উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: সাবর্ণ মণিকাঞ্চন কথা । সুস্মিতা রায়চৌধুরী
“লুট হয়ে গেল ইতিহাসের মণিকাঞ্চন, পতাকা, কৃষ্ণচুড়া– তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”
কৃষ্ণপক্ষের রাতের অবসানে, বিহানবেলায় নতুন বউ জেগে বসে ফুলশয্যায়। প্রেমিকের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতেই ইতিহাস তাকে টানে চারশো বছর পেরিয়ে যাওয়া পুরণো কলকাতায়। দরজার খিল খুলে সন্তর্পণে দালানে গিয়ে দাড়ায় আলতা পা, কাঞ্চন নোলক। নতুন বউ হেঁটে চলেছে অলীক রাজপথ। সময়টা তখন ব্রিটিশদের পা রাখার আগের কলকাতার। একচ্ছত্র জমিদারি সামলে, অপার রহস্য আর ইতিহাসের গন্ধে সতেজ রায়চৌধুরী আভিজাত্য। সেগুন কাঠের বুকশেল্ফ থেকে নতুন বউ হাতে তুলে নেয় হলুদ মলাটের রায়চৌধুরী বংশের পুরণো ইতিহাসের মণিকাঞ্চন। নতুন বউয়ের সামনে যেনো পাল্টে যায় চিত্রপট।
“গঙ্গার পশ্চিমকূল, তথা বারাণসী সমতুল।”
লাল থামওয়ালা নাটমন্দিরের মধ্যবর্তী অংশটায় নিপুণ হাতে আল্পনা এঁকে দেয় বাড়ির মেয়েরা। মায়ের আগমনীর সুরে বেজে ওঠে কাসর–ঘন্টা, ঢাক, শঙ্খ। ধুনুচির গন্ধে যেন একনিমেষে সময় বয়ে চলে উল্টো গতিতে। ইতিহাসের পাতা উল্টাই আমি হাডসনের পাড়ে বসে। দশবছর আগে যখন আদ্যান্ত আধুনিক মানসিকতায় বড় হওয়া একটা মেয়ে নতুন বউ হয়ে এসেছিল এই পরিবারে, তখন অজানা ছিল সবটাই। শুধু বুঝেছিলাম ‘বড়িশা, বেহালা’র এই অংশটায় এখনও পুরনো একটা আভিজাত্যের গন্ধ লেগে আছে যৌথ পরিবারের অন্দরমহলে। হাডসনের হাওয়ায় ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায় অতীতে। নতুন বউয়ের সামনে তখন সাদা কালোয় রঙীন ১৪০৮। বিক্রমাদিত্যর পুত্র লক্ষ্মীকান্তকে হালিশহর থেকে আটটি পরগনার নিষ্কর জমিদারি–স্বত্ত প্রদান করেন মানসিংহ। সেই সঙ্গে তারা পান রায়চৌধুরী উপাধি। লজ্জায় সিঁদুর রাঙ্গা হয় এগারো বছর আগের পেলব ভাবনাগুলো। ঘরে ফিরে মসৃণ সাদা স্যাটিনের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই নতুন বউ দেখে তার স্বামী বাপ্পাদিত্য অঘোরে ঘুমোচ্ছে পালঙ্ক তাকিয়ার ঊষ্ণ ওমে। লক্ষ্য করেছিলাম আমার নতুন পরিবারে সবার নামকরণেই বেশ একটা আভিজাত্য আছে এই বিংশ শতাব্দীতেও। লাল বারান্দায় রাখা আরামকেদারার পাশেই রজতপাত্রে বাস করত আমার লালমলি। সাবেকি ঝাড়বাতিটা দর্পণ সাজাত সেই স্বচ্ছ জলে। ইতিহাসের জাদুকাঠিতে আবার দুরন্ত গতিতে পাল্টে যায় আবহ। লিভিংরুমের রাখা যামিনী রায়ের পেন্টিং, সোফার হাতলে সিংহমুখ, চোঙ্গাওয়ালা গ্রামোফোন, গড়গড়া হাতে মেহফিল সাজায় তখন সাহেব মেম। মুখগুলো যেনো কোথায় দেখেছে ভাবতেই চোখ পড়ে ইতিহাস বইয়ের সাদাকালো ছবিতে।
আমি হেসে উঠি নিজের মনেই। শহুরে একফালি ঘরে বড়ো হয়ে ওঠা অষ্টাদশী তখন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কনিষ্ঠ বউঠান।
প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো পুজোটি এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বড়িশার কাছারি বাড়িতে প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাপুজো করেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সাবর্ণ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু আজ শুধু ইতিহাস নয়, তার সাথে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বর্তমানকেও। নতুন বউয়ের সাধের বড়িশায় তখন বনেদি বাড়ির নতুন চালচিত্র। প্রাচীনকালে বড়িশা মূলত দু–প্রকার ছিল, বড়িষা এবং বড়িশা। বাংলার বারো ভুঁইয়া তথা সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের জায়গিরদারির পূর্ব থেকেই বড়িশা গ্রামের রাজস্বের ভাগ ছিল বেশী। এই বড় হিষ্যা থেকেই “বড়িষা” নামকরণ। আর এই ভাগের বাইরে যে এলাকা ছিল তা ছিল জলাভূমি। এই জলাভূমিতে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরে নিম্ন সম্প্রদায়ের গরিব মানুষজন তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই বঁড়শে থেকে বড়িশা নামের উৎপত্তি।
এখনও সমগ্র রায়চৌধুরী পরিবার মিলিয়ে মোট আটটি পুজো হয়। এর মধ্যে ছ’টি পুজোর অবস্থান বড়িশায়। ‘আটচালাবাড়ি’, ‘বড়বাড়ি’, ‘মেজবাড়ি’, ‘মাঝের বাড়ি’, ‘বেনাকিবাড়ি’ আর ‘কালীকিঙ্করভবন’। যে পুজোটি দেখতে দেশ–বিদেশ থেকে মানুষ আসে তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় আটচালা বাড়ি। প্রথম আটচালাটি ছিল কাঠের থামের ওপর হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া চন্ডীমণ্ডপের মতো। পরে কংক্রিটের আটচালা তৈরি হয় সেখানে। আটচালার লাগোয়া যে থামবিশিষ্ট নাটমন্দির সেখানে রয়ে গেছে দশটি থাম। সাবর্ণ পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী দুর্গামায়ের পুজো হয় আটচালাতেই। ঠাকুর দালানে পুজো এই পরিবারের নিয়মবহির্ভূত। এই পরিবারের সাথে কালীঘাটের সংযোগ সেই ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সুদূর হালিশহর থেকে সাবর্ণ বংশের পদ্মাবতীদেবী সন্তান লাভের জন্য দেবী সাধনা করতে কালীক্ষেত্রে এসেছিলেন। তখন কালীঘাট বর্তমানের অবস্থানে ছিল না। সেখানে সেবক আত্মারাম ঠাকুর তার কাছে দেখেন দেবী মূর্তি। মুগ্ধ হয়ে তিনি সেই মূর্তির আদলে তৈরী করলেন কালীক্ষেত্রের মা কালীকা। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানের কালিঘাটের মা কালীর আদিমূর্তিটি সাবর্ণদের কুলমাতা মা ভুবনেশ্বরীর।
বিয়ের পর প্রথম পুজোয় যে উত্তেজনা ছিল তা আজও ক্রোশ মাইল দূরে অমলিন। রাধাকান্তের মন্দিরে প্রণাম করে আলতা পায়ের ছাপ ফেলে তবেই প্রথম প্রবেশ করা হয় এই পরিবারে। প্রত্যেকটি দুপুর তখন কাটত দুর্গাপুজোর অপেক্ষায়। কাঠের চিরুণীতে চুল আঁচড়ে দিত ন’মা, ন’পিসিরা। কৌতুহল ছিল আমার সাবেকি ইতিবৃত্তে তাই তাদের কাজ ছিল গল্প শোনাতে হবে আমায় রোজ। ডায়েরির পাতায় তখন লিপিবদ্ধ হত সাবেকিয়ানা।
জমিদারি গেছে বহুকাল তবুও ধুলোপড়া ঝাড়বাতিটায়, লাল বারান্দায়, পুরনো ঠাকুর মন্দিরে, সোনার ঘটে, চন্ডিমন্ডপে এমনকি নামের গাম্ভীর্যেও রয়ে গেছে সরল আভিজাত্য। তাই যখন মার্কিনমুলুকে বাঙালি পুজোর এসোসিয়েশনে কুইজ হয় সাবর্ণ পরিবার নিয়ে, তখন হাত উঠে যায় স্বয়ংচল অভিব্যক্তিতে। আমার বাড়ির গল্প, তা গল্প নয়, সত্য ঘটনা।
অনেকেই হয়ত জানেন না রায়চৌধুরী পরিবারের পদবী কিন্তু আদতে রায়চৌধুরী নয়। তাঁদের গোত্র হল ‘সাবর্ণ‘ এবং ‘রায়‘ ও ‘চৌধুরী‘ তাঁদের উপাধি, তাঁদের পদবি গঙ্গোপাধ্যায়। মুঘল সম্রাট আকবর তাঁদের ‘রায়’ ও জাহাঙ্গির তাঁদের ‘চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁদের বংশধররা ‘রায়চৌধুরী‘কেই পদবি হিসেবেই ব্যবহার করেন।
রায়চৌধুরী পরিবারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা চণ্ডী। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী একদিন পুকুরে স্নান করতে গিয়ে উদ্ধার করেন অষ্টধাতুর একটি কলসি। এর তিন দিন পর, তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। তখন ভাটপাড়ার পণ্ডিতরা পুঁথি পড়ে বলেন ইনি ‘মা চণ্ডী‘। দেবী চণ্ডীর রূপ এখানে রক্তবর্ণ, তিনি একদিকে যেমন শান্ত–স্নিগ্ধ, অন্যদিকে তেমনই তেজস্বী।
আরও জানলে অবাক হবেন, মহেশচন্দ্র চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অষ্টধাতুর কলসিটি রায়চৌধুরীদের কূলদেবী। কলসির ওপর রাখা ডাব হল মায়ের মুখমণ্ডল আর ডাবের শিষ হল মায়ের নথ। আরও জানলে বিস্ময় জাগবে সারা বছরে ওই ডাবের শিষ এবং ঘটের জলের কিন্তু কোনও রকম বদল চোখে পড়ে না। আমিও না দেখে বিশ্বাস করিনি এই মহাজাগতিক ঘটনা। সেই প্রথম প্রবীণ বংশধরদের সাথে পরিচয় আমার। নতুন বউয়ের অনুমতি আছে সব কিছু ঘুরে দেখার। ইয়া বড় গ্রীলের বারান্দা, চৌকো খোপের মার্বেল মেঝে পেরিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেই সেই পুকুরের ঘাট। নারকেল, পেয়ারা গাছ দিয়ে ঘেরা সেই ঘাটে বসে অনেক দুপুর কাটত গল্প লিখে। চারদিকে যখন দূষণে ভরছে শহরটা তখন এখানে একটুকরো হিমেল হাওয়ায় শান্তির অনুভূতি। বিশাল বড় মেলা বসে এখানে চণ্ডীপুজোয়।
পুতুলনাচ, মরণকুপ, আঁচার, নাগরদোলা, জিলিপি–গুঘনি, তখনও হরেক মাল পাঁচ টাকায় পাওয়া যেত বেহালা সখেরবাজারের চণ্ডীমেলায়। ফেরা হয়না বহুবছর তবুও আমেজ রয়ে যায় ফেলে আসা দিনের। তাই এখনো নিউইয়র্কের রাস্তায় ‘সামার ফেয়ার’ দেখলেই মনে হয় এরকম ছিল তখনের শীতকাল। ডিসেম্বর মাসে চণ্ডীপুজো হয়। কিন্তু তার আগে সাবর্ণ পরিবার সেজে ওঠে লাল পেড়ে সাদা গরদ শাড়ীতে আর সোনার গয়নায়। নতুন বউয়ের চোখে সেই বছর প্রথমবার জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজা।
শরতের গন্ধ গায়ে মেখে এসে পড়েন মা দূর্গা। দুর্গাপূজা হয় মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতি রচিত পুঁথি “দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী” মতে। শিউলি ফুলের বোঁটার মতো স্বর্ণাভ দেবীর গায়ের রঙ। বিশেষ উল্লেখযোগ্য দেবীর পাশে গণেশের গায়ের রং হয় লাল, অসুরের সবুজ এবং দেবীর এক দিকে থাকেন রঘুপতি, অন্য দিকে শিব। আটচালা বাড়িতে কৃষ্ণপক্ষের নবমীর দিন বোধন হলেও, অন্য বাড়িতে ষষ্ঠীর দিনেই বোধন হয়। সেই দিন থেকে প্রতি দিন চণ্ডীপাঠ, হোম, ভোগ আরতি হয়। সপ্তমীর সকালে দেবীর চক্ষুদান ও নবপত্রিকা স্নান দিয়ে পুজো শুরু হয়। দেবীমূর্তির সামনে সোনার আংটি ও সোনার আসন রেখে মহাসপ্তমী ও মহানবমীর পুজো হয়। সন্ধিপুজোয় দেবী চামুন্ডা রূপে পূজিত হন। সদ্য স্নান সেরে ওঠা নতুন বউয়ের চোখে তখন স্বপ্নীল কল্পনা। এই বুঝি জুড়িগাড়িতে করে নেমে দাঁড়াবেন স্বয়ং লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। সবুজ খরখরি জানলা খুলতেই সিঁদুর ছুইয়ে দেয় আকাশের সোনা রং। জানলার নিচের পদ্মদিঘিতে টলটল করে ওঠে জল। কাশের বনে ভেসে যায় শরতের হালকা হিমেল হাওয়ায়। ঝকঝকে তকতকে নিকানো উঠোনে আল্পনা দেওয়া তুলসি মঞ্চ। বর্ধিষ্ণু এই পরিবারের পুজোয় মিলিত হয় উচ্চবর্ণের হিন্দু, নিম্নবর্ণের হিন্দু এমনকি ইসলাম খৃস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষও। কচিকাঁচারা ভীড় করে দালান জুড়ে। যেহেতু আটটা বাড়ি সখেরবাজার,বেহালার রাস্তা জুড়ে অবস্থিত তাই সাবর্ণদের পুজোর ব্যপ্তি অনেকটাই। আটচালা এবং মাঝের বাড়ি পাশাপাশি অবস্থিত। তার মাঝখানে বেশ সুখ্যাত সার্বজনীন ক্লাবের পুজো থাকলেও তার কর্মকর্তারাও এই বংশেরই। যুগের সাথে থিম পাল্টায় কিন্তু বদলায়না কলকাতার সবথেকে পুরণো বনেদী বাড়ির গৌরব। যশ কমেছে ধনসম্পত্তিতে, চাকরিরত এখন দৈনন্দিনের জীবিকা, জমিদারের দাপট এখন সাদা–কালো ইতিহাস তবুও এতটুকু ম্লান নয় বংশ-পরম্পরায় রক্তের টান।
আরেকটা কৌতুহলও ছিল আমার যে বলিপ্রথায় কি হয় এখানে? আগে এই বাড়ির পুজোয় ১৩টি ছাগল ও ১ টি মোষ বলি হত। এখন পশুবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে কুমড়ো, শশা এই সব বলি হয়। সাবর্ণ রায় চৌধুরী–র বাকি সমস্ত বাড়িগুলিতে আমিষ ভোগের আয়োজন করা হয়। কেবলমাত্র নিমতার বাড়িতে হয় সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ। সকালে ফলমূল, দুপুরে অন্নভোগ আর রাতে লুচি। আসলে ঐতিহ্যের হাতবদল ঘটলেও পেটপুজো বাঙালি মাত্রেই এক। বোধনের পর থেকে পরিবারের মহিলারা ভোগ রাঁধেন। সাদা ভাত, পোলাও, খিচুড়ি— এক এক দিন এক একটা জিনিস রান্না করা হয়। এর সঙ্গে শুক্তো, মুগের ডাল, মোচার ঘণ্ট, লাউ, সবই রান্না করা হয় দেবীর জন্য। এ ছাড়াও দেবীকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয় বলে রুই, ভেটকি, পার্শে, বাটা, ইলিশ— এমন পাঁচ রকমের মাছ থাকে প্রতি দিন। আর থাকে চাটনি, পায়েস, পাঁচ–ছয় রকমের মিষ্টি। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজো চলাকালীন তৈরি করতে হয় খিচুড়ি, ল্যাটামাছ আর কাঁচকলা পোড়া। নবমীর দিন রাতে রান্না করে রাখতে হয় খেসাড়ির ডাল, চালতার অম্বল, কচুশাক আর কইমাছ। দশমীর দিন সকালে ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয় এগুলি।
রাতে লুচি করা হয়। এর সঙ্গে থাকে বেগুনভাজা, পটলভাজা, ছানার ডালনা। দশমীর দিন পান্তাভোগ হয় প্রতি বার। বেশ ব্যতিক্রমী নিয়ম মেনে নিরামিষ ভোগ হয় মহাদেব ও রামচন্দ্রের জন্য ও আঁশ ভোগ হয় দেবী দুর্গার জন্য।
এই পরিবারে বিজয়া একটু অন্য রকম ভাবে হয়। মাকে প্রথম সিঁদুর দিয়ে বরণ করার সৌভাগ্য হয় আমার কয়েকবার। প্রথম যে বরণ করে তার কুলোয় থাকে সিঁদুর, মিষ্টি, পান–সুপারি, আলতা। দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরেই ঠাকুরের সামনেই প্রথম বরণ শেষে শুরু হয় বিজয়া পর্ব। চণ্ডীমণ্ডপে প্রণামের রীতি এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য, এই নিয়মের চল অন্য কোথাও নেই। সব শেষে বাবুঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয় সমস্ত আড়ম্বর। নাহ, মন খারাপের জায়গা নেই রায়চৌধুরীদের নতুন বউয়ের। বিসর্জন শেষেই সবাই মিলে শুরু হয় বিজয়ার মিষ্টি বানানো। বিশাল রান্নাঘরে পাতা হয় পেতলের বড় কড়াই, হাড়ি, হাতা, খুন্তি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। তখন রোজ নতুন কিছু শেখা পুরনো পোরখাওয়া অভিজ্ঞতার কাছে। মায়ের সামনে ধুনুচি নাচ বা প্রথমবার ঢাকে কাঠি বা আটপৌড়ে শাড়ির আঁচলে চাবির গোছায় নতুন সংসারের দ্বায়িত্বভার। এক নিমেষে কিশোরী থেকে বড় হয়ে যায় অষ্টাদশীর সরলতা। নতুন বউয়ের হাতটা আদরে ধরে রাখে স্বতন্ত্র, বর্ধিষ্ণু সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। আর আমার নিউজার্সির ব্যাকইয়ার্ডে ফল–ফলিয়েজের রঙ্গীন মলাটে বাক্সবন্দি হয় ইতিহাসের সত্যি চরিত্ররা আর আগামী প্রগতিশীল জীবন ভাব জমায় ইতিহাসের ধ্রুপদী আলাপে।
তথ্য: লেখিকা সাবর্ণ পরিবারের বংশধরের স্ত্রী, গল্পে ব্যবহৃত তথ্য পরিবারের ব্যক্তিগত