Categories
উৎসব সংখ্যা অনুবাদ: খাঁচা । আব্দুলরেজাক গুরনাহ
আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট
খাঁচা
আব্দুলরেজাক গুরনাহ
অনুবাদক: শুভ চক্রবর্তী
১৯৪৮ সালে আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার জানজিবর দ্বীপে জন্ম নেওয়া আবদুলরেজাক গুরনাহ ১৯৬০ সালে শরণার্থী হিসেবে ব্রিটেনে চলে আসেন। বর্তমানে তিনি কেন্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজী সাহিত্য এবং পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তার সাহিত্যে শরণার্থীদের দুর্দশা এবং আফ্রিকান অঞ্চলের রাজনীতি স্থান পেয়েছে। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত চতুর্থ উপন্যাস প্যারাডাইসের জন্য তাঁকে ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। প্যারাডাইসে পূর্ব আফ্রিকান সমাজে ভালোবাসা এবং দুঃখের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এক এক সময় হামিদের মনে হত যেন তিনি আজন্মকাল দোকানেই ছিলেন এবং তাঁর জীবন হয়তো দোকানেই শেষ হয়ে যাবে একদিন। কিন্তু তিনি আর এ-বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করেননি কখনও, অথবা এটা হতে পারে তিনি রাতের মৃত সময়ে গোপন কথাবার্তা শুনতে পাননি । যদিও একবার ভয়ে তাঁর হৃদয় শূন্য হয়ে হালকা গিয়েছিল। তিনি জানতেন পেরেছিলেন যে তাঁরা এসেছেন মৌসুমী জলাভূমি থেকে যা শহরকে জনপদ থেকে আলাদা করে রেখেছে, এবং যা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর দোকানটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় , যেটা শহরের জমজমাট এলাকা, চৌরাস্তার মোড়ে। তিনি ভোরের প্রথম আলো ফোটার সময়েই দোকানটা খুলতেন যখন, প্রথম সারির কর্মীরা অর্থাৎ খুব ভোরে ওঠেন যে শ্রমিকরা,তাঁরা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ত শহরের বিভিন্ন জায়গায়, এবং তিনি দোকানটা ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ করতেন না যতক্ষণ না শেষ নিঃসঙ্গ খরিদ্দার বাড়ি ফিরে গেছেন । তিনি এটা বলতে পছন্দ করতেন, তাঁর দোকান থেকে তিনি দেখেন সমস্ত জীবন প্রবাহ তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলেছে।দোকানের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি সবসময় দাঁড়িয়েই থাকেন, গ্রাহকদের সঙ্গে তামাশা করেন,কথা বলেন বিভিন্ন বিষয়ে, এমনকি তাঁদের সঙ্গে আলাপও করেন, এবং তিনি যে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন, তাতে তিনি নিজে এবং তাঁর পণ্যদ্রব্যও যেন আনন্দ পাচ্ছে, এটা বেশ একটা ব্যাপার । মানুষের মধ্যে কখনও কখনও এইরকম একটা অনুভূতি জন্ম নেয় । বাস্তবের সঙ্গে অবাস্তবের একটা সামঞ্জস্য গড়ে তোলার একটা চেষ্টা থাকে । পরে তিনি ক্লান্ত হয়ে ডুবে যেতেন তাঁর গন্ধেশ্বরী আসনে, যেটা তাঁর ক্যাশবাক্স হিসেবেও কাজ করত। মেয়েটি এক সন্ধ্যায় কিছুটা দেরিতে দোকানে এলো, ঠিক যখন তিনি দোকান বন্ধ করার কথা ভাবছিলেন। এবং দু’বার হতাশায় তিনি মাথা নাড়লেন, নিজেকে বোঝালেন বিষয়টা । এই ধরনের হতাশাজনক সময়ে এটা বিপজ্জনক একটা কৌশল। দ্বিতীয়বার মাথা নাড়ানোর শুরুতেই তিনি নিজেকে সামলে নিলেন, ঠিক যেন জেগে উঠলেন, যেন জলের মধ্যে তাঁকে কেউ ডুবিয়ে রেখেছে। মনে মনে কল্পনা করলেন একটা বড় হাত তাঁর গলা চেপে ধরছে এবং তাঁকে মাটি থেকে তুলে ধরেছে। মেয়েটি তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে-মুখে একটা বিরক্তির ছাপ নিয়ে অপেক্ষা করছিল সে । ‘ঘি,’ মেয়েটি দীর্ঘ, অপমান জনক সময় অপেক্ষা করার পর বলল। ‘এক শিলিং। ’কথা বলতে বলতে সে নিজেকে নিয়ে অর্ধেক ঘুরে সরে গেল, কেননা তাঁর দৃষ্টি বিরক্তিকর মনে হচ্ছিল । মেয়েটির শরীরে এক টুকরো কাপড় জড়িয়ে বগলের নিচে গুঁজে রেখেছিল । নরম তুলো তার শরীরের সঙ্গে এমনভাবে লেগেছিল, যেন তার রূপের শেষটুকুও গভীর এক প্রবাহে ভেসে যাচ্ছিল জ্যোৎস্নার মতো, যা তার সুন্দর আকৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছিল। মেয়েটির কাঁধ উন্মুক্ত এবং তা অন্ধকারে ঝলমল করছিল। তিনি মেয়েটির কাছ থেকে বাটিটা নিয়ে নিচের দিকে ঘি এর টিনের দিকে ঝুঁকলেন। তাঁর মন আকাঙ্ক্ষায় ভরে উঠছিল; এবং হঠাৎ যেন ব্যথা অনুভব করলেন মনের গোড়ায় । যখন তিনি মেয়েটিকে বাটিটা ফিরিয়ে দিলেন , সে তাঁর দিকে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, তার দৃষ্টি ছিল দূরের প্রান্তরের দিকে এবং চকচক করছিল, সে সেই দৃষ্টির ভিতরে ক্লান্তির অতলে চলে গিয়েছিল । তিনি দেখতে পেলেন যে ও যুবতী , ওর মুখ ছোট এবং গোলাকার, পাতলা গড়ন ঘাড় । মেয়েটি আর কোনো কথা না বলে, ঘুরে, অন্ধকারের ভিতরে চলে গেল,
কংক্রিট খাদের উপর লাফ দেওয়ার জন্য সে একটি বড় পদক্ষেপ নিল, যেখানে রাস্তাটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও অনেকটা গভীর । হামিদ তার পেছনের রূপটুকুই দেখেছিল এবং চেয়েছিল
তার যত্ন নেওয়ার জন্য চিৎকার করে সতর্ক করে দিতে। ও কিভাবে
জানলো অন্ধকারে, ওখানে কিছু ছিল না? শুধুমাত্র একটি দুর্বল কঁক শব্দ যেন শোনা গেল, তিনি তাঁকে আর ডাকার চেষ্টা করলেন না । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন, তার চিৎকার শোনার জন্য , কিন্তু মেয়েটির স্যান্ডেলের এগিয়ে যাওয়ার চটাস চটাস শব্দ আরও অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই শোনা গেল না ।
ও আকর্ষণীয় মেয়ে ছিল, তিনি দাঁড়িয়ে ওর সম্পর্কে ভাবতে থাকলেন এবং রাতে তিনি যে গর্ত দেখেছিলেন সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল, তিনি নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা অনুভব করতে লাগলেন। ও তাঁর দিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল এটা যেন ঠিকই করেছে সে । ওর শরীর এবং মুখটি বাসি মনে হল তখন । অন্য দিনে একাধিকবার নিজেকে পরিস্কার করার সামান্য কারণও ছিল না। দোকান থেকে বেরিয়ে বিছানা অবধি যেতে তাঁর মিনিট কয়েকের বেশি সময় লাগেনি, এবং সে আর কোথাও যায়ওনি কখনও। কি জন্য-বা এত সাফ সুতরা রাখবে নিজেকে ? সঠিক ব্যায়ামের অভাবে তাঁর পা এলোমেলো পড়ছিল। , মাস, বছর এবং দিন এভাবেই বন্দী জীবন কাটিয়েছেন তিনি । এভাবেই একজন
বোকা মানুষ সারা জীবন তাঁর নিজেরই গর্ভগৃহের
অতলে আটকে ছিল। তিনি ক্লান্ত ভাবে চুপচাপ দোকান বন্ধ করলেন এই ভেবে যে রাতের বেলা তিনি আবার সেই একই কাজে লিপ্ত হবেন যা তাঁর প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবে । অপমান জনক একটা ব্যাপার । পরের দিন সন্ধ্যায় মেয়েটি আবার দোকানে এল। হামিদ তখন তাঁর একজন নিয়মিত গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, একজন মানুষ তিনি তাঁর থেকে বয়সে অনেক বড়, মনসুর, যিনি কাছাকাছি থাকতেন এবং সন্ধ্যায় দোকানে এসেছিলেন কিছু কথা বলার জন্য । তিনি তাঁর চোখের ছানি পড়ার জন্য প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং লোকেরা তাঁর দুর্দশা নিয়ে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে উত্যক্ত করত। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মনসুরকে বলতেন যে তিনি অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন । কারণ তাঁর দৃষ্টি আর আগের মতো নেই। তিনি নিজেকে অল্প বয়সি ছেলেদের থেকে দূরে রাখতে পারতেন না । হামিদ মাঝে মাঝে ভাবতেন মনসুর তাঁর দোকানের চারপাশে কোনো কিছুর জন্য ঘোরাঘুরি করে হয়তো । কিন্তু সম্ভবত এটা শুধু কুৎসা আর গুজব ছিল । মেয়েটি এগিয়ে এলে মনসুর কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তিনি আবছা আলোয় তাঁকে চেনার চেষ্টা করার সময় কঠোরভাবে কুঁকড়ে গেল। ‘আপনার কি জুতোর পালিশ আছে? কালো? ‘মেয়েটি জিজ্ঞেস করল ‘হ্যাঁ,’ হামিদ বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল যেন ভয়ের একটা চাঙর। তাই তিনি তাঁর গলা খাঁকরি দিয়ে সাফ করে নিলেন এবং পুনরাবৃত্তি করলেন, হ্যাঁ, আছে।
মেয়েটি এটা দেখে মুচকি হাসল । ‘, স্বাগত প্রিয়! আজ কেমন আছ? ’মনসুর জিজ্ঞেস করলেন । তাঁর উচ্চারণ এতটাই স্পষ্ট ছিল, মোটা এবং গমগম করছিল , যাতে হামিদ নিজেও বিস্মিত হয়েছিল, এটা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, রসিকতা নয়ত! ‘কি সুন্দর গন্ধ তোমার, এমন সুগন্ধি! দেবদুতের মতো কণ্ঠস্বর এবং হরিণের মতো একটি শরীর।
আমাকে বলুন, মিসিচানা, আজ রাতে তুমি কোন সময় ফাঁকা আছ?পিঠটা মালিশ করার জন্য আমার কাউকে দরকার এখন’,মেয়েটি তাঁকে উপেক্ষা করে তখন। ওদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে হামিদ শুনলেন মনসুর মেয়েটির সাথে বেশ কচকচানি চালিয়ে যাচ্ছে, যখন সে পলিশের টিন খোঁজার চেষ্টা করছিল তখন মেয়েটি উচ্চৈস্বরে তাঁর প্রশংসা করছে । এদিকে সময় ঠিক করতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হামিদ পলিশের টিন খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত এটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, তিনি ভেবেছিলেন তিনি তাকে দেখছেন সব সময়, এবং আনন্দিত হয়েছেন যে সে এতটা উদ্বিগ্ন ছিল। সে হাসল, কিন্তু তার ভ্রু কুঁচকে গেল এবং তারপর তাঁকে সে দামটা মিটিয়ে দিল। মনসুর তার পাশে দাঁড়িয়ে স্তোকবাক্য আওড়াচ্ছিল এবং চাটুকারিতা করছিল , তার জ্যাকেট পকেটে খুচরো পয়সার শব্দ করছিল , কিন্তু সে একটাও কথা না বলেই চলে গেল ।
‘ওর দিকে তাকাও হে , দেখো সূর্য নিজেও কিন্তু ওর চেয়ে বেশি উজ্জ্বল হওয়ার সাহস পাবে না। এতই অহংকার ! কিন্তু সত্যটা হলো কি জানো ও সহজলভ্য , ’ সহজেই ধরা দেবে, মনসুর বললেন, তার শরীর মৃদুভাবে দুলছে চাপা হাসির সঙ্গে । ‘আমি অনেক আগেই ওকে পেয়ে যাব। কিভাবে? আপনি কি মনে করেন ও খুব বেশি হাঁকবে ? ওরা সবসময়ই এটাই করে, এইসব মহিলারা, গুমর তো থাকবেই,
সব এই বাতাস এবং ঘৃণ্য চেহারা…কিন্তু একবার আপনি যদি তাঁদের বিছানায় পান , আর তাঁদের ভিতরে ঢুকে যান, তারপর তাঁরাই জানে যে আসল খিলাড়িটা কে। ‘ হামিদ নিজেকে হাসতে দেখলেন, পুরুষদের মধ্যে শান্তি বজায় রেখে। কিন্তু তিনি ভাবেননি যে মেয়েটিকে কেনা যাবে। ও খুব নিশ্চিত ছিল এবং ওর প্রতিটা কাজ এত আরামদায়ক যে তিনি তার ঘৃণ্যতায় যথেষ্ট বিশ্বাস করতে পারেননি মনসুরের নকশার জন্য। বারবার তার মন মেয়েটির দিকে ফিরে যাচ্ছিল, এবং যখনই তিনি একা হচ্ছিলেন তখন নিজেকে তার সাথে অন্তরঙ্গ কল্পনা করছিলেন। রাতে তিনি দোকান বন্ধ করার পর, কয়েক মিনিটের জন্য বসতে যান বৃদ্ধ ফজিরের কাছে , যিনি দোকানটির মালিক ছিলেন এবং দোকানেই পিছনেই থাকতেন। তিনি নিজের দেখাশোনা আর করতে পারেন না
এবং খুব কমই তাকে বিছানা ছেড়ে যেতে বলা হয়। কাছাকাছি বসবাসকারী একজন মহিলা দিনের বেলা ফজিরের দেখাশোনা করেন এবং তার বিনিময়ে দোকান থেকে বিনামূল্যে মুদি সামগ্রী নিয়ে যান, কিন্তু রাতে অসুস্থ বৃদ্ধ হামিদ তার সাথে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পছন্দ করতেন। মরতে বসা লোকটার গায়ের গন্ধ কথা বলার সময় ঘরের আনাচে কানাচে ভরে যেত । সাধারণত তেমন কিছুই বলার থাকত না, ব্যবসার মন্দা এবং অসুস্থ মানুষের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা ছাড়া। মাঝে মাঝে যখন তাঁর ধৈর্য্য কম থাকত, ফজির শুকনো চোখে জল এনে তাঁর অপেক্ষারত মৃত্যুর কথা বলত। তারপর হামিদ বুড়োকে টয়লেটে নিয়ে যেতেন, নিশ্চিত করতেন চেম্বার-পট পরিষ্কার এবং খালি ছিল, এবং তাকে ছেড়ে দিতেন। গভীর রাতে, ফাজির নিজের সঙ্গেই কথা বলতেন, মাঝে মাঝে তার ভাঙা গলায় মৃদুভাবে উঠে আসত হামিদের নাম। হামিদ ভিতরের উঠোনের বাইরে ঘুমিয়েছিল। বৃষ্টির সময় তিনি দোকানের ভিতরে কিছুটা জায়গা করে নিতেন। হামিদ রাতগুলো একাই কাটিয়েছেন এবং কখনো বাইরে যাননি। প্রায় এক বছর তিনি দোকান ছেড়ে কোথাও বেরতে পারেননি ,
এবং তারও আগে তিনি কেবল ফজিরের সঙ্গেই বেরিয়েছেন, বুড়ো শয্যাশায়ী হবার আগে সেটা ।
ফজির তাকে প্রতি শুক্রবার মসজিদে নিয়ে যেতেন, এবং হামিদ মানুষের ভিড় এবং ফাটা ফুটপাথের বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবার কথা মনে রেখেছিলেন। বাড়ি ফেরার পথে তারা বাজারে যেতেন , এবং
বৃদ্ধ লোকটি সুস্বাদু এবং উজ্জ্বল রঙের ফলের নাম বলতেন তাঁদের জন্য শাকসবজি কিনতেন, তার থেকে কিছু বাছাই করে হামিদকে গন্ধ বা স্পর্শ দিয়ে চেনাতেন…কিশোর বয়স থেকে, যখন তিনি প্রথম এই শহরে বসবাস করতে এসেছিলেন, হামিদ তখন থেকেই বৃদ্ধের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ফজির তাঁকে খাবার দেন এবং বিনিময়ে তিনি কাজ করতে থাকেন দোকানে ।প্রতিদিনের শেষে, তিনি তার রাতগুলি একা কাটাতেন, এবং প্রায়ই তার বাবা এবং তার মা, এবং তার জন্মের শহর সম্পর্কে চিন্তা করতেন।
যদিও সে আর সেই ছোট্ট হামিদ এখন আর নেই ,
স্মৃতি তাকে কাঁদাত তাঁর শৈশব এমনভাবে জড়িয়ে থাকত তার মধ্যে; এবং তিনি এমন এক অনুভূতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন যা তাঁকে আর খারাপ হতে দেবে না।
যখন মেয়েটি আবার দোকানে এল, মটরশুটি এবং চিনি কিনতে, হামিদ মাপের ব্যাপারে উদার ছিলেন। মেয়েটি লক্ষ্য করল এবং হাসল।
তিনি আনন্দে ঝকমক করে উঠলেন , যদিও তিনি জানতেন যে তার হাসি
উপহাসবিদ্ধ। পরের বার মেয়েটি সত্যিই কিছু বলল
শুধুমাত্র একটি অভিবাদন, কিন্তু তা আনন্দদায়কভাবে বলা। সে বলল যে তার নাম
রুকিয়া, এবং সে সম্প্রতি এই এলাকায় এসেছে
আত্মীয়দের সাথে বসবাস করতে।
‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ হামিদ জিজ্ঞেস করলেন
‘মোয়েমবেমারিংগো,’ মেয়েটি হাতের ইশারা করে বললেন, ‘অনেক দূর। ওখানে যেতে আপনাকে পাহাড় টপকে যেতে হবে।’ নীল সুতির পোশাক পড়া দেখে তিনি বুঝতে পাচ্ছিলেন ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। যখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কোথায় কাজ করেন, সে প্রথমে মৃদু নাক টানে, যেন বলতে হয় তাই বলা, যেন প্রশ্নটি গুরুত্বহীন ।
তারপর সে হামিদকে বলল যে যতক্ষণ না সে আরও ভাল কিছু খুঁজে পায়, ততক্ষণ সে
শহরের নতুন হোটেলের একজন কর্মচারী ।
‘ওটা সেরা,দি ইকুয়েডর ,’ মেয়েটি বলল । ‘একটা সুইমিং পুল আছে এবং সর্বত্র কার্পেট। সেখানে থাকা প্রায় সবাই শ্বেতাঙ্গ, ইউরোপীয়ান। আমাদের এখানে কয়েকজন ভারতীয়ও আছে, কিন্তু এই লোকদের কেউ বুনো ঝোপ থেকে উঠে আসা বলবে না , কেননা এঁরা কেউ চাদরকে দুর্গন্ধ করে না। ’ তিনি তার বাড়ির উঠোনের শোয়ারঘরের দরজায় দাঁড়ালেন রাতে দোকান বন্ধ করার পর। রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা এবং নীরব সেই সময়ে, , দিনের বিপজ্জনক সে জায়গাটা নয় । প্রায় তাঁর রুকিয়া কথা মনে পড়ত, এবং মাঝে মাঝে তার নাম বলতেন, কিন্তু তার কথা
কেবল তাঁকে তাঁর বিচ্ছিন্নতা এবং তিক্ততার বিষয়ে আরও সচেতন করে তুলত। তাঁর মনে পড়ে গেল কিভাবে সে প্রথমবার তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল,কীভাবে সে দূরে সরে গেল শেষ সন্ধ্যার ছায়ায়। তিনি তাকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন… বছরের পর বছর অন্ধকার জায়গাগুলো তার সাথে এমনটি করেছে, সে ভেবেছিল, যাতে এখন সে তাকিয়ে থাকে বিদেশী শহরের রাস্তার দিকে এবং কল্পনা করে যে একটি অচেনা মেয়ের স্পর্শ হবে তার পরিত্রাণ।
একদিন রাতে তিনি রাস্তায় বেরিয়ে দরজা লাগিয়ে দেন। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকেন রাস্তার সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পের দিকে, তারপর একটার দিকে তারপর আরেকটার। বিস্মিত হলেন কেননা তিনি আর ভয় পাচ্ছেন না । তিনি শুনতে পেলেন, কিছু নড়াচড়ার শব্দ, কিন্তু কিছু দেখতে পেলেন না । যদি না কেউ জানে সে কোথায় আছে,কোথায় যাচ্ছে, ভয় পাওয়ার দরকার নেই, কারণ কিছু একটা ঘটতেই পারে। এটাই সান্ত্বনা ছিল।
তিনি একজন আগন্তুক হিসেবে এখন নিজেকে ভাবছেন। রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধ দোকান , একটা কি দুটি দোকানে আলো জ্বালানো ছিল, তিনি ওখান থেকে কিছুটা সরে গেলেন,তারপর আলো এড়ানোর জন্য অন্যদিকে ঘুরে গেলেন। তিনি কাউকে দেখেননি, না পুলিশ, না রাতের প্রহরী। রাস্তার মোড়ে তিনি কয়েক মিনিটের জন্য একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আশ্চর্য হয়েছিলেন…সবকিছু যেন খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। এককোণে একটি ঘড়ির স্তম্ভ নীরব রাতে মৃদুভাবে টিকটিক করছে। ধাতব র্নির্বোধ পোস্টগুলির পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শেষপ্রান্তে সারি করে বাসগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, এবং দূর থেকে সমুদ্রের শব্দ শুনতে পেলেন । তিনি শব্দের জন্য তৈরি ছিলেন, এবং আবিষ্কার করলেন তিনি সমুদ্র থেকে খুব দূরে নন । জলের গন্ধ হঠাৎ করেই তাঁকে তার বাড়ির কথা ভাবতে বাধ্য করল । সেই শহরটিও সমুদ্রের ধারে ছিল, এবং একবার সে সমুদ্র সৈকতে অন্যান্য শিশুদের মতো অগভীর জলের মধ্যে খেলছিল । তিনি এখন আর মনে করছেন না যে তিনি কোথায় , কোথায় ছিল তাঁর বাড়ি। জল আস্তে আস্তে সমুদ্র-প্রাচীরের পাদদেশে এসে ফিরে যাচ্ছিল, এবং তিনি উঁকি দিয়ে দেখলেন কংক্রিটের দেওয়ালে সমুদ্রের জল এসে ধাক্কা মেরে ফেনা ভেসে উঠছে। একটি জেটিতে তখনও আলো জ্বলছিল। যান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ চলছিল হয়ত। এটা সম্ভব বলে মনে হয়নি যে কেউ রাতের সেই সময়ে কাজ করতে পারে।
উপসাগর জুড়ে আলোগুলো একক বিচ্ছিন্ন বিন্দু, অন্ধকারের পটভূমি জুড়ে। সেখানে কে থাকত?
বিস্ময়ের উদ্রেক হল. ভয়ের একটা কাঁপুনি তাঁর ভেতর দিয়ে ছুটে গেল। তিনি সেখানে বসবাসকারী মানুষের ছবি মনে আনার চেষ্টা করেছিলেন, শহরের সেই অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে।
তার মন তাকে শক্তিশালী পুরুষদের নিষ্ঠুর মুখের ছবি দিয়েছে , যারা তাঁর দিকে তাকিয়েছিল এবং নিষ্ঠুরভাবে হেসেছিল।
তিনি দেখলেন ঝাপসা হয়ে আছে পরিস্কার জায়গাটা
যেখানে অপরিচিতের ছায়া লুকিয়ে ছিল, পরে সেখানে ,দেহটাকে ঘিরে পুরুষ মহিলাদের ভিড় করে দাঁড়াল। তিনি এর শব্দ শুনতে পাচ্ছেন ।একটি পুরানো রীতিতে তাঁদের পা ধড়ফড় করছে, এবং তাঁদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তাঁদের পায়ের নীচে শত্রুদের রক্ত পৃথিবীতে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র শারীরিক হুমকির জন্যই তারা এমন ভয় দেখিয়েছিল, তা কিন্তু নয়। তিনি সেই লোকদের ভয় করতেন,যারা উপসাগর জুড়ে অন্ধকারে বাস করত। কারণ তারা জানত তারা কোথায় আছে, আর তিনি কোথাও ছিলেন না।
সব কিছু সত্ত্বেও প্রতিহত করতে না পেরে,তিনি দোকানের দিকে ফিরে গেলেন একটি অনুভূতি নিয়ে, যে তিনি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেছেন। এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে
রাতে দোকান বন্ধ করে ফজিরের সঙ্গে দেখা করার পর তিনি চলে যান
জলের ধারে ধারে হাঁটার জন্য। ফজির এটা পছন্দ করেননি এবং এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন ।
একা হয়ে গেলেও হামিদ তার বকাঝকা উপেক্ষা করেন এখন। অনেকসময়ই অনেক মানুষের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, তাঁরা কিন্তু তারা এক নজরেই তাড়াতাড়ি অতীত হয়ে গিয়েছে । দিনের বেলায় তিনি
সেই মেয়েটির কথা ভাবেন এবং নজর রাখেন, যে মেয়েটিই এখন তাঁর সময়ের ঘন্টাগুলি পূরণ করছে।
রাতে তিনি তার সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করেন। যখন তিনি নীরব রাস্তায় হাঁটছিলেন যখন, তিনি মনে করতে চেষ্টা করছিলেন,তিনি তার সঙ্গে সেখানে ছিলেন, কথা বলছিলেন এবং হাসছিলেন, এবং কখনও কখনও
তার হাতের পাতা তার ঘাড়ে রাখছিলেন।
যখন সে দোকানে আসে, তিনি সবসময় অতিরিক্ত কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং তার হাসির জন্য অপেক্ষা করেন। প্রায়ই
তাঁরা কথা বলেন, শুভেচ্ছা এবং বন্ধুত্বের কয়েকটি শব্দ বিনিময় করেন ।
যখন জিনিসেএ
ঘাটতি থাকত ,তিনি তাঁর বিশেষ খরিদ্দারের জন্য গোপন মজুদ থেকে তাকে দিয়ে দিতেন।
মাঝেমাঝেই তিনি সাহস করে তার উপস্থিতির প্রশংসা করতেন, আকুলতা এবং বিভ্রান্তির সঙ্গে অস্ফুট শব্দ করতেন যখন সে তাঁকে পুরষ্কার স্বরূপ উজ্জ্বল হাসি দিত। হামিদ মনে মনে হাসলো,
ওই মেয়েকে নিয়ে মনসুরের মনেমনে গর্ব করা নিয়ে।কয়েক শিলিং দিয়ে কেনার মতো মেয়ে সে ছিল
না, কিন্তু তার জন্য বাজিয়ে দেখতে হবে হবে,সাহসের সঙ্গে তাকে জয় করতে হবে। এবং মনসুর,অন্ধ প্রায়, সেরকম তিনি ছিলেন না, হামিদও ছিলেন না,
এই ধরনের কৃতিত্বের জন্য শব্দ বা কণ্ঠ তাঁদের কারোরই ছিল না। এক সন্ধ্যায় রুকিয়া চিনি কিনতে দোকানে আসে। সে
তখনও তার নীল কাজের পোশাক পড়ে, যার বগলের নীচে ঘামের দাগ। অন্য কোন গ্রাহক ছিল না তখন, এবং তার তাড়াহুড়ো আছে বলেও মনেও হয়নি।
সে তাঁকে আস্তে করে উত্যক্ত করতে শুরু করল, যে সে কত কষ্টের মধ্যে রয়েছে ,তার কাজের ক্ষেত্র কতটা কঠিন সে সম্পর্কে কিছু বলতে শুরু করে,
আপনি দোকানে যত ঘন্টা ব্যয় করেন, তাতে আপনার অবশ্যই খুব ধনী হওয়া উচিত ।
আপনি কি উঠোনে একটি গর্ত করে আপনার টাকা লুকিয়ে রাখেন? সবাই
জানে দোকানদারদের গোপন সিন্দুক থাকে । আপনি কি ফিরে আপনার শহরে যাওয়ার জন্য টাকা জমাচ্ছেন ?’
‘আমার কিছুই নেই,’ তিনি প্রতিবাদ করলেন। ‘এখানে কিছুই আমার নয়।’
সে মুখ চেপে অবিশ্বাসের সঙ্গে হাসল। ‘যাইহোক,
কিন্তু আপনি খুবই পরিশ্রম করেন,’সে
বলল। ‘তোমার যথেষ্ট মজা হয়নি।’ তারপর তিনি যখন অতিরিক্ত চিনি ঢেলে দিলেন, তখন সে হাসল । সে বলল, তার কাছ থেকে প্যাকেটটি নেওয়ার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে মেয়েটি বলল, ‘ধন্যবাদ’ । সে প্রয়োজনের চেয়ে এক মুহূর্ত বেশি সময় ধরে সেভাবেই ঝুঁকে থাকল, তারপর ধীরেধীরে সরে গেল। ‘তুমি সবসময় আমাকে বেশি জিনিস দিচ্ছ। আমি জানি এর বদলে তোমার কিছু চাও । যখন আপনি আমার জন্য করবেন, আপনাকেও আমার কিছু দিতে হবে এই সামান্য উপহারের বদলে । ’ হামিদ জবাব দিলেন না, লজ্জায় তিনি অভিভূত। মেয়েটি সামান্য হাসল যেন এটা একটা উপহার ছিল হামিদের জন্য এবং দূরে সরে গেল সে । শেষবারের মতো একবার তার দিকে তাকাল, এবং তার দিকে তাকিয়ে একবার হাসল অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার আগে।