উৎসব সংখ্যা ভ্রমণ: কম্বোডিয়ার স্বর্ণ মন্দিরে । ফাতিমা জাহান
আমাদের দেশে দুর্গা পূজা মানে প্রতিমা, ঢাকের তাল, নাড়ু, কাশফুল, আনন্দ উৎসব। এরকম উৎসব প্রায় এক হাজার বছর আগে কম্বোডিয়ায়ও প্রচলিত ছিল। তখন দেশটি শাসন করতেন হিন্দু রাজা। সে কারণে গড়ে উঠেছিল অনেক হিন্দু মন্দির। এমনকি আকারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যে মন্দির প্রাঙ্গণ, আংকর ওয়াত সেটিও এক সময় হিন্দু মন্দির ছিল। পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা রাজ্য দখল করলে এসব মন্দিরে বৌদ্ধ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন শুরু হয়।
আমি আসলে কম্বোডিয়া এসেছিলাম আংকোর ওয়াত দেখতে। বানতে শ্রাই মন্দির সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না। যে রিসোর্টে উঠেছি সেটা আংকোর ওয়াতের মূল ফটক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে। এত বড় টেম্পল কমপ্লেক্স, হয় সাইকেল নয় মোটর বাইক ভাড়া করে ঘুরতে হয়। সাইকেল রিসোর্টে রাখা আছে। অতিথিরা নিজের ইচ্ছা মতো নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কোন ভাড়া দিতে হয় না। তবে মোটর বাইক ভাড়া করতে হয়। প্রথম দিন আমি সাইকেল নিয়ে মূল আংকোর ওয়াত ঘুরে বেড়িয়েছি। এ যে বিশাল রাজত্বের এক মন্দির আর তার শাখা প্রশাখা। এর মাঝে ঠাঁই করে নিয়েছে গাছপালা। সারাদিন ঘুরে ফিরে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বের হবার সময় দেখা হল একটি ছেলের সাথে, কোসাল নাম। লোকাল গাইড ছেলেটি, তার একটা অটোরিকশাও আছে। আমাকে সেই প্রথম বলল বানতে শ্রাই মন্দিরের কথা। আমি প্রথমে পাত্তা দেইনি। কারণ আমাদের মতো বাজেট ট্রাভেলার সাধারণত নিজে নিজেই কোন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ায়। পরে ভাবলাম অল্প কিছু পারিশ্রমিক যদি ওর সংসার চালাতে সাহায্য করে তবে যাওয়া যায়। আমি তো ভেবেছিলাম আংকোর ওয়াত শুধু এই বাউন্ডারির মধ্যেই, আরও দূর-দূরান্তের যে কিংবদন্তী গল্পের ঝাপি মেলা আছে তা কে জানতো!
ধানক্ষেত আর বন পেরিয়ে মিলল সেই আশ্চর্য মন্দির যা কোন রাজা মহারাজা নির্মাণ করেননি। নির্মাণ করেছিলেন এক জ্ঞানী, মানী ব্যক্তি নাম, ইয়াজনাভারাহা। বানতে শ্রাই শব্দের অর্থ হলো সৌন্দর্যের দুর্গ বা প্রাসাদ। সৌন্দর্য এই মন্দিরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। মন্দিরের প্রাঙ্গণের বাইরে প্রধান ফটক আর চারদিক ঘেকে আঙিনা ঘেরা আছে অনুচ্চ দেয়াল দিয়ে। আশেপাশে একজন মানুষও নেই। খেম্যার স্থাপত্যশিল্পের সবচেয়ে সুন্দর দিক হল স্থাপনার চারধার জুড়ে জলের উপস্থিতি। জল মানুষের মনকে শান্ত করে, শীতল করে চঞ্চলতা। প্রধান ফটকের এত রাজকীয় তোরন যে স্বাগত জানাচ্ছে তার জন্য কোন ধরনের প্রস্তুতি নেইনি। এভাবে কি রাজসিক ঔদার্যে ঢুকে পড়া যায়!
প্রসাদের অভিমান আমি বুঝি। একসময় সরগরম প্রাসাদের আদলের মন্দির এখন জনমানবহীন জঙ্গলের এক অংশ হয়ে পড়ে রয়েছে। একসময় ঝকঝকে থাকত তার শরীর নানা গয়নায়, নৈবেদ্য হত সুগন্ধী ফুলে, কোকিল কন্ঠীরা গান গেয়ে তরঙ্গে ভাসত, কবি রচনা করত তার জন্য স্ততি। এখন চুলে চিরুনি পড়েনা, নিরাভরণ শরীর, মলিন বসন। এত অবহেলা কেন সে সইবে! একতলা মন্দিরে ভবন তিনটি। প্রত্যেকটি ভবনের দেয়ালে ও চূড়ায় কারুকাযে স্তম্ভিত করে আমাকে আর আমার সাথে ঘুরে বেড়ানো বাতাসকে। সবচেয়ে বড় আকারের মন্দিরটি শিব ঠাকুরকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে। তার সামনে একই সোনালী স্যান্ডস্টোন পাথরে তৈরী দ্বাররক্ষী হাজারখানের বছর ধরে অনিমেষ দৃষ্টিতে বসে আছে দুয়ার পরে। পাহারা দিচ্ছে দেবতাকে। মন্দিরের কয়েকটি সিড়ি পেরোলে ভেতরের কারুকাজের ঐশ্বর্যে নিজেকে জড়িয়ে নেয়া যায়। তবে বাইরে থেকে উঁকি দেয়া ছাড়া আর কিছু করতে দেবেননা মন্দির মহারাজ। সরকারি নিয়মকানুনে বাধা পড়ে গিয়েছে দেবতা। ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তখনও শিব ঠাকুরের মুখ দর্শন বাকি। দেবতা কি মুখ ভার করে আছেন!
সারা প্রাঙ্গণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সোনালী মন্দির, মাথার উপরে নীল আকাশ, আশেপাশে সবুজ বন যেন রঙমহলের উচ্ছ্বলতা বাড়িয়ে চলছে। গুড়ো গুড়ো সোনা বৃষ্টির ছটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, অভিমান ভাঙাতে চাইছে উপোবাসে থাকা মন্দিরের। এরাই আপন এখন। আর আপন মন্দিরের চারধারের জলাধার। এর এক কোনায় পা ডুবিয়ে আমি দেখি জলের উপর জলের আঁকা জলছবি। ঝিরিঝিরি জলে, সরে সরে যাওয়া সোনার মন্দির। আর পূর্বের জীবনে ফিরে যাবার জন্য মন্দিরের কিশোরের মতো অভিমান।
পর্যটক, কথাসাহিত্যিক
জন্ম ঢাকায়। বেড়ে উঠা ব্যাঙ্গালোরে, পড়াশোনা ব্যাঙ্গালোর ও সিঙ্গাপুরে।
পেশায় ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিস্ট।