পূজার সাজ

Reading Time: 3 minutes
সকাল বেলা পেপারের প্রথম পাতায় ছবিটা দেখেই পূর্বার মনটা খারাপ হয়ে গেল। খবরটা যদিও গতকালই মেয়ের কাছে পেয়েছিল তবুও ভাবনার গন্ডী থেকে বেড়োনোর আগেই যদি আবারও ঘটনাটা কোনো না কোনো ইন্দ্রিয়ে আঘাত করে তো সটার্ন আবার মস্তিষ্কের কোষে যন্ত্রণাগুলো বাহিত হয়।
রোজকার মতো পেপারটা টেবিলে ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে আবার সরিয়ে নিল। ঢুকিয়ে নিল নিজের ব্যাগেই। রমিত ঠিক এই সময় রোজ ফোন করে একবার। একবার মনে হল রমিতকে বললে কিছুটা হালকা লাগবে। ফোনটা ধরল…
– হ্যালো
– গুড মর্নি ডারলিং।
– হুমম
– কি হয়েছে ? এনি টেনশন ? সুমি ঠিক আছে তো ?
– হ্যাঁ হ্যাঁ। একদম ঠিক আছে। তুমি ভেবো না। ঘুমাচ্ছে ঘরে ?
– স্কুল যাবে না ও ? 
– না ! স্কুল ছুটি আজ। 
– আজ ছুটি ?
– হ্যাঁ। কিছু একটা আছে বোধহয়।
– আচ্ছা শোনো, একটা গুড নিউস। এবার দিন পনেরো জোটানো গেছে। পঞ্চমীতেই ইন। তুমি মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে শপিং টা সেরে ফেলো। আর আমায় কি কি আনতে হবে হোয়াটস অ্যাপ করে দিও।
– হুমম ! সুমি উঠলেই ওকে বলছি।
– হুমম। টাটা। রেডি হই।
– বাই।
ভাবলেও বলতে কিছুই চাইল না পূর্বা ইচ্ছা করেই। রোমিত এত দূরে থাকে। অকারণ খুব টেনশন করবে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বেডরুমে উঁকি মারল পূর্বা। ঘুমোচ্ছে সুমি। ওর সামনে দাঁড়িয়ে দেখল ওর ঘুমন্ত মুখ‌। চুমু খেতে ইচ্ছে করল খুব। মা, শাশুড়িরা বলতেন… ঘুমন্ত বাচ্চাকে নাকি আদর করতে নেই, দুষ্টু হয়ে যায়। দুষ্টু ! কি জানি ! আজ প্রথম একটা ভয় লাগল পূর্বার। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে গাছগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। চারপাশে ফ্ল্যাট। আর কদিন বাদেই পুজো। শিউলির গন্ধ নেই তবুও কোথাও। কদিন আগে সুমিও বায়না করেছিল একটা ফ্রকের কেনার জন্য অন লাইনে। পূর্বার অকারণ অনেকটা বেশি দাম মনে হয়েছিল। না করে দিয়েছিল…. কিন্তু তা বলে !
ছোটোবেলায় পূর্বাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অত ভালো ছিল না। তাই বাবার কাছে বায়না… আকাশ কুসুম ছিল। কোনোবার জামা পেত, কোনোবার পেতোও না। মা কোনোদিন “পূজার সাজ” কবিতাটা তাই পুরো বলে শেখাতে পারে নি পূর্বাকে। মাঝপথেই বারবার কেঁদে ফেলত। তখন বুঝত না কেন কাঁদে মা। এখন নিজের ভিতরটাই হু – হু করে ওঠে। একমাত্র মামার বাড়ির দাদু তাদের সবাইকে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় কিনত পূজোর আগে। মামাতো, মাসতুতো ভাই বোন, মাসীরা, মামারা, মামীরা সবাই মিলে একদিন বেড়োনো হত। তারপর হেঁটে হেঁটে, কখনো ঘেমে, কখনো ভিজে সারাদিন বাজার আর তারপর লস্যি খাওয়া। ভাই বোনেরা কখনো জামাকাপড় পছন্দের সুযোগ পেত না। আর বাড়ন্ত বাচ্চা বলে সবারই দু সাইজ বড় জামা কেনা হতই মনে আছে। তবুও এই একটা দিনের জন্য তাদের কত আনন্দ ছিল। পুজো কেন ? পূর্বা নিজের বিয়ের শাড়ির রঙও পছন্দ করতে পারে নি। বাড়ির বড়রা থাকতে এসব কথা বলার সাহস তাদের সে সময়ে ছিল না। এখন তো মেয়েরা নিজের বাড়ি এমনকি শ্বশুরবাড়ির বাজারও নিজেরাই করে। ব্যাপারটা ভালোই লাগে পূর্বার অবশ্য। নিজের বেনারসীর রঙ একদম পছন্দ ছিল না বলে আর কোনোদিনই সে সেটা পরে নি। তার চেয়ে নিজের পছন্দ করে কেনাই ভালো। কিন্তু…. আবার পূর্বার মনটা একটা মুখেই আটকে যায়, নার্সারিতে পড়া মায়ের হাত ধরে, মায়ের শাড়ির মধ্যে মুখ লুকোনো একটা মুখ। 
সেই সবাই মিলে কাদা পায়ে পুজোর বাজার হারিয়ে গিয়ে শপিং মল হল…ঘাম নেই , কাদা নেই, ভেজা নেই। এক ছাদে সময় কম খরচ, ব্যস্ত জীবন। এখন আরো ছোটো হয়ে আসছে পরিধি। আরো ব্যস্ততা তাই অনলাইন শপিং। ব্যস্ততা … মেয়েটি কি হারিয়ে গেল শুধুই নিজের দাবিতে ? একটা কি জামার জন্যই ? নাকি ও অন্য কিছু পেতে চাইত যা পায় নি। কি জানি… পূর্বা ঘড়ির দিকে তাকাল স্কুলে যেতে হবে।
স্কুলে ঢুকতেই আবার সেই এক আলোচনা।
– এই পূর্বা দি, মেয়েটা তোমার মেয়ের সাথে পড়ত না ? একই ক্লাসে তো ?
– হুমম।
– তুমি চিনতে ? 
– হুমম।
– ওর বাবা মা কারুর সাথে যোগাযোগ ছিল না তোমার ? একই তো ক্লাস।
– হুমম। ফাইভ থেকে অন্য সেকসন হয়ে যায়। 
– ও ! শুধুই একটা জামার জন্য সুইসাইড ? কি জানি অন্য কিছু আছে বোধহয়। প্রেম ঘটিত দেখো গিয়ে
– জানি না রে। নিজের ক্লাসে যাই।
কলিগ তনিমা অনেক কিছু জানবে আশা করেছিল কিন্তু পারল না দেখে হতাশ যে হল পূর্বা সেটা বেশ বুঝতে পারল। খুব বিরক্ত লাগছিল নিজের এ আলোচনা করতে। কাল থেকেই বন্ধুর এই ঘটনায় সুমির মনটা খারাপ হয়ে আছে বেশ বুঝতে পারছিল পূর্বা। রাতেও খায় নি ঠিক করে। এই বয়সটা বড় কঠিন। না লুকোবার না প্রকাশের। আজ বাড়ি ফিরে একটা সিনেমায় যাবে সুমিকে নিয়ে ঠিক করেই রেখেছে। 
পূর্বা একটি সরকারি প্রাইমারী স্কুলে পড়ায়। এখানে সবাই প্রায় ফাস্ট জেনারেশন লার্নার। কাছে একটা ইঁটভাটা আছে। বেশিরভাগ সেখানকার বাচ্চা। মূলত মিড ডে মিল প্রধান লক্ষ্য এদের। তার মধ্যে দিয়ে যতটুকু অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা। 
টিফিন এর বেল বাচ্চাদের সবচেয়ে আনন্দের সময়। প্রতিদিনই খেয়াল করেছে পূর্বা। টিফিনের সময় আজ টিচার্স রুমে বসে মেয়ের ওই বায়না করা জামাটা অন লাইন শপিং এ খুঁজে দেখার চেষ্টা করল পূর্বা। একটা ভয় কাজ করছে গতকাল থেকে। খুঁজেও পেল। সাড়ে চার হাজার টাকা দাম। “বাই নাও” তে আঙুল ছুঁয়ে দ্বিধাগ্রস্ত তখনও পূর্বা।
– ম্যাডাম আমি কাল একটা নতুন জামা কিনেছি।
কচি গলায় খুশির আমেজে পূর্বা মোবাইল থেকে মুখ তুলে তাকাল। মুখের পাশে বাচ্চাটার ভাত লেগে আছে। প্রি-প্রাইমারিতে পড়ে। বছর পাঁচ সবে।
– কি কিনেছিস রে ? দেখালি না তো ?
– এট্টা জিন্স , এট্টা গেঞ্জী। একটা বেল্ট হল না। 
– কেন রে ?
– আমাদের তো পয়সা নেই বেশি। তা হলে আর বুনুর জামা কেনা হত না।
মুহূর্তটা হঠাৎই থেমে গেল পূর্বার। মোবাইলের “বাই নাও” থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। হাতে জলের বোতল থেকে একটু জল নিয়ে বাচ্চাটার মুখ ধুইয়ে মুখে একটা চুমু খেয়ে বলল, খেলতে যা।
স্কুলের জানলাটার সামনে দাঁড়াল। অনেক গুলো বাচ্চা খেলছে মাঠে… মায়ের গলায় “পূজার সাজ” কবিতাটা মনে পড়তে লাগল পূর্বার। শিউলির গন্ধ, পচা পাটের গন্ধ মিলেমিশে নাকে আসছে …

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>