| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা । ইন্দ্রজিৎ ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তাঃ এক চলমান জীবন দর্শনের অন্তর্ভাষণ…

” আমাদের পরিবারে শিশুকাল হইতে গান চর্চার মধ্যেই আমরা বাড়িয়া উঠিতেছি ৷ আমার পক্ষে তাহার একটা সুবিধা এই হইয়াছিলো , অতি সহজে গান আমার সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়া ছিল ৷ তাহার অসুবিধাও ছিল ৷ চেষ্টা করিয়া গান আয়ত্ত করিবার উপযুক্ত অভ্যাস না হওয়াতে , শিক্ষা পাকা হয় নাই ৷ সংগীত বিদ্যা বলিতে যাহা বোঝায় তাহার মধ্যে কোনও অধিকার লাভ করিতে পারি নাই ৷ “

‘জীবনস্মৃতির’ ‘গীতচর্চা’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি তাঁর সাংগীতিক ব্যক্তিত্ব নির্মাণের ভিত্তিভূমির এক অখন্ড ইতিহাসের সজাগ ইঙ্গিত হিসাবে আজও আমাদের কাছে প্রেরণার বিষয় ৷ গান আর রবীন্দ্রনাথ,যেন এক ও একাকার হওয়া এক আশ্চর্য স্বপ্নকল্প ! সৃজন আর আর নির্মাণের মধ্যে যে দূরত্ব , যে আলো-ছায়ার আলাপ আর সংলাপ , যে সীমা ও অসীমের ঐকতান , তারই এক অন্তর্ভাষণের দার্শনিক প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত হয় রবীন্দ্রনাথের সংগীত চিন্তা ৷ চিন্তা তো নিখাদ চিন্তা নয় , তা আসলে জীবনবিশ্বের এমন এক অনুবাদ, এমন এক মহাজাগতিক চিত্ত বিকাশ , যেখানে একই সঙ্গে শোনা যায় , আকাশের কন্ঠস্বর আর ব্যক্তি আমি থেকে বিশ্ব আমি তে পৌঁছনোর আকুল হ’য়ে ওঠা যন্ত্রণাস্নাত আনন্দের ধ্বনি ! এই কন্ঠস্বর ও ধ্বনি রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নায়ুতে , রক্তের কোষে কোষে ধারণ করেছেন ৷ এই ধ্বনিকে মস্তিষ্কের অভিভাষণ জাত বৌদ্ধিক মগ্নতায় এবং হৃদয়ের উষ্ণতায় রবীন্দ্রনাথ এমন এক নান্দনিক উদযাপন ভেতরে ভেতর ঘনিয়ে তোলেন , যেখানে গান আর শুধু গান থাকে না , তা হ’য়ে ওঠে মুক্তি ও মিলনের এক চিরকালীন মানবধর্ম ও মানববিশ্ব ! রবীন্দ্রনাথের গান তাই , গানের সীমা পেরিয়ে হ’য়ে ওঠে এক অতলান্তিক জীবনদর্শন ও জীবনধর্ম ৷ তা আমাদের যেমন মানবধর্মে দীক্ষিত ক’রে , তেমনি অণুবিশ্ব থেকে মানববিশ্বের নাগরিক হ’য়ে উঠতেও প্রাণিত করে ৷ এই প্রাণনার আকুলতাই আমাদের রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তার গহন গভীরে পৌঁছে যেতে আহ্বান জানায় ৷ এই আহ্বানে সাড়া দিয়েই বুঝে নেবার চেষ্টা কর’ব রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তার মৌল স্বরূপটি ৷

রবীন্দ্রনাথের কাছে সংগীত ঠিক কী ছি’ল , কেমন ছি’ল তাঁর সংগীতচিন্তা , সে নিয়ে কথা বলার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক , প্রচলিত ধারণায় সংগীতচিন্তা ঠিক কোন খাতে বইছে ৷ তবে তারও আগে আমাদের মনে রাখতে হবে , কথা ও সুর দুই-ই স্বরযন্ত্র থেকে উৎপন্ন ৷ আমরা কথা বলা শিখছি যে স্বরযন্ত্র দিয়ে , সেই একই স্বরযন্ত্র আবার আমাদের সুরও সৃষ্টি করছে ৷ তাই স্বরযন্ত্রই আমাদের আদি সংগীত যন্ত্র ৷ পাশাপাশি আছে আরও একটি জৈবিক যন্ত্র , তা হ’ল আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় অর্থাৎ কান ৷ কথা ও সুর এই কানের ভেতর দিয়ে ‘মরমে’ প্রবেশ ক’রে আকুল ক’রে তোলে আমাদের প্রাণ ! রবীন্দ্রনাথের কাছে সংগীত এই প্রাণেরই অমোঘ ও অফুরাণ সম্পদ ৷ যার আবেদন কখনও ফুরোনোর নয় ! কথা ও সুরের উৎসভূমি এক হলেও এদের গঠনশৈলী ও প্রকাশভঙ্গি স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ৷ কথা ও সুরের আবেদনও এক নয় ৷ হওয়ার কথাও নয় ৷

মানুষের আদি ও অকৃত্রিম সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হ’ল নিসর্গ তথা প্রকৃতি ৷ নদীর কুলকুল ধ্বনি , ঝর্ণার ঝর ঝর , পাতার মর্মর , সমুদ্রের উথাল-পাতাল , বাতাসের শন্ শন্ ,পাখির কল-কাকলি এ সবই মানুষের অন্তরে ও মস্তিষ্কে প্রবল আলোড়ন জাগিয়ে ভাষা ও সুরের জন্ম দিয়েছে ! সংগীত তাই এক অর্থে মানুষের অন্যতম এক আদিম শিল্প ৷ মানুষের ভাষার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সংগীতের আত্মীয়তা গভীর ও অনন্ত ভাবব্যঞ্জনায় অন্বিত ৷

” গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং এয়ং সঙ্গীত সমুচ্যতে ৷ ” (‘সঙ্গীত রত্নাকর)

এই ঐতিহ্য বাহিত ভাষ্যটিকে আত্মস্থ করেই রামপ্রসাদ রায় তাঁর ‘সঙ্গীত জিজ্ঞাসা ‘ গ্রন্থে বলেছেন— “গীত , বাদ্য ও নৃত্য এই তিনটি কলার একত্র সমাবেশকে সঙ্গীত বলা হয় ৷ কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রে গীতকে প্রধান , বাদ্যকে দ্বিতীয় এবং নৃত্যকে তৃতীয় স্থানীয় রূপে বর্ণিত দেখতে পাওয়া যায় ৷ সুতরাং সঙ্গীত বলতে এই তিনটেকেই বুঝায় ৷ “

শাস্ত্রসম্মত ভাবে সংগীতকে শব্দব্রহ্মের অন্তর্গত একটি পদ ও অলংকার হিসাবে দেখার রীতি সিদ্ধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ৷ আমরা জানি , দেবতার উদ্দেশে ঋষিদের স্তুতিবাচক তথা প্রশংসাসূচক মন্ত্রগুলিই হ’ল প্রকৃত বিচারে ঋক্ ৷ দৈবী আরাধনার এক গভীর ইতিহাস জড়িয়ে আছে এইসব মন্ত্রগুলির মধ্যে ৷ দেবতাদের আরাধনার জন্য ঋকছন্দের মন্ত্র গুলি সুর সংযোগে গাওয়ার রেওয়াজ ছি’ল এবং এই সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে সামগানের বিকাশ ও বিবৃদ্ধি ঘটেছে ৷ এই সাম-এর অর্থ হ’ল , সুর যুক্ত ঋক্ ৷ যাগযজ্ঞের সময় যে সাম গান গাওয়া হ’ত , সেই সাম গান-ই সম্ + গীত অর্থাৎ ভারতীয় সংগীতের মূল অংশ ৷ এই সাম্ গানকেই বেদগান বা বৈদিকগান বলা হয়ে থাকে ৷ বেদের ভিন্ন ভিন্ন শাখায় ভিন্ন ভিন্ন সুর ও স্বরে সাম গান গাওয়া হ’ত ৷ বৈদিক পরবর্তী পৌরাণিক যুগের আঠারোটি পুরাণের অন্তর্গত বিভিন্ন পুরাণে সংগীতের আলোচনা রয়েছে ৷ ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্রে’ নাটকের অঙ্গ বা সহায়ক হিসাবে সংগীতের কথা বলা হয়েছে ৷ এখানে স্বর , তাল ও লয়ের সমন্বয় যুক্ত সংগীতের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে৷

সংগীতের মুখ্য তত্ত্ব হ’ল তার রাগ প্রণালী, যা বহুযুগের ঐতিহ্যেরই অনুসৃতি বিশেষ ৷ এ ক্ষেত্রে তাই মনে রাখতে হবে , সংগীতের প্রধান তিন ভাগ হ’ল— কন্ঠসংগীত , যন্ত্রসংগীত এবং নৃত্যসংগীত ৷ জগৎ আসলে ধ্বনিময় ৷ আমাদের শ্রবণ শক্তির সীমা ও সীমার বাইরে প্রতিনিয়ত নানা ধ্বনির উৎপত্তি হচ্ছে ৷ একারণে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘ধ্বনি’ বা ‘নাদ’-ই ব্রহ্মরূপে স্বীকৃত হয়েছে ৷ অতএব শাস্ত্রকারদের অভিমত অনুসারে ধ্বনি বা নাদ উপাসনা মাত্রই ব্রহ্মের উপাসনা ৷ যে মধুর সাংগীতিক আওয়াজ মনকে আনন্দ দেয় , তাকেই বলে নাদ ৷

মোট কথা , গীত এক প্রকার শ্রবণ উপযুক্ত কলা ,যা মানব হৃদয়ে আনন্দ সৃষ্টির সহায়ক ৷ সংগীত সৃষ্টির পিছনে স্বর এবং ধ্বনির গভীর অন্বয় রয়েছে ৷ ধ্বনির প্রধান বাহন হ’ল সুর ৷ এছাড়া সংগীতের অন্যতম নিয়ামক হ’ল তাল , যা ছন্দেররও অন্যতম নিয়ন্ত্রক অংশ ৷ অর্থপূর্ণ কথা, সুর ও তালের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যে ঐকতান গ’ড়ে তোলে , সেই ঐকতানই হ’ল গীত৷ কার্যত ধ্বনি , সুর ও তালের সমন্বয়ে সংগীত সৃষ্টি হয় ৷ মস্তিষ্কের গভীর উপলব্ধির স্তরে সংগীতের বিশেষ আবেদন রয়েছে ৷ ভারতবর্ষ সহ প্রাচীন মিশর , রোম , গ্রিস প্রভৃতি সভ্যতায় সংগীতের এক দীর্ঘ ইতিহাস লক্ষ্য করা যায় ৷ ভারতবর্ষের দুই প্রধানতম সংগীত পদ্ধতি হ’ল— কর্ণাটকী তথা দক্ষিণী সংগীত এবং হিন্দুস্থানী সংগীত ৷ এই দুই প্রণালীর সংগীত সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গুলো মূলত একই ৷ পরবর্তী কালে ইসলামের সংস্পর্শে সংগীত সমঝদার মুসলমান বাদশাহদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে হিন্দুস্থানী সংগীতের চরিত্রে নানান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়৷

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের তাৎপর্য ‘প্রবন্ধে বলেছেন—”চিত্র এবং সংগীতই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ ৷ চিত্র ভাবকে আকার দেয় এবং সংগীত ভাবকে গতি দান করে ৷ চিত্র দেহ এবং সংগীত প্রাণ ” ৷ রবীন্দ্রনাথের এই সংগীতচিন্তা হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি, বরং নিজের সৃষ্টি ও চর্চার ভেতর দিয়ে তার রূপ গ’ড়ে উঠেছে ৷ ধার্মিকতা , সাহিত্য , স্বাদেশিকতা সহ ঠাকুর বাড়ির বহু বিচিত্র ও বহুবর্ণিল আবহে সংগীত চর্চা ছি’ল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই এক স্বাভাবিক ব্যাপার ৷ এ বাড়ির বাতাসেও সংগীত ঝরে পড়ত৷

রবীন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই গগেন্দ্রনাথের ব্রহ্ম সংগীতে দেশানুরাগের প্রকাশ ছি’ল বেশ তাজা ও সতেজ ৷ বালক রবীন্দ্রনাথের মন ও স্নায়ুর ওপর শ্রীকন্ঠ সিংহ ও অক্ষয় চৌধুরীর গান এক অমোঘ আকর্ষণের আন্দোলন জাগিয়ে তুলত ৷ মা সারদা দেবীর কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ শুনতে শুনতে অদ্ভুত এক গীতি ধ্বনিতে প্লুত হ’য়ে উঠত বালক রবীন্দ্রনাথের মন ৷ নিতান্ত ছেলেবেলাতেই ভারতীয় সংগীত
সম্পর্কে মোটামুটি একটা স্পষ্ট বোধ বালক রবির মনে গেঁথে গিয়েছি’ল !

‘জীবনস্মৃতির’ ‘নানাবিদ্যার আয়োজন’ অংশে কবি জানাচ্ছেন—”রবিবার সকালে বিষ্ণুর কাছে গান শিখিতে হই’ত ” ৷ আবার বালক রবি শ্রীকন্ঠ বাবুর কাছ থেকেও সংগীত চর্চার ইন্ধন পান ৷ “ময় ছোঁড়ো ব্রজকি বাসরী” গানটি বালক রবির মুখে শোনার জন্য শ্রীকন্ঠ বাবু রবিকে “ঘরে ঘরে টানাইয়া লইয়া বেড়াতেন ” ৷ উপনয়নের পর ন্যাড়া মাথার রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে হিমালয় যাত্রা
করেছেন ৷ সেই সময় পর্বে অসাধরণ এক নিসর্গ পটে পিতৃদেবের সামনে ব’সে বালক রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শোনাবার চিত্ররূপ সত্যিই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘জীবনস্মৃতির’ অক্ষর ছাড়িয়ে —”যখন সন্ধ্যা হইয়া আসিত পিতা বাগানের সম্মুখে বারান্দায় আসিয়া বসিতেন ৷ তখন তাঁহাকে ব্রহ্মসঙ্গীত শোনাইবার জন্য আমার ডাক পড়িত ৷ চাঁদ উঠিয়াছে , গাছের ছায়ার ভিতর দিয়া জ্যোৎস্নার আলো বারান্দার উপর আসিয়া পড়িয়াছে , আমি বেহাগে গান গাহিতেছি—
“তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে ,
কে সহায় ভব অন্ধকারে ” ৷
তিনি নিস্তব্ধ হইয়া নতশিরে কোলের ওপর হাত জোড় করিয়া শুনিতেছেন—
সেই সন্ধ্যাবেলাটির ছবি আজও মনে পড়িতেছে” ৷ রবীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াত খুড়তুতো দাদা গণেন্দ্র চমৎকার ব্রহ্মসংগীত লিখতেন ৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—” তাহার রচিত ব্রহ্মসংগীত এখনো ধর্মসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার
করিয়া আছে “৷ গণেন্দ্রনাথের “লজ্জার ভারত যশ গাহিব কী ক’রে” গানটি সে সময়ে হিন্দুমেলায় গাওয়া হ’ত ৷ রবীন্দ্রনাথের গীতি মন সৃজিত হ’য়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই প্রতিভাদীপ্ত গণেন্দ্রনাথের ভূমিকা ছি’ল অত্যন্ত ইতিবাচক ৷

আবার সাহিত্য চর্চায় ও ভাবের শিক্ষায় জ্যোতিদাদা অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বালক রবির ভেতরে এমন এক স্বাধীনতার বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন যে , যার দ্বারা বালক রবির সৃজন স্পৃহার উৎস মুখ স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার অবকাশ পায় ৷ কেননা ——
“এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নতুন নতুন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন ৷…আমি ও অক্ষয়
বাবু তাঁহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম ” ৷ আবার তারুণ্যদীপ্ত আঠারোর রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলাত প্রবাস কালে ইউরোপীয় সংগীতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন ৷ বিখ্যাত গায়িকা মাডাম নীলসন্ (মাডাম আলবানী)-এর
গান শুনছেন এই সময়ে ৷ কন্ঠস্বর খুব জোয়ারি হলেও সেই গান যে যুবক রবীন্দ্রনাথের খুব একটা ভালো লেগেছি’ল , মোটেই তা নয় ৷ ইউরোপীয় সংগীত সম্পর্কে একরকম ধারণাও তখন গ’ড়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের—” এ সঙ্গীত রোমান্টিক ৷ তুলনায় ভারতীয় রাগসঙ্গীত অনেক বেশী ব্যাপক ও গভীর ” ৷ এই সময় পর্বেই খুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি
আইরিশ মেলোডিজ শুনছেন এবং তা গভীর ভাবে অনুশীলন করছেন ৷ ইউরোপীয় সংগীত সম্পর্কে “জীবনস্মৃতি”-র ‘বিলিতি সঙ্গীত’-এর পাতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনন ঋদ্ধ অনুভবের কথা মেলে ধরেছেন—”য়ুরোপার গান এবং আমাদের গানের
মহল যেন ভিন্ন; ঠিক এক দরজা দিয়া হৃদয়ের একই মহলে যেন তাহারা প্রবেশ করে না ৷ য়ুরোপীয় সঙ্গীত যেন মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে বিচিত্র ভাবে জড়িত ৷ তাই দেখিতে পাই , সকল
রকমেরই ঘটনা ও বর্ণনা আশ্রয় করিয়া য়ুরোপের গানের সুর খাটানো চলে ; আমাদের দেশী সুরে যদি সেরূপ করিতে যাই তবে অদ্ভুত ইইয়া পড়ে ,তাহাতে রস থাকে না ৷…আমাদের গান যেন জীবনের প্রতিদিনের বেষ্টন অতিক্রম করিয়া যায়,
এই জন্য তাাহার মধ্যে এত করুণা এবং বৈরাগ্য ” ৷ তাঁর মনে হয়েছে , বিশ্ব প্রকৃতি এবং মানব হৃদয়ের মধ্যে যে অন্তরতম এবং অনির্বচনীয় রহস্য গভীর রূপ আছে , এ দেশের সঙ্গীত যেন সেই বচনাতীত রূপটিকেই দেখিয়ে
দেবার কাজে নিযুক্ত ৷

ইউরোপীয় সঙ্গীতের একেবারে মর্ম কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পেরেছেন , এমনটা মোটেই মনে করতেন না রবীন্দ্রনাথ ৷ তিনি ইউরোপীয় সংগীত নিহিত রোমান্টিকতার মধ্যে যেমন বিচিত্রতার দেখা পেয়েছেন , তেমনি পেয়েছেন প্রাচুর্যের সম্ভার ! এক অদ্ভুত গতি চাঞ্চল্যের ভেতর তিনি আলো-ছায়ার দ্বাদ্বিক সম্পাতে জীবন সমূদ্রের অযুত তরঙ্গ-ভঙ্গের ওঠা নামা অনুভব করেছেন ৷ এরই ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে “আকাশ নীলিমার নির্নিমেষতা’য় এবং
‘দিগন্তরেখার অসীমতার নিস্তব্ধ আভাস”-এ ৷ তাঁর বারবার মনে হয়েছে , এ সংগীত যেন মানবজীবনের বহুবর্ণ বিচিত্রতাকে গানের সুরে অনুবাদ করে প্রকাশ করছে ৷ এমন নয় যে , প্রাচ্য সংগীতের মধ্যে সে চেষ্টা নেই ৷ রবীন্দ্রনাথের মতে সে চেষ্টা প্রবল ও সফল হতে পারেনি ৷ এ প্রসঙ্গে তাঁর সংযোজন—” আমাদের গান ঘন বর্ষার বিশ্বব্যাপী বিরহ-বেদনা ও নব বসন্তের বসন্ত প্রসারিত গভীর উন্মাদনার বাক্য বিস্মৃত বিহ্ববলতা ” ৷

দেশে ফেরার পর প্রাচ্য- পাশ্চাত্যের সুর ও সংগীত অনুশীলনে সারাদিনের বেশীর ভাগ সময় মগ্ন থাকছেন রবীন্দ্রনাথ ৷ এরই প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে তিনি যেমন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ লিখছেন , তেমনিই এক নিরীক্ষামূলক সৃষ্টি হিসাবে ‘কালমৃগয়া’-র ম’ত গীতিনাট্য লিখছেন ৷এরপরই সম্পূর্ণ এক নতুন স্বাদের সৃষ্টি ‘মায়ার খেলা’ কাব্যও সংগীত প্রিয় মানুষকে একেবারে চমকে দিচ্ছে ৷ নাটক নয় , সংগীত-ই এখানে প্রধানতম প্রাণবস্তু ৷’বাল্মীকি প্রতিভা’ থেকে ‘মায়ার খেলা’ পর্যন্ত কবির যে সংগীত যাপন , তা যেন নাটক ও সংগীতের পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণের এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শৈল্পিক বন্ধন ও বন্ধন মুক্তির ইতিহাস ৷ এ যেন এক চলমান ইতিহাস ৷ নান্দনিক অভিলাষে এ চলমানতা এক উচ্চমার্গীয় দর্শনের সন্ধান দেয় ! এই সন্ধানই তো কবি কে পৌঁছে দেয় ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ থেকে ‘প্রভাতসঙ্গীত’-এর সূর্যস্নাত জগতে ৷ এই দুই কাব্যগ্রন্থই সংগীতের এক আশ্চর্য ভুবন তৈরি করে ৷ এখানেই ঘটে কবির ভৌম দর্শন ৷ এক অন্তর্জাত সাংগীতিক অনুরণন জন্ম দেয় এমনই উচ্চকিত বিশ্বাতীত আকুলতার —

“হৃদয় আজি মোর কেমনে গে’ল খুলি,
জগৎ আসি সেখা করিছে কোলাকুলি”৷

এই সময়েই কবির সাংগীতিক যাপনের গভীরে মিশে যাচ্ছে বিশ্বভাবনার বৃত্তে দাঁড়িয়ে বিশ্বাতীতকে স্পর্শ করার হার্দ্য বাসনা ৷ কবি ভেতরে ভেতরে সঞ্চয় করছেন বৃত্ত ভাঙার সামর্থ্য ৷ এই সামর্থ্যের পথ ধরেই কবির বোধ ও বোধি যেন ছুঁতে চাইছে “নাল্পে সুখমস্তি ভূমৈব সুখম্ “-এর উচ্চমার্গীয় সাধনার উচ্চতর আলোক শিখাটিকে ৷

দ্বিতীয়বার বিলাত যাত্রার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় বেথুন সোসাইটির আমন্ত্রণে মেডিকেল কলেজ হলে রবীন্দ্রনাথ যে প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন সেটির বিষয় ছি’ল—সংগীত ৷ যন্ত্রসংগীত নয় , প্রবন্ধটির ভরকেন্দ্র ছি’ল গেয় সংগীত ৷ তিনি বলতে চেয়েছেন , কথাকে সুরের দ্বারা পরিস্ফূট ক’রে তোলাই হ’ল গেয় সংগীতের প্রধানতম উদ্দেশ্য ৷ কিন্তু পরিণত বয়সে পৌঁছে তিনি নিজের অভিমতকে সংশোধন করছেন প্রবল এক প্রত্যয়ের সঙ্গে ৷

জ্যোতি দাদা তখন সস্ত্রীক চন্দন নগরে গঙ্গার ধারের মোরান সাহেবের বাগানে অখন্ড অবকাশ যাপন
করছেন ৷ যুবক রবিও অতর্কিতে সেখানে পৌঁছচ্ছেন ৷ এ সময়েই প্রাণ প্রবাহিনী গঙ্গা কবির অন্তর্চেতনা জুড়ে
যেন সংগীতের লহরী জাগিয়ে তুলছে ! কাদম্বিনীর আন্তরিক সাহচর্যে বৃষ্টিস্নাত
মুহূর্তগুলিতে বিদ্যাপতির মাথুরের পদ
“ভরাবাদর মাহভাদর”-এর বিরহ তপ্ত দাহ কবির সাংগীতিক বিশ্বকে যেন অসীম অনন্ত এক প্রকৃতিতে মুক্তি দিল ৷
বর্ষার রাগিনী প্রকৃতির অন্তর সংগীতকে
অবলীলায় কবির অন্তরে মেলে ধরল ৷
সূর্যাস্তের মুহূর্তে গঙ্গার বুকে নৌকা ভ্রমণ
কবির সংগীত চেতনাকে সত্যিই যেন এক নির্নিমেষ আকুলতা দিল ৷ জ্যোতি দাদা বেহালা বাজাতেন আর রবি কবি গান ধরতেন ৷ পূরবী রাগিনী থেকে বেহাগে পৌঁছতে পৌঁছতে আকাশে চাঁদ জেগে উঠত ! এ ভাবে সংগীতের সঙ্গে সঙ্গ যাপন করতে করতে রাবীন্দ্রিক মন ও মনন যেন বেশ বুঝতে পারছিল , হৃদয়ের ভেতর জন্ম নেওয়া এক অব্যক্ত ব্যাকুলতাই যেন নিজেকে নিজে প্রবলভাবে প্রকাশ করতে চাইছে ! এই চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে , ততই যেন , অব্যক্তের ইশারায় কবি আত্মা টের পাচ্ছে—বিশ্বের
কেন্দ্রস্থল থেকে উৎসারিত এক ধ্বনি অনুরণিত হচ্ছে কবি চিত্তের নিভৃত প্রদেশে ৷ কবি বেশ বুঝতে পারছেন, এত দিন তিনি কেললই বাইরের দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখে এসেছেন , এজন্য জগতের আনন্দরূপ তাঁর না দেখা রয়ে গেছে ৷ তিনি অনুভব করছেন , অন্তরের
গহন ভূমি থেকে একটা আলোক রশ্মি মুক্ত হয়ে যখন সমগ্র বিশ্বের ওপর ছড়িয়ে পড়ল তখন তাঁর চোখের সামনে যে জগৎ উদ্ভাসিত হ’ল সে জগৎ
বস্তু বা ঘটনার খন্ড-বিখন্ড রূপাবয়ব নয়, সে জগৎ আগাগোড়া পরিপূর্ণ এক রূপের সমাহার !

রূপ আর রূপাতীতের অনির্দৃশ্য চলমানতায় কবি অনুভব করেন—” অন্তরের কোন একটি গভীরতম গুহা হইতে সুরের ধারা আসিয়া দেশ কালে ছড়াইয়া পড়িতেছে৷
এবং প্রতিধ্বনি রূপে সমস্ত দেশকাল হইতে প্রত্যাহত হইয়া সেখানেই আনন্দের স্রোতে ফিরিয়া যাইতেছে ৷ সেই অসীমের দিকে ফেরার মুখের প্রতিধ্বনিই আমাদের মনকে সৌন্দর্য্য ব্যাকুল করে ৷গুনি যখন পূর্ণ হৃদয়ের উৎস হইতে গান ছাড়িয়া দেন তখন সেই এক আনন্দ” ৷ এ এক দর্শনজাত আনন্দ বোধের স্বমহিম প্রকাশ ৷ এক অদ্ভুত অতীন্দ্রিয় দর্শনাভূতি কবিকে জগতের মর্ম ঐক্যের আনন্দানুভূতি দান
করেছে ৷ এই অনুভূতির তীব্রতাতেই কবির মনে হয়েছে , বিশ্বকবির কাব্যগান
যখন আনন্দময় হয়ে বিশ্বকবি সত্তারই কেন্দ্রে ফিরে যাচ্ছে তখন সেই অনাবিল আনন্দের প্রবাহকে যদি আমরা আমাদের চেতনার ওপর দিয়ে বইয়ে যেতে দিই , তাহ’লে বোধ হয় আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে জগতের পরম পরিণামের অনির্বচনীয় রূপটি কেমন তা জানা ! আসলে কবি বিশ্বাস করতেন যে ,আমাদের মনের তারটা যদি যথার্থ সুরে বাঁধা থাকে তাহ’লে বিশ্বসংগীতের ঝংকার সমস্ত ক্ষেত্র থেকে উৎসারিত হ’য়ে মনের তারকে অনুরণিত ক’রে তোলে ৷ এই অনুরণনের
ফলেই আমরা অন্তরের আনন্দের দ্বারা জগতের আনন্দলোককে সত্যরূপে আবিষ্কার করতে পারি ৷

একটা কথা যেন আমরা ভুলে না যাই , রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ ক’রে কিছু হয়ে যাননি ৷ এক গহন-গুহ্য ও অন্তরালবর্তী , দ্বন্দ্ব-মথিত রণরক্ত যন্ত্রণা , এবং ক্ষয় ও অর্জনের ভেতর
দিয়ে তিনি যতই একটু একটু ক’রে বিকশিত হয়েছেন , ততই সংগীত তাঁর জীবন জুড়ে সমীকৃত হয়েছে ৷ সংগীতের জারণ ক্রিয়ায় জারিত হয়েছে তাঁর কবি মন , আবার কবিদৃষ্টির
গভীর গভীরতর অন্তর্মুখিতা তাঁকে সুরের হাত ধরতে শিখিয়েছে ৷ একদিকে
ভেতরে ভেতরে অহরহ গান সৃজিত হ’য়ে
উঠছে , আবার অন্যদিকে সংগীতের তাত্ত্বিক কাঠামো ও তত্ত্ববিশ্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে ৷ কোথাও কো’ন ফাঁকি নেই , নেই অ্যাকাডেমিক চালিয়াতির ঢঙে কথা বলার কৃত্রিমতা ৷ একজন সর্ব অর্থে সৃষ্টিশীল মানুষ হিসাবে যখন তিনি সংগীত নিয়ে হাতে কলমে কাজ করছেন , নানান কাটা-ছেঁড়ার মধ্যে দিয়ে সংগীতের অখন্ড সত্তার সন্ধান চালাচ্ছেন , তখন সংগীত কী ও কেন , কী তার চরিত্র ও প্রকৃতি , এসব নিয়ে তাঁর ভাবনা-চিন্তা যে মৌলিক পথেই হাঁটবে ও নতুন কো’ন পথ দেখাবে এবং সে পথ যে প্রথানুগত্যে আটকে থাকবে না , এটাই তো স্বাভাবিক ৷ এটাই তো হওয়ার কথা ৷ এটাই তো তাঁর ম’ত জিনিয়াসের কাছ থেকে আশা করা যায় ৷

আমরা জানি , ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলা গানের জগতে রাগসংগীত একটা ব্যাপ্ত পরিসর তৈরি করে নিচ্ছিল ৷ ঔপনিবেশিকতার সূচনা পর্বের আগে থেকেই লৌকিক সংগীতের
বহু বিচিত্র ধারা নাগরিক রুচি ও মানস
সংস্কৃতির সংস্পর্শে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে অভিযোজনে সামিল হচ্ছে তার ফলশ্রুতিতে তাকে নাগরিকতার দাপটের কাছে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে এবং রূপান্তরিত হয়ে নিত্য নতুন চেহারাও লাভ করতে হচ্ছে ৷ পাশাপাশি পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রবলতর অভিঘাত এবং স্বাজাত্য বোধ ও স্বাদেশিকতার জাগরণ বাংলা গানের
চেহারা ও চরিত্রে নানা বদল নিয়ে আসছে ৷ ঠিক এই প্রেক্ষিতেই যেন এক জন্মগত অধিকারের সনদ হাতে সংগীতকার হিসাবে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ৷ সুর ও বাণীর আশ্চর্য , প্রায় এক অলৌকিক মেলবন্ধনে তিনি কম বেশী আড়াই হাজারের কাছাকাছি গান রচনা করেছেন ৷ ‘পূজা’ , ‘প্রেম’ ‘স্বদেশ’ এবং ‘প্রকৃতি’ মোটামুটি এভাবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের পর্যায় বিভাগ করেছেন ৷ তবে সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণে এবং সুর ও বাণীর বিচিত্রতার ভিত্তিতে
তাঁর গানগুলিকে আরও নানা ভাবে শ্রেণিকরণ করা যেতে পারে ৷ এটা মাথায় রাখার ম’ত বিষয় যে , রবীন্দ্রনাথ
তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর সৃষ্ট সংগীতকে !

বাক্য যেটা বলতে পারেনা , গান সেটাই অনায়াসে বলে ৷ বাক্য যেখানে শেষ ,গান সেখানেই শুরু ৷ তাই
কথাকে কথা বলার স্বাধীনতা দিতে হবে ৷ গীতিকলার নিজস্ব প্রকৃতি যেন সে কথাই বলছে ৷ বচনের সীমাবদ্ধ পরিসর ডিঙিয়ে অনির্বচনীয়তার দিকে এগিয়ে যাওয়াই গানের কাজ ৷ কথার উপদ্রব না থাকলে গানের পরমায়ু বৃদ্ধি পায় , এমনটাই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ ৷ তিনি বলছেন—” হিন্দুস্থানী
গানের কথা সাধারণত এতই অকিঞ্চিতকর যে , তাহাদিগকে অতিক্রম করিয়া সুর আপনার আবেদনে অনায়াসে প্রচার করিতে পারে ৷ এই রূপে রাগিনী যেখানে শুধুমাত্র স্বরূপেই আমাদের চিত্তকে অপরূপ ভাবে জাগ্রত করিতে পারে সেখানেই সংগীতের উৎকর্ষ ” ৷ তাঁর মনে হয়েছে বাংলাদেশে বহুকাল থেকে
কথার অতিরিক্ত আধিপত্যের কারণে বিশুদ্ধ সংগীত নিজের স্বাধীন অধিকার
থেকে বঞ্চিত হয়েছে ৷ “সেই জন্য “এদেশে তাহাকে ভগিনী কাব্যকলার আশ্রয়েই বাস করিতে হয়” ৷ আসলে গানের সুরই পারে অব্যক্তকে ব্যক্ত করতে , ভাষাহীনকে ভাষা দিতে , বচনকে অনির্বচনে নিয়ে যেতে , বিমূর্ত অন্তর্গূঢ়তাকে মূর্ত ও আলোকিত করতে,
পারে অন্তরের নিভৃত প্রদেশে সত্তাতীত অচিন পাখির নিঃশব্দ যাওয়া-আসার
সংবাদ দিতে ৷ এ কারণেই গানের বই ছাপতে কবি বারংবার সংকোচ বোধ করেছেন ৷ তাঁর মনে হয়েছে , গানের বইতে গানের আসল জিনিসটাই বাদ পড়ে যায় ; সেই আসল জিনিসটা হ’ল কথার অতীত সত্য ৷ অনির্বচনীয় সুর ও সংগীতের নিজস্ব ভুবন ৷

“ভাব ব্যক্ত করাই সঙ্গীতের মুখ্য উদ্দেশ্য” ৷ এমনটাই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ ৷ কন্ঠ নিঃসৃত বিভিন্ন স্বর বিবিধ মনোবৃত্তির শরীরগত বিকাশ ৷
তাই “আমাদের মনোভাব গাঢ়তম , তীব্রতম রূপে প্রকাশ করিবার উপায় রূপে সঙ্গীতের স্বাভাবিক উৎপত্তি” ৷ তাই আবেগের ভাষাই সংগীতের প্রাণ ৷
সংগীতকে তাই স্বাভাবিক পথেই বিকশিত হতে হবে , তার জন্য শাস্ত্র , ব্যাকরণ ও সমস্তরকম আনুষ্ঠানিকতা থেকে সংগীতকে মুক্তি দেওয়া আবশ্যক ৷ কেননা , কৌশল নয় , ভাব প্রকাশই সংগীতের প্রধান ধর্ম ৷ সঙ্গীত তাই “সুরের রাগরাগিণী নহে , সঙ্গীত ভাবের রাগরাগিণী” ৷ কবিতার ম’ত সংগীতও ভাবের ভাষা ৷ এজন্যই “যে কো’ন দেশের সংস্কৃতির আদি যুগে…সঙ্গীত ছি’ল কাব্যাশ্রয়ী , তথা কাব্য ছিল সঙ্গীত নির্ভর” ৷ কিন্তু কবিতাকে ভাব থেকে ভাবান্তরে , অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে এগিয়ে যেতে হয় ৷ “ভাবের গঙ্গোত্রী হইতে ভাবের সাগরসঙ্গম পর্যন্ত তাঁহাকে অনুসরণ করিতে হয় ” ৷ সেখানে “সঙ্গীত একটি স্থায়ী স্থির ভাবের ব্যাখ্যা করে মাত্র ” ৷ অতএব আমাদের মনে রাখতে হবে—
“সঙ্গীত ও কবিতার আমরা কোন প্রভেদ দেখি না , কেবল উন্নতির তারতম্য ৷ উভয়ে যমজ ভ্রাতা , এক মায়ের সন্তান , কেবল উভয়ের শিক্ষার বৈলক্ষণ্য হইয়াছে মাত্র ৷…কবিতারও যে স্বাধীনতা আছে সঙ্গীতেরও সেই স্বাধীনতা হউক ; কারণ , সঙ্গীত কবিতার ভাই ” ৷

“The origin and funtion of Music “. নামক হার্বাট স্পেনসরের এই
প্রবন্ধের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ লিখিত ও অভিনীত হহওয়ার পর ৷ ‘সঙ্গীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতাঃ হার্বাট স্পেনসরের মত’
প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেনঃ” ‘সঙ্গীত ও ভাব’ — নামক প্রবন্ধ রচনার পর হার্বাট স্পেনসরের রচনাবলী পাঠ করিতে করিতে দেখিলাম ‘The origin and funtin of Music’-নামক প্রবন্ধে যে সকল মত ব্যক্ত হইয়াছে তাহা আমার মতের সমর্থন করে , এবং অনেক স্থলে উভয়ের কথা এক হইয়া গিয়াছে” ৷ স্পেনসরের বক্তব্য ছিল এটাই যে , কথার মধ্যে যেখানে হৃদয়ের
আবেগ যুক্ত হয় সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই সুর এসে লেগে যায় ৷আমাদের
আবেগর কথায় শুধু কথা নয়, সুর ও থাকে ৷ “এই কথাবার্তার আনুষঙ্গিক সুরটারই উৎকর্ষ সাধন করিয়া মানুষ সঙ্গীত পাইয়াছে” ৷ আর এই সংগীতের একটি প্রধানতম অঙ্গ হ’ল তাল ৷ সংগীতের প্রয়োজন বুঝে রচয়িতা যদি নিজে তার সীমানা বেঁধে দেন , তাহলে সুর ও তালের রেষারেষি বন্ধ হয় ৷ কাব্যে ছন্দের যে ভূমিকা , গানে তালের সেই একই ভূমিকা ৷ এই উপলব্ধির মধ্যে
দিয়ে কবির যেন এক বিশ্ব দর্শন ঘটছে ৷ ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে তিনি ঠিক এই অনুভবের কথাই শোনাচ্ছেন—”কবিতার যেটা ছন্দ , সঙ্গীতে সেটাই লয় ৷ এই লয় জিনিসটি সৃষ্টি ব্যাপিয়া আছে , আকাশের তারা হইতে পতঙ্গের পাখা পর্যন্ত সমস্তই ইহাকে মানে বলিয়াই বিশ্বসংসার এমন করিয়া চলিতেছে অথচ ভাঙিয়া পড়িতেছে না”৷
এভাবেই সংগীত রবীন্দ্র মননে ব্রহ্মান্ড বিদ্যার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে ৷ তাঁর
কাছে সংগীত তাই প্রয়োজনের ‘অন্ন’ নয় , তা হ’ল অপ্রয়োজনের ‘অমৃত’ ৷ এই ‘অমৃত’ সর্বকালের , সর্বমানবের আনন্দরূপ ; যা চিরন্তন ৷ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তিনি সংগীতকে তাই অপরিসীম গুরত্ব দিয়েছেন ৷ আমাদের দেশের শিক্ষাবিভাগ কলাবিদ্যাকে যথাযথ সম্মান দিক , এমনটাই চাইতেন
রবীন্দ্রনাথ ৷

রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা বারংবার বোঝাতে চাইছে , এই সমগ্র জগৎ সংসারের মূল সুর আমাদের সমস্ত সৃষ্টির ভেতর কো’ন না কো’ন ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে ৷ প্রত্যেক যুগ তাই নিজের ম’ত সৃষ্টি চায় ৷ তাই যে যুগে বাঙালি কীর্তন সৃষ্টি করল , সৃষ্টির নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী সেই কীর্তনে মিশে গে’ল সাহিত্য , সংগীত ও নাট্যরস৷
রবীন্দ্রনাথ তাই মনে করেন ,”সঙ্গীতের ম’ত এমন আশ্চর্য ইন্দ্রজালবিদ্যা জগতে আর কিছুই নেই—এ এক নূতন সৃষ্টি কর্তা ” ৷ তাঁর বিশ্বাস ছি’ল , গায়ক গানের মধ্যে দিয়ে নিজের অনুমোদিত বিশেষ ভাবের ব্যাখ্যা করেন ; এ কারণে গায়কের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন ৷ তিনি এও বিশ্বাস করতেন , সংগীত শুধুমাত্র চিত্তবিনোদনের উপকরণ নয়; আমাদের
মনে সংগীত যে সুর বেঁধে দেয় তা জীবনকে এক অভাবনীয় সৌন্দর্য দান করে ৷ এই “সৌন্দর্য মানুষের বীর্যের প্রধান সহায়” ৷ তাই প্রাণের ধর্ম ও সংগীতের ধর্ম অভিন্ন ৷ সংগীতের ভেতরে অদম্য প্রাণশক্তির প্রয়োজন অনুভব করেছেন তিনি ৷ এই প্রাণশক্তি
দ্বারা সংগীত সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও পরিবর্তন করতে পারবে বলেই রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে ৷
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বিশুদ্ধ সুরের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন ৷ বিচিত্র সুর ও শিল্পের মেলবন্ধন কবিকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রাণিত করেছে ৷ তাঁর নিজের গানও এই মেলবন্ধনেই জায়মান থেকেছে ৷ সংগীতের নন্দনতত্ত্বে সাপেক্ষবাদ এবং নিরপেক্ষবাদ , এই দুই মতবাদের পরিচয় পাওয়া যায় ৷ সাপেক্ষবাদ অনুযায়ী জগৎ-জীবন-বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে গভীর অন্বয়ে সম্পৃক্ত ৷ অন্যদিকে নিরপেক্ষবাদ বলছে , সঙ্গীতের জগৎ এমন এক রূপের জগৎ , যা পুরোপুরি লৌকিক অভিজ্ঞতা থেকে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ ৷ তবে এই দুই মতবাদ এমন এক জায়গায় এসে পরস্পর মিলে যায় যেখানে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে মানব
সম্পর্ক গভীর এক ঐক্য সূত্রে বিশ্ব সঙ্গতির দ্যোতক হয়ে ওঠে ৷ রবীন্দ্রনাথ এই উভয় মতবাদের দ্বারা কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত হয়েছেন ; কিন্তু কো’ন এক নির্দিষ্ট মতবাদের দাসত্ব করেন নি ৷ মতবাদের গঠনে যে স্থবিরতা আসে তা তিনি সমর্থন করেন নি বলেই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মত বদলেছেন ৷ এই চলমানতা তাঁর নিজের সৃজনে শেষ দিন পর্যন্ত ফুটে উঠেছে ৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির
ম’ত তাঁর সৃষ্ট সংগীত এবং সংগীত চিন্তায় বন্ধন মুক্তির আদর্শ প্রচার করলেন ৷ আসলে রবীন্দ্রনাথের কাছে গতিতত্ত্বের ম’ত স্থিতিতত্ত্বও সমান ভাবে
সত্য ৷ যে জগৎ রূপের দ্বারা সীমাবদ্ধ, সেই জগৎ-ই আবার গতির দ্বারা অসীমকে প্রকাশ করছে নিত্য পরিবর্তন
ও রূপান্তরের ভেতর দিয়ে ৷ শিল্পের প্রতিটি অংশের ম’ত সংগীতেও এই চলার শেষ নেই ৷ তাই সুর যখন অন্তরের সমস্ত তন্ত্রী কাঁপিয়ে দেয় তখনই জগৎকে নতুন ভাবে জানার আগ্রহ রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তাকে এক দার্শনিক সুদূরতা দান করে ঠিক এই ভাষায়—

“আমি চঞ্চল হে…
আমার আপন গান…
এবার আমায় ডাকলে দূরে…”

এ যেন “হেথা নয় , অন্য কোথা , অন্য কোন খানে”-র অবারণ চলার গতিরাগ , যা তাঁর সংগীতচিন্তারও মর্ম বাণী !

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত