| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনর্পাঠ গল্প : পরকীয়া । সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট
পিতামহীর পাশে বসে আমি হকচকিয়ে যাই। তাঁর চুল থেকে মেথির গন্ধ ভেসে আসে, তাঁর শাড়ি থেকে চিকন একটা খুসবু বের হয়, আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না সেটি কিসের। মনে হয় তিনি যত্ন করে চুল ধুয়েছেন, গা মার্জনা করেছেন, তোরঙ্গ খুলে একটা ভাল শাড়ি পড়েছেন। শাড়িটা ঘি রঙ্গা রেশমী কাপড়ের, জরির কাজ করা পাড়ে, আঁচলে। মনে হয় দীর্ঘ দিন ভাঁজ করা ছিল, এখন সে ভাঁজগুলোএকটি রহস্যময় জ্যামিতির মত তাঁর শরীর ঢেকে রাখে।
কত দাম হবে শাড়িটার? যেন অনেকগুলো আলোর রশ্মি দিয়ে বোনা হয়েছে পিতামহীর শাড়ি। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আমার ঘর আলো করে তিনি বসে আছেন। কিন্তু বিদ্যুতের উজ্জ্বল বাতির নিচে তিনি ব্রিত বোধ করেন। তাঁর ঘরে কখনো এত আলো ছিল না, রেড়ির তেল দিয়ে পিদিম জ্বালাতেন, সন্ধ্যায় ঘটা করে সলতেয় আগুন দেয়া হত চকমকি পাথর ঠুকে। এ কাজটি করত রাহবার মানিক, যাকে জয়সালমিরের এক রাস্তার পাশে কুড়িয়ে পেয়ে বুকের মধ্যে করে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন পিতামহ – সেই কবে, আমরা তা জানার কথা নয়। পিতামহীকে জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর পাওয়া যায় না। তিনি সময় হিসেব করেন একটা ভূমিকম্প অথবা মহামারীর বিয়োনোর ঘটনা সূত্র ধরে। আমার হিসেবে সতেরশ’ আশি থেকে পঁচাশির মধ্যে, কিন্তু পিতামহী সে কথা শুনে চোখ দুটো বড় করে তাকান। তিনি সতেরশ’ আঠারশ’ এসব কথা কিছুই বোঝেন না। রাহবার মানিক পরিবারের একজন হয়ে মানুষ হয়েছিল। যদিও শ্রেণী সচেতনতা মানুষের এমনি যে, ধরেই নেয়া হয়েছিল বালক রাহবার বড় হয়ে ভৃত্য গোছেরই কেউ হবে। এ বিষয়ে পিতামহের সঙ্গে আমার তর্ক আছে – যে শিশু জয়সালমিরে পরিত্যক্ত হয়েছে, দরিদ্র দেহাতি পিতা-মাতা তাকে আল্লার রাহে ছেড়ে দিয়েছে, তাকে দেশে এনে ওই অবস্থানেই কেন রাখতে হবে? তিনি মুখে অনেক প্রগতির কথা বলেন, বিশেষ করে বিদেশ-টিদেশ ঘুরে এলে। দুনিয়ার কোথায় সমাজ কতটা এগিয়ে আমাদের থেকে, কারা কতদূর চলে গেছে উন্নতির রাস্তায়, এসব। অথচ তারই আশ্রয়ে রাহবার বেড়ে উঠল – সন্তানের মর্যাদায় নয়, সেবাদাসের ভূমিকায়! 
পিতামহী আমার কথায় অপ্রসন্ন হলেন, বোঝা গেল। এ বিষয়টা তাঁকে নাড়া দেয়নি, তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেসও করেননি। ‘রাহবার আমাকে মা বলে ডাকত, আমিও তাকে সন্তানের মত দেখতাম।’ তিনি বলেন। 
‘কিন্তু নিজের ছেলের মত status তো তাকে দেননি আপনি? | Status কথাটায় তাঁর খটকা লাগলেও context টা তিনি ধরতে পারলেন। | উনি যদি রাহবারকে তুলে না আনতেন তাহলে ছেলেটা মরেই যেত। মানুষটার ভেতরে সবার জন্য ভালবাসা ছিল, সেটাই বড় কথা।’ 
আমি বুঝলাম তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বিষয়টা তিনি ভিন্নভাবে দেখছেন। আসলে তার মন এদিকে নেই। এ মুহূর্তে রাহবার অথবা তাঁর আপন সন্তানরাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ মুহুর্তে তিনি অপেক্ষা করছেন আমার পিতামহের জন্য। আমার সামনে তার জন্য একটা চেয়ার পেতে রেখেছি, আমার প্রিয় আরাম চেয়ারটি। পিতামহের সঙ্গে কতদিন তাঁর দেখা হয় না। এ এক আশ্চর্য মানুষ, আমার এ পিতামহ। পথের সঙ্গে তাঁর যেন সারা জীবনের একটা বন্ধন। সুযোগ পেলেই | বেরিয়ে পড়েন, কোথায় সব যান! বিয়ের পর পু্রো দু’ বছরের জন্য হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিল তিনি আর আসবেন না। অনেকে ভেবেছে তিনি হয়তো পথেই শেষ হয়ে গেছেন। সে সময় যাতায়াতের অবস্থা ছিল না-বলার মতই। যেতে হ’ত জল আর জঙ্গল, পাহাড় পর্বত পেরিয়ে, ঘোড়া বা খচ্চরে চড়ে। আমাকে লাখ টাকা দিলেও ওই রকম কষ্টের ভ্রমণে কেউ প্ররোচিত করতে পারবে না। কিন্তু পিতামহকে পথই সব সময় ডাকত, আর তিনি বেড়িয়ে পড়তেন। আর পথ ডাকও দিত যখন তখন – নিদ্রায়, স্বপ্নে, জাগরণে। বিয়ের পর তাঁর মনে হয়েছিল তার পূর্বপুরুষদের জানাতে হয় বিয়ের খবরটা, তাঁদের আশীর্বাদ নিয়ে। আসতে হবে। এটি মনে হতেই কাউকে না জানিয়ে, স্ত্রীকেও শুধু আভাসে ইঙ্গিত বুঝিয়ে, তিনি ছুটলেন পশ্চিমে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম পিতামহীকে, ‘তাঁর পূর্বপুরুষেরা কবর থেকে আশীর্বাদ করবেন তাকে ও আপনাকে, এটা তিনি ভাবলেন?’ 
পিতামহী লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘ওঁর চিন্তা ভাবনাটাই বিচিত্র ছিল, মানতে হবে । | কিন্তু দু’বছর পর ফিরে এসে বললেন, পূর্বপুরুষেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। 
‘বলেননি যে তারা আশীর্বাদও করেছেন?’ 
‘জানি না। করলে কি এই দশা হয়?’ 
আমার মনে হল, আশীর্বাদের কথাটা পিতামহ হয়তো ইচ্ছে করেই গোপন রেখেছিলেন, দ্বিতীয়বার বেরিয়ে পড়ার একটা অজুহাত হিসেবে। 
পিতামহী অনেক কষ্টে আচঁলটা বেঁধে রাখছেন। ফ্যানের হাওয়ায় তাঁর চুল উড়ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে দেখে আমি ফ্যানটা খুলে দিয়েছিলাম, এখন তাঁকে আঁচল সামলাতে দেখে বললাম, ‘ফ্যানটা বন্ধ করে দিই?’ 
তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না থাকুক। ভালইতো লাগছে।’ 
আমি তাঁকে খুঁটিয়ে দেখি। তাঁর চুলে কিছুটা লাল আভা, খুব ফর্সা মানুষের যেমন হয়। চুলে একটা টিকলি ধরনের জিনিস দেখা গেল। কানেও দুলটুল পরেছেন, আবার গলায়ও ভারি হার! আলোহীন জীবনহীন একটা গণ্ডগ্রাম বৈ তো কিছু ছিল না উত্তরগড়, সেই সতেরশ আশিতে। তাতেও কত গয়নার সঞ্চয় ছিল পিতামহীর! কখন পরতেন সেসব, কেই বা দেখত? পিতামহীর চোখের পাতা খুব হাল্কা আর স্বচছ, যেন তিনি একটা স্বপ্ন দেখতেই ব্যস্ত। তাঁর সরু নাক দেখে অবাক হলাম। আমার মায়ের নাক সেরকম। নাকে একটা হীরের নাকফুল। তিনি মুখ ফেরালে সে নাকফুলে আলো পড়ে ঝিকমিক করে, ছোটখাটো একটা সৌর বিস্ফোরণের মত। 
পিতামহীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে পিতামহের, তুচ্ছ কারণেই বলা যায়। আসলে পিতামহের মেজাজটা সব সময় চড়াই থাকে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলা তিনি কোনদিন শিখতে পারলেন না। পিতামহী এমন বহু অবস্থার সামাল দিয়েছেন, যেখানে স্রেফ স্বামীর মেজাজের জন্য একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর পিতামহের মেজাজ যখন চড়ে, তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। বলা যায় এক ভিন্ন মানুষ যেন তার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। সদালাপী, বিনয়ী এবং কৌতুকপ্রিয় ভদ্রলোকটি হয়ে দাঁড়ান দুর্মুখ, কটুভাষী, চৌরাস্তার মাতালে। মানুষকে আঘাত করতেই যেন তৈরি থাকেন তখন। তাঁর একটা ছোটখাটো নেশা ছিল, কোথা থেকে সেটা জুটিয়েছেন, আমার জানার কথা নয়। দুপুরের খাবারের পর তিনি আশ্রয় নিতেন বাড়ির সীমানা ঘেষা ছোট টুঙ্গি ঘরটাতে। তাঁর পেছনে চলত রাহবার এক বাটি দুধ হাতে নিয়ে । পিতামহ সে দুধে খানিকটা আফিম গুলে খেতেন। আহার না হলেও তার চলত, সামান্যই খেতেন, কিন্তু আফিম ছাড়া তাঁর দুপুরটি যেন কিছুতেই কাটত না। পিতামহী আগাগোড়া বিষয়টি অপছন্দ করতেন। সেদিন আহারে অরুচি ছিল স্বামীর, যদিও পিতামহী নিজ হাতে পাঁচ রকমের সবজি আর ডাল বেঁধেছিলেন, আমার সন্দেহ দিনটি তাদের একাদশ বিবাহবার্ষিকী ছিল । সতেরশ’ উনআশি সাল সম্ভবত। অবশ্য আমার এ suggestion-এ পিতামহী মস্ত ধন্ধে পড়লেন, মনে হল। তিনি তাঁর মোমের মত আঙুলে হিসেব কষতে লাগলেন। হয়তো তিনি মেলাতে চাইছিলেন তার দিনরাত্রির হিসাবের সঙ্গে কোনো স্মরণীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা কল্পনা বোষ্টমীর অন্তর্ধান। এবং এভাবে অনেকটা সময় তিনি তন্ময় হয়ে কাটিয়ে দিলেন, তার মোমের মত আঙুল উঁচিয়ে রেখে এক অমোঘ নিষেধের বার্তা দিয়ে। গল্পতে ছেদ পড়েছে, আমি কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি, আর ভাবছি কী দরকার ছিল, দিন তারিখের এসব হিসেব নেয়ার? এখন দেখছি গল্পটাই মাঠে মারা যায়। 
‘খবরদার’ হঠাৎ গলা চড়িয়ে বললেন পিতামহী। আমি চমকে তাকালাম তাঁর দিকে, মোমের মত আঙুলটি তিনি আলতোভাবে ঠোঁটের ওপর রেখে আমাকে শাসন করছেন। ‘অসহিষ্ণুতা অত্যন্ত খারাপ জিনিস’ তিনি বললেন, ছোটখাট বিষয়ে এতটা অসহিষ্ণু হতে নেই। 
কী করব’, আমি বললাম একটু কৌতুক করে, ‘বংশের ধারা’ । তাঁর মুখটা করুণ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দেয়ালে একটি টিকটিকির অস্থির আনাগোনার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘তুমিই হয়তো ঠিক, হয়তো বিবাহবার্ষিকী ছিল সেদিন আমাদের। শেষ বিবাহবার্ষিকী।’ স্বামীকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন পিতামহী- আমি বুঝিনা এর পরও সে লোক কী করে না খেয়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন, হঠাৎ করে। পিতামহী সাধছেন, আর তিনি না খেয়ে উঠে যাচ্ছেন – ভাবা যায় না। পিতামহ পাত ছেড়ে শুধু উঠলেনই না, রাগ করে ফরাস ধরে টান দিয়ে থালাবাটি, পাঁচ রকমের সবজি আর ডাল মেঝেতে ফেলে একাকার করেছিলেন । 
রাহবার নিত্যদিনের মত দুধ নিতে এল পিতামহী সবটুকু দুধ ঢেলে দিলেন মাটিতে। দু’টো কুকুর সব সময় টুকটুক করে ঘুরত উঠানে, খাওয়ার সন্ধানে। তাদের কাছে বিষয়টি স্বর্গীয় মনে হল। 
আমি বললাম আপনিও রাগ করতে পারেন? বিশ্বাস হয় না। তিনি বিষন্ন স্বরে বললেন, ‘আমার মধ্যে শয়তান ঢুকেছিল। শয়তান চেয়েছিল আমার সর্বনাশ হোক।’ আমি বললাম ‘শয়তান যদি চেয়েও থাকে আপনাদের ছাড়াছাড়ি হোক, তাকে দোষ দেয়া যায় না। অন্য কোন পুরুষ আপনাকে দেখেনি, শয়তান দেখেছে, তো সে সুযোগটা নিয়েছে। অন্য পুরুষ হলে একই হত ঘটনা।’ 
পিতামহী আমার দিকে ঈষৎ কুপিতভাবে তাকালেন। কিন্তু মনে হল তিনি অখুশি হননি। 
পিতামহের দুপুর আর বিকেল কাটল নিঃশব্দ ক্রোধে। পরিবারের অন্য কেউ সেটা অবশ্য জানল না। কারণ তিনি টুঙ্গিঘর থেকে বের হলেন না। শেষে, সন্ধ্যা হলে, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেন। তাঁর একটা প্রিয় পুস্তক ছিল, নিস্তারনামা। পারস্যের। নবম শতকের রাজকবি এবং বিজ্ঞানী গোলাম হোসেন নিস্তারের জীবনী। সেটি তিনি পড়বেন বলে রাহবারকে হুকুম করলেন বাতি জ্বালাতে। দিল্লী থেকে পিতামহ আতশ কাচের চিমনী এনেছিলেন, রাতে বই পড়তে বসলে এই চিমনী দিয়ে বাতিটা জ্বালাতেন। রাহবার চকিমকি পাথর দিয়ে ঠুকে নিমেষের মধ্যে সলতে ধরাল। তারপর আতশ কাচের চিমনী বসাতে গেল বাতিতে-আর হাত থেকে পড়ে আতশ কাচের চিমনী শত খন্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল উঠোনে। 
কাচভাঙর শব্দ মেলাতে না মেলাতেই পিতামহ হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন এক খণ্ড চেলা কাঠ এবং কোনদিকে না তাকিয়ে, কোনো বাক্য ব্যয় না করে, রাহবার মানিককে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। 
রাহাবারের চিৎকার জয়সালমিরে তার স্বর্গীয় পিতামাতার কবরে পৌছে যাওয়ার কথা। তার ভাগ্য ভাল যে পিতামহী কুড়ি গজের মধ্যেই ছিলেন, তিনি ত্রস্তে বেরিয়ে নিরস্ত করতে এলেন স্বামীকে। 
তিনি কী বলেছিলেন স্বামীকে, আদৌ কিছু বলেছিলেন কিনা, স্মরণ নেই। কিন্তু হঠাৎ সমস্ত আক্রোশ যেন এসে পড়ল তাঁর ওপর। রাহবার তাঁর হাত গলিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি ক্ষেপ করলেন না। তিনি তাঁর চেলা কাঠটি এবার সজোরে বসিয়ে দিলেন পিতামহীর পিঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেলেন পিতামহী। প্রথমে ভাবলেন, হয়তো রাহবারকে মারতে গিয়ে তার গায়েই ভুল করে মেরে বসেছেন, কিন্তু দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বার যখন আঘাত পড়ল তাঁর গায়ে, তিনি বুঝতে পারলেন, এ আক্রমণের লক্ষ্য তিনি। 
পিতামহী মাটিতে বসে পড়লেন। তাঁর হাটু শরীরের ভার নিতে অস্বীকার করছিল। তিনি মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে পারলেন না, তাঁর চোখ দুটি শুধু হলুদ কিছু আলোর নাচন দেখল। তাঁর শুধু মনে হতে লাগল, দিনটি কি কারণে যেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সকাল থেকে তিনি সেটি ভেবে নিয়ে দিনটির জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। 
পিতামহ তাকে আগে কখনো আঘাত করেনি। প্রশ্নই হয়তো ওঠে না। আমাকে পিতামহী নিজে না বললে আমিও হয়তো বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু তবুও, শেষ পর্যন্ত, পিতামহীর গায়ে চেলা কাঠের প্রহার! আর এমন একটা দিনে, তার কাছে যে দিনটি বিশেষ কোনো কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচিছল সকাল থেকেই। 
ছেলে মেয়েরা মায়ের অবস্থা দেখে হৈ চৈ করে কান্না শুরু করলে পিতামহ সম্বিৎ পেয়েছিলেন কিনা, কে জানে-তিনি কাষ্ঠখণ্ড ফেলে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর আর নিস্তারনামা পড়া হল না। আর কোনোদিনই হল না। শুনেছিলাম, তার নয় বছরের ছেলে সেটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। সত্য মিথ্যা জানি না। পিতামহী অবশ্য বলেন, গোলাম হোসেন ওই কাজ করতেই পারেন না। | তিনি বইয়ের ভক্ত ছিলেন। পরে পন্ডিত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। 
পিতামহ ছেলের নাম রেখেছিলেন গোলাম হোসেন। একটাই ছেলে ছিল তাঁর, সৈয়দ গোলাম হোসেন। আমার এখনো ধারণা, গোলাম হোসেনই নষ্ট করেছিলেন নিস্তারনামা, বাবার ওপর রাগ থেকে। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকত না সৈয়দ গোলাম হোসেনরও। 
আমি পিতামহীকে একটা প্রাসঙ্গিক কথা জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি যে সোজা পিত্রালয়ে চলে গেলেন, ছেলেমেয়েদের হাত ধরে, সেটা কি খুব রাগ থেকে করেছিলেন? 
পিতামহী বললেন, ‘কতটা রাগ ছিল জানি না, কিন্তু অপমানটা বুকে বিঁধেছিল। একটা দুঃখ ছিল। শেষমেষ চলে গেলাম একটা শূন্যতাবোধ থেকে।’ 
তাঁর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। তাঁর কাছে জীবনটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমার angst-পীড়িত পিতামহী আমাকে বললেন । 
আমি বললাম, ‘পিতামহের খুব প্রিয় জিনিস ছিল নিশ্চয়, ওই আতশ কাচের চিমনিটা ওরকম জিনিস আপনাদের সময়ে খুব সহজলভ্য হওয়ার তো কথা নয়।’ 
‘ওরকম চিমনি’, পিতামহী আস্তে আস্তে বললেন, ‘আরো একটা ছিল ওঁর।’ 
পিতামহের ক্রোধটা তাহলে ভিন্ন জায়গায় ছিল। কিন্তু পিতামহী কিছুতেই আমাকে কোনো অনুমান করতে দিলেন না। পুরুষের কিছু বিশেষ ক্রোধ হয়তো থাকে, তার নারীকে নিয়ে। এ নিয়ে আর প্রশ্ন করা কেন?’ 
মনে হল আমি তার কথার হেঁয়ালিটা ধরতে পারলাম। কিন্তু ‘পুরুষের’ কথাটায় আমার হাসি পেল। তিনি সারাজীবনে বাইরের তিনজন পুরুষ দেখেছেন কিনা, সন্দেহ। 
কিন্তু পিতামহের গোপন ক্রোধটা কি এমনই ছিল যে, পিতামহীর পেছন পেছন তালাকনামাটাও তিনি পাঠিয়ে দিলেন? আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, তিনি কেন এরকম চরম একটি কাজ করলেন। বিষয়টা আমি তদন্ত করে দেখেছি, কিন্তু উত্তরগড়ে একজন জীবিত লোকও নেই, বিষয়টা সম্পর্কে জানে। আমার মা অবশ্য বলেন : পিতামহী চলে যাবার সময় বলেছিলেন, এ বাসায় তিনি আর ফিরবেন না। তার চলে যাওয়া পিতামহকে সামাজিকভাবে হেয় করেছিল, তিনি কৌতুকের পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন তাঁর সমাজে, যেখানে স্ত্রীরা স্বামীদের বাড়ি থেকে বেরোতেন একমাত্র লাশ হতে পারলে। মা আরো বলেন । হতে পারে পিতামহীর পিতার ছিল প্রচণ্ড দাপট, অর্থের এবং প্রতিপত্তির। পিতামহী তো পিত্রালয়ে যাননি, বলা উচিত জুড়িগাড়ি পাঠিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর অহংকারী পিতা। মেয়েকে প্রহারের কথা শুনে তিনি ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়েছিলেন। তিনি পণ করেছিলেন, ওই উন্মত্ত লোকের ঘরে মেয়েকে আর ফিরে যেতে দেবেন না । 
তালাকনামা না পাঠিয়ে পিতামহের মুখ রক্ষার আর কোনো উপায় ছিল না, উন্মও হন আর যাই হন। 
“আপনার মনের অবস্থা কেমন ছিল, সে সময়?’ আমি প্রশ্ন করলাম। 
পিতামহী এবার সত্যি সত্যিই বিরক্ত হলেন ! এটা একটা প্রশ্ন হল, করার মত? 
‘আমি জানতে চাইছি, আপনার কি একবারও আনন্দ হয়নি এরকম স্বামীর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে?’ আমার সাফ সাফ প্রশ্ন। তিনি কঠিন চোখে আমার দিকে তাকালেন। তার মাথার আঁচল খসে পড়েছে, চুল উড়ছে হাওয়ায়। তাঁর কপালে ঘাম জমেছে, চোখের নিচে ক্লান্তির স্পর্শ। ক্লান্ত এবং গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি, যেন বাতাস থেকে কিছুটা শক্তি গ্রহণ করতে চাইছেন। তিনি বললেন, ‘হা! আমার আনন্দ দেখে বাবা আবার আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। এমনই আমার আনন্দ!’ 
ছোটবেলায় মা যখন গল্প বলতেন – তিন চারটে গল্পই বলতেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানা climax গুলোও বারবার নতুন শিহরণ জাগাত, অপরিচয়ের আনন্দ দিত – তেমনি শিহরিত হলাম পিতামহীর কথা শুনে। ঘটনাটা আমার জানা, মা’র কাছেই আনুপূর্বক শুনেছি; মা শুনেছেন তার শাশুড়ি অর্থাৎ আমার পিতামহীর কাছে, তিনি আবার শুনেছেন তাঁর মা অথবা পিতামহীর কাছে। গল্পটা জানা, কিন্তু ঘটনার পেছনের ঘটনাগুলো আমার জানার কথা নয়। বস্তুত পিতামহী যে আজকে আমার ঘরে এসেছেন, সে শুধু পিতামহের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নয়, ঘটনার পেছনের ঘটনাগুলো আমাকে জানাতেও। 
বেশ চমৎকার গুছিয়ে বলতে পারলাম, বিষয়টা, ‘ওই ঘটনার পেছনের ঘটনা কথাগুলো ব্যবহার করে! 
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার দ্বিতীয় স্বামীতো খুব বুড়ো ছিলেন, তাই না? 
তিনি অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লেন। 
‘পেশায় হাকিম?’ 
এবার পিতামহী কিছুটা বিরক্ত হলেন। ‘বলেছি তো, তাঁর দরকার ছিল আর একটা হাকিমকে বিয়ে করা। কবরে মানুষটার একটা পা চলে গিয়েছিল, আরেকটা পা আমার হাতে গছিয়ে দিলেন বাবা।‘ 
‘কেন দিলেন? আর কি পাত্র ছিল না?’ 
পিতামহী নিচু হয়ে নখ খুঁটতে থাকলেন। তার চোখ দুটি ভিজে এসেছে। আমি টিস্যু পেপার তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার আব্বাজানের কি দায়দেনা কিছু ছিল সে লোকের কাছে? 
তিনি আলতো করে চোখ মুছে বললেন, ‘বাবা তাঁর কব্জার মধ্যে ছিলেন, তিনি বাবাকে উঠতে বললে উঠতেন, বসতে বললে বসতেন।’ আমার হঠাৎ মনে হল, হয়তো হাকিম কোনো গোপন অসুখের কথা জানতেন পিতামহীর আব্বাজানের, যেটা জানাজানি হলে সমাজে তার মুখটা হয়তো খাটো হয়ে যেতো। তাঁকে নিশ্চয় ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন বুড়ো হাকিম । 
আমি এবার একটা সাহসী প্রশ্ন করলাম পিতামহীকে, যদিও ভয় ছিল অতটা স্বাধীনতা নেয়া ঠিক হবে কিনা, তবে প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম, আমার ভয়টা অমূলক। আমি বললাম, ‘ওই বুড়ো হাকিমের সাথে কখনো কি, ইয়ে, মানে, শয্যাভাগ করেছেন? 
তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন চপেটাঘাত করবেন। কিন্তু তার মুখে একটা রক্তিম হাসি দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘তোমার পিতামহ আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতেন না, যদি ওটা হত।’ 
বছরতিনেক পিতামহের কোনো খবর ছিল না। এত বড় বাড়িটা শূন্য পড়ে রইল। রাহবার মানিক সন্ধ্যের সময় পিদিম জ্বালাত, আর একা বসে বসে নেশা করত। শূন্য ঘরে সে কেঁদে বেড়াত। আমি শুনেছি, বেশি নেশা করলে সে ভাঙা আতশ কাচের একটা টুকরো দিয়ে হাত কেটে রক্ত বের করত। তার ধারণা ছিল ওই কাচের চিমনিটা সে রাতে না ভাঙলে তার পিতা ঘর ছেড়ে যেতেন না, মা ঘর ছেড়ে যেতেন না। প্রসঙ্গত উল্লেযোগ্য, রাহবার মানিকের বয়স ছিল উনিশ, সে বছর। 
তবে কাচের চিমনি ভাঙা আর সংসার ভাঙার মধ্যে যে একটা প্রতীকী যোগাযোগ আছে, সেটি রাহবারের হৃদয়ঙ্গম করার কথা নয়। সে আনপড় ছিল, যাকে বলে unlettered । অথচ আমার পিতামহ মুখে প্রগতির অনেক গল্প করেন। হা প্রগতি! 
তিন বছর পর হঠাৎ একদিন দিনারপুরের বান্দিশ গ্রামে পিতামহীর পিতৃগৃহে এসে হাজির আমার পিতামহ। বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি চেহারার, শুধু চুলটা কাঁধ ছাড়িয়ে গেছে, আর চোখদুটো হয়েছে আরো অস্থির। চোখের তারায় চকমকি পাথরের চমক। দুই ভুরুর মাঝখানে দুটো গভীর আলিফ চিহ্ন। আমার পূর্বপুরুষেরা নিমগ্ন ধরনের মানুষ ছিলেন, রাগীও ছিলেন। মা বলেন, এ রকম যাদের জোড়া আলিফ থাকে ভুরুর মাঝখানে, তারা রাগী এবং নিমগ্নচিত্তের হয়। 
মা সবসময় generalise করে কথা বলতে পছন্দ করেন। তবে পিতামহের প্রাক্তন শ্বশুর তার মধ্যে রাগ বা ক্রোধের কিছু দেখলেন না। পিতামহ তাজিমের সাথেই কথাবার্তা বললেন তার সাথে। তিনি এবার পূবে গিয়েছিলেন, শ্যাম দেশে। সেখানকার সমাজ কতটা এগিয়ে, তারা কতদূর চলে গেছে উন্নতির পথে, অথচ আমরা কোথায় পড়ে আছি, এসব কথা বললেন । পিতামহীর আব্বাজান শরাফতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মাথা নাড়লেন টাড়লেন । কিন্তু এক ফাকে মোটামুটি জানান দিয়ে দিলেন যে, দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে যেন তিনি ফেরত রাস্তা ধরেন। তিনি অবশ্য রেখে ঢেকে এভাবে বললেন, ‘শুনেছি আপনার বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে, যত্নের অভাবে। সে সবের দেখভালে লেগে যান, আজকে থেকে।’ 
পিতামহ মাথা নাড়লেন । কিন্তু দুপুরের আহারের পর বিশ্রাম নিতে গিয়ে তার মনে হল, কিছু নেই, কেউ যেন নেই- আহা! দুধের বাটি নেই, রাহবার মানিক নেই। এবং পরক্ষণেই: হাসিবা নেই, হাসিবা নেই, হাসিবা নেই! 
তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিন বছর আগের ওই দিনের ঘটনা তার মনে পড়ল। বুকের মধ্যে ছাইচাপা ছিল যে আগুন, সে এখন জ্বলে উঠল । তিনি সটান প্রাক্তন শ্বশুর মহাশয়ের দহলিজে গিয়ে উপস্থিত হলেন। শশুর মহাশয় একাই বসে ছিলেন, আলবোলার নল হাতে নিয়ে। পিতামহ কোনো ভণিতা না করে বললেন, ‘আমি একবার হাসিবাকে দেখতে চাই, তার সাথে কথা বলতে চাই। তাকে আজই নিয়ে আসা হোক।’ 
শশুর সাহেবের হাত থেকে আলবোলার নল খসে পড়ল। নাউজুবিল্লাহ’ তিনি বললেন, ‘এমন কথা মুখে আনাও পাপ । হাসিবা এখন অন্যের স্ত্রী, তার সাথে দেখা করার আপনার কোনো অধিকার নেই। এমন বলার’ও আপনার কোনো অধিকার নেই। 
মনে হল, তিনি আদ্যোপান্ত জানতেন আমার পিতামহের মনের খবর, কী জন্য এসেছেন, কী করবেন, কী বলবেন। যেন মহড়া দিয়ে রেখেছিলেন কথাগুলোর। কারণ, বলতে পেরে তাঁর খুব আরাম বোধ হ’ল। 
পিতামহ কো্নো কথা না বাড়িয়ে ফিরে গেলেন, মেহমানখানায় । হাসিবা অর্থাৎ পিতামহী থাকতেন কয়েকশ’ গজের মধ্যে, একই গ্রামে; বস্তুত বাড়িটার গাছগাছালি সেখান থেকে চোখে পড়ে, যেখানে পিতামহ গুম হয়ে বসেছিলেন কিছুক্ষণ, একটা গাছের নিচে। তারপর তার কী মনে হল, লম্বা পা ফেলে বুড়ো হাকিমের বাসার দিকে ছুটলেন। তিনি নিশ্চয় অনুমান করেছিলেন, বেলা চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে, যেহেতু সময়টা গরমের কাল, হাসিৰা পুকুরে নেমে গা ধোবেন। এটি তার বহুকালের অভ্যাস। চারটা থেকে পাঁচটা বললাম, কিন্তু পিতামহের ঘড়ি ছিল সূর্য। বলাই বাহুল্য তিনি সেভাবেই আন্দাজ করলেন। হাসিবা সারাদিন খাটাখাটি করতেন, নিজে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতেন, রান্না বা রান্নার তদারকি করতেন । অনেক অর্থেই তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন। কিন্তু সাড়ে চারটা বাজলেই পুকুরে গিয়ে অনেকক্ষণ গা ডুবিয়ে বসে থাকতেন। তিনি নিজেকে ভাবতেন জলকন্যা; যেন তার চোখের জল থেকে তৈরি হয়েছে পুকুর, এবং সেখানেই তিনি গা ডুবিয়ে আছেন। ‘ডুবে আছি আমি আমার গোপন অশ্রু জলে বা ভাবের দিক থেকে এর কাছাকাছি কো্নো গানও তিনি গুনগুন করে হয়তো গাইতেন। পিতামহ হাকিম সাহেবের বাড়িটা ঘুরে, গাছ বেয়ে, বেড়া টপকে নেমে, পেছনের জেনানা পুকুরের বেড়া ভেঙে ঘাটের বাঁধানো শানের পাশে ঘাপটি মেরে বসে রইলেন। 
অনতিক্ষণ পরে তিনি দেখতে পেলেন, হাতে নানাবিধ বস্ত্র, ক্ষার, সাবান ও স্নানের অন্যান্য উপকরণ নিয়ে হাসিবা আসছেন। পিতামহের হৃৎপিন্ড হয় বন্ধ হয়ে গেল, অথবা এমন লাফ দিল যে, সেটি আর তার নিয়ন্ত্রণে রইল না। 
তাঁর মনে হল, এ দৃশ্যটির জন্য তিনি লক্ষ বছর অপেক্ষা করতে পারেন। পিতামহীর চোখ কিছুটা নিমীলিত, তার কপালে ঘাম, গালে কিছুটা রক্তিম আভা। তাঁকে দেখে আমার ধারণাটি বদ্ধমূল হল, আমার পিতামহ ওই মুহূর্তে কিছুমাত্র উন্মাদ বা জিনে পাওয়া মানুষ ছিলেন না, যেমনটি বলা হয়েছিল তাঁকে বাচিয়ে দেয়ার জন্যে। তাকে আমি কিছুতেই কোনো দোষ দিতে পারলাম না। 
‘আপনার জন্য যে কেউ সে কাজটি করত, পিতামহী’ আমি বলি। 
‘না, যে কেউ তোমার পিতামহের মত হতে পারে না, তিনি আমাকে শুধরে দেন, তার মত কেউ কোনদিন হতে পারে না।’ 
আমি বলতে গিয়েও বলি না যে, এই ভদ্রলােকই আপনাকে চেলা কাঠ দিয়ে প্রহার করেছেন। সেটা ভুলে যাবেন না। 
পিতামহ সজোরে চেপে ধরেছেন পিতামহীর হাত, কিছু বলতে পারছেন না তিনি, শুধু হাসিবা! হাসিবা! করে যাচ্ছেন, যেন অদৃশ্য তসবিহ টিপছেন অদৃশ্য আঙুলে, আর হাসিবা স্থানকালপাত্র বিবেচনা করে চোখে দেখছেন হলুদ আলোর নাচন। 
বলাবাহুল্য তিনিও কাঁপছেন, সামান্য বাতাসে নারিকেলের পাতা যেমন কাঁপে। 
পিতামহীর আব্বাজান জানতেন, সৈয়দ সাহেব কী করবেন, তিনি লোক পাঠিয়েছেন পিছু পিছু। হাকিম সাহেবের দুটো খাস লোক বাড়ির দেখাশোনা করত- ঘোড়ায় চড়ে হঠাৎ হঠাৎ ত্রিপুরা থেকে রাজার লোক বলে পরিচয় দিয়ে কোনো দুর্জন চলে আসত, তাদের ঠেকানার জন্যে। তারাও অনুসরণ করেছে পিতামহকে। তারা খবর দিয়েছে হাকিম সাহেবকে। তিনি খাটিয়া বাহিত হয়ে এসেছেন। পিতামহ হাত ধরে আছেন হাসিবার, হাসিবা কাঁপছেন বাতাস লাগা নারিকেলের পাতা মত, এ দৃশ্য সহজে কল্পনা করা যায় না। যায় না, অর্থাৎ ১৭৮২ সালে। হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল, একটা মহাশোরগোল। পরকীয়া প্রেম- আহা! মাটিতে অর্ধেকটা শরীর পুঁতে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান আছে। গর্হিত কাজ, একেবারেই। 
পরকীয়া! কথাটার ভিতরেই যেন নিষেধের একটা পাহাড়। অথচ কী আকর্ষণ, প্রতিটি অক্ষরে! 
আমার পিতামহ টের পেলেন, অক্ষরে অক্ষরে, বিষয়টা তিনি কোথায় নিয়ে এসেছেন। 
পাত্রপাত্রী যেহেতু সামান্য নন, শাস্তিটাও তাই অসামান্য কিছু হল না। হাসিবা ফিরলেন পিতৃগৃহে এবং ফেরার সময় তার মুখে স্বর্গীয় আলো দেখা গেল। ছেলেমেয়েরাও ফিরল, তারা ওই বুড়ো হাকিম থেকে বুড়ো নানাজানকেই অধিক পছন্দ করতেন। কিন্তু গোল বাঁধালেন আমার পিতামহ। 
তিনি আবার নিরুদ্দেশ হলেন। 
কোথায় গেল, কেউ জানল না । হঠাৎ করেই পিতামহী আমাকে জানালেন, পিতামহ আমার বাসায় আসবেন, আজ রাতে, আমি যেন একটা চেয়ার পেতে রাখি। তিনি নিজে এসেছেন, আগেই বলেছি, মেথি দিয়ে চুল ধুয়ে, ভাল একটা জরির কাজ করা রেশমি শাড়ি পড়ে। একটা সুগন্ধী মেখেছেন, কিন্তু ঠাহর করতে পারছি না সেটি কী। তিনি মাথায় টিকলির মত একটা অলংকার পরেছেন, গলায় হার, কানে দুল, নাকে হীরের নাকফুল। তাকে দেখতে লাগছে মনসুরের আকা মনসুরের আঁকা শাহজাদীর মত। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, এক গ্লাস পানি চেয়ে নিয়ে খেয়েছেন পিতামহী। আমার মনে হল, তিনি কিছুটা যেন নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। তাঁর জীবনে অভিজ্ঞতা প্রচুর হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর বয়সটাই বা এমন কী। তিরিশও তো পার হয়নি । আর আমার পিতামহ, যাকে দেখে আমি ঘাবড়ে যাই, অত উঁচু মাথার মানুষ, তিনিও কি চল্লিশ পার হয়েছেন? আমার ছেলে দেখহি তার মত উঁচু মাথার হচ্ছে, আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। 
পিতামহ ঘরে ঢুকে আমার দিকে কিছুক্ষণ কঠোর চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঈদের দিনে যে রকম কোলাকুলি করে মানুষ, সে রকম বুক মেলালেন। পেশীবহুল, শক্তিশালী মানুষ তিনি, ময়লা, তামাটে রঙ গায়ের, যেন সারাদিন রোদে পোড়া ছাড়া তার করার কিছু নেই। তাঁর ঘন কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো, মুখে দাড়ি, চোখ দু’টি চকমকি পাথরের মত উজ্জ্বল, কপালে রেখা এবং দুভুরুর মাঝখানে জোড়া আলিফ। 
রাগী এবং নিমগ্ন চিত্তের মানুষ, আমার মনে পড়ল। 
পিতামহীর মুখের ওপর সবটা আলো যেন পড়েছে এ ঘরের – সাদা এবং উজ্জ্বল তার মুখ, যেন হেমন্ত দুপুরের আকাশ । তাঁর চোখের তারা নাচে, তার ঠোট দুটি কাঁপে যেন তাঁর ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছে। মাথা নিচু করে পিতামহী বলে থাকেন, তাঁর টিকিলিতে আলো প্রতিফলিত হয়। 
আমার রাগী পিতামহ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। 
কখন এলেন? তিনি জিজ্ঞেস করেন। 
তিনি জিজ্ঞেস করেন, এত নরম এবং গভীর গাঢ় স্বরে, যেন বহুলর একটি ঝর্ণা ঝরে। পড়ছে, তার শব্দটি এখানে এসে পৌছাচ্ছে যেন বহু গাছগাছালির মধ্য দিয়ে, বুনো ঝোপ, আর আকন্দ-জুঁই ফুলের গন্ধের মধ্য দিয়ে । আমি অবাক হয়ে যাই। আমি বিশ্বাস করতে পারি না, এ মানুষটি এত রাগী? এতটা উন্মাদ? এতটা অমানুষ? 
আমি তার দিকে তাকাই। তার মুখে নানা কষ্টের চিহ্ন, তাঁর গলার পাশে পুরনো একটা গভীর ক্ষতের দাগ, যেন কেটে গিয়েছিল বিশ্রীভাবে। তাঁর হাত দুটি আলতো করে রাখা আমার প্রিয় আরাম কেদারার হাতলে। তার গায়ে লম্বা সাদা কুর্তা, মাথায়। একটি কালো পাগড়ি, তার চোখ দুটিতে ভর করছে শ্রাবণের সব মেঘ, কালো এবং অন্ধকার হয়ে আসে তার চোখ। 
আমি কিছু একটা বলতে চাই। পিতামহী মাথা নিচু করে নখ খোঁটেন, তার সাথে চোখাচোখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বরং পিতামহকেই জিজ্ঞেস করি, ‘কিছু দিই আপনাদেরকে, এককাপ চা?’ বলেই আমার ভুল ভাঙে, চায়ের নাম কি কোনোদিন শুনেছেন তাঁরা? আমি নির্বোধের মত নিজে নিজে হাসি এবং অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাবার জন্য বলি, ‘এক গ্লাস দুধ দিই, আপনাকে?’ 
পিতামহ হাতের ইশারায় নাকচ করে দেন সে প্রস্তাব। একটু ঝুঁকে তিনি বলেন পিতামহীকে, ‘আমি দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, হাসিবা, আমার নেশা ছেড়ে দিয়েছি। শুধু ছাড়তে পারিনি একটা নেশাকে।’ 
আমি তার কথাবার্তা শুনে কিছুটা হতাশ হই। সাধারণ মানের সব কথাবার্তা, সস্তা গল্পের ডায়ালগের মত । কিন্তু পিতামহীর দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে যাই। এই নেশার কথাটা যেন তাকেই নেশা ধরিয়েছে। তার মুখ লাল হয়ে গেছে, মাথাটা আরো নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়েছে । হাতের নখ খুঁটে যাচ্ছেন এত জোরে যেন নখটা এখনই উপড়ে ফেলবেন। আমি উঠে দাঁড়াই। আমি বেরিয়ে আসি ঘর থেকে, তারা সেটা টের পান না। আমি বেরিয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দেই, তারা সেটা টের পান না। তাঁরা নেশার কথা বলেন, নেশার কথা শোনেন। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত