Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Rabindranath Tagore Poet,History & Growth of Calcutta Telephones

প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথের বিশ্বায়নচেতনা । বিশ্বজিৎ ঘোষ

Reading Time: 3 minutes

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক মহান মানবতাবাদী লেখক। পৃথিবীর সমগ্র মানুষের জন্য, মানবসমাজের কল্যাণার্থে তার অন্তহীন ভাবনার জন্য তিনি ‘বিশ্বকবি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। জন্মগত উচ্চ আভিজাত্য, ঠাকুরবাড়ির অভিজাত জীবনাচার, ব্রাহ্ম ধর্মদর্শন, ঔপনিষদীয় প্রতীতি এবং পাশ্চাত্য চিন্তাস্রোত অঙ্গীকার করে রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর রূপান্তরিত হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত সুস্থিত হয়েছেন প্রগতিশীল সমাজচেতনা ও বিশ্বমানবমুক্তির সর্বজনীন দার্শনিক প্রত্যয়ে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘ আশি বছরের জীবনবৃত্তে বিচিত্র চিন্তা, বিপ্রতীপ মূল্যাশ্রয়ী আদর্শ এবং বহুভুজ দার্শনিক প্রত্যয়ে অবিরল বিচরণ করলেও, রবীন্দ্রনাথের সকল চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্রস্থ প্রাণশক্তি ছিল মানবকল্যাণদর্শন। এই মানবকল্যাণ আকাঙ্ক্ষা থেকেই আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে রবীন্দ্রভাবনায় দেখা দিয়েছিল বিশ্বায়নের চেতনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসলোকের বিশিষ্টতা এই, সেখানে একই সঙ্গে ভাবয়িত্রী এবং কারয়িত্রী প্রতিভার মিলন ঘটেছে। কারয়িত্রী প্রতিভার টানে জীবনের নানা সময়ে তিনি অনেক কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, স্থাপন করেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মচর্যাশ্রম ক্রমে পরিণত হয় বিশ্বভারতীতে। এই বিশ্বভারতী-ভাবনার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের বিশ্বায়নচেতনা প্রথম প্রকাশ লাভ করে। ‘বিশ্বভারতী’ নামের মধ্যেই বিশ্বায়নের ধারণা লুকিয়ে আছে। ১৯১৬ সালে বক্তৃতা-সফরে আমেরিকা যান রবীন্দ্রনাথ। সেখান থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মৌল দর্শন ব্যাখ্যা করে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লেখেন_ ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে_ ঐখানে স্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে_ স্বাজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে_ ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।’ এই ভাবনার কয়েক বছর পর কবি বিশ্বভারতীর তরুণ শিক্ষক সুহৃৎ কুমার মুখোপাধ্যায়কে এক পত্রে লেখেন_ ‘ভারতের একটা জায়গা থেকে ভূগোল বিভাগের মায়াগণ্ডী সম্পূর্ণ মুছে যাক_ সেইখানে সমস্ত পৃথিবীর পূর্ণ অধিষ্ঠান হোক_ সেই জায়গা হোক আমাদের শান্তিনিকেতন।’


আরো পড়ুন: বস্তুবাদের নিরিখে রবীন্দ্রনাথের ভাববাদিতা


একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে যখন বিশ্বায়ন নিয়ে সবাই মুখর, রবীন্দ্রনাথের ভাবনা এবং কর্মে তা-ই দেখা দিয়েছিল। অভিন্ন রূপে, আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ পূর্বে। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বভারতী’ ছিল আজকের বিশ্বপল্লীরই প্রথম অনুভাবনা। আজ পৃথিবীজুড়ে বিশ্বায়ন সম্পর্কে যে চিন্তা-ভাবনা চলছে, সে প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বায়নচেতনা পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বায়নচেতনা ও বিশ্বমানবতাবাদ একই অর্থবোধক। তিনি ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে এই বিশ্বমানবতাবাদের বাণী উপস্থাপন করেছেন, যা আজকের বিশ্বায়ন নীতির মূল কথা। ওই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন_ ‘এতকাল ধর্ম ছিল সম্প্রদায়কেন্দ্রিক_ সেই সম্প্রদায়গুলো আবার বহু উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত, পরস্পরের ঈশ্বরই মানুষের মিলনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু ধর্ম আসলে একটাই_ তা হচ্ছে মানুষের ধর্ম।’ জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এই মানবধর্মের প্রতিভূরূপেই রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করলেন মহামানবের আবির্ভাব বার্তা_ ‘ওই মহামানব আসে’ রবীন্দ্রনাথের এই মহামানব কোনো মহাপুরুষ নন, এ মহামানব হচ্ছে_ ্তুঞযব গধহ্থ _ মনুষ্যত্বের প্রতীক_ সমগ্র মানুষের পুঞ্জীভূত মানবিক গুণের সমাহার। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বচেতনার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, তিনি মানুষের মধ্যে কোনো ভেদকে স্বীকার করেননি, বরং এই ভেদ দূর করার বাণী উচ্চারণ করেছেন। তার বিশ্বমানবচেতনায় যেমন দূর হয়েছে ধর্মীয় বিভেদ, তেমনি অবলুপ্ত হয়েছে ভৌগোলিক সীমারেখা। বিশ্বের সকল মানুষকে নিয়ে তিনি কল্পনা করেছেন একটি অখণ্ড সমাজ_ স্বদেশের মধ্যেই লক্ষ্য করেছেন ‘বিশ্বময়ীর বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’; আবার বিশ্বের মাঝে উপলব্ধি করেছেন আপন অস্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো তার উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ সঙ্গীত_ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা বিশ্বায়নচেতনার নানা রূপ লক্ষ্য করি। ‘গোরা’ উপন্যাসে বিশ্বায়নচেতনার একটি স্বতন্ত্র রূপ প্রকাশিত। তার অনেক সঙ্গীতেও প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বায়নচেতনা। আবার বিশ্বায়ন নীতির ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি যে নেতিবাদী প্রবণতা পরিদৃশ্যমান, সে সম্পর্কেও অর্ধশতাব্দীর অধিককাল পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর পূর্বেই বিশ্বায়ন নীতির আগ্রাসী রূপ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে নির্ভুলভাবে ধরা পড়েছে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় তার ‘কালান্তর’, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থচিন্তার কারণে বিশ্বায়ন অনেক ক্ষেত্রে আজ পরিণত হয়েছে অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে। আকাশ সংস্কৃতির দাপটের কাছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন-প্রায়, অর্থনৈতিক শোষণে দরিদ্র দেশসমূহ আজ বিপর্যস্ত। বিশ্বায়নের মূল কথা হলো সকলের সম্মিলিত সত্তার একক রূপ_ সকলকে মিলিয়ে এক বিশ্ব; কিন্তু আজ এক দেশ এক সংস্কৃতিই হয়ে উঠছে সব দেশ সবার সংস্কৃতি। পূর্ব-পশ্চিমের মিলন নয়, বরং পশ্চিম জোর করে চেপে বসেছে পূর্ব-পৃথিবীর ঘাড়ে। বিশ্বায়নের নামে আজ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব গ্রাস করতে উদ্যত পূর্ব-পৃথিবীর অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। বিশ্বায়ন নীতির দোহাই দিয়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই ষড়যন্ত্র রবীন্দ্রচিন্তায় বহু বছর পূর্বেই পরিলক্ষিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বায়নচেতনা ছিল ইতিবাচক ও সদর্থক। তাই মানুষের মুক্তির জন্য তিনি কামনা করেছেন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব পৃথিবীর জাগরণ। তিনি জীবনের অন্তিম সময়ে ঘোষণা করেছেন_ “…মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি। … এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে-
 অধর্মেনৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
 ততঃ সত্নান্, জয়তি_ সমূলন্ত বিনশ্যতি’।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>