| 18 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: আনিতে আমার প্রাণের উমারে

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

One of the most impressive and formidable goddesses of the Hindu pantheon and one of the most popular is the goddess Durga. Her primary mythological function is to combat demons who threaten the stability of the cosmos. In this role she is depicted as a great battle queen with many arms, each of which wields a weapon. She rides a fierce lion and is described as irresistible in battle. The demon, she is most famous for defeating is Mahisa, the buffalo demon. Her most popular epithet is Mahisa-mardini, the slayer of Mahisa, and her most common iconographic representation shows her defeating Mahisa.

(Durga: Hindu Goddesses etc: David Kinsley)

দেবী দুর্গার এই পরিভাষাটি সর্বাধিক প্রচলিত। সব চেয়ে প্রভাবীও। তবে সামগ্রিক নয়। দুর্গা এক বহুস্তরীয় দেবীকল্পনা।​​​​​​​ শুধুমাত্র​​​​​​​যুদ্ধদেবী​​​​​​​হিসেবে দুর্গাকে ​​​​​​​চিনতে ​​​​​​​চাইলে ​​​​​​​মস্তো​​​​​​​ ভুল​​​​​​​ হবে।​​​​​​​তাঁর ​​​​​​​কোনও ​​​​​​​একমাত্রিক ​​​​​​​পরিচয়​​​​​​​নেই। দেবী দুর্গার​​​​​​​ইতিহাস ​​​​​​​জটিলবর্ণাঢ্য।​​​​​​​ এই​​​​​​​ দেবীর​​​​​​​ সামগ্রিক ​​​​​​​পরিচয় খুঁজতে গেলে নানা ​​​​​​​রকম​​​​​​​ঐতিহাসিক,​​​​​​​পৌরাণিক,​​​​​​​আধ্যাত্মিক ও লৌকিক ​​​​​​​পরিপ্রেক্ষিতগুলি মনে রাখা দরকার। সময়ের ক্রমপর্যায় অনুযায়ী সন্ধান করলে একেবারে আদি স্তরে তিনি ছিলেন শষ্যদেবী। প্রাগইতিহাস Fertility Cult-এর অংশ। প্রজনন শক্তির দেবী হিসেবে তাঁর উদ্দেশে মানুষ ও অন্যান্য জীবের রুধির নিবেদন করা হতো। ব্রাহ্মণ্য যুগ শুরু হবার আগে পর্যন্ত দুর্গা ছিলেন আরণ্যক শবর ও নিষাদ জাতির এক আর্যেতর ভীষণাহিংস্রঅতি জাগতিক দেবী কল্পনা। আর্য ব্রাহ্মণ্য যুগ সূচনার পর দেবদেবীদের প্রাথমিক কল্পনাগুলি কেন্দ্রিত হয়েছিলো হিমালয়ের পার্বত্য প্রদেশে।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

লক্ষ্যণীয়সে​​​​​​​ সময়ের​​​​​​​ সব দেব-দেবীর​​​​​​​ সঙ্গেই​​​​​​​ হিমালয়​​​​​​​ ও​​​​​​​ অন্যান্য পার্বত্য​​​​​​​ প্রদেশের ঘনিষ্ট ​​​​​​​সম্পর্ক ​​​​​​​চোখে​​​​​​​ পড়ে।​​​​​​​আর্য​​​​​​​ প্যান্থিয়নে ​​​​​​​দেবীদের​​​​​​​ উপস্থিতি​​​​​​​ ছিলো ​​​​​​​নগণ্য।​​​​​​​ সেই​​​​​​​ সভ্যতা ​​​​​​​ছিলো​​​​​​​ একান্তভাবে​​​​​​​ পুরুষতান্ত্রিক।​​​​​​​ প্রধানা ​​​​​​​দেবী ​​​​​​​হিসেবে ​​​​​​​পাওয়া​​​​​​​ যায়​​​​​​​ পার্বতীকে। ​​​​​​​নাম​​​​​​​ থেকেই ​​​​​​​স্পষ্টতিনি পর্বত প্রদেশের​​​​​​​ কন্যা। ​​​​​​​তাঁর​​​​​​​ সঙ্গে​​​​​​​ আর্যেতর​​​​​​​সম্প্রদায়ের ভয়ঙ্করীযুদ্ধদেবী দুর্গার কোনও সম্পর্ক ছিলো না। তবে হিমালয় হোক বা বিন্ধ্যদুর্গার সঙ্গে পর্বতের অনুষঙ্গ সব সময়েই জড়িয়ে থেকেছে।

উত্তর ভারতের পিতৃকেন্দ্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দুর্গাকে স্বাধীনাস্বাধিকার প্রমত্তা অনার্যদেবী হিসেবে ​​​​​​​দেখা​​​​​​​হতো। পরবর্তীকালে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রয়োজনে এই ​​​​​​​দেবীর​​​​​​​ মধ্যে পারিবারিক ​​​​​​​মাতৃভাব​​​​​​​ সঞ্চার​​​​​​​ করা​​​​​​​হয়েছিলো। আবহমান​​​​​ ভারতীয়‘ ভার্যা ও কন্যার ভাবমূর্তিটির ​​​​​​​সঙ্গে​​​​​​​ ব্রাহ্মণ্য ​​​​​​​ব্যবস্থা​​​​​​​ স্বচ্ছন্দ ​​​​​​​ছিলো। পিতৃতান্ত্রিকএকান্নবর্তী ব্যবস্থায় মাতৃত্ব‘ নামক পরিচয়টিকে নারীত্বের চূড়ান্ত সিদ্ধি হিসেবে দেখা হতো। নিজস্ব সংস্কৃতির মাপে ফেলা আর্য​​​​​​​ সভ্যতার​​​​​​​ এই প্রয়াসটি আসলে অনার্য মূল্যবোধের উপর আর্য প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার ​​​​​​​একটি ​​​​​​​কৌশল​​​​​​​মাত্র। ভারতীয় ​​​​​​​দেবতা পরম্পরায় বিশেষ জলবিভাজক তাৎপর্য​​​​​​​ আছে। আর্য ধারণা বশবর্তী এই কৌশলকে সফল করতে একাকীযুদ্ধপটিয়সী দেবী দুর্গাকে​​​​​​​ বড়ো​​​​​​​ মূল্য ​​​​​​​দিতে​​​​​​​ হয়েছিলো। তিনি আর্য সামাজিক মতের ​​​​​​​সঙ্গে সমঞ্জস বিবাহ‘ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথার ​​​​​​​বশ্যতা​​​​​​​ স্বীকার​​​​​​​ করতে ​​​​​​​বাধ্য হয়েছিলেন। একজন ​​​​​​​স্বাধীনা দেবীকে ​​​​​​​ইচ্ছেমতো চালনা‘ করতে পারা র ​​​​​​​সাফল্য পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের পক্ষে অবশ্যই একটি বৃহৎ কৃতিত্ব ছিলো। ​​​​​মূল পার্বতী‘ দেবী দুর্গার কোনও পুরুষ অভিভাবক বা সঙ্গী ছিলেন না। তিনি কারও ভার্যা বা দুহিতাও ছিলেন না। আর্য স্বভাবমানচিত্রের বাইরে থাকা​​​​​​​ একজন স্বাধীনা নারী ছিলেন তিনি। প্রথমে পুরাণতারপরে তান্ত্রিক পরম্পরার ভিতর দিয়ে এসে এই দেবীকে শিব বা মহাদেবের বিবাহিত ভার্যা হয়ে পরিচিত ​​​​​​​হতে ​​​​​​​হয়েছিলো। তন্ত্রসাহিত্য পরম্পরায় ​​​​​​​জগতের চালিকা শক্তি হিসেবে এই দেবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। যদিও মৌল পরিচয়ে তিনি ছিলেন শিবের শক্তি। তাঁর কোনও একক অস্তিত্ত্ব ছিলো না। ভারতবর্ষের সর্বত্র শিবভার্যা ও গণেশজননী হিসেবে তাঁর লোকপ্রিয় একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।

মধ্যযুগের পরবিশেষত মুঘল যুগের দ্বিতীয়ার্ধেএদেশের​​​​​​​সংস্কৃতিতে দেবী দুর্গাকে পারিবারিক মাতৃদেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপক প্রয়াস চোখে পড়ে। চারজন সম্পূর্ণ অন্য ধারার পৌরাণিক দেবদেবীযথাগণেশকার্তিকেয়লক্ষ্মী ও সরস্বতীমাতারূপী দেবী দুর্গার পরিবারের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে পড়েন। এই প্রয়াসটি একমাত্র বঙ্গদেশে ইশুরু হয়ে ছিলো ​​​​​​​এই​​​​​​​যুগে। কিংবদন্তি মানতে গেলে তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণের পূজিত দুর্গাপ্রতিমার প্রসঙ্গ এসে পড়ে। যদিও এ প্রসঙ্গে ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদারের দাবিও স্বীকার করা হয়।

বঙ্গদেশে দেবী দুর্গার জনপ্রিয়তার উত্থানের পিছনে নানা রাজনৈতিক সূত্র কাজ করেছিলো। সামন্তরাজা ও জমিদারদের প্রভাবপ্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে এই দেবীর পূজা উপলক্ষে বৃহৎ উদযাপনের আয়োজন হতো।

‘…The Pujas have always been means of demonstrating wealth and prestige, and the worship of Durga has long been associated with sovereignty, useful in the context of eighteenth century Bengal for bolstering the rajas’ claims to identity and power. In other words, the rise of the Pujas in Bengal in the eighteenth century signals an important transformation in the self-perceptions of the Hindu elite. In this regard, I find it fascinating that Ramprasad Sen (c. 1718-1775), the man usually credited with initiating the genre of bhakti poetry to Kali and Durga, was a patronee of another initiator, Raja Krsnacandra Ray. What the exact relationships were between the zamindar and his poet, and between the ritual and devotional worship of Durga, is now very difficult to ascertain, particularly in respect to origins. Indeed, the popularizing of Sakta deities through bhakti creates an added complication in this task of historical reconstruction.

(Unanswered Questions on the Relationship between Politics, Economics, and Religion:

The Case of Durga Puja in Late Eighteenth-Century Bengal- Rachel Fell McDermott)

বঙ্গদেশে আঠারো শতকের পর থেকে দুর্গা নতুন পরিপ্রেক্ষিতে আবির্ভূতা হন। রাজা বা জমিদারদের আঙিনা থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষ মিলিত প্রয়াসে এই দেবীর পূজা উপলক্ষে উৎসব উদযাপন করতে শুরু করে দেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারো জন বন্ধু মিলে বারো ইয়ারি‘ দুর্গাপুজোর সূত্রপাত করেন। দুর্গাপুজোর এই ধরনের মিলিত আয়োজন কলকাতা পর্যন্ত আসতে সময় নিয়েছিলো। সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মতে ১৮৩২ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ হরিনাথ কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। বারোয়ারি পুজোর ধারাতেই বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে কলকাতায় সর্বজনীন‘ দুর্গাপুজোর আয়োজন শুরু জয়।

‘The baro-yaari puja gave way to the sarbajanin or community puja in 1910, when the Sanatan Dharmotsahini Sabha organized the first truly community puja in Baghbazar in Kolkata with full public contribution, public control and public participation. Now the dominant mode of Bengali Durga Puja is the ‘public’ version.’

(M. D. Muthukumaraswamy and Molly Kaushal: Folklore, Public Sphere, and Civil Society)

জমিদারি বিধি-নিষেধের বেড়া পেরিয়ে দেবী দুর্গা বাঙালির কাছে নিত্য নবরূপে প্রতিভাত হতে শুরু করেছিলেন। দেবী দুর্গাকে নিয়ে বাঙালির সৃজনশীলতা ক্রমশ স্ফুরিত হতে থাকে। তাঁরা অনেকদিন ধরেই দেবীকে মাতারূপে আরাধনা ​​​​​​​করতেন। তার পাশাপাশি বহু মানুষ তাঁকে কন্যারূপে দেখতে আগ্রহী ​​​​​​​হয়ে উঠলেন। দেবীর​​​​​​​নানা পারিবারিক‘ সম্পর্ককে​​​​​​​ভিত্তি​​​​​​​করে চারপাঁচশো বছর ধরে তাঁর বহুস্তরীয় পরিচয় গড়ে উঠেছিলো । আদি যুদ্ধদেবীর রূপ থেকে অব্যাহতি পেয়ে দুর্গা গৃহস্থ ঘরনীর রূপ পরিগ্রহ করেন। ক্রমশ এই বিবর্তনের ক্রমপর্যায় লক্ষ করতে গেলে দেবীর যে রূপগুলি পাওয়া যায়তা হলোহিমালয়কন্যাশিবভার্যা ও গণেশজননী। সনাতনী তথা কৃষিমুখী সমন্বয়ের চাহিদা মেটাতে পরবর্তীকালে তাঁর অন্য ‘সন্তান’ হয়ে এসেছিলেন কার্তিকেয়লক্ষ্মী ও সরস্বতী। ​এই​​​​​​​সব​​​​​​​দেবতার​​​​​​​সঙ্গে​​​​​​​দুর্গার প্রাথমিক পুরাণ​​​​​​​যুগে​​​​​​​কোনও​​​​​​​সম্পর্ক​​​​​​​ছিলোনা। কিন্তু ​​​​​​​পরবর্তীকালে​​​​​​​ মানুষ পারিবারিক জননী‘ হিসেবে দুর্গাকে দেখতে চেয়েছিলো। বিশেষত বঙ্গদেশে। ইতিহাস অনুযায়ী বৈদিক সরস্বতী দুর্গার থেকে প্রাচীনা দেবী। আর্যদেবী হিসেবে লক্ষ্মীর মহিমাও দুর্গার আগেই​​​​​​​প্রতিষ্ঠিত​​​​​​​হয়েছিলো। পুরাণযুগে লক্ষ্মী ও দুর্গা উভয়েই একযোগে বিষ্ণুমায়ার প্রকাশ ছিলেন। এতো বিষম ​​​​​​​ব্যতিক্রম​​​​​​​থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মীকে দেবী দুর্গার দুহিতা রূপে দেখতে চাওয়ার স্পৃহা বঙ্গীয় পারিবারিক আবেগের একটি নির্ভুল নমুনা।

‘…দুর্গা দুর্গতিনাশিনীই হোনদুর্গাসুরনাশিনীই হোন বা দুর্গরক্ষিণীই হোনতিনি শস্ত্রধারিণী এবং অরিমর্দিনীকিন্তু পার্বতী উমার কোনও প্রাচীন উল্লেখের মধ্যেই আমরা এই শস্ত্রধারিণীঅরিমর্দিনী রূপের উল্লেখ পাই না। উমাকে প্রথম পাইলাম কন্যারূপে– বহুশোভমানা হৈমবতীরূপে। তাহার পরে পাইলাম শিবপ্রিয়ারূপেতাহার পরে পাই গণেশজননী ও কুমারজননীরূপে। তাহার পরে যখন লক্ষ্মীসরস্বতীও তাঁহাদের স্বাতন্ত্র্য বর্জন করিয়া মায়ের কন্যাত্ব স্বীকার করিলেন তখন মায়ের সোনার সংসারকে পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলাম। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এই পার্বতী উমার প্রেমময়ী পত্নীত্ব এবং অনন্তস্নেহময়ী মাতৃত্বের রূপই প্রাধান্য লাভ করিয়া আসিয়াছেশিবের সহিত প্রণয়কলহ বা গৃহকলহ ব্যতীত মায়ের ভ্রূকুটিকুটিল মুখ কখনও বড় একটা দেখা যায় নাইঅস্ত্রশস্ত্র ধারণ ত দূরের কথা। কিন্তু মহাদেবী যখনই ভয়ঙ্করীরণোন্মাদিণীঅসুরনাশিনীতখনই তিনি দুর্গাচণ্ডীকালী। মায়ের এই অসুরনাশিনী মূর্তির সহিত সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত হইল মায়ের চণ্ডীরূপ। আমার দৃঢ়বিশ্বাসদেবীর এই অসুরনাশিনী চণ্ডী বা চণ্ডিকার ধারা মায়ের পার্বতী উমার ধারা হইতে একটি পৃথক ধারা। পরবর্তী কালে দুই ধারা নির্বিশেষে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে।

(দেবীর বিচিত্র ইতিহাসঃ ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্যঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত)

উল্লেখ করে দেওয়া ভালোএই প্রসঙ্গে পণ্ডিত শশিভূষণ উক্ত ‘হাজার হাজার বৎসর’ কালক্রমটি ঘটনা‘ নয়। ইতিহাসের মাপে অতিশয়োক্তি বলা যায়।

বাঙালির শারদীয়া দেবী দুর্গার সঙ্গে বাংলার মেয়েদের বছরান্তে পিতৃগৃহে আসার আবেগটি নিপুণভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই দুর্গা ভয়ালকরাল হন্ত্রী দেবতা নন। উত্তরপশ্চিম ভারতে প্রচলিত নবরাত্রের সঙ্গে চিহ্নিত যুদ্ধদেবী বা তান্ত্রিক মতের শক্তিস্বরূপা কোনও ​​​​​​​দেবীও​​​​​​​নন। তিনি ব্রহ্মরূপসনাতনী কাত্যায়নীর মতো বিপুল গরিমাও​​​​​​​প্রদর্শন​​​​​​​করেন​​​​​​​না। যদিও এই দুর্গা দেবীর পূজাপ্রকরণের মধ্যে পুরাণ ও তন্ত্রমতের ব্যাপক প্রভাব চোখে ​​​​​​​পড়ে। পুরোহিততন্ত্রের অধিকারপ্রমত্ত আচারআচরণও​​​​​​​যথেষ্ট প্রকট ​​​​। কিন্তু বাঙালিদের জন্য সেই ​​​​​​​সব শাস্ত্রীয়‘ লোকাচারের​​​​​​​আবেদন​​​​​​​ বিশেষ তাৎপর্য রাখেনা। তাঁরা দেবী দুর্গার শারদীয় যাত্রাটিকে মেয়ের বাড়ি ফেরা হিসেবে দেখতেই ভালোবাসেন। সেজন্য দেবীপক্ষের শুরু থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়টি বাঙালির জন্য প্রকৃতপক্ষে ‘দেবীপক্ষ’ নয়। ​​​​​​​তাকে কন্যাপক্ষ‘ বলাটাই​​​​​​​হয়তো সমীচীন। বাংলার সাধারণ মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। কখন কন্যারূপী দুর্গার আগমনে চিরাচরিত দুঃখময় জীবনে আনন্দের ফুল্ল মুহূর্তগুলি জেগে উঠবে। দেবীর রূপের এই বিবর্তন একান্তভাবেই বঙ্গীয় পারিবারিক লোকবিশ্বাসের​​​​​​​অঙ্গ। শরৎকালীন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বাঙালি শিল্পীরা একটি বিশেষ ধারার সঙ্গীত পরম্পরাও সৃজন করেছিলেন। অন্যান্য শিল্প মাধ্যমেও দেবী দুর্গার দুহিতারূপী সত্ত্বাটিকে গরিমান্বিত করার প্রয়াস পাওয়া হয়েছে।Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

এই বিবর্তনটির কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আগে সমাজের পারিবারিক একক গুলির ভূমিকা বিচার করতে হবে। পারিবারিক একক ছিলো পুরাণযুগ এবং পরবর্তীকালের আর্যসভ্যতার ভিত্তি। আর্য পারিবারিক মূল্যবোধের ছাঁচ ছিলো একান্তভাবে পিতৃতান্ত্রিক​​​​​​​ও রক্ষণশীল। তারা তৈরি ​​​​​​​হয়েছিলো সমাজবন্ধন’ নামক একটি বিমূর্ত তাড়না থেকে। বৈদিকযুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে পৌঁছে যাবার পরে ​​​​​​​এই​​​​​​​বাঁধাবাঁধি তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমশ পারিবারিক রক্ষণশীলতার চাপ একক মানুষের আত্মপরিচয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার​​​​​​​প্রভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাস চূর্ণ হয়ে যায়। এ জন্যই ভারতীয় সভ্যতাসংস্কৃতির দীর্ঘদিন ​​​​​​​ধরে​​​​​​​গড়ে​​​​​​​তোলা সৌধ বহিরাগতদের সামান্য আক্রমণে বালুর ​​​​​​​প্রাসাদের​​​​​​​মতো ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিলো। পারিবারিক রক্ষণশীল পবিত্রতার দায় ​​​প্রতিষ্ঠা​​​​​​​করতে​​​​​​​গিয়ে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা দৈবী চরিত্রদের সাহায্য ​​​​​​​নিতো। বিভিন্ন আখ্যানে নানা রকম দেবতাদের পাত্রপাত্রী করে গল্প বাঁধার​​​​​​​কৌশল​​​​​​​ নেওয়াটাই তখন স্বাভাবিক​​​​​​​পদ্ধতি​​​​​​​ছিলো । এই রকম একটা সময়ে পুরাণকাররা ত্রিকালপতিদেবাদিদেব মহাদেবকেও মানুষী সংসারবন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। তাঁকে মানুষের পারিবারিক যাপনের অনুকরণে দৈনন্দিন ধুলোখেলার শরিক করে ফেলা হয়। পুরাণযুগ থেকেই সতী বা উমা এবং পার্বতীর সঙ্গে শিবের একটা সাংসারিক বন্ধনের উপাখ্যান প্রচলিত ​​​​​​​ছিলো। নানা কাব্যকাহিনীর মাধ্যমে তার​​​​​​​প্রচার​​​​​​​ছিলো​​​​​​​অব্যাহত। যদিও শিবের অবস্থান বিশেষ বদলায়নি । কিন্তু নানা কারণে পার্বতীর রূপ পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। এই​​​​​​​সব​​​​​​​রূপের মধ্যে প্রধান মহিষমর্দিনী‘ অবতার । অন্য রূপগুলি নানা তন্ত্রোক্ত শক্তিদেবীর নামে আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। দেবীর রূপগত বিবর্তনের নানা ধারা সমান্তরাল ভাবে চলে এসেছে প্রায় হাজার দুয়েক বছর। এদের মধ্যে হিমালয়দুহিতা হিসেবে সতীউমা বা পার্বতী রূপটির ​​​​​​​চিরন্তন লোকপ্রিয়তা​​​​​​​আছে। গুপ্তযুগের অনেক আগে থেকেই শিবের এই সাংসারিক গার্হস্থ্য যাপনটি নিয়ে লোকের আগ্রহ চোখে পড়ে। কালিদাসের কুমারসম্ভব‘ আবহমান ধারণাটিরই কাব্যিক প্রকাশ। দুই পুত্র নিয়ে ভার্যাসহ কৈলাশে শিবের সংসার নির্বাহ,​​​​​​​এদেশের সাধারণ মানুষের সাইকির মধ্যে গভীরভাবেই প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো। পার্বতী ক্রমাগত রূপ পরিবর্তিত হয়ে কখনও মহাদেবী‘ হয়ে​​​​​​​গেছেনকখনও বা আদ্যাশক্তি‘ অথবা সুপরিচিত মহিষমর্দিনী। এই পরম্পরাটিকেই আধ্যাত্মিক চিন্তায় প্রাথমিকতা দেওয়া ​​​​​​​হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও কন্যা‘ উমা বা জামাতা‘ মহেশ্বরের ইমেজ কখনও ম্লান হয়নি। অধিকন্তুসময়ের সঙ্গে তাতে নানা নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে। বৈদিককালে দেবী সরস্বতী স্বাধীনা ছিলেন। পুরাণযুগে তিনি ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। নানারূপে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে বিষ্ণুর যোগাযোগও আদিকাল থেকেই রয়েছে। কিন্তু সম্ভবত ভাগবত পুরাণের কালে এসে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই আদ্যাশক্তি‘ বা পার্বতীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। মোটামুটিভাবে ষোড়শ শতক থেকে পূর্বভারতে এই দুই দেবী ব্রহ্মা বা বিষ্ণুর পুরোনো ‘আশ্রয়’ ছেড়ে শিবের সংসারের সঙ্গে পাকাপাকি​​​​​​​ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

মধ্যযুগে বাংলাঅসম ও ওড়িশা অঞ্চল পিতৃতান্ত্রিকব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে পড়ে। উপরন্তু​​​​​​​​​​​​​এই​​​​​​​সব​​​​​​​দেশে কৌম শাক্তসংস্কৃতির ব্যাপক চর্চাও শুরু ​​​​​​​হয়ে​​​​​​​যায়। ফলত ​​​​​​​দেশের​​​​​​​পূর্বপ্রান্তের সমাজজীবনে যথেষ্ট পরিমাণে মাতৃতান্ত্রিক ঝোঁক দেখা​​​​​​​যেতো। দেবী দুর্গার ভগবতীরূপব্রাহ্মণ্যমতে মহাদেবীর পালনকর্ত্রী ভাবমূর্তির প্রতীক। যৌথপরিবারের গৃহলক্ষ্মী হিসেবে দেশের এ প্রান্তে সেই রূপটি ​​​​​​​চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত​​​​​​​ হয়ে গিয়েছিলো। সপ্তমাতৃকা বা চৌষট্টি যোগিনী পরিবৃতা চামুণ্ডা বা ছিন্নমস্তারূপ যুদ্ধদেবী ক্রমে হয়ে গেলেন স্নেহময়ীসন্তাননিষ্ঠ মাতা। মাতা এবং তাঁর সন্ততিরাই জনমনে পাদপ্রদীপের আলোটি আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। গৃহকর্তা‘ শিব সেখানে উপলক্ষ মাত্র। সাবেকি ভূমিনির্ভর কৃষি অর্থনীতির শর্ত পূরণ করতে ভারতবর্ষ একদিন যৌথ পরিবারব্যবস্থাকে আশ্রয় করেছিলো। তারই ফলশ্রুতিউমাহৈমবতীপার্বতী ইত্যাদি চরিত্র মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি শারদীয় দেবী দুর্গার​​​​​​​ভাবমূর্তি। বাঙালির কাছে তিনি ​​​​​​​এই নতুন ভাবমূর্তিতে আবির্ভূত​​​​​​​হয়েছিলেন। দেবী দুর্গার আনুকূল্যে যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থাটি সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে​​​​​​​বরণীয়​​​​​​​হয়ে​​​​​​​ওঠে।​​​​​​​যথেষ্ট আনুগত্যও লাভ করে। অষ্টমনবম শতক নাগাদ সংকলিত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গণেশজননী ও শিবের প্রিয়তমা পত্নী দুর্গাকেই সর্বজন আরাধ্যা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী বলা হয়েছিলো। দুর্গার এই রূপের সঙ্গে মার্কণ্ডেয়পুরাণদেবীপুরাণ বা দেবীমাহাত্ম্যে বর্ণিত ভয়ংকরী মহিষমর্দিনী রূপের কোনও সম্পর্ক নেই।

বঙ্গদেশের চরিত্রলক্ষণ প্রসঙ্গে আমাদের কবি একটা উপমা দিয়েছিলেন। বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি‘, অর্থাৎ বঙ্গদেশের মানুষের যাপন​​​​​​​ও বিচারের মধ্যে একটি সজল আবেগের প্রভাব সর্ব ক্ষেত্রেই বলবতী । উত্তর ভারতের ভীষণা যুদ্ধদেবী বা তন্ত্রজাতরুধিরপিপাসু ঘোরা মাতৃদেবতা বঙ্গদেশে এসে সম্পূর্ণ অন্য রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন। তিনি এখানে বঙ্গতনয়া এক গৃহলক্ষ্মীর অবতারে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। আমাদের কবিরা তাঁকে নিয়ে যে সব গান বাঁধেনতার মধ্যে কালক্রমে স্নেহসম্মানের আবেগটিই প্রবল হয়ে ওঠে। দেশের অন্যত্র দুর্গার প্রতি প্রযোজ্য জমকালো প্রধানা দেবীর গরিমার সিংহাসন ত্যাগ করেবঙ্গীয় দুর্গা বাড়ির মেয়ে হয়ে তিনি বাঙালির কাছে আসেন। শরতের কটা উজ্জ্বল দিন আরও উজ্জ্বলতর করে তিনি জীবনকে ভরিয়ে দেন। আবেগপ্রবণ বাঙালি বাপমা তাঁদের কন্যাকে স্নেহজালে বেঁধে রাখতে কোনও​​​​​​​কসুর করতে ​​​​​​​চান​​​​​​​না। উমারূপী দুর্গার পতি ভোলানাথের জন্য ​​​​​​​বাঙালির সংলাপ কবি এভাবেই বেঁধে দেন,

‘… মার প্রাণে কি দুঃখ ধরে

জামাই নাকি ভিক্ষা করে

এবার নিতে এলে বলব হরে

উমা আমার ঘরে নাই।।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত