রবীন্দ্র বিরোধিতার স্বরূপ: পাকিস্তান পর্ব

Reading Time: 3 minutes

১.

পাকিস্তানের জন্মমৃত্যুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িত। পাকিস্তান শুধু একটা রাষ্ট্র নয়-একটা পন্থাও বটে। এই পাকিস্তানপন্থা মানুষের সম্প্রীতির জায়গাটি ভেঙে দিতে চেয়েছে-চেয়েছে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি চাগিয়ে তুলতে। উদ্দেশ্য বাঙালি নামক একটা বিকাশমান জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে শেষ করে ফেলা। একটি নিরঙ্কুশ উপনিবেশ কায়েম করার লক্ষ্যে জাতি হিসাবে বাঙালিকে পঙ?গু করে দেওয়া।

খুব কঠিন কথা। কিন্তু সরল সত্যি। তারা পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই পন্থাটিকে হাজির করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভেতর দিয়ে। তারা ধর্মকেই রাষ্ট্র গঠনের ও জাতীয়তা নির্ধারণের একমাত্র নীতি হিসাবে গ্রহণ করে। এই নীতির মধ্যেই পাকিস্তানের জন্ম ১৯৪৭ সালে। মৃত্যু ১৯৭১ সালে। এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে পাকিস্তানের ভূতটির আছর দেখা দিচ্ছে।

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লীগ ভারতের মুসিলম প্রধান অঞ্চলগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের দাবী উত্থাপন করেছিল। বলা হয়েছিল , এই রাষ্ট্রসমূহের অন্তর্ভূক্ত ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্বশায়িত এবং সার্বভৌম। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে অন্য এক প্রস্তাবে, ভারতের উত্তর-পূর্বে বাংলা ও আসাম, উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান, প্রভৃতি ব্যাপক মুসলমান জনঅধ্যূষিত অঞ্চলগুলুসহ একটি মাত্র সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বস্তুত এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই প্রণীত হয়েছিল পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের স্থায়ী উপনিবেশ পরিণত করার গোপন ও সুপরিকল্পিত সনদ। তারা বলে, যেহেতু মুসলমান আন্দোলেনর ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলাই হবে যুক্তিসঙ্গত। অথচ মুসলিম লীগ এবং এর নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই ধর্মানুরাগী ছিলেন না। কিংবা ইসলামের কোনোরূপ উৎকর্ষ সাধনও তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা তাঁদের শোষণ কৌশলকে কার্যকর করার লক্ষ্যে ইসলাম ধর্মের একটি রাজনৈতিক সংস্করণ বের করে ফেলে। ধর্মকে যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয় তখন তারা ফ্যাটসীবাদে পরিণত হয়।

পাকিস্তানের সূচনাতেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে মুসলিম লীগ যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়, মূলত তা ছিল এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামান্তর। ১৯৪৭ সালের পরেও এই দাঙ্গা স্থায়ী হয়েছিল। ফলে এই ভেদরাজনীতির বাইরে অবস্থান করেও অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়– দেশচ্যূত হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির বছর খানের মধ্যেই প্রথম আক্রান্ত হয় বাংলা ভাষা। শুরু হয় ভাষা সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা সে আক্রমণ প্রতিরোধ করে। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য থেকেই বাঙালী আত্মপরিচয় ফিরে পায়। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটে। বুঝতে পারে দ্বিজাতিতত্বের অসারতা এবং কপট রাজনীতির হিংস্রতা। বাঙালি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানপন্থার নাগপাশ থেকে মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হতে শুরু করে। এই মুক্তির আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ সহায় হয়ে উঠেন।

পর্যায়ক্রমে পাকিপন্থা শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা পূর্ববাংলায় একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদি গ্রুপও তৈরি করে ফেলে। তাদের সহায়তায় কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা হরফ পরিবর্তন, বাংলা ভাষার ইসলামী রূপদান এবং বাংলা ভাষা সংস্কার প্রভৃতি জঘণ্য কাজ শুরু করে। আক্রান্ত হন রবীন্দ্রনাথ। কালক্রমে ১৯৭১ সালে পাকিপন্থা বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষ। ধর্ষিতা হয় ৩ লাখ নারী। দেশত্যাগের শিকার হয় এক কোটি বাঙালি। এর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভুমিষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।

রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালী জাতিসত্তার সঙ্গে এত প্রখরভাবে প্রবলভাবে প্রাণবন্ত হয়ে সঙ্গী হবেন-সেটা পাকিপন্থা গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল বলেই পাকিস্তানের জন্মর পরপরই রবীন্দ্রবিরোধিতার বীজটি রোপণ করে।

২.

পাকিস্তান শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। এর পরিকল্পনা হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই। ১৯৪১সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়।

একাত্তরের পাকবাহিনীর সহযোগী সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন একাত্তরের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন–

আমাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলা ভাষায় মুসলিম কালচারের পরিচয় থাকে এমন সাহিত্য সৃষ্টিতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করা। একই সময় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়্যারম্যান নির্বাচন করা হয়। সে সময় এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ লেখেন, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন তারা দেখছেন-সেখানে যে বাংলা ভাষা চালু থাকবে , সে ভাষার চরিত্র হবে হিন্দুত্ব বর্জিত।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে গেল। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা নয়-একমাত্র উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করবে তারা পাকিস্তানরে শত্রু।

সে সময় পূর্ববঙ্গে মাত্র ১.৫২% মুসলমান অধিবাসী ছিলেন বিদেশাগত। এরা ছিলেন ধনী এবং বাস করতেন শহরে। ছিলেন উর্দুভাষী। অধিকাংশ উর্দুভাষীরা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। আর ৯৮% মুসলমান বাস করতেন গ্রামে। এরা কথা বলতেন বাংলা ভাষায়। জীবিকার জন্য নির্ভর করতেন জমির উপর। জোলা, দরজি, ঘরামি, কশাই ইত্যাদি পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন অনেকে। যথারীতি উর্দুভাষী গ্রামবাসী গরীব চাষাভূষো মুসলমানদের আতরাফ বা নিম্নশ্রেণীর বলেই গণ্য করতেন।

ভাষাতাত্ত্বিক গ্রিয়ারসন আলোচনায় মন্তব্য করেন যে, গ্রামের নিম্নশ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমানদের ভাষায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থাকলেও ভাষাগত কোনো পার্থক্য ছিল না, অল্প কিছু ধর্মীয় শব্দ ছাড়া।

এসব সত্ত্বেও তারা মনে করছেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি নাও হয় তাহলেও অন্তত: সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান তর্কাতীত।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>