| 25 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা ভ্রমণ : পাহাড় ও সমুদ্রের দেশে  । জিললুর রহমান 

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

২১ জুন ২০২১: চট্টগ্রাম 

বছরের দীর্ঘতম দিনে আমার ছুটি মন্জুর হলো। চট্টগ্রামে ছুটে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। আমাকে গ্রহণ করতে গাড়িরসাথে সাথে তিনকন্যাসহ স্বয়ং গৃহদেবী হাজির——উদ্দেশ্য নেভাল বীচে পেঁয়াজু ভক্ষণ। অতএব গাড়ি ছুটে গেল নদীর কিনারধরে ধরে। সারি সারি চেয়ার সাজানো নদীপাড়ে। রাস্তার অপর পাড়ে দোকানিরা নানাভাবে আহবান জানাচ্ছে তাদের আতিথ্যগ্রহণের। একটা দোকানে গিয়ে রুমি পেঁয়াজু আছে কিনা জানতে চাইলে দোকান কর্মচারী জবাবে বললেন “ পেঁয়াজু আছে, কেঁকেরা আছে”। আমি বেশ আগ্রহী হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম “কি আছে?” সে আবার বললো “কেঁকেরা আছে”। খুব মজাপেলাম শুনে। চট্টগ্রামে কাঁকড়াকে “কেঁএরা” উচ্চারণে ডেকে থাকে। বিক্রেতা নিজ গুনে চাঁটগাঁইয়া ভাষা সংশোধন করে“কেঁকেরা” বানিয়েছেন। যেমন, চঅরি>চাকুরি। বেশ মজা পেয়ে সেই দোকানেই বসে পড়লাম সদলবলে। আমি বলে বসে ভাবতেলাগলাম—— কেঁএরা যদি কেঁকেরা হয়, তবে তো ‘পেঁয়াজু’কে ‘পেঁকাজু’ ডাকা উচিত। লোকটা কিন্তু তেমন করেনি। এই যে ক্ষেত্রবিশেষে শব্দের উচ্চারণে গাঠনিক ভিন্নতা, এসব সাত-সতের ভাবতে ভাবতে গরম গরম পেঁয়াজু খেয়ে নিলাম। ‘কেঁকেরা’ এযাত্রায়আর আস্বাদন হলো না। শহরে পৌঁছে ল্যাবে অপেক্ষমান রোগী ও স্লাইড দেখা শেষ করতে করতে রাত্রি দশটা বেজে গেল।বাচ্চাদের সাথে আড্ডা দেবার মতো শারীরিক সামর্থ্য পেলাম না, অগত্যা নিদ্রাদেবীর আরাধনাতে নিজেকে এলিয়ে দিলাম। 

২২ জুন ২০২১ : পাহাড়ের পথে

সকালটা বেশ আয়েশ করে উপভোগ করলাম। না, কোনো প্রাতঃভ্রমণের তাগিদ ছিল না মনের ভেতর। হাতে বেশ ক’দিনের ছুটিরয়েছে। তাই ভোরবেলা যথারীতি ঘুম ভাঙলেও আলস্যে সময় গড়িয়ে দিলাম অনেকটা। প্রাতরাশ সারতে সারতে সকাল নয়টা।দশটার দিকে মাথায় ভ্রমণের বাই উঠলে বাচ্চাদের সব অনলাইন ক্লাস বন্ধ করে জামাকাপড় গুছাতে বললাম। আমার বাচ্চারাওওদের মায়ের মতো ৫ মিনিটে গুছিয়ে প্রস্তুত হতে জানে। সেই সাতানব্বই সাল থেকেই আমাদের এই ছুটে চলা——অন্তবিহীন, অর্থবিহীন। 

সকাল এগারটা নাগাদ আমরা রওনা দিলাম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটক পার হয়ে চকবাজার, আন্দরকিল্লা, লালদিঘী, ফিরিঙ্গিবাজার, ব্রিজঘাটা হয়ে পৌঁছে গেলাম কর্ণফুলী সেতুর ওপরে। ততক্ষণে গাড়িতে গতি এসেছে। পথও বেশফাঁকা। তবে, শান্তির হাটে কিছুটা অশান্তি প্রায়শই ঘটে থাকে। তারপর পটিয়া। চট্টগ্রামের ভাষায় ‘ফইট্টা’। আর ফইট্টা’র সাথেঅন্তমিলে চলে আসে ‘লইট্টা’——যদিও ফইট্টা শহরের সাথে লইট্টা মাছের তেমন কোন জেনেটিক বা পরিবেশগত সংযোগেরতেমন কোন তথ্যপ্রমাণ এখনও পর্যন্ত মেলেনি। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো  আমাদের যাত্রা সুগম করার জন্যে পটিয়া শহরকে পাশকাটিয়ে নতুন চওড়া হাইওয়েতে গাড়ির গতি যেন পঙ্খিরাজ হয়ে গেল। কিন্তু বাইপাস সড়কটি শেষ হতেই একটা বাজারে ঢুকেপড়লাম। এটাকেও এড়ানো গেলে ভাল হতো।   কিন্তু ‘উপায় নাই গোলাম হোসেন’ বলে যানবাহনের ভীড়ের মধ্যে গুতোগুতিকরতে করতে কিছুক্ষণ এগুতে হলো। এভাবে চন্দনাইশের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, যেখানে ‘চন্দ’কে ‘নাইস’ তথা সুন্দরবলা হয়েছে সেখানেও যথেষ্ট ভীড়ভাট্টা এবং হাটবাজারের কর্দম বিদ্যমান। দোহাজারি এসে কিছুক্ষণ আহাজারি করলাম।লোকাল বাস এবং ট্যাম্পু ইত্যাদি পেসেন্জার প্রত্যাশায় রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে থেকে সময় ক্ষেপন করা এসব দুর্বহ মনে হচ্ছিল।কোনোক্রমে কেরাণীহাট পৌঁছালে বান্দরবনের পথটি দৃশ্যমান হলো। পথনির্দেশক ফলকে লেখা দেখলাম বান্দরবান ২৩কিলোমিটার। ততক্ষণে দুপুর ১২:৩৫। পেট একটু একটু কথা বলছে। বান্দরবানের পথে গাড়ি ঢুকতেই প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠলো।পাহাড়ী চড়াই উৎরাইয়ের সড়ক পথে চলতে চলতে দুইপাশের চোখ জুড়ানো সেগুন শালবৃক্ষ সহ নানা ধরনের গাছের উপচে পড়াসবুজ দেখে এতোক্ষণের পথকষ্ট এবং ক্লান্তি যেন নিমেষে উধাও হয়ে ধায়। তবে, কিছুক্ষণ পরেই টের পাই বেশ কয়েকটি স্থানেরাস্তা ভেঙে গিয়েছে। বিকল্প রাস্তা অবশ্য তৈরি করে দিয়েছে সেনাবাহিনীর ইন্জিনিয়ারিং কোর। গাড়ির চাকা ও শরীর কর্দমাক্তহয়ে গেছে অনেক আগেই। রেইছা বাজার এলে সেনা বাহিনীর চেক পোস্টে দাঁড় করালো বটে, তবে পরিচয় জানাতেই এগিয়ে যেতেইশারা করলো সেনাসদস্য। এর পরে মেঘলা পেরিয়ে সোজা নীলাচল। নীলাচলের ইকো সেন্স রিসোর্টে এটা আমাদের প্রথমপদচারণা নয়। গতমাসেও কড়া লকডাউন-কালে আকস্মিক সফরে এখানে এসেছিলাম। এদিকে জনমানুষের ঢল নেই, ঢলাঢলিও নেই। সামাজিক দূরত্ব এখানে স্বাভাবিক প্রবণতা। তাই এদিকে আসতে মন টানে। বান্দরবান শহরে ঢুকার আগেইডানদিকে অনেক উঁচু একটা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে নীলাচলের রাস্তা। সরকারী পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র নীলাচল বন্ধ। তাইকোনো ভীড়ভাট্টা নেই। আমরা উঠতে থাকি খাড়া চড়াই বেয়ে। সরকারী নীলাচলের আগে একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে রিসোর্টকরেছে আমাদের জাকির——মেঘলা’য় হলিডে ইন রিসোর্টের কর্ণধার। বিশাল এলাকা নিয়ে তার এই নতুন কর্মযজ্ঞ এখনওআনুষ্ঠানিকভাবে সূচিত হয়নি। অফিশিয়ালভাবে এখনও বন্ধ, কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। গুগলম্যাপ যেখানটায় ঈঙ্গিত করে সেখানে থামলে রিসোর্টের তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। একটা বাঁশ ও তারে ঘেরা উঠোনেরএকপাশে একটি ছোট কাঠের ঘর, আর অপর পাশে একটি ছাউনি মতো এলাকা। এসব ভবিষ্যতে যখাক্রমে রিসেপশন এবংজুস-বার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। গাড়ি দেখে বয়স্ক মারমা দারোয়ান বাঁশ সরিয়ে দিলে উঠোন থেকে একটা ছলিন বিছানো পথপাহাড়ের ধার ঘেঁষে নীচে নেমে গেছে। এই পথ বাইরে থেকে বুঝার যো নেই। কেউ টেরই পায় না এখানে কোন রিসোর্ট রয়েছে।গাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে থাকলো নীচে। একটু পরেই একটি প্রশস্ত সমতল মতো মালভূমির মতো এলাকা। এখানেই গাড়িরাখতে হলো। অনুভা পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে বললো, “এখানে কোথায় থাকবো? কোথায় রিসোর্ট?” আমরা এক ধার দিয়ে নেমেযাওয়া সিঁড়ির সন্ধান পেয়ে এগুতেই হাজির হলো ক্লিনটন ও ফাহিম——এখানকার কর্মচারী। আমাদের ব্যাগগুলো কাঁধে তুলেনিয়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে। একটু পরে একটি বেড়ার কুঁড়েঘর, ভদ্দরলোকের ভাষায় কটেজ। মাত্র ৫টা কটেজ——একেকটারদূরত্ব এমন যে একটা থেকে অপরটা তেমন ভাল করে দেখাই যায় না। কোনটার ছাউনি, কোনোটার বারান্দার কোণা দেখা যায়।গতবার যে ডুপ্লেক্স কুঁড়েতে ছিলাম, তা আজ খালি নেই। কোন এক নবদম্পতির যুগল সেই যে তিনদিন আগে এসেছেন, যাবারনামটি করছেন না এই নিরিবিলি পরিবেশ পেয়ে। অতএব আমাদের এবারের ঠাঁই হলো সবচেয়ে উঁচু কুঁড়েটিতে। একপাশে সোফাআর অপরপাশে খানিক উঁচু শয়নব্যবস্থা। আর বারান্দার নকশা সেই আগেরটির মতোই, তবে, এই উচ্চতা থেকে দূরে পাহাড়মেঘ ও আকাশের উচ্ছ্বাস আরও প্রাণ্জন এবং সতেজ মনে হলো। আমরা হাল্কা হয়ে, মুখ হাত ধুয়ে রওনা দিলাম শহরেরউদ্দেশ্যে। মধ্যমপাড়া আর উজানিপাড়ার মধ্যিখানে আমাদের প্রিয় জুম্ম রেঁস্তোরা। বহুবার এই রেঁস্তোরায় আমরা খেয়েছি।বিশেষত রুমা—বগালেক—থানচি—তিনডু—বড়মোদক—সাইকটপাড়া—কেওক্রাডাং যাওয়া আসার সময় এখানে ভরপেটখেয়ে রওনা হবার অভ্যেস যেন অনন্তকালের। আজও যথারীতি ঢুকে পড়লাম জুম্ম রেঁস্তোরায়। পরিবেশিত হলো, তোজা’র সাথেলাল মরিচের ভর্তা, তেঁতুল পাতা সদৃশ্য এক ধরনের টক পাতা দিয়ে তৈরি পাতলা মুরগীর স্যুপ, টকপাতা দিয়ে দেশী শামুকেরঝোল তরকারী, কুঁচিয়া মাছ (কুঁইচ্যা: যাকে বড় চোখ দেখাতে নেই), হলুদের ফুল দিয়ে মন্ডূকের তরকারী এবং বরবটি দিয়ে বাঁশখড়ুল (কচি বাঁশ)। হরিণ আর গুইসাপের তরকারী ছিল, কিন্তু কারও পেটে আর তাদের ঠাঁই হবার নয়। অতএব এবার ক্ষান্তদিলাম। এদিকে অনুভা ও তার মায়ের সখ হলো মুন্ডি খাবার। কিন্তু পেট খালি নেই। পেট খালি করার তাগিদে আমরা রওনাদিলাম পাহাড় ভ্রমণে। যেতে যেতে একটি পথপার্শ্বের দোকানে চা খেলাম। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি ও ফটো ক্লিকের পরে ফিরে গেলামআবার শহরে। অনুভা আর রুমি মুন্ডির স্বাদ নিলো। তারপর আবার নীলাচলের পথে। এবার বিকেলের রোদ মেঘের খেলায় ছবিতোলা হলো অনেক। বাচ্চারা বিশ্রামের পাঁয়তারা করলে আমি রুমিকে নিয়ে পাহাড়ে হাঁটতে বেরুলাম। পাহাড় চূড়ায় আলাপপরিচয় হলো নতুন ম্যানেজার রাগিবের সাথে। রেডিসন ছেড়ে এসেছে, হালিশহরের ছেলে——হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্সকরা। আমাদের আদিলের সাথে তার বন্ধুত্বের খবর পেলাম। আদিল যে ঢাকায় চলে গিয়েছে তা’ও জানলাম। আমাদের পেশাজানে বলে সে তার ফুফাত ভাই ডা. মামুনুর রশীদ সফদারের কথা বললো। মামুন ভাইকে আমার ইউএসটিসি কর্মজীবনেসিনিয়র কলিগ হিসেবে পেরেছিলাম; রুমি পেয়েছিল শিক্ষক হিসেবে। গতবছর তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। কিছুক্ষণের জন্যেআবহাওয়া ভারী হয়ে গেল, মেঘ ঘনিয়ে এলো, দু’চার ফোঁটা বৃষ্টির ছিটা এসে লাগলো মাথায় ও মুখে। আমরা নেমে আসছিলাম, তখন দেখি জাকির তার বাগানকর্মীকে নির্দেশনা দিতে দিতে উঠে আসছে উপরে। জাকিরের সাথে সেই যে আলাপ শুরু হলো সেআড্ডা আর থামে না, এমনকি মশকের উৎপাতও আমাদের আলাপে বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। জানতে পেলাম ক্ষমতাধরেরা এখানেকি কি উপায়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, জানা গেল রিসোর্ট নিয়ে জাকিরের বিশদ পরিকল্পনা। হাঁটতে হাঁটতে নেমে যাইনির্মিয়মান খাবারঘরে——বারান্দায় গিয়ে বসলাম। একমাসের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে। নির্মাণ শ্রমিকেরা আমাদের চাবানিয়ে খাওয়ালো। চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত এবং সন্ধ্যারাত্রির আকাশ উপভোগ করলাম। একসময় রুমি মেয়েদের জন্যে অস্থিরহয়ে ওঠায় আড্ডায় যতি টেনে এগিয়ে গেলাম আমাদের কুঁড়েঘরে। এর মধ্যে জাকিরের নির্দেশে বারান্দায় বিছানার জন্যেশীতলপাটি চলে এসেছে। আমরা বারান্দায় দুটো বালিশ নিয়ে পানিতে শুয়ে পড়লাম। চারপাশে তিনমেয়ের কোলাহলে সন্ধ্যাটামধুর হয়ে উঠলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা যখন বাড়তে লাগলো সে এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু পাটি সিক্ত হয়ে উঠলেআমরা ঘরে ঢুকে যাই। রাতের খাবারে ছিল থানকুনি পাতার ভর্তা, করলা ভাজি, লাউ-চিংড়ি, বাইল্যা মাছ, গরু ও মুরগীরমাংস। ভরপেট খেয়ে নিদ্রা বড় সুখকর হলো। গভীর রাতে ঝমঝম বর্ষণে ঘুম ভেঙে গেলে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতেলাগলাম এই অঝোর ধারা। তারপর বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারায় চোখ বুঁজে এলে আবার ঘুমে ঢলে পড়ি। 

২৩ জুন ২০২১ : বান্দরবানের সকাল 

সকাল সাড়ে পাঁচটায় রুমি উঠে বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো। আমি এবং বাচ্চারা আরও কিছুক্ষণ আলসেমি করলাম।মোটামুটি ৬টার পরে আর শুয়ে থাকা সম্ভব হলো না। কুঁড়েঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুন্দর সবুজ সকাল উপভোগ করলাম।তারপর বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে শহরের দিকে। পথে লোকজন না দেখে ভাবলাম এখনও দোকানপাট নিশ্চয় খোলেনি। কিন্তুশহরের ভেতরে ঢুকে “তাজ্জব বনে যাই”। লোকে গিজগিজ করছে প্রধান সড়কে। মধ্যম পাড়ার রেঁস্তোরাগুলোতে যেন “তিল ঠাঁইআর নাহি রে”। অনেক ক’টা রেঁস্তোরা ঘুরে অবশেষে আবার ফিরে যাই নীলাচলের পথে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে মারমাদের একটাপাড়ায় একটি চা-দোকানে চা আছে কিনা জিজ্ঞেস করে গাড়ি থামালাম। লুচির মতো তুলতুলে পরোটা চা’য়ে চুবিয়ে চুবিয়েখেলাম। তারপর ইকো সেন্স রিসোর্টে ফিরে আড্ডা বিশ্রাম ও প্রকৃতি দর্শন চলছে। এর মধ্যে অদিতার ক্লাস শুরু হয়েছে। আমরাচুপচাপ থাকার চেষ্টা করছি। রিসোর্টের প্রাতরাশ এসেছে। অদিতার ক্লাস শেষ হলে খাবো, এমন সময় ফোন পেলাম কমলের——আমাদের অভিযাত্রা দলের নিয়মিত একজন সদস্য। সে বান্দরবান আসছে, আমরা আছি কিনা জেনে নিল। আমরা প্রাতরাশেরএকটা অংশ তুলে রাখলাম কমলের জন্যে। আমাদের জন্যে জাকির উপহার পাঠালো ওর বাগানের গাছের আমের জুস।একেবারে নির্ভেজাল আম। প্রাতরাশ শেষ করার আগে আবার আম কেটে পাঠানো হলো। জাকিরের আন্তরিকতায় আবারও মুগ্ধহলাম। 

আমরা কিছু সুন্দর ছবি তুলতে পারার প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম। কমল এসে পৌঁছালে, তার নাস্তা সারার সময়আমরা জামাকাপড় পাল্টে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। কমল সবাইকে শাদা জামা পরিহিত দেখে চমকে গিয়ে গভীর আনন্দে মগ্ন হয়েলেগে পড়লো ছবি তোলার কাজে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আরও মায়াবী হয়ে উঠছে পাহাড় ও আকাশ। বৃক্ষরাজি দুলে দুলেঝেড়ে নিচ্ছে পাতায় জমে ওঠা জল। এর মধ্যে নানান ভঙ্গিমায় কমলের ক্যামেরা তুলে নিলো অনেকগুলো ছবি। কমলের সাথেপ্রথমবার এখানে এসেছেন শিল্পী অপরূপ দে। তিনিও মোবাইল ফোনে আমাদের কিছু ছবি ধারণ করলেন। জানতে পেলাম, তিনিএসেছেন আজ সারাদিন ছবি আঁকবেন বলে। আর কমল এসেছে এই ইকো সেন্স রিসোর্টের এবং রিসোর্ট থেকে দৃশ্যমান প্রকৃতিরছবি তুলতে। বৃষ্টি ঝরঝর সকাল উপভোগ করতে করতে দুপুর প্রায় সমাগত। আমরা বারোটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম রিসোর্ট থেকে। 

২৩ জুন ২০২১ : সমুদ্র সকাশে

বারোটার পরে রওনা দিয়েছি বান্দরবান থেকে। কেরাণীহাট আসতে আসতেই একটু আধটু ক্ষুধার উদ্রেক করলো। কিন্তু অনুভারঅনেক দিনের সখ পৌষীর খাবার খাবে। অতএব সিদ্ধান্ত হলো দিবারাশ সেই কক্সবাজার পৌঁছেই সারবো। গাড়ি ঘুরে গেল বামে।যতোই ক্ষুধা বাড়তে লাগলো, পথ মনে হলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে যখন ঈদগাহ্ পার হচ্ছি তখন জানা গেলপৌষী কোভিডকালে বন্ধ রেখেছে, এবং এখনও খোলেনি। তবে, পাশেই ঝাউবন এবং রান্নাঘর খোলা আছে। কলাতলীর মোড়েপা রাখতেই, থুক্কু গাড়ীর চাকা পড়তেই খিদে যেন চনমনিয়ে উঠলো। দ্রুত এগিয়ে গেলাম শহরের দিকে। ঝাউবন রেঁস্তোরার পাশেরান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। অদিতার এক দাবী —— লইট্টা ফ্রাই, আর কিছু না। একমাত্র কক্সবাজারের রেঁস্তোরাগুলোতেই গরমগরম লেবু জলে হাত ও বাসন প্রক্ষালনের সুন্দর রেওয়াজ রয়েছে। হাত ধোয়া শেষ হতেই ভাত ও ডালের সাথে বিশাল থালায়সাজানো হরেক রকম ভর্তাভাজি চলে এলো। খাওয়া শুরু করে দিলাম পরম তৃপ্তির সাথে। ক্ষুধার্তের পেটে সকল খাবারই অমৃতমনে হয় বলেই শুনেছি। এলো কেচকি মাছ, গরু ভুনা এবং অতি বিখ্যাত লইট্টা ফ্রাই। রুমি চেয়ে নিলো নিয়মিত পরিবেশনেরআচার, অনেকগুলো কাঁচামরিচ ও লেবু। 

ভরপেট খেয়ে সকলেই আলস্যকাতর হয়ে উঠেছি। তবু সমুদ্র সকাশে যাবার জন্যে মনটা আকুলি বিকুলি করতে থাকে। শীঘ্রইরওনা দিলাম পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতের পাড় ধরে চলে যাওয়া পথ ধরে। আমাদের দুর্ভাগা——এর কোনো সুন্দর বাংলা নামআমরা দিতে পারিনি। আমরা বিপুল গর্বে বলে থাকি —— মেরিন ড্রাইভ। আমরা তো বলতে পারতাম সৈকত সড়ক কিংবাবালুচর পথ। কিন্তু না, এখন সবকিছু ইংরেজীতে ডাকার নয়াযুগ এসেছে। যাই হোক, মেরিন ড্রাইভে চলার সময় দুই পাশে সবুজবৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোকরশ্মি যেন এক মায়ার খেলায় মেতেছে। বামপাশের সুউচ্চ পাহাড়শৃঙ্গগুলো সবুজের আচ্ছাদনেদৃষ্টির অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছে। ডানপাশ থেকে জলের কল্লোলধ্বনি মেঘগর্জনের মতো কানে এসে হাঁকছে, আর গাছের আড়ালছেড়ে যখন উন্মুক্ত হয় সমুদ্রের সফেন স্বরূপ, সে রুদ্র রূপের বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়——কেবল দেখে যাই, কেবল দেখতেইথাকি। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ সৌন্দর্যকে যেমন প্রাণ দেয় মৃদু সমীরণে বৃক্ষের এপাশ ওপাশ দোলা, তেমনি সাগরের সৌন্দর্যকে মোহময়করে তোলে উচ্ছসিত উর্মি——একটার পেছনে আরেকটা, তার পেছনে আরেকটা——এইভাবে ফুঁসে ফুঁসে ওঠা সাগরকেপাহাড়ের চেয়ে অনেক বেশি সচল ও ব্যস্ত মনে হয়। 

সাগরের উল্লাসে আমরাও উল্লসিত হয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতের মৃদু স্বর শুনতে শুনতে এগিয়ে চলি টেকনাফমুখী বালুচর পথে।হিমছড়ির পর থেকে সাগর যেন আরও বেশি বেশি দৃশ্যমান হলো। আমরা গাড়ীর সার্শি নামিয়ে সাগরের সঙ্গীত শুনলাম।এইভাবে একসময় পৌঁছে যাই মারমেইড বীচ রিসোর্টে। 

মারমেইড বীচ রিসোর্টে রাত্রিযাপনের প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষা বেশ অনেক দিনের পুরনো, আজ তবে শেষপর্যন্ত এতে পদার্পন করলাম।যেখানে কক্সবাজার থেকে ইনানী পর্যন্ত ক্রমশ নানা উচ্চতার বহুতল দালানে ভরে উঠেছে সেখানে এই মৎস্যকন্যা পান্থশালা তথামারমেইড রিসোর্ট একটি বিপ্লবী ব্যতিক্রম। নির্ধারিত স্থানে গাড়ি রেখে এগিয়ে গেলাম অভ্যর্থনা কক্ষের দিকে। আমাদের বরণকরা হলো একটি লতায় লাগানো রক্তবর্ণ জবাফুল দিয়ে। আপ্যায়িত হলাম ডাবের জল পান করে। আনুষ্ঠানিকতাপর্ব শেষ হলেব্যাটারিচালিত ত্রিচক্রযানে চড়ে এগিয়ে গেলাম সরু কঙ্কর-জমানো পাকা পথ ধরে। চারপাশের বৃক্ষরাজি এবং টিনের কিংবাছনের চালার কুঁড়েঘরগুলো দেখে রুমির মনে পড়ে গেল আনোয়ারার গ্রামের কথা। সারি সারি কুঁড়েঘর, বাইরে থেকে দেখতে জীর্ণমনে হলেও, ভেতরে সব অত্যাধুনিক সুব্যবস্থা বিদ্যমান। আমাদের টমটম যেখানটায় থামলো তারপরে আর গাড়ি চলার পথনেই। পথের শেষেই সরগরম সমুদ্র আস্ফালন করে চলেছে। আমরা হাতের বামে সৈকতের বালির বস্তার বাঁধের সাথে পায়ে চলাপথে দু’কদম এগিয়ে দেখি একটি সুন্দর ভিলার সামনে প্রশস্ত উঠোন ঘিরে বেড়ার দেয়ালে একটি ছোট ফটক রয়েছে। আর সেইফটকের পাশে একটি নামফলকে লেখা “Dr. Zillur Rahman’s Villa”——অর্থাৎ আমি এই ভিলার একরাত্রির অধিশ্বর।অবশ্য আমার মতো অস্থির মানুষের জন্যে এহেন অচঞ্চল কর্মব্যস্ততাহীন একটা অনন্তব্যস্ত সাগরের তীরে আলস্যজড়িতগৃহকোণে পড়ে পড়ে ঘুমানো একরাত্রির অধিক হয়তো অসহনীয়ই হয়ে যাবে। তাই একরাতের বাদশাহীই উত্তম, অন্যথায় রাজাবাদশাদের একাকিত্বের অসহায়ত্ব তো কতো কাহিনীতেই পড়েছি। বিশাল উঠানের একপাশে মঞ্চ তৈরির ব্যবস্থা, এবং সারা উঠানবৃক্ষছায়ায় আবৃত। মাঝেমধ্যে রোদ্দুরের ঝিকিমিকি আলো এসে খেলে যায়। উঠোনের পরে প্রশস্ত বারান্দায় উঠার আগে দুইপাশেদুটি জলের কল। সৈকত থেকে ফিরে এখানে পা ধুয়ে তারপর গৃহপ্রবেশ করতে হয়। পাশাপাশি দুটি আলিশান কক্ষ, আবারমাঝখানে দরজা দিয়ে যুক্ত। বিশাল প্রক্ষালন কক্ষ——অনেকের শয়নকক্ষও এর চেয়ে ছোট হয়ে থাকে। আমরা ব্যাগগুলোযথাস্থানে রেখে ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। ঘরের ভেতর থেকে সাগর দৃশ্যমান, তবে ভাটার কারণে সাগর অনেক দূরে সরেআছে ——মাঝখানে বিশাল চওড়া সৈকত। এর মধ্য বাচ্চাদের কক্ষের ভেতর অকস্মাৎ তক্ষক ডেকে উঠলো ‘টোট্ট্যেং’ বলে।শৈশবে এই প্রাণীটিকে আমরা ‘টোট্ট্যেং’ নামেই ডাকতাম। আমাদেরকে মুরব্বীরা শিখিয়েছিলেন যখনই সে ডেকে উঠবে ‘টোট্ট্যেং’ বলে, সাথে সাথেই যেন আমরা বলি ‘তোর মা’র ঠ্যাং’, সে আবার ডাকলে আমরা আবার বলবো ‘তোর বাপের ঠ্যাং’। এরকম৩/৪ বার বললেই টোট্ট্যেং থেমে যেতো। আমি বড় হয়েও এই প্রক্রিয়াকে কার্যকর দেখেছি, বাপের ঠ্যাং মায়ের ঠ্যাং তুলে প্রত্যুত্তরদিলে এরা ভয়ে বা লজ্জায় ডাকা বন্ধ করে দেয়। টোট্ট্যেংকে যে তক্ষক ডাকে তা জেনেছি অনেক অনেক পরে। এটি অনেকটাটিকটিকির বড় আর গুইসাপের ছোট সংস্করণ বলা যায়—— (ইংরেজি: Gecko, বৈজ্ঞানিক নাম:Gekko gecko) গেকোনিডিগোত্রের একটি গিরগিটি প্রজাতি। পিঠের দিক ধূসর, নীলচে-ধূসর বা নীলচে বেগুনি-ধূসর। সারা শরীরে থাকে লাল ও সাদাটেধূসর ফোঁটা। পিঠের সাদাটে ফোঁটাগুলি পাশাপাশি ৭-৮টি সরু সারিতে বিন্যস্ত। কমবয়সী তক্ষকের লেজে পরপর গাঢ়-নীল ওপ্রায় সাদা রঙের বলয় রয়েছে। মাথা অপেক্ষাকৃত বড়, নাকের ডগা চোখা ও ভোঁতা। চোখ বড় বড়, মণি ফালি গড়নের। লেজসামান্য নোয়ানো। দৈর্ঘ্য নাকের ডগা থেকে পা পর্যন্ত প্রায় ১৭ সেমি এবং লেজও প্রায় ততটা। তক্ষকের ডাক চড়া, স্পষ্ট ও অনেকদূর থেকে শোনা যায়। ডাকের জন্যই এই নাম। কক্‌কক্‌ আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্‌-ক্কা’ বা ‘টোট্ট্যেং’ ডাকেকয়েক বার ও স্পষ্টস্বরে। এরা কয়েকবার ডেকেই থেমে যায় বলেই এদের মা-বাপ তুলে গালাগাল দিলে কার্যকর ফল সহজেইপাওয়া যায়। এরা কীটপতঙ্গ, ঘরের টিকটিকি, ছোট পাখি ও ছোট সাপ খেয়ে থাকে। ছাদের পাশের ভাঙা ফাঁক-ফোঁকড় বা গর্তেঅথবা গাছে বাস করে। অনেকে ভুলক্রমে তক্ষককে বিষাক্ত সরীসৃপ হিসেবে চিহ্নিত করে। আসলে তক্ষক দক্ষিণ এশিয়ায়বিপর্যস্ত একটি প্রাণী। ব্যাপক নিধনই এর বিপন্ন হওয়ার কারণ। তাই টোট্ট্যেংয়ের উপস্থিতি প্রথম টের পেয়ে অরণি যখন চমকেগিয়ে ভীতি ও বিস্ময় নিয়ে ছুটে এলো, বললাম, এরা ক্ষতি করে না। বরং টোট্ট্যেং থাকলে ঘরে পোকামাকড় আসবে না, সাপআসবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ‘তোর বাপের ঠ্যাং মায়ের ঠ্যাং’ বললেই এরা চুপ হয়ে যাবে। এ যুগের বাচ্চা কি আর আমাদেরমতো ঈমানদার হবে! সে একথা বিশ্বাসই করলো না। অদিতাসহ আমি টোট্ট্যেং খোঁজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখা মিললো না।কোনো এক কোণে হয়তো লুকিয়ে পড়েছে। আমি এবং রুমি জামা পাল্টে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র দর্শনে। কিন্তু লাজুক সাগর ভাটারটানে সরে গেছে বহুদূরে। দেখি বিস্তীর্ণ সৈকতে একটি গভীর খালের মতো সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, তা পেরিয়ে বহুদূরের সমুদ্রেরকাছে যাওয়া বড় কঠিন। তবু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলাম, এমন সময় রিসোর্টের গার্ড আমাদের বাধা দিয়ে বললো, একটু পরেইসাগর নিজেই এখানে চলে আসবে তাই অতো দূরে যাবার দরকার নেই। আমি বললাম, ঠিক আছে, তাহলে আমরা বরং এগিয়েগিয়ে সাগরটাকে টেনে নিয়ে আসি। এখন টের পেলাম গার্ড শব্দের আরেকটি অর্থ প্রতিবন্ধক। আমাদের জানানো হলো, এইপান্থশালার অতিথিদের আটকে রাখাই তার কাজ। এক রাতের বাদশাহী করতে এসে আবারও টের পেলাম রাজা বাদশারাকতোটা অসহায় থাকে তাদের রক্ষীদের কাছে। নিরাপত্তার নামে রক্ষীদের অনুমতি ছাড়া দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজাও কোথাও পাফেলতে পারে না। অগত্যা নিঃসঙ্গ বালুচরে দুজনে চরে বেড়ালাম চখাচখীর মতো। এমনি করেই একসময় “আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়েএলো, গেল রে দিন বয়ে”। আমরা ফিরে এলাম নীড়ে। অদিতা এর মধ্যে তক্ষকটাকে আলমিরা ও দরজার আড়ালে পুনরাবিষ্কারকরলে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনের উদ্ধারকর্মীদল চলে এলো এবং দু’তিন মিনিটের মধ্যেইআমরা তক্ষকমুক্ত কক্ষে নিশ্চিন্তে আনন্দে মেতে উঠলাম। আঁধার হবার একটু পরেই সাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়লোআমাদের উঠোনে। আমরা বেরিয়ে গিয়ে তাকে আবাহনী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এলাম। এর মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে।বারান্দায় পেতে রাখা আয়েশ করার আসনে বসে সদলবলে অন্ধকার রাত্রিতে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলাম। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরমতো ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়তে বাড়তে রক মিউজিকের প্রবল ঝংকারে টিনের চালা ঝমঝমিয়ে উঠলো। সে এক অনবদ্যসুরধ্বনিতে আমরা দীর্ঘ সময় নিশ্চল নিশ্চুপ বসে রইলাম। একদিকে সাগর উর্মি এসে আছড়ে পড়ছে উঠোনে, অন্যদিকে তুমুলবর্ষণ সঙ্গীত টিনের চালায়——“এমন দিনে তারে বলা যায়” —— মনে পড়ে গেল রবিঠাকুরের বহুচর্চিত চরণ:—

“এমন দিনে তারে বলা যায়

 এমন ঘনঘোর বরিষায়।

  এমন দিনে মন খোলা যায়–

এমন মেঘস্বরে       বাদল-ঝরোঝরে

     তপনহীন ঘন তমসায়॥

     সে কথা শুনিবে না কেহ আর,

     নিভৃত নির্জন চারি ধার।

দুজনে মুখোমুখি         গভীর দুখে দুখি,

     আকাশে জল ঝরে অনিবার–

     জগতে কেহ যেন নাহি আর॥

     সমাজ সংসার মিছে সব,

     মিছে এ জীবনের কলরব।

কেবল আঁখি দিয়ে   আঁখির সুধা পিয়ে

     হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–

     আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥

     তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার

     নামাতে পারি যদি মনোভার।

শ্রাবণবরিষনে         একদা গৃহকোণে

     দু কথা বলি যদি কাছে তার

     তাহাতে আসে যাবে কিবা কার॥

     ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,

     বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।

যে কথা এ জীবনে   রহিয়া গেল মনে

     সে কথা আজি যেন বলা যায়–

     এমন ঘনঘোর বরিষায়॥

কিন্তু এ ঘোর বরিষণে আমরা দুজনে রয়েছি কাছাকাছি, তবে সন্ততির দল আমাদের ঘিরে আছে। এই দলবদ্ধ একাকিত্বের আনন্দ, এরকম মহৎ মুহূর্ত রবিঠাকুর কতোটা পেয়েছেন জানিনে——তিনি তো ভরা হাটের মধ্যে থেকেও একান্ত একাকী দিন যাপন করেগিয়েছেন। আমরা আণ্ডাবাচ্চা সকলে মিলে এই উচ্ছল জলকল্লোলের সঙ্গীত মূর্চ্ছনায় ঢলাঢলি করে একে অপরের ওম নিয়ে বুঁদহয়ে রইলাম——যতক্ষণ না নিশিরাশ নিয়ে আমাদের দুয়ারে এসে দাঁড়ালেন দুই খাদ্যকর্মী। যেমন রিসোর্টের নাম বাংলা না দিয়েতারা একটা ভুল করেছে, তেমনি তাদের খাবারের মধ্যে দেশীয় রেসিপি না রেখে আরও মারাত্মক ভুল করেছে বলে আমি মনেকরি। অগত্যা শাদা ভাতের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বেইকড রেড স্নাইপার তথা শেঁকা কোরাল মাছ এবং চিনাপদ্ধতিতেতৈরি সব্জির সাথে পাস্তা আর নানরুটি দিয়েই পেটপূর্তি করতে হলো। তবে হয়তোবা সমুদ্রতীরে ক্ষুধাবৃদ্ধি হেতু অথবা পাচকেরগুণে খাবার বেশ উপাদেয় ছিল। সারারাত্রি বৃষ্টি ঝরেছে। এর মধ্যে টাইমজোনের কারণে অনুভার সকালের ক্লাস আমাদের রাত্রেশুরু হলো। অনুভা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর অন্যদের নিশ্চুপ থাকতে হয়। এই নির্বাক সময়ে যার যার মতো করে প্রকৃতিকে অনুভবকরার পালা। একসময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। অনুভার ক্লাস কখন শেষ হয়েছে জানি না। তবে যখন ভোরে ঘুম ভাঙলো, তখনসূর্যোদয় হয়ে গেছে। 

২৪ জুন ২০২১ : ইনানীতে হয়রানি 

সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি রুমি ঘরে নেই। আমিও প্রাতকৃত্য সেরে বেরিয়ে গেলাম। মনে হলো, রুমি মনে মনে আমারই প্রতীক্ষায়ছিল। আমি তার কাছে গেলে দু’জন মিলে সৈকতে হাঁটতে লাগলাম। আমাদের সামনে বিস্তীর্ণ চর। একটা খালের মতো খাঁড়িআর একটি দ্বীপের মতো চরে কিছু জেলে কাজের আয়োজন করছে। আর আছে চারটি কুকুর, সকালের মিষ্টি রোদে আড়মোড়াভাঙছে। রুমি লক্ষ্য করলো, পানি বাড়ছে। মানে, তখন আবার জোয়ারের ক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রথম টের পেলো রুমি। জানালো, পানি বাড়ছে। আমরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছি, এবং সাগর এগিয়ে আসছে দ্রুত। কিছুক্ষণের মধ্যেই খালটি নিশ্চিহ্ন হয়েগেল। ছোট হচ্ছে দ্বীপটির আকৃতি। কিছু উদ্ভিদ জলে তলিয়ে গিয়েছে। রুমি খুব উদ্বিগ্ন কুকুরগুলো কীভাবে আসবে? অবশেষেতলিয়ে গেল দ্বীপ——কুকুরেরা সাঁতরে চলে এল তীরে, জেলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জাল নিয়ে। আমরা ফিরে এলাম আমাদের লবণজলের পিঠা ( সল্ট ওয়াটার কেক) শীর্ষক ভিলার ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটু পরে অদিতা এগিয়ে এলো আমার কাছে, এবং রুমি ফিরে গেল ঘরে। টিপটিপ বৃষ্টি কখন থেকে শুরু হলো আমরা জানি না। ততক্ষণে সাগরের ফেনিল জলরাশি এসেউঠোনে আছড়ে পড়ছে যেন। অদিতা আমার কিছু ছবি তুললো। মৎস্যকন্যার ডিমের একটা সিমেন্টের ভাস্কর্য ছিল কাছেই, তারসাথে ছবি নিলাম। রুমি ঘরে ফিরে অরণিকে জাগালো। অনুভাও একসময় উঠে এলো। প্রাতরাশ এলো থালা সাজিয়ে। আমারজন্যে পেঁপের রস (জুস) এবং অন্যদের মেশানো ফলের রস (মিক্সড ফ্রুট জুস), সবার জন্যে খিচুড়ির সাথে ডিমের ওমলেট এবংমুরগীর ঝোল  তরকারী (চিকেন কারি) এলো। খাবারের সাথে ৩ কাপ চা ও ২ কাপ কফি এবং এক গ্লাস দুধও এসেছিল। ভরপেটখেয়ে ওঠার পর রুমি বললো বেড়াতে বেরুবে। আবার শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে রওনা দিলাম। গাড়ি ঘুরালাম রয়াল টিউলিপেরদিকে। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত চালনায় গাড়ি এসে থামলো রয়্যাল টিউলিপের সামনে। এদের সৈকতের ধারে শান বাঁধানো ঘাট রয়েছেবিশাল। গাড়ি থামাতেই মেয়েরা ছুটে গেল সেইদিকে। রুমি ডেকে নিলো এক কিশোর ফটোগ্রাফারকে। আমিও ক্যামেরায় বন্দীকরে নিলাম ওদের উচ্ছলতা। নৌকার সামনে ত্রিভঙ্গমুরারীর ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতেও দেরী হলো না। কিশোরফটোগ্রাফার কিন্তু ঝানু ব্যবসায়ী। মাত্র ১০/১২ মিনিট সময়ে আমরা ৪/৫ টি জায়গায় ছবির জন্যে কিছু উপযুক্ত ভঙ্গিতেদাঁড়িয়েছিলাম। ভেবেছিল ১৫/২০টা ছবি হবে। আগেকার রিলের যুগ হলে হয়তো ৮/১০টা ছবিই হতো। কিন্তু কিশোর ফটোগ্রাফারওহীদুল ইসলাম এতটাই ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন যে এই অল্প সময়ে সে ২৫২টি ছবি ধারণ করেছে। রুমি এবং অনুভা প্রায় আধঘন্টাকসরত করে ১২৮টি ছবি বাছাই করে নিলো। কিন্তু যথাযথ ফোকাস না হওয়ায় অধিকাংশ ছবিই তেমন ভাল হলো না। আমরাইনানীতে দীর্ঘ কালক্ষেপণের পরে ফিরে এলাম মৎসকন্যা রিসোর্টে। অভ্যর্থনায় জানিয়ে রাখলাম আমাদের ১১টায় গৃহত্যাগেরসময় থাকলেও অরণির পরীক্ষা রয়েছে ১২:২০ থেকে ১টা পর্যন্ত। অতএব, আমরা যেন ১টা পর্যন্ত অবস্থানের অনুমোদন পাই।ওরা সানন্দে জানালো, যেহেতু আজ কোনো নতুন বাদশা’র আগমন ঘটবে না আমাদের ভিলায়, অতএব, আমাদের রাজত্বপ্রলম্বিত হওয়ায় তেমন  কোনো বাধা রইল না। এখন তো আর সেই সুলতানী আমল নেই যে তলোয়ার উঁচিয়ে নতুন রাজাকেবাধা দিতে পারবো। অতএব, বিনাযুদ্ধে রাজ্যজয়ই শ্রেয়। আমরা এর মধ্যে ছবি তোলা এবং রিসোর্টের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনকরে যাচ্ছি। সাগর আবার পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে। সময় গড়িয়ে মধ্যাহ্নের দিকে। একসময় ঘরে নীরবতা নামিয়ে আনতেহলো, অরণি অনলাইনে পরীক্ষা দিতে বসেছে। আমরা স্নান সমাপন করে প্রস্তুতি নিলাম কক্ষ ত্যাগের। ঠিক একটায় ইন্টারকমেজানালাম আমরা যেতে চাই। তারপর বেরিয়ে পড়লাম কক্সবাজার শহরে দিবারাশ গ্রহণের জন্যে। এবার বসলাম ঝাউবনরেঁস্তোরায়। রূপচাঁদা, লইট্টা ফ্রাই এবং ভর্তাভাজি আদেশ দিয়ে অপেক্ষা করছি, এমন সময় এলো ম্যাজিট্রেটের নেতৃত্বে সশস্ত্রলোকজনসহ মোবাইল কোর্ট। আমাদের খাবার আসতে বেশ বিলম্ব হলো। নাকে মুখে খেয়ে ফের ছুটে চলা ফিরতি পথে। 

২৪ জুন ২০২১ : পেকুয়ার জমিদার

সকালে ইনানী বীচে তিনকন্যার ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফোন এসেছিলো পেকুয়ার জমিদারনন্দন সাজ্জাদ হোসেন রনির। তার জোর আবেদন , ফেরার সময় একটু তাদের বাড়িতে যেন যাই। রনি আমার চট্টগ্রাম কলেজেরসহপাঠী। অবশ্য আমার সেকশনে না পড়ায় এবং স্বভাবগত অমিশুক চরিত্রের কারণেও ১৯৮৩/৮৪ সালে তার সাথে ঐকান্তিকদহরম মহরম গড়ে ওঠেনি। আর যার ক্যাম্পাসে কিছুটা বিটকেল এবং অসামান্য বুদ্ধিমত্তার সহপাঠী ছিল আমি তাদের ঘনিষ্টহতে ভয় পেতাম হয়তোবা। রনির সাথে সম্পর্ক এবং ঘনিষ্টতা বাড়ে অনেক পরে। তখন আমি আমার পেশায় মোটামুটি একটাঅবস্থান তৈরি করেছি, আর রনি তো সফল ব্যবসায়ী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎ এবং পরবর্তীতে ফেসবুকের কল্যাণেআমাদের প্রায়শ টুকটাক আলাপচারিতা ঘটতে থাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, রনি ফেসবুকে তার স্ত্রীর আঁচলে লুকিয়েথাকে। মানে রনির নিজের নামে কোনো ফেসবুক একাউন্ট নেই, তবে সে ভাবীর ফেসবুকে নিত্য বিচরণ করে। হয়তো ঝামেলাএড়াতে অথবা ভাবীর কর্মকাণ্ডও নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সে এই পন্থা গ্রহণ করেছে, এমনটা অনেকেই ভাবতে পারে। কিন্তুরনি তেমন ছেলেই নয়। সে সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত হলেও শিশুসুলভ সারল্য এবং দুষ্টমির চোখের মণিগুলো এখনও তেমনইজ্বলজ্বলে, যেন কোন অষ্টাদশী চপল তরুণ। রনি ঢাকায় থাকতো জানতাম, কিন্তু প্রায়ই সে চট্টগ্রাম আসতো। আমার মতোতারও তিনকন্যা, বড় মেয়ে ঢাকা মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছে। অথচ যেন সেদিনের কথা, আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেসাক্ষাত ঘটেছিল ঢাকা বিমানবন্দর রেল স্টেশনে, তখন সে মেয়েকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি করিয়েদিয়েছিল। সময় কতো দ্রুত যায়! আমি ফেসবুকে কোনো লেখা বা ছবি আপলোড দিলে বেশ রসিয়ে দুষ্টুমিভরা মন্তব্য করেমাঝেমাঝে চমকে দেয় এক নারী যার নাম নাইমা নুসরাত তিথি। আবার আমাকে তুই তোকারিও করে দেখলাম, রুমিকেওদেখালাম। পরে প্রোফাইল ঘেঁটে উদ্ধার করলাম——এ আমাদের সাজ্জাদুল কবির রনির কাণ্ডকারখানা। একবার লিখেছিলাম, আর কতো বউয়ের আঁচলের তলে লুকিয়ে থাকবি! কিন্তু যেখানে তার নিত্য নির্ভরতা এবং পরম স্বস্তি, তা সে জারি রাখবেই।আজও প্রথমে মেসেন্জার থেকে রিং করেছিল নাইমা নুসরাত তিথির একাউন্ট থেকে। সময় মতো ফোন ধরতে পারিনি বলে সেতার ফোন থেকে সরাসরি ফোন করলো। চকরিয়া থেকে সোজা না গিয়ে বাম দিকের সড়ক পথটিই নিয়ে যায় পেকুয়ায়। সে আরওউস্কানি দিলো, পেকুয়া থেকে বাঁশখালীর রাস্তা দিয়ে গেলে একঘন্টার রাস্তা কমে যায়। আমি ঈমানদার মানুষ। তার কথা বিশ্বাসকরলাম। আর ভাবতে থাকলাম, একটা নতুন পথ ও নতুন জায়গা দেখার এই সুযোগ নিলে ভালই হয়। এখন অন্যেরা আগ্রহীহলেই হলো। একটু দোনোমনো করলেও শেষ পর্যন্ত সকলেই নতুন পথ ও স্থান দেখার উদগ্র আকাঙ্ক্ষার কাছে বশ মানলো।সন্ধ্যায় অনুভার বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও নিশিরাশের আয়োজন আছে, তবু সে আগ্রহ দেখানোয় শেষ পর্যন্ত গাড়ী চকরিয়া থেকেঘুরে গেল পেকুয়ার পথে। রনিকে ফোনে জানিয়ে দিলাম ফেরার পথে আমরা ওর বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্যে থামবো এবং চাখাবো। সে অবশ্য দিবারাশের নিমন্ত্রণ করেছিল, কিন্তু অরণির পরীক্ষা হেতু তা সবিনয়ে বাতিল করতে হলো। চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডের হাঁক ডাক, অযথা থেমে থাকা গাড়ীর কারণে তৈরি জ্যাম, এবং দোকান সওদা সহ মানুষের ব্যস্ততার যতো গ্যাঞ্জাম ঠেলেযখন বামে মোড় নিলাম, তখনও বুঝিনি সামনে রাস্তাঘাট কেমন। কয়েকটা বাঁক অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতেই হঠাৎসতেজ সবুজের ডালি সাজিয়ে সমস্ত বৃক্ষরাজি মৃদু দুলে উঠে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। দুই পাশে বিশাল বিশাল সবজলাধারে চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্যের খামার, আর ছায়াঘেরা ঘরদোর মেতে উঠলো বর্ষার সৌন্দর্যের উৎসবে। একেক বাঁক পেরিয়েআসতেই নতুন নতুন স্নিগ্ধতার বিস্ময়ে আমরা উচ্ছাসে উদ্বেলিত। এইভাবে একসময় চকরিয়া পেকুয়ায় গিয়ে পড়লো।ভেবেছিলাম, এখানে জলাধারগুলোয় অনেক হাঁস ভাসতে দেখবো, আর তারা সারাক্ষণ পেঁক-পেঁক পেঁক-পেঁক পেঁক-পেঁক করেআমাদের কান ঝালাপালা করে দেবে। অথবা হয়তো দেখতে পাবো চারপাশে সব কাঁচা রাস্তা কাদায় প্যাঁক প্যাঁক করছে, আরযাবতীয় মনুষ্যকুল প্যাঁক বা কাদায় আছড়ে আছড়ে পড়ছে। জানি না, হয়তো শতবর্ষ আগে এমনই ছিল। কিন্তু রনিদের জমিদারীতো তেমন প্যাঁকসর্বস্ব হয়ে থাকতে পারে না। তাই সুন্দর গুছানো উপজেলার সকল দফতর এমনকি হাসপাতালও বেশ ছিমছামগুছিয়ে রেখেছে। রনিকে জানালাম, গুগল মশাই জমিদারবাড়ির মসজিদ খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু জমিদারবাড়ি গুগল মশাই’রতালিকায় নেই। জবাব রনির যেন তৈরিই ছিল, জমিদারী শুকিয়ে মুমূর্ষু হয়ে গিয়েছে তাই গুগল সাহেব পাত্তা দিচ্ছে না, তবেমসজিদের সামনে এলেই চলবে। আমরা এগিয়ে চলেছি পেকুয়া উপজেলার চৌমুহনীর দিকে। একটু পরেই জমিদার সাহেবেরফোন এলো, সে লাল জিপ নিয়ে বেরিয়েছে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। কিন্তু এদিকে গুগল মশাই আমাদের ঢুকিয়ে দিল একটাচিকন রাস্তায়। এদিকে জমিদার আমাদের অশান্ত হয়ে ফোন করছে, কেন তখনও আমাদের দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে তারপরামর্শ মতো গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরতে দিয়ে দেখি তার গাড়ি চিকন রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। আমাদের দেখা পেয়ে নিশ্চিন্তে আমাদেরগাইড করে নিয়ে গেল জমিদারবাড়িতে। ওর বাড়িতে ঢুকার মুখেই বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিতমসজিদ। মসজিদের পেছনে বিশাল পুকুর। আমরা যখন পৌঁছি তখন আসরের আজান হয়েছে, মুসল্লীদের ব্যস্ত লক্ষ্য করাযাচ্ছে। বিশাল পুকুরের একটি ঘাট মসজিদ থেকে নেমেছে, সেখানে চলছে অজু করার ভীড়। আমরা পাশ দিয়ে প্রবেশ করলামপ্রশস্ত উঠোনে। উঠোনের ধার দিয়ে যাবার সময় দেখলাম পুকুরের এ পাড়েও একটি সুন্দর ঘাট রয়েছে বসে আড্ডা জমানোরব্যবস্থাও আছে। তারপর উঠানের একপাশে ছলিন বিছানো পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে থামি জমিদার বাড়ির সামনে। পুরনোজমিদার বাড়ির কারকার্যময় দালানের পাশে রনির নতুন তৈরি বাড়িটিও বেশ বনেদী। আমরা নতুন বাড়ির সিংহদুয়ার দিয়েপ্রবেশ করতেই অভ্যর্থনা জানালেন ভাবী। জমিয়ে আড্ডা দিতে বসে গেলাম। এর মধ্যে পরোটা ও গরুর নলা চলে এলে বেশআয়েশ করে খেলাম। রনির মেঝ মেয়ের খুব যত্ন করে তৈরি কফি বেশ রসিয়ে রসিয়ে খেলাম। এদিকে অনুভা বারবার ঈঙ্গিতকরছে সময়ের দিকে। তবু কিছু কাল ক্ষেপন করে দেখে নিলাম বাড়ির আশপাশ এবং পুকুর পাড়েও খানিকক্ষণ আড্ডা দিলাম। রনির আন্তরিক অভ্যর্থনার এই উষ্ণতা আমাকে হয়তো আবার আরেকদিন এ বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যাবে, তবে আপাতত দ্রুতবিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাঁশখালী হয়ে ঘরে ফেরার নতুন পথের সন্ধানে। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত