পুরুষের চোখে নারী হয় বেশ্যা নয়ত দেবী
জারিফা জাহান
“Women are already strong.It’s about changing the way the world perceives that strength.”
– G.D. Anderson
একটা ছোট্ট সবুজ বিন্দু। গোলাকার তবে আয়তন নগণ্য। নেট পরিভাষায় এই প্যাচপ্যাচে ক্রেডেনশিয়াল মানেই ‘অন’, ডিফল্ট স্টেটাস তারসাথে, ‘অ্যাভেলবল’… যেন চায়ের সাথে টা এর মত লেজুড় এরা একে অপরের।
এখন অ্যাকাউন্টের মালিক যদি ‘মালকিন’ হন, তখন এই সবুজ স্টেটাসটি হয় পাখির চোখ। কিছু পুরুষতন্ত্র রক্ষাকারী (এবং অবশ্যই ফেকুগণ) এক্কেবারে ‘মেল গেজ’ এর জোব্বা চাপিয়ে নিজেদের উৎসর্গ করেন ‘মিশন মেয়েতোলা’য়। চেনা গল্পের প্লটে ধাপে ধাপে আসে চ্যাট, ছবিতে কমেন্ট, ফোন নং, প্রোপোজাল…। সবজান্তাদের বিচারে, এ হলো গ্রিন সিগন্যাল। চ্যাটবিন্দুতে সবুজ মানেই টংকার, চ্যাট বক্স নামক রাস্তায় সিগন্যাল সবুজ হলেই কমনসেন্সকে পুঁটুলি পেতে দক্ষিণের কোনে মাটিচাপা দিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হেঁটে যেতে হয় অনুমতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। আর যেখানে যখন ধাক্কা খাবে, সে মেয়েকে ‘তুলে’ ভয় দেখাবে, গালাগালি, ধর্ষণের হুমকি, নিদেনপক্ষে হাতের কাছে অ্যাসিড থাকলে তো পোয়াবারো, ছিপি খুললেই তোমার একদানে কিস্তিমাৎ।
১-১.৫ কেজির গ্রে ম্যাটারহীন খুপরিতে কোথাও একটা বাসা বাঁধে অনিশ্চয়তার মাকড়সা জাল, নারীর ছাপিয়ে যাওয়ায় ভয়ের ঝুল জমে আরো পুরু হয় সে মস্তিষ্কে। অন্ধকারের শাহেনশাহ তাই সদর্পে হাজির হন টেস্টোস্টেরনের আধিপত্যদর্শনে, সবুজ বিন্দুটির আক্ষরিক অর্থ বোঝাতে হয় সেই ‘টার্গেট’ কে, সে মেয়ে তো ‘অ্যাভেলবল’ … প্রমাণ করতেই হয় তাকে।
মেয়ের গলা টিপে দিতে হয় যদি সে প্রতিবাদ করে, যদি সে ‘না’ বলে, আর এ ব্যাপারে তো জলভাত, কলঙ্কের বিটুমিন- ‘রেপ থ্রেট’। বাচ্চা থেকে বুড়ি, আমজনতা থেকে কবি- সবার ‘ইকুয়াল রাইট’ চেকলিস্টটিতে।
পুরুষের চোখে হয় নারী ‘বেশ্যা’, তাদের সম্ভ্রম পুরে রাখা হয় যোনিতে, পুরুষসিংহের নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী এই ‘সম্ভ্রম’ই একটি মেয়ের চরিত্রের বিশুদ্ধতার মাপকাঠি(তাই ‘নষ্ট’ হওয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে দমিয়ে রাখা যায়) আর না হয় পুরুষের কাছে নারী সম্বন্ধীয় অতিভক্তি ফেতিশিস্টিক, সে দেবী এবং মা। অথচ প্রতিটা মেয়েই সাধারণরূপে অসাধারণ- নারী পরিচয়ের প্রাপ্য সম্মানটুকুই শুধু তার চাহিদা।
এইটুকু পড়েই এবার যারা আমায় শাপশাপান্ত করতে আসবেন, তাদের মধ্যে অবধারিত কিছু কমেন্ট এর উত্তর আগাম দিয়ে রাখি।
‘সব পুরুষ সমান নয়’
আমিও ১০০ শতাংশ সহমত। বিশ্বাস করুন, দুনিয়াটা ধর্ষক-প্রতারক এ গিজগিজ করছে, মাথা তোলার জায়গা নেই… এই ভয়ঙ্কর ভাবনাটা আমি মিউট বোতামের হিমঘরেই রেখে দিতে চাই, নাহলে এ দেশে বাপি সেনরা থাকতো না। তবে শুধু এই মুষ্টিমেয় বিকৃতমনস্ককে জুজু ভেবে দেশের প্রতিটা মেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে কেন? এই ‘সমান নয় পুরুষ’রা কি শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল চৌহদ্দিতেই বদ্ধ? তাহলে এক বছরে ৩৫০০০ রেপ কেস কীভাবে নথিবদ্ধ হয়? বছরে ৩০০ র উপর অ্যাসিড হামলা চলে ‘বদলা’ নেওয়ার খেলাঘর হিসেবে?
‘তোমার বাবা-ভাই ও তোমার মতে খারাপ?’
ঐ যে বললাম, সবাই খারাপ জিনিসটা একদম সোনার পাথরবাটির মিথ। যে লোকেরা কৃমিকীট, তারাও আদতে কারোর বাবা কারোর ভাই, তবে কি তারা শুধুমাত্র নিজেদের লোকের কাছেই নিরাপদ? সেই হিসেবে তো সব মেয়েই কারও না কারও মা-বোন-দিদি। তাহলে সেই মেয়েরা কি শুধুমাত্র সম্মানীয়, শুধুমাত্র নিজেদের লোকের কাছে?
কেউ ধর্ষক হয়ে জন্মায় না বা অ্যাসিড হামলাকারীর মুকুটে পৌরুষত্বের বাইসেপ প্রদর্শিত হয় না দুনিয়ার আলো ছুঁতেই। দায়ী মানসিকতা, পরিবর্তন দরকার পেট্রিয়ার্কল সামাজিকতার, তাকে কালো প্লাস্টিক পরিয়ে পিছনের দিকে হাঁটলেই আমাদের ঘুম ভাঙা পাল্টে মানবতাবাদের কনোসিউরের পুনর্জন্ম না হোক, মেয়েদের ‘অসম্মানিত’ হওয়ার ভয়ে চোখে শ্যাওলা(তারও রং সবুজ) জমার নিয়ম বন্দী থাকবেনা উদ্বাস্তু পেশীপ্রদর্শনের উগ্রতায়।
