| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: কালীঘাট পট–বাংলার নগরায়িত লোকসংস্কৃতি

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

১৯১৭ সালের ৮ই আগস্ট, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম। খ্যাতিমান সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং এলেন তাঁর বাবা জন লকউড কিপলিং-এর লাহোরের আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সংগৃহীত ২৮টি জল রঙে আঁকা ছবি মিউজিয়ামকে উপহার দেবার জন্য। এই একই শৈলীর ছবি মিউজিয়ামের সংগ্রহে আগে ছিল না এমনটি নয়, কিন্তু রুডইয়ার্ড কিপলিং উপহার দেওয়ার পর থেকে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিলেন তাঁদের সংগৃহীত এক বিশিষ্ট শৈলীতে আঁকা ৬৪৫টি জল রঙে আঁকা ছবি, রেখাচিত্র ও হাতে রং করা লিথোগ্রাফের দিকে। অচিরেই বিশ্বের শিল্পবেত্তাদের কাছে বাংলার এই চিত্রশৈলী পরিচিত হলো ‘কালীঘাট পট’ নামে। কয়েক বছর পর, ১৯২৬ সালেকলকাতার ‘রূপম’ পত্রিকার জুলাই-অক্টোবর সংখ্যায় অজিত ঘোষের ‘ওল্ড বেঙ্গল পেইন্টিংস’ নিবন্ধে উদ্ভাসিত হলো কালীঘাট পটের চিত্রশৈলীর নান্দনিক গুরুত্ব আর ১৯৩২ সালে কলকাতার ‘অ্যাডভান্স’ পত্রিকায় মুকুল দে লিখিত নিবন্ধ ‘ড্রইংস অ্যান্ড পেইন্টিংস অফ কালীঘাট’ এই চিত্রশৈলীর উৎকর্ষতাকে পৌঁছে দিল শিল্পরসিক বিশ্বে। প্রায় এই একই সময়, গুরুসদয় দত্ত শুরু করলেন কালীঘাটের পট সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ আর যামিনী রায়ের প্রতিভাশালী তুলির টানে কালীঘাটের লোকায়ত চিত্ররীতি পরিব্যক্ত হলো এক আধুনিক চিত্রভাবনায়।

বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার এক জনবহুল এলাকা কালীঘাট অন্ত-মধ্যযুগ বা তারও পূর্ববর্তী কাল থেকে অন্যতম শক্তিপীঠ হিসাবে পরিচিত। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকেই ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের কারণে কলকাতায় দ্রুত নগরায়নের প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়। ১৮০৯ সালে তখনকার কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল কালীঘাটে আদিগঙ্গা বা টালির নালার ধারে অবস্থিত পুরোনো কালী মন্দিরকে বর্তমান রূপে পুনঃনির্মাণ করান সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার। উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে কলকাতার নগরায়ন ও সুগমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কালীঘাটের এই কালী মন্দিরে তীর্থযাত্রীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কলকাতার উপকণ্ঠবর্তী কালীঘাটের তীর্থক্ষেত্র হিসাবে পরিচিতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে আশেপাশের এলাকায় কর্ম চঞ্চলতাও বৃদ্ধি পায়। কালীঘাটের মন্দিরের আশেপাশের দোকানে পটচিত্র বিকিকিনিঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না হলেও ১৮২৫-১৮২৬ সাল থেকে এখানকার পটচিত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৮৩২ সালে লন্ডন থেকে সোফি শার্লট বেলনস ‘টোয়েন্টি ফোর প্লেটস ইলাসট্রেটিভ অফ হিন্দু অ্যান্ড ইউরোপিয়ান ম্যানার্স ইন বেঙ্গল’ নামে একটি চিত্রমালা সম্বলিত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে প্রকাশিত ১৪ সংখ্যক ছবিতে একটি গ্রামের কুটিরের অভ্যন্তরের দৃশ্য দর্শিত হয়েছে। এই কুটিরের দেয়ালে যে চৌকো ছবিটি দেখা যাচ্ছে সেই চিত্রটি কালীঘাট পটচিত্র রীতিতে আঁকা শিবের প্রতিকৃতি বলে শিল্পবেত্তা উইলিয়াম জর্জ আর্চার অনুমান করেছেন। তাঁর মতে, কালীঘাটের পট যে ইতিমধ্যেই গ্রামের কুটিরের অভ্যন্তরে পৌঁছে গেছিল, এই ছবিটি তার সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য ঐতিহাসিক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর এই মতকে ভ্রান্ত বলে মনে করেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


উনিশ শতকের প্রথমার্ধে, প্রায় শুরু থেকেই, কালীঘাটের পটচিত্র শিল্পীরা আঁকার জন্য বেছে নেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের জড়ানো পটের পরিবর্তে কাগজের চৌকো পট। জড়ানো পটের বিস্তারিত পৌরাণিক বা সামাজিক কাহিনি বর্ণনার পরিবর্তে শুরু হয় একটি বিশেষ আখ্যান বস্তুর চিত্রায়ন। কোনও কোনও আধুনিক শিল্পবেত্তা, যেমন আর্চার, এই পরিবর্তনের কারণ হিসাবে ইউরোপীয় চিত্ররীতির প্রভাবের কথা ভেবেছেন, আবার অনেকে এই প্রভাব মানতে চাননি। কালীঘাটে আগত তীর্থযাত্রীদের মধ্যে এই সুলভ পটচিত্রগুলির চাহিদার ক্রমিক বৃদ্ধি দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিল্পীদের কালীঘাটে আসার জন্য আকর্ষিত করে।কালীঘাটে আসা শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই বাংলার গ্রামের চিরাচরিত পটুয়া বা চিত্রকর সমাজের পরিবর্তে কুম্ভকার, সদগোপ বা সূত্রধর সমাজ থেকে এসেছিলেন। তাঁদের অনেকের মাটির প্রতিমা বা কাঠের খেলনা নির্মাণের, রথের গায়ে চিত্র অঙ্কনের অথবা পোড়ামাটির সরা চিত্রণের পূর্ব অভিজ্ঞতা এই নতুন চিত্ররীতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। কালীঘাটে আগত শিল্পীদের মূলত তুলির টানে আঁকা রেখা নির্ভর পটচিত্রগুলি প্রথম প্রথম শুধু কালী মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় তীর্থযাত্রীদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ক্রমবর্ধমান বাজারের কয়েকটি দোকানঘর থেকে বিক্রি হতো। সেই কারণে, আধুনিক শিল্পবেত্তাদের কেউ কেউ ‘বাজার চিত্রশৈলী’ বলে এই শৈলীকে অভিহিত করেছেন। কিন্তু, এই চিত্রশৈলীর জন্মের কয়েক দশকের মধ্যেই কালীঘাটের বাজার থেকে পটের পসরা সংগ্রহ করে বাংলার গ্রাম-গঞ্জের মেলায় বিক্রি শুরু হয়ে যায়। কালীঘাটের পটচিত্র শিল্পীদের, যাঁদের তৎকালীন বাংলায়‘ পটুয়া’ বা ‘পোটো’ নামে পরিচিতি ছিল, শুধু পট বিক্রি করে সংসার চালানো সম্ভব ছিল না। তাই, কাঠ ও মাটির খেলনা নির্মাণ, মন্দিরের জন্য পোড়ামাটির অলংকৃত ফলক আর মাটির প্রতিমা নির্মাণ– সব রকম শিল্পকর্মেই তাঁরা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এই সব কাজের সুবিধার জন্য কালীঘাট মন্দিরের কাছে যে এলাকায় এই পটুয়ারা সপরিবারে একত্রিত হয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন, সেই এলাকা পটুয়াপাড়া বা পোটোপাড়া নামে পরিচিত হল। কালীঘাট পটচিত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে শুধু কালীঘাট নয়, সেই সময়কার কলকাতা শহরের সীমার মধ্যেও বিভিন্ন স্থানেও পটুয়ারা এসে একত্রে বসবাস করতে শুরু করেন। বর্তমান মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এলাকায় পটুয়াটোলা আর নারকেলডাঙার কাছে পোটোপাড়া লেন তারই সাক্ষ্য বহন করছে। তবে, কলকাতার বিভিন্ন এলাকার পটুয়ারা ঠিক কী চিত্রশৈলীর অনুসরণ করতেন বলা কঠিন, কারণ কুমোরটুলির তৎকালীন চালচিত্র শৈলীর সঙ্গে কালীঘাট পটের শৈলীর মিল খুব কম।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


কালীঘাটের পটচিত্র শিল্পীদের জীবন ও কর্মের বিস্তারিত বিবরণ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কালীঘাট পটচিত্র শৈলীর ইতিহাসের মধ্যপর্বের তিন উল্লেখনীয় শিল্পী নীলমণি দাস, বলরাম দাস, ও গোপাল দাস। এঁদেরই প্রায় সমসাময়িক শিল্পীবটকৃষ্ণ পাল থাকতেন চেতলায়। এই চিত্রশৈলীর শেষ পর্বের দুই খ্যাতিমান শিল্পী নিবারণ চন্দ্র ঘোষ ও কালীচরণ ঘোষ ছিলেন দুই ভাই। তাঁদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন কলকাতার কাছে গড়িয়ায়। উনিশ শতকের শেষে তাঁরা কালীঘাটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। কালী মন্দিরের পাশে নকুলেশ্বরতলায় তাঁদের পট বিক্রির দোকান ছিল। এই শিল্পীদ্বয়ের সমসাময়িক আরও দুই শিল্পী পরাণ চন্দ্র দাস ও বলাই দাস বৈরাগী। বিশ শতকের প্রথম দিকের শিল্পী কানাই লাল ঘোষ কালী চরণ ঘোষের পুত্র। বিশ শতকের তিরিশের দশকে নিবারণ চন্দ্র ঘোষ ও কালী চরণ ঘোষেরমৃত্যুর পর কালীঘাট পটের ধারা বিলুপ্ত হয়। শিল্পীদ্বয়ের বংশধররা পটচিত্র আঁকা ছেড়ে কেবল পোড়ামাটির সরা চিত্রণ ও মাটির প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রায় একই সময় পরাণ চন্দ্র দাস রেঙ্গুন ও বলাই দাস বৈরাগী নবদ্বীপ চলে যান। কালীঘাট পটচিত্র শৈলীর শেষ জ্ঞাত শিল্পী রজনী চিত্রকরকে (১৮৯২-১৯৬৮) ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকে কলকাতায় এসে নিবারণ চন্দ্র ঘোষের কাছে পট আঁকা শিখেছিলেন।

আঠারো-উনিশ শতকের বাংলায় কয়েকটি মন্দিরকে ভিত্তিচিত্র দিয়ে অলংকৃত করতে দেখা যায়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বহড়ুর শ্যামসুন্দর মন্দির, বীরভূম জেলার দুবরাজপুর ও ইলামবাজারের শিবমন্দির, হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির এবং বাজিতপুরের দশভুজা মন্দির এর মধ্যে উল্লেখনীয়।১৮২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বহড়ুর শ্যামসুন্দর মন্দিরের দেয়ালে ভিত্তিচিত্র এঁকেছিলেন গঙ্গারাম ভাস্কর। তাঁর আঁকার রীতি ছিল অষ্টাদশ শতকের বাংলার রাজস্থানী অণুচিত্রের দ্বারা প্রভাবিত চিত্ররীতি, কালীঘাটের পটচিত্রের ধারার সঙ্গে কোনও মিল নেই। কালীঘাটের শিল্পীরা বাংলার মন্দিরের ভিত্তিচিত্রের ধারার অনুসরণ করার কথা ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না। অবশ্য ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বহড়ুর মন্দিরের ভিত্তিচিত্রে কালীঘাট পটের পূর্বাভাস খুঁজে পেয়েছেন।

১৮৩০ থেকে ১৯৩০ সাল, মাত্র একশো বছর কালীঘাটের পটচিত্র শৈলীর সৃজনকাল। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে রঙিন ছাপা চিত্র বাংলা কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে শুরু করে।প্রায় একই রকম বিষয় নিয়ে আঁকা ‘বটতলার ছবি’ নামে পরিচিত কলকাতায় ছাপা ছবিগুলিও কালীঘাটের পটচিত্রের বাজার দখল করতে শুরু করে। বিদেশে ছাপা উন্নত মানের রঙিন ছাপা ছবিও এই সময় কলকাতায় এসে যায়। ১৮৫৪ সালে কলকাতায় আর্ট স্কুল স্থাপিত হয়, ১৮৬৪ সালে সরকার এই স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর্ট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের অনেকে দেবদেবীদের লিথোগ্রাফ বা ওলিওগ্রাফ বানিয়ে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে শুরু করেন।এরপর জার্মানি ও মুম্বাইতে ছাপা স্বল্প মূল্যের কালীঘাট পটের রঙিন অনুকৃতিও বহু সংখ্যায় কলকাতায় আসতে শুরু করে। এর ফলে আসল হাতে আঁকা কালীঘাটের পটচিত্রের চাহিদা খুবই কমে যায়। পরিণামে,পটচিত্রের শিল্পীরা কালীঘাট ছেড়ে নবদ্বীপ ও বাংলার অন্যান্য তীর্থস্থানে চলে যেতে শুরু করেন। বিশ শতকের প্রথম তিন শতকের মধ্যে লোকচিত্রের এই ধারা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


