| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

সাম্প্রদায়িকতার আখ্যানে রবীন্দ্রনাথ – হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

আমার এ লেখাটি নিয়ে চিন্তার সলতে জ্বালিয়েছে ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ (১৮.০১.২১) ‘যেন লজ্জা স্বীকার করি’। দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর লেখায় মূলত তিনটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন – (১) ‘ফেক’ নিউজ’, (২) কর্তিত বা খণ্ডিত উদ্ধৃতি – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মতো স্রষ্টার যাঁর সৃষ্টি সম্ভার বিপুল, এবং (৩) ইতিহাসের কোন বিশেষ সময়ক্রমে কোন উক্তি বা বক্তব্য জন্ম নিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে। তৃতীয় ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯২১-এর মোপলা বিদ্রোহ, ১৯২১-এর কিছু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ১৯২৫-২৬-এর ‘কাজিয়া তুঙ্গে’ ওঠার প্রসঙ্গ এনেছেন। সাথে এটাও জানিয়েছেন “একটি সাময়িকভাবে শান্ত বছরে চিঠিটি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ।”
এ প্রসঙ্গের সূত্র ধরে আমরা ইতিহাসের পথে আরও খানিকটা হাঁটতে পারি। প্রাক-উপনিবেশিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অল্পবিস্তর সুলুক সন্ধান করতে পারি। ইতিহাস ও কল্পকাহিনীর (মিথ) মধ্যেকার সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে পারি। পুরাণ বা গল্পগাথা থেকে যেমন ইতিহাসের উপাদান খুঁজে নেবার চেষ্টা করা যায় তেমনি বিপরীত পথে ধূর্ত পায়ে হেঁটে ইতিহাসের মধ্যে পুরাণ, কল্পকাহিনী, গল্পগাথার উপাদান সফলভাবে নতুন করে প্রবিষ্ট করানো যায়। এরফলে অতি সহজে বিশ্বাস করার বা শক্তিশালী গুজবে প্রভাবিত হবার মতো বিপুলসংখ্যক মানুষের মাঝে কোনটি ইতিহাস আর কোনটিই বা ‘ফেক নিউজ’ তথা মশলাদার কল্প-কাহিনী এ বিভাজনরেখা অস্পষ্ট করে ফেলা যায় শুধু দুটি কাজ নিষ্ঠাভরে করে গেলে – প্রথম, ফেক নিউজ নিরন্তর, ছেদহীনভাবে তৈরি করে যেতে হবে; দ্বিতীয়, ‘নির্মিত’ খবরগুলোকে অবিরত এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে হবে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে। যদিও একাজের জন্য একটি একেবারে তৃণমূল স্তর অব্দি প্রসারিত ও সজীব রেজিমেন্টেড সংগঠন থাকতে হবে।

ফেক নিউজ – সামান্য কথা

নেচার জার্নালে প্রকাশিত নোয়েবল ম্যাগাজিন-এর একটি সংবাদ “Synthetic media: The real trouble with deepfakes” (১৬.০৩.২০২০) বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে জানায় – “একেবারেই না। এসমস্ত ছবি হল “deepfakes” – গভীর মিথ্যে। এগুলো হচ্ছে কম্পিউটারে তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত মিথ্যেকে সত্যি করে দেখানো ছবি। আপনি নিজেও নিজের সিন্থেটিক ছবি ThisPersonDoesNotExist.com-এ তৈরি করতে পারেন। যে সমস্ত কথা বারাক ওবামা বা ভ্লাদিমির পুতিনের মুখে বসানো হয়েছে বা যে কাজগুলো করেছেন বলে দেখানো হচ্ছে সেগুলোর কোনটাই তাঁরা বলেননি বা করেননি।” বায়োলজির দিক থেকে এটা বলার কথা যে যতবেশি মানুষ উপরিস্তরের নিউরনের কাজের মধ্যে আটকে থাকবে ততবেশি গুজব এবং মিথ্যের বাতাবরণ ফনফনিয়ে বেড়ে উঠবে। নিঊরনের পাশে শুয়ে থাকা গ্লায়াল কোশের কাজ যত কম হবে তত মানুষের গভীরে গিয়ে ভাবার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা কমবে। স্মৃতির গভীর থেকে উঠে আসা চিন্তার বিস্তার কমে যাবে। এতে লাভ? রাষ্ট্র এক মানুষ-পিণ্ড তৈরি করতে পারবে যারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। শুধু দৌড়ে চলে নির্মিত মিথ্যা, অর্ধসত্য বা গুজবের পেছনে – একে নিজের মধ্যে আত্মীকরণও করে নেয়। এবং নিপুনতার সাথে যদি এই কাজটিই সেকেন্ড মিনিট ঘন্টা দিন বছর ধরে ছেদহীনভাবে করে যাওয়া যায় তাহলে জনমানসে গুজব গেলানোর সাথে ভোটের ঈপ্সিত ফলাফলের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক তৈরি করা যায় – কি আমেরিকায়, কি অন্যত্র।
ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত (অক্টোবর ১, ২০১৭) একটি খবরের শিরোনাম ছিল – India’s millions of new Internet users are falling for fake news – sometimes with deadly consequences”। এ প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছিল – “যেখানে আমেরিকায় বলা হয় ফেক নিউজ ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ে সাহায্য করেছে, ভারতে, যেখানে ৩৫.৫ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, সেখানে মিথ্যা সংবাদ প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে – জাত এবং ধর্মের মাঝে হিংসা বাড়িয়ে তুলছে, এমনকি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়কেও প্রভাবিত করছে।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় রোমিলা থাপারের একটি আমন্ত্রিত প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল (মে ১৭, ২০১৯) “They Peddle Myths and Call It History” শিরোনামে। এ প্রবন্ধে থাপার বলেন – “জাতীয়তাবাদীরা একটা গ্রহণযোগ্য ইতিহাস নির্মাণ করে যেখানে এই রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে তাদেরই অবদনাকে ইতিহাসে আনা হয় যাদেরকে এরা প্রয়োজনীয় মনে করে; অতি জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন তাদের নিজস্ব এবং বিশেষ ধরনের ইতিহাস যেখানে এরা বর্তমানে যা করছে তাকে অতীত দিয়ে বৈধ করে তোলা যায়। ভারতের ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং ইতিহাসের এই ভার্সনটিকে স্কুল কলেজে শিক্ষার মধ্য দিয়ে চারিয়ে দেওয়া হল এদের মতাদর্শের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ … মুসলিম এবং হিন্দু উভয় জাতীয়তাবাদেরই শেকড় রয়েছে ব্রিটিশদের ভারতকে নিয়ে উপনিবেশিক বোঝাপড়ার মধ্যে।”
দ্য আটলান্টিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল একটি সংবাদ (এপ্রিল ১০, ২০১৯) “Misinformation Is Endangering India’s Election” শিরোনামে। এ খবরে হোয়াটস্যাপ গ্রুপে অসংখ্যবার প্রচারিত একটি খবর ছিল – কংগ্রেসের সাথে কাশ্মীরি জঙ্গীদের যোগাযোগ এবং অর্থসাহায্য করা নিয়ে। সংবাদটিতে বলা হচ্ছে – “The claim, however, was fake. No member of Congress, either a national or a state level, had made any such statement.”
এরকম একটি ক্রমাগত বিরামহীনভাবে গড়ে নেওয়া সামাজিক গণমানসিকতার প্রেক্ষিতে আলোচনা করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতা, ইতিহাসের পারম্পর্য এবং এসবের মধ্যেকার অন্তর্গত টানাপোড়েন ও সম্পর্ক।

রবীন্দ্রনাথের চিঠি এবং অন্যান্য

১৯৪৬ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর চতুর্বিংশ খন্ডে ৩৭৪ থেকে ৩৭৭ পাতা জুড়ে রয়েছে কালিদাস নাগকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি যা দীপেশ চক্রবর্তীর আলোচনার ভরকেন্দ্র। পরে এই চিঠিটি “কালান্তর’ সংকলনে সংকলিত হয়। দীপেশ চক্রবর্তী যে চিঠিটির ঊল্লেখ করেছেন “৭ই আষাঢ়, ১৩২৯” বঙ্গাব্দে লেখা সে চিঠিটি শুরু হচ্ছে এভাবে – “ঘোর বাদল নেমেছে। তাই আমার মনটা মানব-ইতিহাসের শতাব্দীচিহ্নিত বেড়ার ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে।” এরপরে লিখছেন – “ঠিক যখন আমার জানলার ধারে বসে গুঞ্জনধ্বনিতে গান ধরেছি –
আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে
আমার ম্নে
আমার ভাবনা যত উতল হল
অকারণে—
ঠিক এমনসময় সমুদ্রপার হতে তোমার প্রশ্ন এল, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কী। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মানবসংসারে আমার কাজ আছে – শুধু মেঘমল্লারে মেঘের ডাকের জবাব দিয়ে চলবে না, মানব-ইতিহাসের যে-সমস্ত মেঘমন্দ্র প্রশ্নাবলী আছে তারও উত্তর ভাবতে হবে। তাই অম্বুবাচীর আসর পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে হল।” এরপরে রবীন্দ্রনাথের চিন্তনপথের একটি সরণ ঘটলো এখানে। লিখলেন – “পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র – সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান-ধর্ম।” চিঠিতে এরপরের অংশ – “অপরপক্ষে হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয় – অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-co-operation। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। মুসলমান্ধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ।” চিঠিতে এগোলেন রবীন্দ্রনাথ – “আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল – এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকলপ্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই। আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত।” এ অংশটি আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সমান সত্যি! যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায় তারা পৃথক, বাধাগ্রস্ত। তাদেরকে পৃথক করে বাধা দেবার এক প্রবল রাষ্ট্রিক উদ্যোগ দুর্মর বেগে সমাজকে প্লাবিত করছে, আবিষ্ট করছে।
পরে অন্যত্র (“হিন্দুমুসলমান”) বলছেন – “আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম, ‘এ কেন’ তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে; অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে।” “কোট বা চাপকান” প্রবন্ধে বললেন – “এক্ষণে যদি ভারতবর্ষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাঁড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনমতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। যদি বিধাতার কৃপায় কোনোদিন সহস্র অনৈক্যের দ্বারা খণ্ডিত হিন্দুরা এক হইতে পারে, তবে হিন্দুর সহিত মুসলমানের এক হওয়াও বিচিত্র হইবে না। হিন্দু মুসলমানের ধর্মে না – ও মিলিতে পারে, কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে—আমাদের শিক্ষা আমাদের চেষ্টা আমাদের মহৎ স্বার্থ সেই দিকে অনবরত কাজ করিতেছে। অতএব যে – বেশ আমাদের জাতীয় বেশ হইবে তাহা হিন্দু মুসলমানের বেশ।”
আরেকটি গভীরতর সত্য উচ্চারণ করেছিলেন ক্রান্তদর্শী এই মানুষটি। “হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয়” প্রবন্ধে বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে লিখলেন – “বাঙালি বাংলা ভাষার বিশেষত্ব অবলম্বন করিয়াই সাহিত্যের যদি উন্নতি করে তবেই হিন্দিভাষীদের সঙ্গে তাহার বড়ো রকমের মিল হইবে। সে যদি হিন্দুস্থানীদের সঙ্গে সস্তায় ভাব করিয়া লইবার জন্য হিন্দির ছাঁদে বাংলা লিখিতে থাকে তবে বাংলা সাহিত্য অধঃপাতে যাইবে এবং কোনো হিন্দুস্থানী তাহার দিকে দৃক্‌পাতও করিবে না। আমার বেশ মনে আছে অনেকদিন পূর্বে একজন বিশেষ বুদ্ধিমান শিক্ষিত ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্য যতই উন্নতিলাভ করিতেছে ততই তাহা আমাদের জাতীয় মিলনের পক্ষে অন্তরায় হইয়া উঠিতেছে। কারণ এ সাহিত্য যদি শ্রেষ্ঠতা লাভ করে তবে ইহা মরিতে চাহিবে না — এবং ইহাকে অবলম্বন করিয়া শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষা মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া থাকিবে। এমন অবস্থায় ভারতবর্ষে ভাষার ঐক্যসাধনের পক্ষে সর্বাপেক্ষা বাধা দিবে বাংলা ভাষা। অতএব বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ভারতবর্ষের পক্ষে মঙ্গলকর নহে।’”
“কালান্তর” সংকলনে লিখলেন – “আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোর্‌বানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করি নি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এপর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন।”
অন্যত্র আরও তীব্র ভাষায় বলেছেন – “মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবেই।
মানুষকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা যাহাদের অভ্যাস নহে, পরস্পরের অধিকার যাহারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখিবার কাজেই ব্যাপৃত– যাহারা সামান্য স্খলনেই আপনার লোককে ত্যাগ করিতেই জানে, পরকে গ্রহণ করিতে জানে না– সাধারণ মানুষের প্রতি সামান্য শিষ্টতার নমস্কারেও যাহাদের বাধা আছে– মানুষের সংসর্গ নানা আকারে বাঁচাইয়া চলিতে যাহাদিগকে সর্বদাই সতর্ক হইয়া থাকিতে হয়– মনুষ্যত্ব হিসাবে তাহাদিগকে দুর্বল হইতেই হইবে। যাহারা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে, ঐক্যনীতি অপেক্ষা ভেদবুদ্ধি যাহাদের বেশি, দৈন্য অপমান ও অধীনতার হাত হইতে তাহারা কোনোদিন নিষ্কৃতি পাইবে না।”

প্রাক-উপনিবেশিক এবং উপনিবেশিক যুগে সাম্প্রদায়িকতার সংক্ষিপ্ত চেহারা

এ বিষয় নিয়ে যোগ্য ব্যক্তি এবং ঐতিহাসিকেরা বিবিধ ও সুপ্রচুর বিশ্লেষণ করেছেন। আমি সামান্য কিছু যোগ করার অধিকারী হয়তো। সি এ বেইলি তাঁর “The Pre-history of ‘Communalism’? Religious Conflict in India, 1700-1860” (Modern Asian Studies, 19.2, 1995, pp. 177-203) প্রবন্ধে দেখাচ্ছেন প্রাক-উপনিবেশিক সময়ে ও সমাজে ধর্মীয় সংঘাত থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রেই, অন্তত ১৮২০ পর্যন্ত, তা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের চেহারা নিয়েছে। অর্থাৎ, ধর্মীয় দূরত্ব মানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এরকম কোন সরল সমীকরণ করার যাথার্থ্য নেই। তিনি ঐতিহাসিকভাবে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যুদ্ধজীবী (warbands) রাজপুত শ্রেষ্ঠদের হারেমে মুসলমান রমণীদের রাখা হত। এবং এই প্রথা উলমাদের অসীম বিরক্তির কারণ ছিল। তিনি দেখিয়েছেন হিন্দুরা যেমন বহুক্ষেত্রে মসজিদ রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে, তেমনি মুসলমান সুলতানেরাো বহু মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এমনকি শিখেরা গুরুদ্বারের মধ্যে মসজিদও বানিয়েছে। বেইলি প্রশ্ন করছেন জমি নিয়ে যুদ্ধ কিভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠলো? অনেক কারণের মধ্যে সম্ভাব্য একটি কারণ, বেইলির মতে, গোঁড়া জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী সাম্প্রদায়িকতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।
হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের প্রসঙ্গে ইংরেজ শাসনের একেবারে গোড়ার দিকে যারা বিভিন্নভাবে লিখেছেন তাদের একজন শ্রীরামপুরের ত্রয়ী কেরি-মার্শমম্যান-ওয়ার্ডের একজন উইলিয়াম ওয়ার্ড। তাঁর লেখা পুস্তক (শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ সালে ২য় সংস্করণ ২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়) হল A View of the History, Literautre, and Mythology, of The Hindoos: Including a minute Description of their Manners and Customs, and Translations from their Principal Works। ওয়ার্ড বলছেন কলকাতার কুখ্যাত এবং লম্পট চরিত্রসম্পন্ন বাড়ির সংখ্যা অবিশ্বাস্য। এর একটি বিবরণ দিচ্ছেন তিনি – “কয়েক বছর আগে ক্ষত্রিয় জাতের হিন্দু রাজারা ইংরেজ উপপত্নী রাখতো, এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিম রমণীর পরিবারকেও পুষতো। এদের পুত্রদের হিন্দুমতে পৈতাও দেওয়া হয়েছিল এবং সবার বিয়ে হয়েছিল হিন্দুদের সাথে। রাজার রক্ষিতা এই মহিলার আলাদা বাড়ি ছিল যেখানে রাজা নিয়মিত যেতেন। এই মহিলা মূর্তি পুজো করতো এবং একজন ব্রাহ্মণ পূজারী ছিল, ছিল একজন ব্রাহ্মণ গুরু। চারপাশের সমস্ত হিন্দু এই মহিলার বাড়িতে রান্না হওয়া খাবার খেতো। ফলে শাস্ত্রাচারীদের মতে কয়েকহাজার হিন্দুর জাত খোয়া গিয়েছিল।”
ওয়ার্ড একথাও জানাচ্ছেন যে কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, মুর্শিদাবাদের মতো বড়ো শহরগুলোতে অনেক ধনী হিন্দু মুসলিম উপপত্নীর সাথে সহবাস করে এবং “amongst the lower orders, this intermixture of the casts for iniquitous purposes is still more general.” (১ম খণ্ড, পৃঃ ২১০) অর্থাৎ, নীচুতলার মানুষের মধ্যে ধর্মীয় এবং সম্প্রদায়গত আদানপ্রদান ও মেলামেশা স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ফলে সাম্প্রদায়িকতা এবং এর ফলে উদ্ভুত দাঙ্গা বিবেচ্য বিষয় ছিল বলে মনে হয়না। প্রসঙ্গত স্মরণে রাখবো, ওয়ার্ড পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে কিংবা নৌকোতে করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামের অভ্যন্তরে মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশেছেন। ফলে ঊনিশ শতকের শুরুতে তাঁর এই অভিজ্ঞতা ফেলে দেবার মতো নয়, বরঞ্চ গুরুত্বপূর্ণ।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ইতিহাসের উত্তরাধিকার” (নিম্নবর্গের ইতিহাস, সম্পাঃ গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ, ১৯৯৮, পৃঃ ১২১-১৬০) প্রবন্ধে বলছেন – “সেকুলার ইতিহাস চর্চার সংকট এইকাহ্নেই – আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এইজন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান।” ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের রাজাবলী (১৮০৮) দিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা শুরু। রাজাবলী কার্যত পৌরাণিক উপাদান সমৃদ্ধ হিন্দু বিবরণ বললেও অত্যুক্তি করা হয়না। এই বইটি নিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ড তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলছেন – “The work compiled by Mrityoonjŭyů … on the different Hindoo kingdoms in Hindoost’hanŭ; most of which were subdued by it.” (পৃঃ ২৬) ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আলোকপ্রাপ্ত ওয়ার্ডেরও নজরে এসেছে রাজাবলী-র ইতিহাসের ঢংয়ে পৌরাণিক চরিত্র এবং প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের কাহিনী বলা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন – “বঙ্কিমের যুগে এসে পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে, পৌরাণিক বিবরণের থেকে ইতিহাসের মালমসলা বের করার পদ্ধতি নিয়ে যে আলোচনা হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় তা আভাসটুকুও নেই।” মৃত্যুঞ্জয়ের মতো যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারা একটি কাজই মনোযোগ দিয়ে করেছেন – হিন্দু গরিমায় উজ্জ্বল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি গড়ে নেওয়া। আবার বিপরীতদিকে, মুসলমান রচয়িতা যারা তাদের কাছে মক্কা এবং মহম্মদের গরিমা কীর্তন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরকমভাবে যেখানে ইতিহাস লেখার একটি জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দু ইতিহাস লেখার উদ্যোগ শুরু হল সেখানে, পার্থ প্রশ্ন করছেন, “তাহলে হিন্দু নয় অথচ ভারতের অধিবাসী, এমন জনগোষ্ঠীর স্থান কোথায়?” তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা জনপ্রিয় ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৫৮ থেকে ১৮৭৮ সালের মধ্যে ১৮টি সংস্করণ হয়েছিল) আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের আধুনিক চিহ্ন রামচন্দ্রের হাতে পত্পত্ করে উড়ছে, এ-ছবি একশো বছর আগের ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণের কল্পনায় সহজেই এসে গিয়েছিল।” জাতীয়তাবাদীর কাছে প্রাচীন ভারত হয়ে উঠল তার ক্লাসিকাল আদর্শ। বেইলি তাঁর লেখায় যে ইঙ্গিত করেছিলেন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোন অসঙ্গতি নেই, বরঞ্চ সাযুজ্যপূর্ণ সেকথাই অন্যভাবে পার্থর বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইতিহাস রচনার সাথেই সংপৃক্ত হয়ে আছে সাম্প্রদায়িক বোধের বিকাশ।
পার্থ তাঁর পর্যবেক্ষণে জানাচ্ছেন – “বস্তুত জাতীয়তার অর্থ হিন্দু জাতীয়তা, এই ধারণাটিকে কোনও প্রাক-আধুনিক ধর্মীয় মতাদর্শের বলে ভাবলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ আধুনিক। আধুনিক অর্থেই তা যুক্তিবাদী; অযৌক্তিক আচার-ব্যবহার কুসংস্কার বিরোধী। আধুনিক অর্থেই তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক; রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং সার্বভোউমত্বের ব্যাপারে কট্টরপন্থী এবং সমাজনীতি নির্ণয় ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী।” (পৃঃ ১৫৩)
এখানেই রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসবোধ, নেশন তথা রাষ্ট্রিক চেতনা এবং সমাজে মুক্ত মানুষের ভূমিকার প্রসঙ্গে এই ইতিহাসের নির্মাণের সাথে অনপেনয় দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে ফেলাও যায়না, গেলাও যায়না, আবার রাখাও যায়না। ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের মতো করে আত্মীকরণের জন্য টুকরো টুকরো অংশে ভেঙ্গে যেমন যেমন দরকার ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার মাঝে কখনোসখনো কিছু ফাঁক-ফোকরও চোখে পড়ে। ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিতেরা মাঝেমধ্যে আতান্তরেও পড়েছেন। এরকম একজন ভূদেব মুখোপাধ্যায়। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর স্বপ্নলন্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস। নামেই অনুমান করা যায় যেহেতু স্বপ্নলব্ধ এজন্য বহু কথাই হয়তোবা স্বপ্নের ঘোরে বলা, সঠিক অর্থে ঐতিহাসিক যুক্তির বাঁধনে রচিত নয়। তাঁর লেখায় ভূদেব জানাচ্ছেন যে সাহেবুদ্দিন মহম্মদ ঘোরি ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এসে পৃথ্বীরাজ রাওয়ের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে বলছেন – “কিন্তু ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া যদিও বরাবর অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তথাপি হিন্দুদিগের জাতীয় প্রকৃতির অন্যথাচরণ হইতে পারে না। … আপনি নিজ দলবল সহিত নির্বিঘ্নে স্বদেশে গমন করুন।” (পৃঃ ৩) এটুকু অংশের স্বতঃপ্রকাশিত যে হিন্দুদের মানবিক এবং নৈতিক অবস্থান মুসলমানদের ওপরে। এরপরে মনে হয় ভূদেব একটু আতান্তরে পড়েছেন। লিখছেন (দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম) – “একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন “যে রাম সেই রহীম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়”। মুসলমান বলিতেছেন “ঠাকুর যথার্থ কহিয়াছেন, সমস্ত জগৎ সেই এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই বিভূতি মাত্র, মানুষ ভেদে যেমন আচারভেদ-পরিচ্ছদভেদ-ভাষাভেদ – তেমনি উপাসনার প্রণালীভেদও হইয়া থাকে। সকলেই এক পিতার পুত্র। … কোন্ মুসলমান হিন্দু দেবতার এবং ব্রাহমণ ঠাকুরের যথোচিত সম্মাননা না করে? আমার জানত অনেক মুসলমান ব্রাহ্মণদিগকে খরচপত্র দিয়া দুর্গোৎসব করান। … নগরময় এইরূপ কথোপকথন, কোথাও হাস্য পরিহাস, কোথাও গান বাজনা, কোথাও প্রীতিভোজের সমারোহ।” (পৃঃ ১০-১১)
একই ব্যক্তির একই লেখায় মুসলমানদের নিয়ে দুধরনের বয়ান দেখতে পাচ্ছি। কোনটাকে গ্রহণ করবে পাঠক? কিংবা দুটোকেই গ্রহণ করবে? একটি যুক্তি তো রয়েছে যে এটা স্বপ্নলব্ধ ইতিহাস। ফলে স্বাভাবিক ব্যাখ্যার অতীত অনেককিছুই ঘটতে পারে। আরেকটি সম্ভাবনা হল অন্তর্গত সাম্প্রদায়িক বোধকে নিয়ে যে জাতীয়তাবাদী ভাষ্য এবং ইতিহাস নির্মিত হচ্ছিল সেটা সবসময়ে একমাত্রিক ছিলনা। কিছু ভিন্ন স্বরের অস্তিত্ব ছিল হয়তো। যদিও আমাদের বর্তমান আলোচনার চৌহদ্দির বাইরে সে প্রসঙ্গ।
ইতিহাস রচনার তাত্ত্বিক এবং বৌদ্ধিক পরিসরের বাইরে ছিল ব্যবহারিক দিক – উপনিবেশ সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরে। কলকাতা থেকে ঊনিশ শতকের শুরুর দিক থেকে ফার্সিতে সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং নরমপন্থী সংবাদপত্র ছিল জাম-ই-জাহান-নুমা। ১৮৪৫ পর্যন্ত এই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। (এ এফ সালাহউদ্দিন আহমেদ, সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল – ১৮১৮-১৮৩৫, প্যাপিরাস, ২০০৩, পৃঃ ১২৭) কোর্টের ভাষা ছিল ফার্সি। পরিণতিতে, ইংরেজিতে শিক্ষিত হিন্দুদের ফার্সি আয়ত্ব করা আবশ্যিক ছিল। হিন্দুদের ক্ষেত্রে এটা অসন্তোষ এবং বিরোধিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। মে, ১৮২৮-এ ইংরেজ সরকার পয়সা বাঁচানোর জন্য ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর subscription বন্ধ করে দেয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২) ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫-এ হিন্দু কলেজের পরিচালকবৃন্দ সহ কলকাতার ৬,৯৪৫ জন অধিবাসী (এর মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকেরাও ছিল) উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে স্মারকলিপি দেয় যেখানে বলা হয় কোর্টে ইংরেজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আছে তুলে নেওয়া হোক। স্মারকলিপি প্রদানকারীরা উল্লেখ করে যে ফার্সি “as foreign to the natives of Bengal as to their rulers”। এসবের ফলশ্রুতিতে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি জুডিশিয়াল ডেসপ্যাচে (২৬ জুন, ১৮৩৫) ফার্সিকে ভাষার ব্যবহারিক মাধ্যম হিসেবে বিলোপ করা হয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৪)
এর বিপরীত একটি ঘটনাও ঘটেছিল। সে বছরেই (১৮৩৫) ফার্সিতে ৮,৩১২ জন মুসলিম অধিবাসীর স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয় – “Petition on behalf of the Muslims of Calcutta against the Proposed Abolition of Madrasa”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬৪-২৬৭) কিন্তু সংখ্যাধিক্য থাকা সত্বেও ফলপ্রসূ হলনা। একদিকে ভাষা হিসেবে ফার্সি নির্বাসিত হল, অন্যদিকে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ইংরেজের তৈরি মাদ্রাসা ইংরেজদেরই সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে গেল। মুসলিম সমাজের গণমানসিকতায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়লো। শুধু মাদ্রাসাই নয় ১৮৩৫-এ ভারতের প্রথম মেডিক্যাল স্কুল নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশনও বন্ধ হয়ে গেল। সংস্কৃত কলেজ বা হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষিত হিন্দুদের ওপরে যেরকম প্রভাব পড়ত, এ প্রভাবও সেরকম। আমাদের ধারণা মুসলিম মানসিকতায় “অপর” নির্মিত হতে শুরু করল – একদিকে হিন্দু, অন্যদিকে ইংরেজ।
এখানে NMI বা নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন কিছুটা আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। ১৮২২-এ তৈরি হওয়া এই আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য তৈরি ভারতের প্রথম মেডিক্যাল স্কুল। ডাক্তারদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তৈরি করার জন্য এখানে ৩ বছর পড়ানো হত। এবং সেসময়ে উর্দু হয়েছিল পশ্চিমী পদ্ধতিতে ডাক্তারি শিক্ষার ভাষাগত মাধ্যম। (সীমা আলাভি, ইসলাম অ্যান্ড হীলিং – লস অ্যান্ড রিকভারি অফ অ্যান ইন্ডো-মুসলিম মেডিক্যাল ট্র্যাডিশন, ১৬০০-১৯০০, পৃঃ ৭০)। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান জন টাইটলার রবার্ট হুপারের The Anatomist’s Vade-Mecun আরবীতে অনুবাদও করেছিলেন ১৮৩০ সালে।

১৮৩৫-এ এ প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে দিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হল। সেদিন এখানকার সমস্ত ছাত্রকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হল। “নেটিভ” শিক্ষক শেখ ওয়ারিস আলি এবং হীরা লালের তত্ত্বাবধানে নিজেদের খরচে নৌকা ভাড়া করে এরা ফিরে গেল দিল্লি, এলাহাবাদ, লক্ষনৌ-এর মতো জায়গাগুলোতে – নিজেদের ভিটেতে। আলাভি বলছেন – “As the students of the NMI and its staffers dispersed into the qasbas and towns of the North Indian countryside, so did their new ideas and texts. These now became diffused in local society”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৮) এরা এবং এদের বংশধরেরা সিপাহী বিদ্রোহের সময় লক্ষ্যণীয় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সেসময় বাংলার হিন্দু বাবুরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে সিপাহীদের দমনে প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়েছে।

আবার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন কালান্তর প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৭-এ বিশ্বভারতী থেকে। এই সময়কাল জুড়ে একাধিক ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। এ সংকলনের “হিন্দুমুসলমান” প্রবন্ধে স্পষ্টভাবে বললেন – “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ।” (পৃঃ ৩২৮-২৯) অন্য আরেকটি প্রবন্ধ “স্বামী শ্রদ্ধানন্দ”-তে তিনি বলছেন – “আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দুসমাজের কোথায় কোন্ ছিদ্র, কোন্ পাপ আছে; অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই। … আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয়। কেননা, অন্তরের মধ্যে বহু কালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি, বাইরেও বহু দিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর। …. আমাদের মধ্যে কত ছোটো ছোটো সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্রাদেশিকতা – উত্তীর্ণ হয়ে কে আসবে?” (পৃঃ ৩২৪-২৫)
এ সত্যকে কি আমরা স্বীকার করতে পারব? কিংবা প্রত্যেকের নিজের আত্মচিহ্ন মুছে ফেলে একটি সমস্তত্ব রাষ্ট্রিক সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাব? রবীন্দ্রনাথ আমাদের বড়ো শক্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত