উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: মাতৃবন্দনার সূচনায় স্বপ্নাদেশ । সুকন্যা দত্ত
Reading Time: 5minutes
পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক জীবনের বদল ঘটে। নবাবদের শাসনের আঁচলে থাকা রাজা বা জমিদাররা নতুন করে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে চান। একদিকে শুরু হয় ইংরেজ প্রভুদের তোষণ অপরদিকে প্রজাদের বশীভূত করার কৌশল। এই উভয়দিকটি সমান্তরালে বজায় রাখার জন্য উৎসবের আশ্রয় আবশ্যক হয়ে পড়ে। বনেদি বাড়ীকে কেন্দ্র করে সূচনা হয় দুর্গোৎসবের। আভিজাত্য প্রদর্শন, প্রজাদের করায়ত্ত করার তাগিদে মহা আয়োজন শুরু হয়। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে খাওয়া দাওয়ায় অংশ নেয় হাজার হাজার প্রজা।
দুর্গা পুজোর শুভ সূচনার সাথে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় রাজা কিংবা জমিদারের স্বপ্নাদেশ। পূজা প্রাপ্তির অভিলাষে দেবী ভক্তকে পুজো প্রচারের নির্দেশ নেন। তবে দেবীর আদেশে মাতৃবন্দনার প্রচারের পিছনে আত্মপ্রচারের ইঙ্গিত একেবারে অস্বীকার করা যায় না।
গত দুবছর আগে দুর্গা পুজোয় জমিদার বাড়ী, রাজবাড়ীর পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। তাদের পূজা পার্বণের সাথে জড়িয়ে আছে অলৌকিক কাহিনী। দেবী স্ব মহিমায় সেখানে বিরাজমান। পুজোর কটা দিন ধূমধাম, আলোর রোশনাই, ঢাকের বাদ্য, ধূনোর গন্ধ, রমনীদের আনন্দোল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। আমার লেখায় তুলে ধরেছি চিল্কিগড়ের কনক দুর্গা মন্দির, কলকাতার বেলেঘাটার ভট্টাচার্য বাড়ী এবং কামারপুকুরের লাহাবাড়ীর পুজোর প্রেক্ষাপট।
চিল্কিগড়ের কনক দুর্গা মন্দির…
দুবছর আগে গিয়েছিলাম ঝারগ্রামের চিল্কিগড়ে, কনকদুর্গা মন্দির দেখতে। এই মন্দিরের সাথে মিশে আছে ইতিহাস। চিল্কিগড়ের এক প্রান্তে ঘন সবুজ জঙ্গল। গা ঘেষে বয়ে চলেছে স্বচ্ছতোয়া ডুলুং নদী। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢলে পড়া সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে উদাস হয়ে পড়ছিলাম। নদীর আশেপাশে দু একজন মানুষ। বাকী সকলে ভীড় করেছে মন্দির প্রাঙ্গণে। রাজবাড়ীর কাছে কনক দুর্গা মন্দিরে অষ্টধাতুর অশ্বারোহিনী চতুর্ভুজা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। এখানে কালিকা পুরাণ ও তন্ত্রমতে দেবীর আরাধনা হয়। প্রাচীন সময়ে প্রতি অমাবস্যা তিথিতে হতো নরবলি। এখন সে প্রথা রদ হয়েছে। কনক দুর্গা মন্দিরের দুর্গাপুজো ঘিরে রয়েছে অলৌকিক কাহিনী। বহু আগে ওড়িশ্যার এক ব্রাহ্মণ রাজার রাজত্ব ছিলো এখানে। রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। উত্তরাধিকারের অভাবে রাজার রাজ্যপাট চলে যায় সামন্তদের হাতে।
সে সময় জামবনীর সামন্ত রাজা ছিলেন জগদীশ চন্দ্র দেওধল। তিনি স্বপ্নে দেবীর সোনার মূর্তি তৈরির আদেশ পান। সেইসময় থেকে শুরু হয় দুর্গাপুজো। ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন জামবনী রাজা গোপীনাথ সিংহ রায় আশ্বিন মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে কনক দুর্গার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রানী গোবিন্দমনির হাতের কঙ্কন দিয়ে নির্মিত হয় কনক দুর্গা বিগ্রহ। গোপীনাথ সিংহের কন্যা সুবর্ণমণির সাথে বিবাহ হয় ধলভূম পরগনার রাজা সপ্তম জগন্নাথ দেও ধবলদেবের। পরবর্তীতে তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র কমলাকান্ত দেও ধবলদেব চিল্কিগড়ের রাজা হলে ওনার বংশধরেরা মন্দিরের সেবাইত। প্রথম পুজারি হন রামচন্দ্র সরঙ্গি। পরে ওনার উত্তরসূরীরা হন বংশ পরম্পরায় পূজার কাছে নিযুক্ত হন। তৎকালীন সময়ে গোপীনাথ সিংহ সপরিবারে ডুলুং নদীর নৌকাবিহারে মন্দিরে পুজোয় আসতেন। আজ ও পরিবারের সদস্যরা ষষ্ঠীর দিন ডুলুং নদীতে জল ভরতে আসেন। জলপূর্ণ ঘট রাতভর মন্দিরের বাইরে একটি বেলগাছের তলায় রাখা হয়। সপ্তমীর দিন সকালবেলা এক কলসি জল ঢেলে সেই ঘট বিশুদ্ধ করা হয়। তারপর যজ্ঞ, আরতি পুজার্চনার মধ্য দিয়ে ঘট গৃহে প্রবেশ করানো হয়। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, সংলগ্ন জঙ্গলে অষ্টমীর রাতে দেবী উমা স্বয়ং ভোগ রান্না করেন। সে রাতে অরণ্য মধ্যে নিশি পুজা হয়। দেবী দুর্গার ভোগে খিচুড়ির সাথে দেওয়া হয় হাঁসের ডিম। কনক দুর্গা মন্দিরে দশমীতে হয় রাবণ পুজো। একটি কলাগাছকে রাবণ বানিয়ে মশাল জ্বালিয়ে তীর ক্ষেপণ প্রতিযোগিতা হয়। অধুনা নব নির্মিত মন্দিরে পুজো হলে ও আগে পুরাতন মন্দিরে পুজা প্রচলিত ছিলো। তবে এখন সে মন্দির জরাজীর্ণ প্রায়। ভগ্ন দেওয়ালের পাঁজর চিরে বেড়িয়ে আছে বট অশ্বত্থের শিকড়। কথিত আছে বজ্রপাতে মন্দিরটি মাঝখান থেকে সমানভাবে দ্বিখন্ডিত হওয়ার দরুন ১৯৩৭ সালে নতুন দেবালয় নির্মিত হয়। পুরাতন মন্দিরটির মাথায় চক্র দেখে অনুমিত সম্ভবত এটি বিষ্ণু মন্দির।
বেলেঘাটার ভট্টাচার্য বাড়ীর পুজো…
দেবী দুর্গার মূর্তি কল্পনা করলেই চোখে ভাসে হরিদ্রাভ কিংবা পীতবর্ণ। কোথায় ও আবার বলা হয়েছে দেবী অতসী ফুল বর্ণা,”তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভ্যাম”। আবার ঋগ্বেদ অনুসারে তিনি “লোহিতকৃষ্ণশুক্লাম।” তবে বেদ বা পুরাণে যাই বর্ণিত থাক, ব্যতিক্রমী গল্প ও কিন্তু চোখে পড়ে। দেবীর গাত্র বর্ণ নিয়ে বেলেঘাটার ভট্টাচার্য বাড়ীর পুজোর এক অবিশ্বাস্য কাহিনী লোকমুখে প্রচারিত। এই বনেদি বাড়ীর দেবী দুর্গার গায়ের রঙ নিকষ কালো। তিনশো বছরের প্রাচীন পূজার শুভ সূচনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলবসন্তপুর অঞ্চলে। সে গ্রাম এখন পদ্মানদীর জলের তোড়ে ভেসে হারিয়ে গিয়েছে। তৎকালীন নাটোরের রানী ভবানীর সময়ে হরিদেব ভট্টাচার্য প্রথম এ গ্রামে দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। হরিদেব ভট্টাচার্য নদীয়া জেলার মানুষ ছিলেন। একসময় নাটোরের রাণী প্রদত্ত জমিতে তিনি বসবাস শুরু করেন। সকলের কাছে স্থল বসন্তপুরের জমিদার রূপে পরিচিত হন।
দুর্গা পুজো প্রচলনের পূর্বে এ গৃহে কালী পুজার প্রচলন ছিলো। স্বয়ং হরিদেব ভট্টাচার্য নিজে ও মা কালীর ভক্ত ছিলেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নাদেশে দুর্গা পুজার আদেশ পান। দেবী দুর্গা কালো মূর্তি আরাধনার আদেশ দেন। তবে হরিদেব মহাশয় এর কাছে কৃষ্ণকায়া রূপ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। বহু পন্ডিতের বহু বিধান শেষে এক বিচিত্র ঘটনা ঘটে। গ্রীষ্মের এক দুপুরে বেনারসে গঙ্গার ঘাটে হরিদেব ভট্টাচার্যের সাথে এক সাধুর সাক্ষাৎ হয়। তিনি স্বপ্নাদেশ বর্ণিত দুর্গার রূপের কথা শুনে বলেন, এই রূপ বর্ণিত আছে চন্ডীতে। সেখানে তিনি হলেন ভদ্রকালী। অবশেষে হরিদেব ভট্টাচার্য এই অভিনব মাতৃমূর্তির পুজো শুরু করেন।
এই বাড়ীর পুজোয় সপ্ত সিন্ধুর জল ব্যবহৃত হয়। সারা বছর ধরে সাতটি নদীর জল সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পুজো হয় তন্ত্র মতানুসারে। দেবী দুর্গা কৃষ্ণবর্ণা হলে ও মহিষাসুরের গাত্র সবুজ রঙের। চার সন্তানের গায়ের রঙ ও স্বাভাবিক। দুর্গার ডানপাশে লক্ষ্মী ও কার্তিক এবং বাম পাশে সরস্বতী ও গণেশের অধিষ্ঠান। পদ্মার তীরে যে কাজল কালো দুর্গা দেবীর বিগ্রহ বন্দনা শুরু হয়েছিলো গঙ্গাতীরে আসার পর ও সেই নিয়ম অটুট আছে।
কামারপুকুরের লাহা বাড়ীর পুজো…
কামারপুকুরের নাম কে না জানেন? রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পুন্য জন্মক্ষেত্র। হুগলী জেলার এই কামারপুকুরের লাহা বাড়ীর শতাব্দী প্রাচীন দুর্গা পুজোকে ঘিরে রয়েছে এক অত্যাশ্চর্য ইতিহাস। একবার ধর্মদাস লাহা জমিজমা বিষয়ক মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। একদিনের কথা। মামলার শুনানিতে যোগ দিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি চুঁচু্ড়ার আদালতের দিকে যাচ্ছিলেন। মাঝ পথে পরিশ্রান্ত হয়ে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তার দু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। স্বপ্নে দেখেন, দেবী স্বয়ং প্রকটিত হয়ে তাকে মামলায় জেতার আশ্বাস দিচ্ছেন।
দেবী বলেন, “ধর্মদাস বাড়ি গিয়ে তুই আমার পুজো করিস। খানাকুল থেকে দুই পটুয়া তোর বাড়িতে যাচ্ছে।” মামলায় জিতে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে দেবীর স্বপ্নাদেশ ভুলে যান। বাড়ি ফিরতেই দেখেন খানাকুল থেকে দুই পটুয়া এসে বসে আছে। পটুয়ারা জানায়, একটি বালিকা এ বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দুর্গা প্রতিমা গড়ার কথা বলেছে। ধর্মদাস লাহা অবাক হয়ে যান। সেই ১১২৭ বঙ্গাব্দ থেকে লাহাবাড়িতে দুর্গা পুজার শুরু হয়। পরে অবশ্য ১২০২ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত মায়ের মন্দিরে পুজোর প্রচলন ঘটে। এ পরিবারের সদস্য কৃষ্ণেন্দু লাহার মতে, দেবী মা যাত্রা শুনতে ভালোবাসেন বলে আজ ও বংশানুগতভাবে যাত্রা পরিবেশিত হয়ে আসছে। মহালয়ার দিন থেকে টানা আটদিন যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়। নবমীতে কুমারী পুজো হয়। কামার পুকুরের মাছ পুজোয় ব্যবহৃত হয়। এই লাহাবাড়ীতে বালক রামকৃষ্ণদেব পুজো দেখতে আসতেন। একবার মহালয়ায় প্রতিমা রঙ করার কারিগর অনুপস্থিত থাকায় চক্ষুদান সম্পন্ন করেছিলেন স্বয়ং পরমহংসদেব।
দুর্গা পুজোকে ঘিরে সেজে ওঠে গ্রাম থেকে শহর। রাজবাড়ি থেকে জমিদার বাড়ি। তাদের পুজোর ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে প্রাচীনত্বের গন্ধ। দালানকোঠার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেবী আরাধনা, মাতৃ বন্দনা, মন্ত্রোচ্চারণ ধ্বনিত হয়। পবিত্র পুজার ভক্তির সাথে অলৌকিক ইতিহাসের মেলবন্ধন বনেদি বাড়ীর প্রাণবায়ু।
বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। কয়েকটি ব্লগে লেখাও প্রকাশিত হয়েছে।তথ্যমূলক লেখার প্রতি আগ্রহে কলমে ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি, নানান দেশের খাদ্যাচরণ, ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ রয়েছে।বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি ও ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকে গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।