বিষয়বস্তুর নিরিখে কালীঘাটের পটচিত্রগুলিকে ৬টি পৃথক ধারায় বিভক্ত করা যেতে পারে – ১. দেবদেবী ও পৌরাণিক কাহিনির চিত্রায়ণ, ২. ঐতিহাসিক চরিত্র ও কাহিনির চিত্রায়ণ, ৩. সামাজিক ঘটনাবলির চিত্রায়ণ ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি, ৪. পশুপাখির চিত্র, ৫. প্রচলিত জনপ্রিয় উপদেশমূলক কাহিনির চিত্রায়ণ এবং ৬. ব্যঙ্গ বা শ্লেষমূলক চিত্র।প্রায় শুরু থেকেই কালীঘাটের পটচিত্রে বিষয়বস্তু চয়ন ও রূপকল্পের ভাবনায় আধুনিকমনস্কতা অনুভব করা যায়।

কালীঘাটের শিল্পীদের আঁকা প্রথম দিককার ছবি গুলিমূলত ধর্মাশ্রিত, গ্রামবাংলা থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের সংগ্রহ করে নিয়ে যাবার জন্য আঁকা। এই একই কারণে কালীঘাট সমেত আজও ভারতের প্রায় সর্বত্র মন্দিরের নিকটবর্তী দোকানগুলিতে দেবদেবীদের প্রতিমার আলোকচিত্র বিক্রি হয়। আজকের মতো তখনও তীর্থযাত্রীরা এই চিত্রগুলি নিজেদের গৃহে উপাসনার জন্য কিনে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের পটে রূপায়িত হিন্দু দেবদেবী ও পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখনীয় শিব, পার্বতী, বিষ্ণুর বরাহ, নৃসিংহও বামন অবতার, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, জগদ্ধাত্রী, গণেশ জননী, যশোদা-কৃষ্ণ, রাধা-কৃষ্ণ, জগন্নাথ ও ষড়ভুজ শ্রীচৈতন্যের চিত্র, কৃষ্ণলীলার চিত্র এবং রামায়ণের কাহিনির চিত্রায়ণ। অবশ্য শুধু হিন্দু দেবদেবী নয়, কালীঘাটের শিল্পীরা তাঁদের মুসলমান ক্রেতাদের জন্য এঁকেছেন মহরমের তাজিয়া ও দুলদুলের চিত্র। ক্রমশ কালীঘাটের শিল্পীরা তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আসা শিশুদের জন্য পশুপাখির ছবি আঁকতে শুরু করেন। যেসব পশুপাখির ছবি কালীঘাটের শিল্পীরা আঁকতেন, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিড়াল, বিভিন্ন রকমের মাছ, বিড়ালের মাছ বা পাখি শিকার, সাপের ব্যাঙ শিকার, গাছের ডালের টিয়া, পায়রা, সিংহ, শিয়াল, হরিণ প্রভৃতি।উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে পটচিত্রের চাহিদা বৃদ্ধির উদ্দেশে কালীঘাটের শিল্পীরা বিষয়বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে শুরু করেন। ঐতিহাসিক, সামাজিক, উপদেশমূলক কাহিনি ও শ্লেষধর্মী চিত্র আঁকা শুরু হয়ে যায়। চিত্রায়িত ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্যে রানি লক্ষ্মীবাইয়ের সংগ্রাম, কোম্পানির গোরা সৈন্যের কুচ, ইংরেজদের স্থাপিত আদালতে খুনের বিচার ও শ্যামাকান্তের বীরত্বের কাহিনি উল্লেখযোগ্য। শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৫৮ সালে, তৎকালীন ঢাকা জেলায়। উনিশ শতকের শেষ দিকে বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের কারণে তাঁর লৌকিক নায়কে উত্তরণ ঘটে, কালীঘাটের পটুয়ারাও এই নায়কের ছবির চাহিদা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। একই কারণে, সমসাময়িক বহুল আলোচিত সামাজিক ঘটনাবলি, যেমন, ১৮৭৩ সালে কলকাতার উচ্চ আদালতে তারকেশ্বরের মোহন্ত ও এলোকেশীর মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক ও এলোকেশীর হত্যা নিয়ে মোকদ্দমার বৃত্তান্ত, উনিশ শতকের শেষে পরিবর্তিত নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনযাত্রা, বহুবিবাহের পরিণাম, মদ্যপ স্বামীর স্ত্রীর উপর অত্যাচার, পত্নীর বশীভূত স্বামী সবই উঠে এসেছে কালীঘাটের পটে। বাংলায় প্রচলিত উপদেশমূলক কাহিনির চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে শিল্পীরা লোকশিক্ষার কথা সব সময় মাথায় রেখেছিলেন আর তৎকালীন বাংলায় প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ও সংস্কারকে ব্যঙ্গ করে আঁকা ছবিগুলি ছিল শিল্পীদের সমাজ ভাবনার প্রতিফলন। শ্লেষাত্মক পটের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল উনিশ শতকের বাবু সংস্কৃতির প্রতি ব্যঙ্গ, বিশ শতকে এই ধরণের পট আঁকা বন্ধ হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে তৎকালীন বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাস, সংস্কার, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনার প্রতিফলন ঘটেছে কালীঘাটের পটচিত্রে আর শিল্পীদের নিজস্ব সামাজিক অবস্থান সেই ভাবনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলার উনিশ শতকের সামাজিক পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশ রক্ষণশীল, সম্ভবত তৎকালীন বাংলার সাধারণ মানুষরাও এই একই ভাবনার শরিক ছিলেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


উনিশ শতকের শেষার্ধে কালীঘাটের পটশিল্পীরা রঙিন ওলিওগ্রাফের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকার জন্য ছবিতে রেখার সঙ্গে রঙের সংযোগ ঘটান। কালো, লাল, হলুদ ও নীল রঙের ব্যবহার শুরু হয়। রঙের ব্যবহারে পটের আকর্ষণ বাড়লেও তাদের অকৃত্রিম সারল্য হ্রাস পায়।প্রথম পর্বে কালীঘাট পটচিত্র শিল্পীরা তুলির টানেই রেখা আঁকতেন। কিন্তু, এই সময় থেকে শিল্পী পরিবারের পুরুষরা প্রথমে পেন্সিল দিয়ে ছবির বহির্রেখা এঁকে ছায়াপাতের ছোঁয়া দেবার পর নারীরা সেই ছবিটিকে রঙে ভরিয়ে দিতেন, এর পর তুলির শেষ টানগুলি দিয়ে ছবিটির কাজেরসমাপ্তি হতো পুরুষ শিল্পীর হাতে। কালীঘাটের পটচিত্রের শেষ পর্বেলিথোগ্রাফের বহির্রেখার উপর রং তুলির টানে সমাপ্ত ছবিও দেখা গেছে। এই পর্বে ছাপা উডকাটকে রং করে বিক্রি করাও শুরু হয়।ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অবশ্য লিথোগ্রাফ বা উডকাটকে রং করাকে কালীঘাট পট চিত্রের ধারার সঙ্গে যুক্ত করতে রাজি হননি।

কালীঘাটের পটের চিত্রশৈলীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রেখার বলিষ্ঠতা। শিল্পী তাঁর মনের কথা সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলতেন সুপরিকল্পিত তুলির কয়েকটি টানের মাধ্যমে। কালীঘাটের শিল্পীদের রেখার অবিচ্ছিন্ন গতিধারায় দেহের ভাবভঙ্গি, বলিষ্ঠ ও কমনীয় ভাব এবং দেহে ও মনের ভাবাবেগ কাগজের উপর ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা আজও বিস্মিত করে। রেখার আভিজাত্য, ছন্দোময়তা ও সহজতা কালীঘাটের পটকে কৌলিন্য প্রদান করেছে। কালীঘাটের পটে সরু ও মোটা রেখার ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে আপাত নিরর্থক মনে হলেও, এই রীতি এই চিত্রশৈলীকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। অনেক আধুনিক শিল্পবেত্তা কালীঘাটের পটচিত্রে নগ্নতা প্রদর্শন নিয়ে অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কালীঘাটের শিল্পীরা ক্রেতাদের রুচির দিকে লক্ষ্য রেখে তাঁদের পটে অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় নগ্নতা নিয়ে এসেছেন, কিন্তু ‘শিব’ বা ‘মাতা ও পুত্র’ প্রভৃতি চিত্রভাবনায় বাহ্যিক নগ্নতার ঊর্ধ্বে যে অন্ত-র্জগতের পরিচয় পাওয়া যায়, তার অসামান্যতা অনস্বীকার্য। কালীঘাটের পটের জনপ্রিয়তার মূল কারণ ছিল সহজ চিত্রভাষার মাধ্যমে সমাজের তৃণমূল স্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন। কালীঘাটের পটে প্রায় একই আদর্শে কল্পিত হয়েছে দেবদেবী আর মানবমানবীর রূপ; ছবিতে প্রদর্শিত পুরুষদের নধর বপু, বাবরি চুল, সরু গোঁফবা নারীদের বঙ্কিম ভ্রূ, টিকালো নাক, সুডৌল অঙ্গসৌষ্ঠব বাংলার তৎকালীন সমাজের সৌন্দর্যের ধারণারই প্রতিফলন।

কালীঘাটের পটচিত্রে রেখার প্রয়োগ ভারতীয় চিত্রকলায় রেখার ঐতিহ্যগত প্রয়োগ থেকে অনেক ভিন্ন হলেও, রেখাপ্রধান এই চিত্রশৈলীর ধারা ভারতের চিত্রশিল্পের মূল বৈশিষ্ট্যেরই অনুসারী। ভারতীয় চিত্ররীতিতে শারীর বিদ্যাগত অনুপুঙ্খতা ও আলো-ছায়ার প্রয়োগ নিয়ে কখনও খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বাংলার পালযুগের পুথিচিত্র থেকে অন্ত-মধ্যযুগের জড়ানো পট বা বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস – গতিময় রেখার মাধ্যমে সজীবতা সৃষ্টির উদাহরণ সর্বত্র বিরাজমান। কালীঘাটের শিল্পীরা মূলত সেই ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করেই রেখার প্রয়োগে আধুনিক ভাবনার সাক্ষ্য রেখে গেছেন। তাঁরা আলোছায়ার মাধ্যমে ছবিতে ত্রিমাত্রিকতার আভাস সৃষ্টির জ্ঞান সম্ভবত অর্জন করেছিলেন মাটির প্রতিমা রঞ্জনের অভিজ্ঞতা থেকে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


কালীঘাটের পটের শিল্পীদের মূল লক্ষ্য ছিল সস্তায় বহু সংখ্যক সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের ছবি বিক্রি। মুকুল দে উল্লেখ করেছেন, কালীঘাটের মন্দিরের আশেপাশের দোকানগুলিতে বিশ শতকের প্রথম দিকে একটি পটচিত্রের মূল্য ছিল ২ পয়সা থেকে ১ আনা। সেই কারণে প্রত্যেক ছবির জন্য সময় ও অর্থের মিতব্যয়িতার দিকে শিল্পীদের নজর রাখতে হতো। কাঠবিড়ালী বা ছাগলের লেজের লোম দিয়ে তৈরি হতো তাঁদের তুলি। লাল রঙের জন্য আলতা আর কালো রঙের জন্য তাঁরা ভুসো কালি ব্যবহার করতেন।তাঁরা অপরাজিতা ফুলের পাপড়ি থেকে নীল রং আর হলুদ গুঁড়ো দিয়ে হলুদ রং তৈরি করতেন। সস্তা, পাতলা ফোলিও কাগজের উপর কালো রঙের তুলির টানে তাঁরা সমস্ত ভাবভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতেন। শাড়ির পাড়টি কালো রঙে এঁকে তাঁরা আলতা তুলির দাগ দিয়ে বাকি কাপড়ের ভাঁজগুলি দেখিয়ে দিতেন। এই আর্থিক বিবেচনার দিক থেকেই কালীঘাটের শিল্পীরা পরবর্তীকালে বাংলার মিলের কাগজের পরিবর্তে বিদেশি মিলের কাগজ ও বিদেশি জলরঙের ব্যবহার শুরু করেন। কালীঘাটের শিল্পীরা ছবির গুণমানের চাইতেও বেশি জোর দিতেন ছবির মাধ্যমে নিজেদের ভাবনাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। কালীঘাটের চিত্রে মিতব্যয়িতার ঘাটতি মেটানো হয়েছে রেখার বাস্তবিকতাবোধের মাধ্যমে। শিকারী বেড়ালের গোঁফ যেভাবে কালীঘাটের শিল্পীরা যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, বাস্তবিকতার কারণে তার আকর্ষণ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর থেকে বাংলার আর্থিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কোম্পানির আমল বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে প্রভূত পরিবর্তনের সময়। বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা, দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যের পরিমণ্ডলে এই সময় যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে পড়ে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর অনেক জমিদার ও মধ্যবিত্ত পরিবারগ্রাম থেকে চলে আসতে শুরু করেনকলকাতায়, কোম্পানির প্রবর্তিত ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং প্রবর্তন করলেন নবীন উচ্চবর্গীয় ‘বাবু’ সংস্কৃতির। কলকাতার উচ্চবর্গীয় বাবুদের কাছে শিল্পের আদর্শ ছিল তৎকালীন ইউরোপীয় শিল্প, কালীঘাটের লোকচিত্রের ধারা তাঁদের কাছে উঁচুমানের বলে মনে হয়নি। কলকাতার বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও, রেলপথে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের সংযোগ স্থাপিত হবার দৌলতে কালীঘাটের শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মের ক্রেতা হিসাবে পেয়ে গেলেন অগণিত সাধারণ মানুষদের।গ্রামের ক্রেতাদের সীমিত আর্থিক সামর্থ্য কিন্তু সংখ্যার আধিক্য পটুয়াদের প্রেরিত করল গণ-উৎপাদন প্রয়োজনে জড়ানো পটের আকার, মাধ্যম ও চিত্ররীতির দ্রুত বর্জনে, জন্ম নিল একেবারে নতুন ধারার পট।কিন্তু, একদিন প্রযুক্তির শক্তির কাছে হার মানতে হলো হাতের পেশীর শক্তির, রঙিন ছাপা ছবি দখল করে নিল হাতে আঁকা পটের বাজার –এক শতকের বর্ণময় অস্তিত্বের পর হারিয়ে গেল বাংলার নগরায়িত লোকচিত্রের শৈলী। অবশ্য বাজার থেকে লুপ্ত হবার প্রায় অব্যবহিত পরেই কালীঘাট পট লাভ করল আন্তর্জাতিক পরিচিতি, অর্জন করল শিল্পোত্তীর্ণ চিত্রশৈলীর সম্মান। বিগত শতকে অতি সুলভ কালীঘাট পট আজ দুর্লভতার কারণে বিশ্বের শিল্পবাজারে এক মহার্ঘ পণ্যে পর্যবসিত।

 

তথ্যসুত্র:

১. Archer W.G., Bazaar Paintings of Calcutta: The Style of Kalighat. London: Her Majesty’s Stationery Office, 1953.

২.Archer W.G., Kalighat Paintings, A Catalogue and Introduction. London: Her Majesty’s Stationery Office, 1971.

৩. ভট্টাচার্য অশোক, বাংলার চিত্রকলা ; কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৪, পৃ.৯৭-১০১।

৪. Chatterjee Ratnabali, From the Karkhana to the Studio: A Study in the Changing Social Roles of Patron and Artist in Bengal. New Delhi: Book & Books, 1990, pp. 45-73.

৫. Dey Mukul, “Drawings and Paintings of Kalighat” in Advance, Calcutta, 1932 [http://www.chitralekha.org/articles/mukul-dey/drawings-and-paintings-kalighat].

৬. Dey, Mukul, “The Painters of Kalighat: 19th Century Relics of a OnceFlourishing Indian Folk Art Industry Killed by WesternMass Production Methods” in The Statesman, Calcutta, Sunday, October 22, 1933, p. 19.

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত