| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা ভ্রমণ: কম্বোডিয়ার স্বর্ণ মন্দিরে । ফাতিমা জাহান

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
দেবী দুর্গা ধেয়ে যাচ্ছেন ত্রিশুল হাতে দুর্বিনীত মহিশাসুরের দিকে। পনেরো দিনের যুদ্ধেও আয়ত্তে আনা যায়নি মহিশাসুরকে। ত্রিলোক দখল করার নেশায় মত্ত সে। বারে বারে রূপ বদল করে যুদ্ধে ধোঁকা দিয়ে এসেছে দুর্গা দেবীকে। আজ সে মহিষের বেশে ধেয়ে আসছে মা দুর্গাকে আক্রমণ করার জন্য। পনেরো দিনেও একটুও ক্লান্ত নয় মা। ত্রিশুল দিয়ে অবশেষে বধ করলেন মহিশাসুরকে। আর এই চিত্রটিই খোদাই করা আছে আমাদের দেশ থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের এক দেশে, দেশটি কম্বোডিয়া।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


আমাদের দেশে দুর্গা পূজা মানে প্রতিমা, ঢাকের তাল, নাড়ু, কাশফুল, আনন্দ উৎসব। এরকম উৎসব প্রায় এক হাজার বছর আগে কম্বোডিয়ায়ও প্রচলিত ছিল। তখন দেশটি শাসন করতেন হিন্দু রাজা। সে কারণে গড়ে উঠেছিল অনেক হিন্দু মন্দির। এমনকি আকারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যে মন্দির প্রাঙ্গণ, আংকর ওয়াত সেটিও এক সময় হিন্দু মন্দির ছিল। পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা রাজ্য দখল করলে এসব মন্দিরে বৌদ্ধ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন শুরু হয়।

আমি এখন যে মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছি তার নাম ‘বানতে শ্রাই’। মূল আংকোর ওয়াত মন্দির থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি।  এই মন্দিরটির বহু মূল্যবান কারুকাজ খোদাই আংকর ওয়াতের সবচেয়ে দামী জহরত। মানুষের মনে স্থান করে স্থান করে নিয়েছে আরও একটি কারণে, এই মন্দিরে হিন্দু দেবতার উপাসনার পর অন্য কোন দেবতার উপাসনা হয়নি। এভাবেই রয়েছে হাজার বছর ধরে। এটি শিব ও  ভগবান বিষ্ণুর  মন্দির।
এই মন্দিরটি দূর থেকে দেখতে এক সোনার বরণ কন্যার মতো। আগাগোড়া সোনার জড়োয়া গহনায় মোড়ানো। স্যান্ডস্টোনে নির্মাণ করা কোন স্থাপনা যে এত রূপ ছড়ায়, এত সোনালী জাদুকরী তার সাক্ষী এখানকার নির্জন পরিবেশ। মূল আংকোর ওয়াত বেশ দূরে হওয়ায় দর্শনার্থীদের ভীড় তো নেই-ই উল্টো এক নির্বাক দেশের অচিনপুরী হয়ে রয়ে গিয়েছে জঙ্গল আর ধানক্ষেত পেরিয়ে আসা এই মন্দির।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


আমি আসলে কম্বোডিয়া এসেছিলাম আংকোর ওয়াত দেখতে। বানতে শ্রাই মন্দির সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না। যে রিসোর্টে উঠেছি সেটা আংকোর ওয়াতের মূল ফটক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে। এত বড় টেম্পল কমপ্লেক্স, হয় সাইকেল নয় মোটর বাইক ভাড়া করে ঘুরতে হয়। সাইকেল রিসোর্টে রাখা আছে। অতিথিরা নিজের ইচ্ছা মতো নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কোন ভাড়া দিতে হয় না। তবে মোটর বাইক ভাড়া করতে হয়। প্রথম দিন আমি সাইকেল নিয়ে মূল আংকোর ওয়াত ঘুরে বেড়িয়েছি। এ যে বিশাল রাজত্বের এক মন্দির আর তার শাখা প্রশাখা। এর মাঝে ঠাঁই করে নিয়েছে গাছপালা। সারাদিন ঘুরে ফিরে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বের হবার সময় দেখা হল একটি ছেলের সাথে, কোসাল নাম। লোকাল গাইড ছেলেটি, তার একটা অটোরিকশাও আছে। আমাকে সেই প্রথম বলল বানতে শ্রাই মন্দিরের কথা। আমি প্রথমে পাত্তা দেইনি। কারণ আমাদের মতো বাজেট ট্রাভেলার সাধারণত নিজে নিজেই কোন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ায়। পরে ভাবলাম অল্প কিছু পারিশ্রমিক যদি ওর সংসার চালাতে সাহায্য করে তবে যাওয়া যায়। আমি তো ভেবেছিলাম আংকোর ওয়াত শুধু এই বাউন্ডারির মধ্যেই, আরও দূর-দূরান্তের যে কিংবদন্তী গল্পের ঝাপি মেলা আছে তা কে জানতো!

সকাল সকাল তাই কোসালের অটোরিকশায় চড়ে বসলাম। আশেপাশে ঘন জঙ্গল, কোথাও সবুজ ধানক্ষেত। ফাঁকা জায়গা নেই কোথাও। ধানক্ষেত দেখতে ঠিক আমাদের দেশের মতো। জঙ্গলের ডাকও আমাদের দেশের মতোই মায়া আর রহস্যে ঘেরা। পথের দু’ ধারে প্রাচীন বৃক্ষ ছায়া দিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে এতটুকু ক্লান্তি নেই তার, এতটুকু ক্লান্ত হয়না সে পাতা নাড়িয়ে ছায়া দিতে। আর যেখানে ধানক্ষেত সে পথের দু’পাশে থোকায় থোকায় সাদা স্পাইডার লিলি ফুল ফুটে আছে, আমাদের দেশে যেমন কাশফুল ফুটে থাকে তেমনি। স্পাইডার লিলি সবসময়ই আমাদের কাছে বিদেশি ফুল, আমরা শখ করে বাগানে সাজিয়ে গুছিয়ে লাগাই, কোন সুক্ষণে বাগান আলো করে সুবাস দেয়া শুরু করে! আর এখানে তো পথেঘাটের শোভা বাড়িয়ে চলছে এই সুবাসিত সাদা মুকুটের মতো ফুল। এই সব পথের শোভা দেখতে দেখতে এক সময় দেখি বানতে শ্রাই এর মূল ফটকে এসে পড়েছি। মন্দিরের চারপাশে জলাধার নিসর্গের শোভাকে টলটলে করে দিল। চারকোনা আঙিনার চারপাশে জলাধার রাখা খেম্যার স্থাপত্যশিল্পের উদাহরণ। এদেশের মানুষের ভাষা খেম্যার, শিল্প কলাকে বলা হয় খেম্যার বা খ্ম্যার শিল্প। খেম্যার স্থাপত্যশিল্পে মূল ভবন থাকে মাঝখানে এর দু’ পাশে অন্যান্য খর্বাকায় ভবন। ভবনগুলো সাধারণত গোলাকৃতি পিরামিডের মতো দেখতে। আমার কাছে এই ভবনকে মনে হয়েছে কারুকার্যময় একেকটা ওয়াচ টাওয়ারের মতো।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


ধানক্ষেত আর বন পেরিয়ে মিলল সেই আশ্চর্য মন্দির যা কোন রাজা মহারাজা নির্মাণ করেননি। নির্মাণ করেছিলেন এক জ্ঞানী, মানী ব্যক্তি নাম, ইয়াজনাভারাহা। বানতে শ্রাই শব্দের অর্থ হলো সৌন্দর্যের দুর্গ বা প্রাসাদ। সৌন্দর্য এই মন্দিরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। মন্দিরের প্রাঙ্গণের বাইরে প্রধান ফটক আর চারদিক ঘেকে আঙিনা ঘেরা আছে অনুচ্চ দেয়াল দিয়ে। আশেপাশে একজন মানুষও নেই। খেম্যার স্থাপত্যশিল্পের সবচেয়ে সুন্দর দিক হল স্থাপনার চারধার জুড়ে জলের উপস্থিতি। জল মানুষের মনকে শান্ত করে, শীতল করে চঞ্চলতা। প্রধান ফটকের এত রাজকীয় তোরন যে স্বাগত জানাচ্ছে তার জন্য কোন ধরনের প্রস্তুতি নেইনি। এভাবে কি রাজসিক ঔদার্যে ঢুকে পড়া যায়!

মেঝেতে সোনার আভা, তোরন জুড়ে খোদাই করা ফুল লতা পাতা আর দেবতার মূর্তি যেন তাল তাল সোনার আলোকছটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। রূপে চোখ ঝলসে যায় যায়। বাইরের শোভা এমন হলে ভেতরে কেমন!
একটু বৃষ্টির ছটা চারদিক এখন চকচক করছে। আর এই বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে একজন দ্বাররক্ষী ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। ভেতরে প্রাসাদসম স্বর্ণ পাষাণের মন্দির বেশ হাকডাক দিয়ে বলছে, ‘ এত দিনে এলে তবে! দেখতে পাচ্ছোনা আমার জামা পুরনো হয়ে গিয়েছে, গায়ে জমেছে শ্যাওলার আস্তরণ। সোনার বরণ যায় যায়। আর তুমি কি কিছুই বলবে না?’


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


প্রসাদের অভিমান আমি বুঝি। একসময় সরগরম প্রাসাদের আদলের মন্দির এখন জনমানবহীন জঙ্গলের এক অংশ হয়ে পড়ে রয়েছে। একসময় ঝকঝকে থাকত তার শরীর নানা গয়নায়, নৈবেদ্য হত সুগন্ধী ফুলে, কোকিল কন্ঠীরা গান গেয়ে তরঙ্গে ভাসত, কবি রচনা করত তার জন্য স্ততি। এখন চুলে চিরুনি পড়েনা, নিরাভরণ শরীর, মলিন বসন। এত অবহেলা কেন সে সইবে! একতলা মন্দিরে ভবন তিনটি। প্রত্যেকটি ভবনের দেয়ালে ও চূড়ায় কারুকাযে স্তম্ভিত করে আমাকে আর আমার সাথে ঘুরে বেড়ানো বাতাসকে। সবচেয়ে বড় আকারের মন্দিরটি শিব ঠাকুরকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে। তার সামনে একই সোনালী স্যান্ডস্টোন পাথরে তৈরী দ্বাররক্ষী হাজারখানের বছর ধরে অনিমেষ দৃষ্টিতে বসে আছে দুয়ার পরে। পাহারা দিচ্ছে দেবতাকে। মন্দিরের কয়েকটি সিড়ি পেরোলে ভেতরের কারুকাজের ঐশ্বর্যে নিজেকে জড়িয়ে নেয়া যায়। তবে বাইরে থেকে উঁকি দেয়া ছাড়া আর কিছু করতে দেবেননা মন্দির মহারাজ। সরকারি নিয়মকানুনে বাধা পড়ে গিয়েছে দেবতা। ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তখনও শিব ঠাকুরের মুখ দর্শন বাকি। দেবতা কি মুখ ভার করে আছেন!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


একই মন্দিরের আরেক পাশে পাথরে নির্মিত ভক্ত হনুমান দল দ্বাররক্ষক হয়ে বসে রয়েছে হাজার বছর ধরে৷
মন্দিরের গায়ে তখন মহাভারত এক বিশাল সমুদ্রের মতো গল্প বলে যাচ্ছে৷ খোদাই করা দেবদেবীরা জীবন্ত হয়ে উঠছে এই অলৌকিক অসামান্য শোভার সামনে। সোনালী অক্ষরে লেখা হয়েছে মন্দিরের একেকটি ইট, পাথর। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা সোনালী দেবতারা কোথাও আসনে আসীন, কোথাও যুদ্ধে ব্যস্ত কোথাও উদ্যানে উদাসীন। শিব মন্দিরকে মাঝখানে রেখে এক পাশে বিষ্ণু ভগবানের মন্দির, আকারে একই রকম পিরামিড বা আমাদের দেশের চারচালা টিনের ঘরের মতো। লম্বায় শিব মন্দিরের চেয়ে খানিক খর্বাকায়, গলায় মনিমুক্তার হার, মাথায় মুকুট। এই মন্দিরগুলোর কারুকাজ আমায় ভারতের কোনার্ক বা  ভুবনেশ্বরের মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। একই রকম কারুকাজ, প্রায় একই ধরনের খোদাই। যেন স্যান্ডস্টোনকে অমূল্য আভরণে জড়িয়ে রাখাতেই তাদের আনন্দ।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সারা প্রাঙ্গণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সোনালী মন্দির, মাথার উপরে নীল আকাশ, আশেপাশে সবুজ বন যেন রঙমহলের উচ্ছ্বলতা বাড়িয়ে চলছে। গুড়ো গুড়ো সোনা বৃষ্টির ছটা হয়ে ছড়িয়ে  পড়ছে, অভিমান ভাঙাতে চাইছে উপোবাসে থাকা মন্দিরের। এরাই আপন এখন। আর আপন মন্দিরের চারধারের জলাধার। এর এক কোনায় পা ডুবিয়ে আমি দেখি জলের উপর জলের আঁকা জলছবি। ঝিরিঝিরি জলে, সরে সরে যাওয়া সোনার মন্দির। আর পূর্বের জীবনে ফিরে যাবার জন্য মন্দিরের কিশোরের মতো অভিমান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত