| 16 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: অতীত কথায় এক কবিরাজবাড়ির দুর্গাপুজো

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ একটা বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর গল্প বলি আসুন। গল্প বলছি বটে, গল্প কিন্তু নয়। এ এক পরিবারের অভিজ্ঞতার কথা, বিশ্বাসের কথা। ইতিহাস সময়ের সাথে সাথে রূপকথার মতো আলো-আঁধারের রঙ-জালি হয়ে পরে। কি যে ঘটেছিল আর কি যে মুষ্টিমেয় মানুষের ধারণায় বেঁচে আছে তা বোঝা দুষ্কর হয়ে যায়। তেমনি এক দুর্গাপুজোর ইতিহাসের কথা বলি আপনাদের।
স্থান – ব্যারাকপুর, কালিয়ানিবাস। 
কালিয়ানিবাসের প্রায় সবকটি বাড়ির পুজোই এই পরিবারের অংশ। কালিয়াবাস নামটি কিন্তু এই পরিবারের এপার বাংলায় এসে এখানে বসত শুরু করার পর, তাদের নামেই নামকরণ হয়। 
এপার বাংলায় এই বাড়ির পুর্বপুরুষরা আসার পরে , দুর্গাপুজোর বয়স নয় নয় করেও পঁচাত্তর বছর হয়ে গেল। আর ওপারের সময়টা চারশো পঁচানব্বই বছর হবে, মতান্তরে পাঁচশ ছাড়িয়ে। মুঘল সাম্রাজ্যের সময় থেকে চলে আসছে এই কবিরাজবাড়ির দুর্গাপূজা। এদের পদবী দাশগুপ্ত। অর্থাৎ এঁদের পুর্বপুরুষেরা ছিলেন রাজবৈদ্য। বাড়ির নাম ছিল কবিরাজ বাড়ি। কিন্তু কালের স্রোতে রাজবাড়ি হয়ে যায়।  ব্যারাকপুরে রাজবাড়ি নামে এখনও একডাকেই পরিচিত।
তা এই বংশে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। বহুযুগ ধরেই একান্নবর্তি পরিবার এবং তার সাথে পুরোহিত, পালমশাই প্রভৃতির পরিবার বংশ পরম্পরায় করে আসছে পুজো। একচালার শোলার সাজ পরা ‘সপরিবারায়ই, সবাহনায়ই’ মাতৃমূর্তি। আগে এ বাড়ির পুজোয়,  প্রতিপদ, মহাষষ্ঠীর বোধনকালে, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী ও মহানবমীতে হতো পাঁঠাবলি। 
আমার গল্পকাল মুঘলদের সময়ের নয়। এ আমার কাছেও নিতান্ত বেদনার যে আমিও এই ইতিহাসকে প্রায় রূপকথার পর্যায়ে গিয়েই জেনেছি। যাক সে কথা। বলতে বসেছি এখনকার বংশের আট প্রজন্ম  আগের বংশোদ্ভূত পুর্বপুরুষের কথা। পেশায় তিনি ছিলেন রাজবৈদ্য। পুজোর জন্য রাজার কাছে ছুটি নিয়ে তাঁর দেশের বাড়িতে ফেরার কথা। সাথে নিয়ে যেতে হবে প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী, উপাচার ইত্যাদি।

বাঁধ সাধল স্বয়ং রাজা। তিনি সে বছর রাজবৈদ্যকে ছুটি দিতেই নারাজ। বললেন, “বৈদ্যমশাই, ওটি হচ্ছে না, আপনি পুজোর পরে বাড়ি যান”।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
ছবি: প্রতীকী

মন ভেঙে গেল রাজবদ্যি নরহরি দাশশর্মার। বাড়ির পুজো, বছরকালে একটাবার মায়ের অমন সুন্দর মুখখানি দেখা – হবে না সে বছর?  খাওয়া দাওয়া মাথায়, দুর্গামায়ের প্রতি একবুক অভিমান নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি ঘুমিয়ে পরলেন।স্বপ্ন দেখলেন সে রাতে – একটি বাচ্চা মেয়ে, ঠেঙো কাপড় পরা, তার দিকে চেয়ে হাসছে। মেয়েটি একগঙ্গা কথা বলে গেলেন রাজবদ্যিকে। বললেন , “অত মন খারাপ করিস না। রাজা মানা করেছেন ঠিকই কিন্তু কাল উনি তোকে যেতে দেবেন। ছুটি পেয়ে নদীর তীরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবি, কোন মাঝি আমায় এক রাতের মধ্যে  পারাপার করিয়ে দেবে? যে-ই আসুক, বিনা বাক্যব্যয়ে তার নৌকায় চড়ে বসবি। নামার সময় নৌকায় যা পাবি , নিয়ে নামিস। পুজোর কাজে লাগবে। শোন, আমায় আর খাটো কাপড় দিস না বাবা, পুরো শাড়ি দিস। আর একটা  কথা, ষষ্ঠীতে আর বলি দিস না। এবারের বলি আমি আমার বাঁ হাতের কেনে আঙুল দিয়ে বন্ধ করে মন্ডপের ছাঁদের ঈশানকোণে রক্ত মুছে এসেছি। বলিতে বাঁধা পরলে বুঝবি ঘোর বিপদ।”  এই অবধি বলে, সেই কিশোরীমূর্তি মিলিয়ে যেতে থাকলেন একটা আলোর বলয়ের মধ্যে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল রাজবৈদ্য অর্থাৎ নরহরি দাশগুপ্তর। মন খুবই দোলাচলে- রাতের স্বপ্নটা মনকে খুব মেঘলা করে রেখেছে। বেলা হতেই ডাক পাঠান কামাক্ষার তৎকালীন অধীশ্বর। বলেন, “বদ্যিমশাই, কাল সারারাত বড়ই অস্বস্তিতে কেটেছে, মন বলছে, আপনাকে আটকে ভালো করিনি। পুজোর দিনে, বাড়ি যেতে না দেওয়া ঠিক নয়। তার উপর আপনি সাধক মানুষ, তার উপর বাড়িতে পারিবারিক পুজো। আপনি বাড়ি যান। আমার আপনার দুজনের পুজোই তাহলে ভালো কাটবে।”
বিগলিতচিত্তে জিনিষপত্র গুছিয়ে, টাকাকড়ি নিয়ে রওনা হলেন নরহরি দাশগুপ্ত, তার মৃন্ময়ীমায়ের দিকে, সেনহাটি। পদ্মার পাড়ে আসতে রাত নেমে এলো। হাঁক দিলেন উৎসুক যাত্রী, “কোন মাঝি এক রাতের মধ্যে ওপারে নিয়ে যেতে পারে আমায়”। তক্ষুনি কেউ এগিয়ে এলেন না বটে, তবে কিছু পরে, এক বুড়ো মাঝি এগিয়ে আসে। বলে, “কত্তা আসেন এই নৌকায়”।
নৌকায় উঠে বসলেন রাজবৈদ্য। লম্বা পথের ধকলে ঘুম নেমে এল দুচোখের অলিন্দে। ভোর জেগে উঠল বুড়ো মাঝির ডাকে। চোখ খুলে বাংলার সবুজ দেখে শরীরে যেন প্রাণ এল। নামার সময় দেখলেন নিজের জিনিসপত্রের সাথে রয়েছে আরো তিনটি বস্তু – একটি বাসুদেব বিগ্রহ , একটি দক্ষিনাবর্ত শঙ্খ এবং একটি পুঁথি। বিগ্রহ ও শঙ্খটি পরিবারের দুটি শাখাবাড়িতে সযত্নে নিত্য পুজো পায়। আর পুঁথিটি হলো কালিকাপুরাণ। ভুর্জপত্রে পরিষ্কারভাবে লেখা এই পুঁথি অনুসারেই এখনও পুজো হয় এই বাড়ির সবকটি একান্নবর্তি পরিবারের ভাগে। 
নরহরি সব নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি পৌঁছান। সব কিছু নামিয়ে রেখে ওঠেন মন্ডপের ছাঁদে। থরথর করে কাঁপছে তার সারা শরীর। খড়ের চালার ঈশানকোণে দেখেন অনেকটা রক্ত মোছা। সেইবারের পর থেকে আর ষষ্ঠীতে আর বলি হয়নি কখনও। ২০০৭ থেকে বিধান নিয়ে পাঁঠাবলি বন্ধ করা হয়েছে সময়ের সাথে তাল রেখে। তিনি ওই রক্ত দেখে অস্থির হয়ে নেমে এসে আছড়ে পরেন দেবীর পায়ে। ভক্তি, প্রেম, দেখা না-দেখা সব মিলিয়ে এক অন্য আলোময় জগতের হাতছানি যেন। 
ওই পুঁথি এখন জাতীয় সংগ্রহশালায় রয়েছে সাথে এই পরিবারের বংশতালিকা। নরহরি দাশগুপ্ত অবশ্য ওইবারের পুজোর পরে নিজে হাতে উদ্ধার করে লিপিবদ্ধ করেন ওই পুঁথি যেটি মেনে এই কবিরাজবাড়ির পুজো চলে আসছে। সময়ের ধুলোমাখা সেই এক সময় থেকে। তার উত্তরপুরুষের মুখে শুনেছি, তিনি আর থাকেননি সংসারে বেশি দিন। সংসার ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, এই অনুভূতি আর পুজোর প্রতি অদম্য এক ভালবাসা রেখে যান তার প্রজন্মের জন্য।
এ তো গেল সেনহাটির কথা, বাংলাদেশে। এবারে কালিয়ানিবাসের একটা অলৌকিক ঘটনার কথা বলি।  এটা আমাদের দুই প্রজন্ম আগের কথা। তখনও এই পরিবার প্রকৃত অর্থেই একান্নবর্তি ছিল। মানে সারা বছরই একসাথে খাওয়া-দাওয়া, থাকা আর কি। পুজোর সময় রান্নার ঠাকুর কাজকর্ম সেরে মন্ডপের খোলা মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক রাতে কেউ যেন তাকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ভয়ে পালিয়ে বাড়িতে ঢুকে আসে তিনি। আসলে মণ্ডপের ঘটস্থাপনের স্থানটি ঘিরে একদম সরু একটা রেখা টানা থাকে। এটি দেবতার পথ। এটির উপর তিনি শুয়ে পরেছিলেন, তাই এমন কান্ড। এখনও মন্ডপে বসার সময় এই পথটি  ছেড়ে বসার রীতি পালন করা হয়ে চলেছে।
অদূর অতীতেও বেশ কিছু এমন ঘটনা আছে যেগুলি বিশ্বাস ও যুক্তিবাদী ঢেউয়ে বারবার ধুঁয়ে যায় তবে তাও তারা বেঁচে থাকে, জেগে থাকে। বাড়িরপুজোর আলাদা টান, আলাদাই মাধুর্য। আর তার সাথে যখন মিশে থাকে ঐতিহাসিক বা আধিদৈবিক কোন হালকা অথচ গভীর আভা তখন সেই পুজো আর শুধু বছরকার উৎসব থাকে না, হয়ে ওঠে ঐতিহ্য, গর্ব আর পারিবারিক শক্তি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত