| 24 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক এবং মৌলবাদী প্ররোচনা । অসীম সাহা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

খুব ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুল ইসলামের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে নজরুলের মতো এত বড় মাপের একজন কবি নোবেল প্রাইজ না পেতে পারে। এটা শুনে যেমন বিস্মিত হই, তেমনি স্তম্ভিতও হই। কিন্তু এ নিয়ে বেশি তর্ক করতে গেলে অনেক সময় নানা ধরনের মৌখিক আক্রমণের শিকার হতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

যারা এ ধরনের কথা বলেন- তাদের যুক্তি, রবীন্দ্রনাথ যেহেতু হিন্দু (আসলে তিনি একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী) ছিলেন, সেহেতু মুসলমান বলে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে তিনি এ ধরনের একটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এককথায় সাম্প্রদায়িক। রবীন্দ্রনাথ কতটা সাম্প্রদায়িক ছিলেন, সেটা বোঝাবার জন্য ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী একটি বুকলেট প্রকাশ করেছিল, যেখানে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা থেকে নানা ধরনের উদ্ধৃতি তুলে ধরে তারা দেখানোর চেষ্টা করেছিল, রবীন্দ্রনাথ শুধু নজরুল ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্নই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে একজন সাম্প্রদায়িক হিন্দু।

অথচ তারা মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথের বৃহত্তর মানবসত্তার বিশ্লেষণ না করে এবং নজরুলের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত গভীর সম্পর্কের ইতিহাসের কথা না জেনেই শুধু একটি নিকৃষ্ট ধর্মীয় মৌলবাদী উদ্দেশ্য থেকেই যে একটি জঘন্য অভিযোগের পাথর রবীন্দ্রনাথের বুকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, যারা রবীন্দ্রনাথকে খুব মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছেন, যারা রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ, সমালোচক; এমনকি যারা নজরুল-বিশেষজ্ঞ ও নজরুলের প্রকৃত ভক্ত, তারাও নানা ধরনের ইতিহাস, রবীন্দ্রজীবন এবং তার রচনাগুলো পাঠ করে নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন, কখনও কখনও নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিংবা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের মতের অমিল হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক শুধু মধুরই ছিল না, তার চেয়ে আরও গভীরতর ছিল।

এ কথা সত্য, কখনও কখনও নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোন কোন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে, দু’একবার তিক্ততরও সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ভূমিকা যতটুকু ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিছু মানুষের বিভ্রান্তিমূলক প্ররোচনা। এর মধ্যে সজনীকান্ত-মোহিতলাল মজুমদারও ছিলেন। মোহিতলালের কবিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। তাই তার প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘মোহিতলাল সাধারণের কাছে ইতিমধ্যে খ্যাতিলাভ করেছেন। এই খ্যাতির কারণ তার অকৃত্রিম পৌরুষ। অকৃত্রিম বলছি এজন্য, তার লেখায় তালঠোকা পাঁয়তারা মারা পালোয়ানি নেই। যথার্থ যে বীর সে সার্কাসের খেলোয়াড় হতে লজ্জাবোধ করে। পৌরুষের মধ্যে শক্তির আড়ম্বর নেই, শক্তির মর্যাদা আছে, সাহস আছে, বাহাদুরি নেই।’

আর একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথ শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের দরিদ্রজীবনের অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত কথাসাহিত্যের প্রশংসা করতে গিয়ে যে কথাগুলো বলেন, তাতে অনেকের কাছে মনে হয়েছে, ‘দারিদ্র্য’ নামে কবিতাটি লিখে নজরুল ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান/তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান’ বলে দারিদ্র্যকে মহিমন্বিত করার যে চেষ্টা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ বুঝি তাকেই কটাক্ষ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছেন, ‘দেখেছি দরিদ্র জীবনের যথার্থ অভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে লিখবার শক্তি তার আছে বলেই তার রচনায় দারিদ্র্য ঘোষণার কৃত্রিমতা নেই। তার বিষয়গুলি সাহিত্যসভার মর্যাদা অতিক্রম করে নকল দারিদ্র্যের সখের যাত্রাপালায় এসে ঠেকেনি। নবযুগের সাহিত্য নতুন একটা কাণ্ড করছি জানিয়ে পদভাবে ধরনি কম্পমান করবার দাপট আমি তার দেখিনি…।’

শৈলজারঞ্জনের কবিত্বশক্তির প্রশংসা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘তালঠোকা পাঁয়তারা মারা পালোয়ানি নেই। যথার্থ যে বীর সে সার্কাসের খেলোয়াড় হতে লজ্জাবোধ করে। পৌরুষের মধ্যে শক্তির আড়ম্বর নেই, শক্তির মর্যাদা আছে, সাহস আছে, বাহাদুরি নেই।’ বলার ফলে বিশেষভাবে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল এবং নজরুলও ধরেই নিয়েছিলেন তার বিদ্রোহ এবং দারিদ্র্যকে ব্যঙ্গ করার জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমন কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মনের কথা তো আর কারও জানার কথা নয়। কিন্তু নজরুল রবীন্দ্রনাথের এ ধরনের বক্তব্যে কতটা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তা জানা যায় যখন তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনেকটা আক্রমণের ঢংয়েই বলেন, ‘আরও একটা কথা। যেটা সম্পর্কে কবিগুরুর একটা খোলা কথা শুনতে চাই। ওর আমাদের উদ্দেশ্য করে আজকালকার লেখাগুলো শুনে মনে হয়, আমাদের অভিশপ্ত জীবনের দারিদ্র্য নিয়েও তিনি যেন বিদ্রুপ করতে শুরু করেছেন। আমাদের এই দুঃখকে কৃত্রিম বলে সন্দেহ করার প্রচুর ঐশ্বর্য তার আছে জানি এবং এও জানি, তিনি জগতের সবচেয়ে বড় দুঃখ ওই দারিদ্র্য ব্যতীত হয়তো আর সব দুঃখের সঙ্গেই অল্প বিস্তর পরিচিত। তার কাছে নিবেদন তিনি যত ইচ্ছা বাণ নিক্ষেপ করুন তা হয়তো সইবে; কিন্তু আমাদের একান্ত আপনার এই দারিদ্র্য-যন্ত্রণাকে উপহাস করে যেন আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে না দেন। শুধু এই নির্মমতাটাই সইবে না।…’

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নজরুলের এই যন্ত্রণাবিদ্ধ বক্তব্য প্রদানের পেছনে মুসলিম লেখকদের অনেকেরই যে প্ররোচনা ছিল, তাতে সন্দেহ থাকার কোন কারণ নেই। তারা তো চাইছিলেনই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দূরত্ব তৈরি হোক। নজরুলের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তারাই আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এতে আগুনে ঘৃতাহুতির মতো রবীন্দ্রনাথের আরও একটি বক্তৃতা, যেটা তিনি দিয়েছিলেন ১৯২৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি কলেজে তাকে প্রদত্ত সংবর্ধনা-সভায়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, “সৃষ্টির শক্তিতে যখন দৈন্য ঘটে, তখনি মানুষ তাল ঠুকে নতুনত্বের আস্ফালন করে। পুরাতনের পাত্রে নবীনতার অমৃতরস পরিবেশন করবার শক্তি যাদের নেই, তারা শক্তির অপূর্বতা চড়া গলায় প্রমাণ করবার জন্য সৃষ্টিছাড়া অদ্ভুতের সন্ধান করতে থাকে। সেদিন কোন একজন বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে দেখলাম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন ‘খুন’। পুরাতন ‘রক্ত’ শব্দে তার রাঙা রং যদি না ধরে তা হলে বুঝব সেটাই তার অকৃতিত্ব। তিনি রং লাগাতে পারেন না বলেই তাক লাগাতে চান। আমি তরুণ বলব তাদেরই, যাদের ঊষাকে নিউমার্কেটে ‘খুন’ ফরমাস করতে হয় না।” রবীন্দ্রনাথের এ কথা নজরুলকে আরও বেশি ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।

তিনি লিখেছিলেন, ‘কবির চরণে ভক্তের সশ্রদ্ধ নিবেদন, কবি তো নিজেও টুপি-পায়জামা পরেন, অথচ আমরা পরলেই তার এত আক্রোশের কারণ হয়ে উঠি কেন, বুঝতে পারিনে। এই আরবি-ফার্সি শব্দ প্রয়োগ শুধু আমিই করিনি। আমার বহু আগে ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রভৃতি করে গেছেন।…

আজ আমাদের মনে হচ্ছে, আজকের রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই চিরচেনা রবীন্দ্রনাথ নন। তার পেছনের বৈয়াকরণ পণ্ডিত এসব বলাচ্ছে তাকে।’

আসলে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে ভুল বুঝে নজরুল এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তিনি তার কবিতায় ‘খুন’ শব্দের প্রয়োগ করতে গিয়ে আÍপক্ষ সমর্থন করে আরও বলেন, ‘খুন শব্দটি আমি ব্যবহার করি আমার কবিতায়, মুসলমানি বা বলশেভিকী রং দেয়ার জন্য নয়। হয়তো কবি ও-দুটোর একটারও রং আজকাল পছন্দ করছেন না, তাই এত আক্ষেপ তার। আমি শুধু খুন নয়, বাংলায় চলতি আরও অনেক আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছি আমার লেখায়। আমার দিক থেকে ওর একটা জবাবদিহি আছে। আমি মনে করি, বিশ্ব কাব্য-লক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং আছে। ও সাজে তার শ্রীহানি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। …যে খুনের জন্য কবিগুরু রাগ করেছেন, তা দিনরাত ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তা খুন করা, খুন হওয়া ইত্যাদি খুনাখুনি ব্যাপারেই নয়, হৃদয়েরও খুন-খারাবি হতে দেখি আজও এবং তা শুধু মুসলমানপাড়া লেনেই হয় না।’

এই বিতর্ক হয়তো আরও অনেকদূর পর্যন্ত গড়াত; কিন্তু প্রমথ চৌধুরী একটি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের যেন আর অবনতি না ঘটে তার জন্য ‘আÍশক্তি’ পত্রিকাতেই ‘বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা’ শীর্ষক একটি রসাÍক রচনার মাধ্যমে নজরুলের ভুল অপনোদনের চেষ্টা করেন। নজরুলকে উদ্দেশ্য করে ‘খুন’ সম্পর্কে যে রবীন্দ্রনাথ তার বক্তব্য রাখেননি এবং এটা যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নজরুলের ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত তা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘এ সন্দেহ আমার মনে উদয় হয়নি, যে সভায় তিনি কথা বলেন সে সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, কোন উদীয়মান তরুণ কবির নবীন ভাষার উদাহরণস্বরূপ তিনি খুনের কথা বলেন। কোন উদিত কবির প্রতি তিনি কটাক্ষ করেননি।’

প্রমথ চৌধুরীর এ লেখা নজরুলের মনের ক্রোধকে অনেকাংশেই প্রশমিত করে। তিনি প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার আগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। মৌলবাদীদের মনোবাসনা অপূর্ণই থেকে যায়।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক, এটা মৌলবাদী মুসলমানরা যেমন চাননি, তেমনি চাননি মৌলবাদী হিন্দুরাও। তাই এদের দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য দুই পক্ষ থেকে নানা ধরনের সমালোচনা, আক্রমণ এবং ষড়যন্ত্রও অবিরামভাবে চলে আসছিল।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই মুসলিম মৌলবাদীরা নজরুল শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন প্রভৃতি রচনা করার কারণে তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ‘কাফের’ বলতেও দ্বিধা করেননি। বিভিন্ন মুসলিম সম্পাদিত পত্র-পত্রিকায় তাকে হিন্দুদের পোষ্য বলে আক্রমণ করছেন। তারা চেয়েছিলেন, নজরুল শুধু মুসলমানদেরই থাক, ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ হিসেবে মেনে নিয়ে তিনি যে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদেরই অপমান করছেন, সেটা জানিয়ে দিতেও তারা কসুর করেননি।

কিন্তু যে কবি মানবতার কবি, যে কবি ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করতে বাধ্য হন এবং দীর্ঘদিন অনশন করার ফলে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে যাওয়ার ফলে রবীন্দ্রনাথ যাকে অনশন ভঙ্গ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখে অনুরোধ জানান, ‘তাকে শুধু অমুসলিম বলে পরিত্যাগ করার মতো অনুদারতা দেখানো রবীন্দ্রনাথের মতো মানবতাবাদী কবির পক্ষে যে কিছুতেই সম্ভব নয়, সেটা আর কেউ না বুঝলেও নজরুল অন্তত বুঝতে পেরেছিলেন।

নজরুল যাতে ‘হিন্দু-সংস্কৃতি’র বলয় থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে শুধু মুসলমানদের জন্য কাজ করেন, তার জন্য মাওলানা আকরম খাঁ, ইব্রাহীম খাঁসহ আরও অনেকেই তৎপর ছিলেন; কিন্তু কমরেড মুজফফর আহমদের সংস্পর্শে এসে সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার কারণে, তার পক্ষে এ ধরনের একটি সংকীর্ণ চিন্তার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাই ইব্রাহীম খার মতো একজন বিজ্ঞ মুসলিম লেখক যখন নজরুলকে চিঠি লিখে আবেদন জানিয়েছিলেন, ‘আজ তোমায় কয়টি কথা বলব, গুরুরূপে নয়, ভাই রূপে, ভক্ত রূপে। …কথাগুলি বুকের তলে অনুদিন তোলপাড় করছে। …সমাজ (মুসলিম সমাজ) মরতে বসেছে, তাকে বাঁচাতে হলে চাই সঞ্জীবনীসুধা, কে সেই সুধা হাতে এনে এই মরণোসন্মুখে সমাজের সামনে দাঁড়াবে, কোন সুসন্তান আপন তপোবনে গঙ্গা আনয়ন করে এ অগণ্য সাগরগোষ্ঠীকে পুনর্জীবন দান করবে, কাঙাল সমাজ উৎকণ্ঠিত চিত্তে করুণ নয়নে সেই প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে। কে জানি না, কিন্তু মনে হয়, তোমায় বুঝি সে সাধনার বীজ জমা আছে। হাত বাড়াবে কি? ইব্রাহীম খাঁ (‘ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত-শাহাবুদ্দীন আহমদ)।

ইব্রাহীম খাঁ এ চিঠিতে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের প্রতি নজরুলকে ভূমিকা রাখার জন্য যে আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন, তার উত্তরে নজরুল যে কথা বলেছিলেন তা মৌলবাদী মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত তো হয়ইনি, উপরন্তু তারা তাকে হিন্দুসংস্কৃতির ক্রীড়নক বিবেচনায় এমন সব আক্রমণাÍক আলোচনা-সমালোচনা করেছিলেন, যা নজরুলের চরিত্র হননের জন্য শুধু যথেষ্ট নয়, ভয়ংকরও বটে।

কিন্তু উভয় পক্ষের কোন মৌলবাদীই তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারেননি। তারা কেউই শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হননি। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে মানবতাবাদী কবি নজরুল কেন শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কবি হিসেবে বেঁচে থাকবেন? তার সাধনা যেখানে মানুষ হওয়ার সাধনা, সেখানে রবীন্দ্রনাথের মহামানব হওয়ার মিলনতীর্থে একত্রিত হওয়ার সাধনাই তো তার জীবনের লক্ষ্য হবে। রবীন্দ্রনাথ যতই পূজা পর্যায়ের গান লিখুন কিংবা নজরুল যতই শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন, গজল, গীত কিংবা ইসলামী গান রচনা করুন, তা তো তারা করেছিলেন সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার কথা মনে রেখেই। আপাতভাবে সেগুলোতে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও তা কখনও তাদের মানবতাবাদী সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

আজ এত বছর পরে এসেও মৌলবাদী মানসিকতার ধারক-বাহকরা রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক নিয়ে তাদের বিভিন্ন রচনায় রবীন্দ্রনাথকে যেমন আক্রমণ করে চলেছেন, তেমনি আক্রমণ করছেন নজরুলকেও। কিন্তু মানবতার সত্য মৃত্তিকার ভেতরে এমন গভীরভাবে প্রোথিত যে, তার শেকড় উৎপাটন করা মৌলবাদী কেন, কারও পক্ষেই কোনদিন সম্ভব নয়। আর সেটা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে মৌলবাদীদের হাজার প্ররোচনা সত্ত্বেও এই দুই মহৎ কবি চিরকাল বাঙালি জাতির হৃদয়ে ক্রমাগত ভাস্বর হয়ে উঠতে থাকবেন, এ কথা খুব জোরের সঙ্গেই বলা যায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত