছে একের পর এক, তখন তাঁর সন্তানেরা স্কুলে পড়েন এবংতাদের স্কুলে ইংরেজি এবং উর্দু পড়ানো হতো, কাশ্মীরি ভাষা নয়। কিন্তু জারিফা কাশ্মিরী ভাষা ছাড়া অন্য কিছু জানেন না, তাই তাঁর কবিতাও কাশ্মীরি ভাষাতেই আসতে থাকল, যে ভাষাটি প্রায় অবহেলিত, এমন কী কাশ্মীরেও। জারিফা ভাবলেন তাঁর কবিটা বোঝার জন্যে সন্তানদের কাশ্মীরি ভাষা শিখতে বলা উচিত হবে না। কে-ই বা সেই ভাষার শিক্ষা দেবে! তাছাড়া তিনি তাঁর কবিতা সম্পর্কে নিশ্চিতও ছিলেন না, বুঝতে পারছিলেন না স্বামী বা সন্তানদের জানাবেন কিনা। অনেক বছর পরে সাহসে ভর করে যখন তিনি জানালেন স্বামী-সন্তানকে, তাঁরা জারিফার কবিতার গভীরতা দেখে বিস্মিত হন।
কিন্তু তিনি যত কবিতা রচনা করেছিলেন, ততদিনে অনেক কবিতাই অনেক বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। যেহেতু তিনি লিখতে জানেন না, তাই সেগুলো নথিভুক্ত করার কোনও উপায়ও ছিল না। প্রাথমিকভাবে টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করার চেষ্টা হয়েছিল, জারিফার বড় মেয়ে নিজের জানা হরফে লেখার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু কার্যত এগুলি বিশেষ সুবিধেজনক হয় নি। কারণ কবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সন্তানরা সব সময় যেতে পারে না বিভিন্ন কবিতা-পাঠের জায়গায়, অথবা, যদি-বা যায় তারা, কিন্তু কবির কানে কানে তাদের কবিতাটি বলার পর সে্টি পাঠ জারিফার কণ্ঠে – পুরো বিষয়টি সুবিধেজনক হয় না। তাই জন্যে জারিফা একটি নিজস্ব পদ্ধতি বার করেন। কাগজে একটি লাইনে সুন্দরভাবে বিস্তৃত বৃত্তের মাধ্যমে একটি স্ক্রিপ্ট তৈরী করলেন, ছোট বড় বৃত্ত, আবার কিছু কিছু পুরো বৃত্তাকারও নয়, কিছু কিছু একে অপরের কাছাকাছি। লাইনগুলি ডানদিক থেকে বাঁদিকে যায়, যেভাবে উর্দু এবং কাশ্মীরি স্ক্রিপ্ট লেখা হয়। লাইনগুলি আসলে জারিফার নিজস্ব কোডেড ভাষা, যা তিনি তৈরী করেছেন, তিনি ছাড়া আর কেউই বুঝবে না, তাঁকে বাদ দিয়ে লাইনগুলি কেউ পড়তেও পারবে না। এই বিষয়ে জারিফা জান অহঙ্কারের সঙ্গে বলেন, এ’টি আমার ভাষা, বৃত্তের ভাষা, বছরের পর বছর এই ভাষা আমি তৈরী এবং সম্প্রসারিত করেছি। নানাবিধ বৃত্তে ভরা তাঁর অনেক খাতা আছে তাঁর কবিতার ভাণ্ডার নিয়ে।
তাঁর একটি কবিতার কিছু অংশ ইন্টারনেটে পেয়েছি আমি, যা বাংলা করলে এরকম হয়
আমার যৌবন ধ্বংস করি নি আমি
আগুন আমাকে লালন করে যেমন।
আমার যৌবন অপ্রতিরোধ্য
অনিত্য এই জগতে।
উর্দু শিক্ষক সেরাজ আনসারি বলেছেন কবিতার জগতে এই ধরণের প্রচেষ্টা তিনি ছাত্র বা শিক্ষক হিসেবে দেখেন নি। কিছু বিশেষজ্ঞর মতে জারিফা বিশ্বের প্রথম কবি, যিনি তিনি তাঁর নিজের বর্ণমালা তৈরী করেছেন তাঁর কবিতাকে নথিভুক্ত করার জন্যে। অবশ্য সেই লিপি তিনি ছাড়া আর কেউই বুঝবে না। জারিফার কন্যা কুলসুম এই কোডেড বর্ণলিপি ডিকোড করে জনবিদিত হরফে লিপিবদ্ধ করা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তার অকস্মাৎ মৃত্যুতে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
কাশ্মীরের জনপ্রিয় কবি আব করিম পারওয়ানার মতে জারিফা একজন মরমী কবি। সুপরিচিত লেখক শাহবাজ খান বলেন, জারিফার কবিতায় সুফিবাদের মাত্রা আছে। তাঁর কবিতার শৈলী তাঁকে স্বতন্ত্র করে দেয়। এবং তিনিই বিশ্বের একমাত্র কবি, যিনি কাব্যিক বৃত্ত পড়তে পারেন। এ হেন কবির কিছুই যেন হারিয়ে না যায়। জারিফা জান-এর কাব্যজগতের রহস্যময়তা যাতে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে সেরকম ব্যবস্থা যেন নেওয়া যায়। এমন আশা করবো আমরা।
জন্ম দক্ষিণ কলকাতায়। পেশা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় স্থপতি। আটের দশকে কবিতা দিয়ে লেখালিখির শুরু।সেঁজুতি ভাদুড়ী ছদ্মনামেও লিখেছেন। কবিতা, গদ্য, সম্পাদনা মিলিয়ে ৩৫ টি বই প্রকাশিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একাধিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে বেজিং-এ ভারতীয় দূতাবাস আয়োজিত একক কবিতা সন্ধ্যায় অংশ নিয়েছেন। পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, কবি বিষ্ণু দে স্মৃতি পুরস্কার, কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিক স্মৃতি পুরস্কার, শান্তিলতা দেবী স্মৃতি পুরস্কার, কিঞ্জল পত্রিকা সম্মাননা, বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন সম্মাননা ইত্যাদি।