| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা অনুবাদ: বৈঁচি ফলের ঝোপ । আন্তন চেখভ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
 
 
 
 
সেই ভোর বেলা থেকে আকাশ বাদলা মেঘে আচ্ছন্ন।এখনও দিন ফুরোয়নি তবুও চারদিক শীতল আর বিষণ্ণ হয়ে আছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সেই দিনগুলির মত যখন মেঘ মাথার ওপর নেমে এসে বৃষ্টি হবে হবে ভাব অথচ বৃষ্টি হয় না।ইভান ইভানিচ একজন পশু চিকিৎসক আর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বারকিন, দুজনে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত হেঁটেই চলেছেন। ফাঁকা প্রান্তরে রাস্তা যেন আর ফুরোচ্ছিল না। অনেক দূরে মিরনোসিতস্কোয়ে গ্রামের হাওয়া কল তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন।এবং ঐ গ্রাম পেরিয়ে ডানদিকে যে স্বল্প উচ্চতার ঢেউ খেলানো পর্বতমালা দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁরা দুজনেই জানতেন যে ঐ পর্বতমালা আসলে নদীর তীরে। ওর অদূরেই আছে হরিত তৃণভূমি, সবুজ উইলো গাছ আর গ্রামের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। যদি তাঁরা ঐ পাহাড়গুলোর কোন একটির শীর্ষে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখেন তাঁরা নিশ্চিত যে সীমাহীন উদার খোলা ভূমি আর টেলিগ্রাফ পোস্ট দেখতে পাবেন।
 
এমন একটা নিস্তরঙ্গ দিনে প্রকৃতি যেখানে সহৃদয় ও বিষণ্ণ ইভান ইভানিচ আর বারকিন এই সমতল ভূমির জন্য এক উচ্ছ্বসিত ভালবাসা অনুভব করলেন এবং ভাবলেন তাঁদের দেশটা সুবিশাল আর সুন্দর। বারকিন বললেন, “শেষবার আমরা বড় প্রকোফের কুটিরে ছিলাম। তুমি বলেছিলে তুমি কোন গল্প আমায় বলতে চাও।”
 
“হু,আমি তোমায় আমার ভায়ের গল্প বলতে চেয়েছিলাম, “ইভান ইভানিচ এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাঁর কাহিনির ভূমিকা স্বরূপ নিজের পাইপে অগ্নি সংযোগ করলেন।কিন্তু সেই মুহূর্তে বৃষ্টি নামল আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে এমন মুষলধারে ঝরতে লাগল যে কখন থামবে তার আর দিশা পাওয়া মুশকিল হয়ে গেল। ইভান ইভানিচ আর বারকিন চুপ করে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলেন। কুকুরগুলো কাক ভেজা হয়ে বেদনার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
 
বারকিন বললেন, আমাদের একটা আস্তানা খোঁজার দরকার আছে। চলো আলেখিনের বাড়িতে যাই, কাছাকাছিই।”
 
“চলো যাওয়া যাক।”
 
তাঁরা দুজনে নতুন ফসল বোনা মাঠ পেরিয়ে, ডানদিকে বাঁক নিয়ে একটা রাস্তায় এসে পৌছলেন।খুব শিঘ্রি পপলার,একটা বাগিচা আর গোলাঘরের লাল ছাদ নজরে এলো। নদীর জল ঝিকমিক করছে, চোখে পড়ছে অনেকদূর অবধি জলের বিস্তার। একটা জল-চক্রচালিত কারখানা এবং একটা চুনকাম করা স্নানের ছাউনি এই নিয়ে হল সোফিনো-যেখানে আলেখিন বাস করেন।
 
কারখানা চলছিল তাই কারখানার শব্দে বৃষ্টির শব্দ ঢাকা পড়ে গেছিল। আর সমস্ত বাঁধ যেন কাঁপছিল। গাড়ির সামনে ঘোড়াগুলো দাঁড়ান আর তাদের মাথাগুলো নীচের দিকে ঝোঁকানো ছিল। মজুরগুলো কাঁধে আর মাথায় ভারি বস্তা নিয়ে এদিক ওদিক আসা যাওয়া করছিল। দিনটা ছিল স্যাঁতস্যাঁতে, কর্দামাক্ত আর ঝোড়ো হিমেল হাওয়ার। নদীর জল দেখাচ্ছিল শীতল ও ক্রুদ্ধ। ইভান ইভানিচ আর বারকিন ইতিমধ্যে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার দুর্দশা, নোংরা আর শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্যের অস্বস্তি ভোগ করছিলেন। তাঁদের বুটজুতোগুলো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছিল। কারখানা আর বাঁধ পেরোনোর সময় তাঁরা চাষীর গোলাঘর যাওয়ার ওপরদিকের পথ ধরে এগোতে লাগলেন। তাঁরা এত নিশ্চুপ ছিলেন যে একে অপরের নৈশব্দের দ্বারা উত্যক্ত হচ্ছিলেন।
 
একটা গোলাঘরের মধ্যে থেকে ঝাড়াই বাছাই আওয়াজ পাওয়া গেল। গোলাঘরের দরজাটা খোলা ছিল আর ঐ খোলা দরজা দিয়ে ধুলোর ঝড় বইছিল। দরজার চৌকাঠে আলেখিন স্বয়ং দাঁড়িয়ে ছিলেন।
 
চল্লিশ ছোঁয়া একজন শক্তসমর্থ মানুষ। তাঁকে জমিদার অপেক্ষা একজন অধ্যাপক বা শিল্পী বেশি মনে হয়।উনি একটা নোংরা সাদা শার্ট পড়েছিলেন।কোমড়ে এক টুকরো দড়ি আর পরনে ট্রাউজারের বদলে ড্রয়ার। ওঁর বুটজুতোগুলো কাদা আর খড়ে মাখামাখি। চোখ আর নাকের চারদিকে ধুলোর স্তর। উনি ইভান ইভানিচ আর বারকিনকে দেখে চিনতে পারলেন, ওঁদের দেখে খুশি হলেন।
 
“আপনারা আমার বাড়ির দিকে যান, আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি, “আলেখিন হেসে বললেন।
 
বিশাল এক দোতলা বাড়ির নীচের তলায় আলেখিন থাকেন। দুটো ঘর,ঘরের গম্বুজাকৃতি ছাদ আর ছোট ছোট জানালা। আগে এখানে তত্ত্বাবধায়করা থাকতেন।ঘরগুলো মলিন ভাবে সজ্জিত।সস্তা ভদকা,রাই-রুটি আর গোলাঘরের গন্ধে ভরপুর। অতিথি না এলে আলেখিন খুব কমই দোতলার ঘরে ওঠেন।ইভান ইভানিচ আর বারকিনের সঙ্গে এক পরমা সুন্দরী পরিচারিকার দেখা হল-তরুণীটির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাঁরা ক্ষণকাল থেমে গিয়ে অজ্ঞাতসারে একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
 
হলঘরে ওঁদের পেরিয়ে যেতে যেতে আলেখিন বললেন, “আপনাদের এখানে দেখে আমি কতটা খুশি হয়েছি কোন ধারনা করতে পারবেন না,সত্যি এ বড় বিস্ময়কর প্রাপ্তি। “পরিচারিকার দিকে ফিরে হাঁক দিয়ে বললন, “পেলাগেয়া এই ভদ্রলোকদের বদলানোর জন্য পোশাক দাও। আমিও পাল্টাব কিন্তু তার আগে আমায় স্নান করতে হবে। গত বসন্ত থেকে আমি স্নান করি না। এখানে ওরা গুছিয়ে গাছিয়ে নিতে নিতে আপনারাও ইচ্ছে করলে স্নান সেরে নিতে পারেন।”মনোহরণী, শান্ত, নম্র পেলাগেয়া ওঁদের জন্য তোয়ালে আর সাবান এনে দিল।আলেখিন এবং তাঁর অতিথিরা স্নানের ছাউনির নীচে গিয়ে দাঁড়ালেন।
 
আলেখিন পোশাক ছাড়তে ছাড়তে বললেন, “অনেকদিন হয়ে গেল আমি স্নান করি না। দেখছেন, আমার বাবার বানানো এই সুন্দর স্নানের একটা জায়গা আছে কিন্তু যে কোন কারণেই হোক আমি স্নানের জন্য সময় করে উঠতে পারিনি।” আলেখিন সিঁড়ির ধাপে বসে ওর লম্বা চুল, গলা আর সমস্ত শরীর ভাল করে সাবান মাখালেন। জলের রং বাদামি।
 
ইভান ইভানিচ গৃহকর্তা মাথার দিকে তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, “হ্যাঁ,আপনার অবশ্যই উচিত…” আলেখিন অপ্রতিভ হয়ে গায়ে সাবান মাখতে মাখতে বললেন, “অনেকদিন হয়ে গেল স্নান করিনা, ”আর এখন জল কালির মত ঘন নীল।
 
ইভান ইভানিচ ছাউনি থেকে উঠে ঝপ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আর বৃষ্টির মধ্যে সাঁতার কাটতে লাগলেন তাঁর হাত আন্দোলিত হতে লাগল, জলে একটা তরঙ্গ উঠল আর জলের সাদা লিলিফুলগুলো সেই তরঙ্গে দুলে উঠল। নদীর মাঝ বরাবর সাঁতরে চলে এলেন, তারপর একটা ডুব দিয়ে অন্যত্র কোথাও ভেসে উঠলেন।তারপর আবার সাঁতার আর ডুব দেওয়া,চেষ্টা করতে লাগলেন নদীর তলদেশ স্পর্শ করার।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত