| 29 নভেম্বর 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও দর্শন । হাবীব ইমন

আনুমানিক পঠনকাল: 17 মিনিট

এক.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রগতিচেতনা তাঁর সাহিত্যে ভাবগভীরতা ও বৈশিষ্ট্যে সুদৃঢ়। তিনি রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তবে তাঁর রাজনীতির দর্শন আমাদেরকে আন্দোলিত করে। প্রশ্ন হলো, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও দর্শন কী! রবীন্দ্রনাথকে জানা মানে নিজেকে আবিষ্কার করা। নিজের উপলব্ধির দরজাটা আরেকটু খুলে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ যখন নিজের কথা বলেন এভাবে, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না-এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা’―তখন বিষয়টা অনেকাংশে উল্টোভাবে দেখা যায়-তাঁকে জানার মতো মনোসংযোগ কি আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে? আমরা রবীন্দ্রনাথের মূলত এক-তৃতীয়াংশ কাজের মধ্যেই কবি রবীন্দ্রনাথ বা গীতিকার, সুরকার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের দিন-রাত যাপন করি। রবীন্দ্রনাথের নন্দনবোধ তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখছে―দার্শনিক কাব্যে সুর পড়লে তা হয়ে ওঠে গান; এবং এই গান কিংবা পদ্যগুলো আওড়াই নিয়ত বা বিশেষ দিনগুলোতে―‘এই যেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথ আছেন―যাঁর দার্শনিক ভাবনা আমাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি, চির আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক।

দুই.
প্রগতিশীল সাহিত্য কাকে বলে? প্রগতি কথাটাও আপেক্ষিক। যে সাহিত্য পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চেতনাকে শাণিত করে অথবা শ্রেণি-সংগ্রামের পক্ষে সহায়ক হয় তা-তো অবশ্যই প্রগতি সাহিত্য। যেমন ম্যাক্সিম গোর্কির রচনা, নজরুল বা সুকান্তের কবিতা অথবা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প, এমনকি রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা’র মতো কবিতা বা ‘শাস্তি’ নামক ছোটগল্পটি এই ধরনের সাহিত্য। কিন্তু প্রগতি সাহিত্যকে যদি শুধু এতোটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় তাহলে ভুল হবে। তা হবে প্রগতি সম্পর্কে যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে সমাজে সামন্ত চিন্তা-চেতনা প্রবলভাবে বিরাজমান, সেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রগতিশীল। শেক্সপীয়র অবশ্যই সাম্যবাদী ছিলেন না। শ্রেণি সংগ্রামের কবি বা নাট্যকার ছিলেন না। তবু মার্কস কেন তাঁকে মহৎ মনে করতেন? শেলী বায়রনের কাব্যকে মার্কস বিপ্লবী রোমান্টিসিজম বলে অভিহিত করে প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে, মার্কসের মতে, ইংরেজ কবি কলরিজ বুর্জোয়া সমাজকে প্রত্যাখান করলেও তা ছিল অতীত অভিমুখী, সামন্তঅভিমুখী। গ্যেটেকেও মার্কস তাঁর বিভিন্ন রচনায় বহুবার উদ্ধৃত করেছেন, যদিও গ্যেটে ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিলেন। দান্তের ডিভইন কমেডিতে যে কাহিনি আছে, তা হলো, প্রেমিকার খোঁজে স্বর্গযাত্রা। তবু দান্তের মধ্যে মার্কস দেখেছেন, ‘অতুলনীয় ক্ল্যাসিকাল বিশুদ্ধতা এবং মানুষের প্রতি পক্ষপাত’। মানুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব―এটা গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য বালজাকের ‘ডিভাইন হিউম্যান’ মার্কসের এতো প্রিয় ছিলো। এই বই সম্পর্কে এঙ্গেলসও বলেছেন, এর থেকে ‘আমরা যা শিখেছি, তা সেই সময়ের সকল ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ আর পরিসংখ্যানবিদদের একযোগ করলেও, তার চেয়ে বেশি শিখতে পারিনি’।
তলস্তয় সমাজবাদী ছিলেন, তবে তার সমাজতন্ত্র ছিলো বাইবেল নির্ভর এবং তিনি কখনো সশস্ত্র বিপ্লব অনুমোদন করতেন না। তবু লেনিন তাঁর রচনাকে বলেছেন, ‘রুশ বিপ্লবের দর্পন’। তিনি তলস্তয় সাহিত্য পাঠ করতে উৎসাহিত করেছেন, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল অংশসমূহকে বাদ দিয়েই তলস্তয়কে গ্রহণ করতে হবে। যেমন মার্কস দার্শনিক হেগেলের দ্বন্ধমূলক তত্ত্ব, যা ছিলো বিপ্লবী, তাকে গ্রহণ করেছিলেন, ভাববাদী দিককে পরিত্যাগ করে। একইভাবে রবীন্দ্র সাহিত্যে কেবল ভাববাদী দর্শনই আছে, আর কিছুই নেই, এমন মনে করা নিশ্চয়ই ভুল হবে। রবীন্দ্রসাহিত্যে বাস্তবমুখিতাও আছে, ব্যাপকঅর্থে সমাজপ্রগতির উপাদানও আছে। সেইজন্যই তিনি মহৎ। রবীন্দ্র সাহিত্যের একটা বড় অংশে ভাববাদের প্রাধান্য থাকলেও তাঁর যে বিশ্বমানবতাবাদী অবদান এবং প্রগতির পক্ষে যে বিশাল ভ‚মিকা তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে বুর্জোয়া কবি, জমিদার ইত্যাদি বলে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন বা বাতিল করার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছিলো, তাকেই মূর্খতাই বলতে হবে। তা হবে প্রগতির নামে ক্যারিকেচার।

তিন.
স্বদেশ, স্বজাতি, স্বধর্মীদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে এমন বিভাজক জাতীয়তাবাদের জন্ম হতে পারে, যা পুরো জাতিকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এমন ধারণার ‘ঘোরতর’ সমর্থক। তিনি ‘জাতি’ শব্দের চেয়ে ‘দেশ’ শব্দটি বেশি পছন্দ করতেন। নবজাগরণ বলতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বিদেশি বন্ধু সি এফ এন্ডরুজের কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের অনুভ‚তি থেকে এ বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হওয়া যায়―
আমরাই সমগ্র মানবজাতির জন্য স্বাধীনতা অর্জন করব। আমার ভাষায় ‘নেশন’ কথাটির কোনো প্রতিশব্দ নেই। যখন এই শব্দটি অন্যদের কাছ থেকে ধার করে আমরা ব্যবহার করব, সেটা আমাদের পক্ষে ঠিক খাটে না। কারণ আমরা সন্ধি করব নারায়ণের সঙ্গে, নারায়ণী সেনার সঙ্গে নয়। তাই আমাদের যে জয়, সে ভাগবৎ রাজ্যেরই জয়। পশ্চিমকে আমি দেখেছি। যে অপবিত্র ভোজে সে সর্বদা মত্ত, … তাতে আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। জ্বলন্ত মশালের আলোয় মধ্য রাত্রের এই যে মত্ততা, তা আমাদের জন্য নয়। আমাদের রয়েছে শান্ত উষার … নবজাগরণ।

‘লীগ অব নেশনস’-এর ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ পক্ষপাতমূলক ‘লীগ অব নেশনস’-র সমালোচনায় তাকে ‘অজগর নীতি’-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাঁর কাছে ‘জাতি’ হচ্ছে ইংরেজিNation-এর বাংলা অনুবাদ। তার জন্য তিনি ‘নেশন’-কে কিছুটা মানতে পারলেও ‘ন্যাশনালিজম’-কে গ্রহণ করতে পারেননি। ১৮৮৩ সালে যখন নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছিল ‘ন্যাশনাল’ সাইনবোর্ড ধারণ করে, রবীন্দ্রনাথ তখন ‘জিজ্ঞাসা ও উত্তর’ প্রবন্ধে লিখলেন―‘জাতীয় তহবিল বা জাতীয় ভান্ডার (ন্যাশনাল ফান্ড) নাম করে যখন মুসলমানদিগের নিকট হইতেও টাকা লওয়া হইতেছে, তখন উক্ত ভান্ডারকে জাতীয় কিরূপে বলা যায়?’ জাতি বলতে তখন হিন্দুর জাতীয়তাকেই বোঝানো হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই সব কর্মকান্ডের ভেতর ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয়। তিনি ওই সমস্ত উদ্যোগকে জাতীয় না বলে দেশীয় বলা শ্রেয় মনে করতেন। শব্দটি দেশীয় হবে আবার অসাম্প্রদায়িকও হবে।‘Nationalism’ নামক বইয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন―কিভাবে জাতীয়তবাদ মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ পশ্চিমের হাতিয়ার, যা রাষ্ট্র তার স্বার্থে নিয়োগ করলে শান্তি বিনষ্ট হয়, হানাহানি সৃষ্টি হয়, মানুষে মানুষে ও সভ্যতা পড়ে যায় সংকটে। ১৯১৬ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান ও আমেরিকায় ন্যাশনালিজমের ওপর বক্তৃতা করেন। এই ন্যাশনালিজম তাঁর মতে, বিশ্বের জন্য ভয়াবহ বিপদ এবং এর পেছনে চালিকাশক্তি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও লুণ্ঠনের অতি উগ্র বাসনা।
ধ্রুপদি ও লোক সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করেন। অসংখ্য বক্তৃতায় ধর্ম, জাতি, সমাজ, শিক্ষা, স্বদেশ, মুক্তি, সভ্যতা নানা বিষয়ে তাঁর দর্শন ব্যক্ত করেছেন। ১৯১৭ সালে জাতীয়তাবাদের ওপর একটি ইংরেজি বক্তৃতায় রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর অনুধাবন এই উপমায় বুঝিয়েছেন―‘রাষ্ট্রের কাজ ডিমের খোসার মতো। এই ডিম ও খোসার উপযোগিতা একেকজনের কাছে একেক রকম। ডিমের খোসাটি ডিমের ভেতরে থাকা ছানাটিকে নিরাপত্তা দেয়। আর সকালের প্রাতরাশকারীর কাছে এই খোসার কোনো মূল্য নেই’। পরাধীন ভারতবর্ষে যে রাষ্ট্রকে রবীন্দ্রনাথ নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জেনেছেন, সেটি প্রাতরাশকারীর কাজে লেগেছে, ডিমের ভেতরে ছানার কোনো উপকার করেনি। এ রাষ্ট্র ছিল নির্মম, ভয়াবহ, যে বোতল দিয়ে সে দুধ খাওয়াত শিশুকেÑঅর্থাৎ দিতো শিক্ষা, সেটা গিয়েছিল শুকিয়ে; কিন্তু স্ফীত হয়ে উঠছিল সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সিআইডি ও টিকটিকি। এ রাষ্ট্র্রকে রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত সমাজের প্রতি। ব্রিটিশ-ভারতের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের মালিকানা দেখিয়ে ছিলেন ইংরেজদের।
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার লাভ করছেন, তখনই ইউরোপ এবং অনেক দেশেই বেজে যায় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তি, যার সঙ্গে আমরা রাজনীতির সংযোগ কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু বাস্তবটা মোটেও এ-রকম নয়। রবীন্দ্রনাথ শুধু যে রাজনীতি সচেতন ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন নতুন এক ধরনের রাজনীতি―¬সহনশীল রাজনীতির প্রবক্তা। ১৯১৭ সালে জাপানে দেওয়া এক বক্তৃতায় যে ভাষায় সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা যে গীতাঞ্জলি-র  স্রষ্টার, তা মেনে নিতে করতেই কষ্ট হয়। তাঁর মতে, সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি―‘feeds upon their dead flesh and grows fat upon it, so long as the carcasses remain fresh, but they are sure to rot at last, and the dead will take their revenge by spreading pollution far and wide and poisoning the vitality of the reader’.

এই কঠোর সমালোচনার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদের রাজনীতির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেলেও এই তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতা মোটেই পাল্টায়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন বিতর্কিত এই কারণেই যে, সাম্রাজ্যবাদকে তিনি ফেলেছেন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একই সূত্রে। জাপানের একাধিক জায়গায় বক্তৃতায় তিনি সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উচ্চারণই করেননি। করেছেন জাতীয়তাবাদ কথাটি। তাঁর মতে, উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাই বিশ্বযুদ্ধসহ সকল রাজনৈতিক সংঘর্ষের মূল কারণ। এটি রবীন্দ্র দর্শনের সীমাবদ্ধতা বলেও অনেকে মনে করেন। কেননা রবীন্দ্রনাথ পুঁজির বাড়বাড়ন্ত, শ্রেণি সংঘাত ইত্যাদি মার্কসীয় তত্ত¡ ও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, কিন্তু মূল উৎস হিসেবে জাতীয়তাবাদী আবেগকেই দেখেছেন। জাতীয়তাবাদী আবেগ সম্পর্কে তাঁর যে একটি বিভ্রান্ত অবস্থান ছিল সেটি তিনি নিজেও যে অস্বীকার করেছেন তা নয়। অনেকের মতে, জাতীয়তাবাদ যে গঠনমূলকও হতে পারে, মানবিকতার পূজারী রবীন্দ্রনাথ তা উপলব্ধি করেননি। চারপাশের যুদ্ধ বিগ্রহ, অন্ধ জাতীয়তাবাদের প্রকোপ কবিমনকে বিভ্রান্ত করেছিল। যে অন্ধ জাতীয়তাবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন, তার থেকে উত্তরণের উপায়ও তিনি পরিষ্কার বলে যাননি।

১৯৩০ সালে স্টালিন সময়কালেই রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণ করে এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি এই ভ্রমণকে ‘তীর্থ দর্শনের’ মতো পবিত্র মনে করেছেন। সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণকে তিনি ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান’ বলে বিবেচনা করে তার বিভিন্ন দিকের ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যেটা আমার চোখে ভালো লেগেছে, সে হচ্ছে এই ধনগরিমার সম্পূর্ণ তিরোভাব’ (রাশিয়ার চিঠি)। রবীন্দ্রনাথের চোখ ‘ভিন্ন চোখ’ নয়, বরং মানবিকতার চোখ। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও বলশেভিক দলের ক্ষমতায় আসার সহিংস বিপ্লব পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বিরাগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের রচনায় মার্কসবাদ সম্পর্কে বিশেষ কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। কোনো কোনো লেখায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সামান্য কিছু বক্তব্য আছে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক―দুটোই। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিপীড়ন, শোষণ, হত্যাযজ্ঞ কবিমনকে বিক্ষুব্ধ করেছে, পীড়িত করেছে। আবার তিনিই শ্রেণি সীমাবদ্ধতার কারণে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনাও করেছেন।

হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিবরণী থেকে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং এই ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল―‘আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ’। এই কারণে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে বাস্তবসম্মত উপযোগমূলক শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান। এই ধরনের মতবাদ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রানসিকোর একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল ভারতীয় চরমপন্থী রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

চার.
প্রথমে জীবনে রবীন্দ্রনাথও যে ইংরেজদের মধ্যে উদারতা দেখেছেন সে-কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করে গেছেন, কিন্তু গান্ধীর অবৈজ্ঞানিকতা, তাঁর আধুনিক সভ্যতা বর্জন, বিদেশি বস্ত্র পোড়ানো, চরকা নিয়ে বাড়াবাড়ি, জন্মনিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতার ব্যাপারে উদাসীনতা―এসবের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের কোনো সমর্থন তো নয়ই, আগ্রহও ছিলো না। গ্রামকে উন্নত না করলেও যে দেশের উন্নতি নেই―এই সত্য রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কাজ উভয়ের ভেতরেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিলো।


Rabindranath Tagore


গান্ধী এবং তাঁর রাজনীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দ্বৈত আচরণ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ছিলো উভয়পক্ষ থেকেই প্রচুর সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের। স্বাধীনতার জন্য আত্মশক্তির বিকাশ চাই, একথা রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর মতোই জোর দিয়ে বলেছেন। মহাত্মা উপাধিটি তো রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। বেশ কয়েকবার গান্ধীর আমন্ত্রণে কংগ্রেসের অধিবেশনেও এসেছেন তিনি। কিন্তু গান্ধীর রাজনীতিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গ করেছেন বহুবার। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপাথর্ক্য অনেক বড় আকার ধারণ করে। বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন, কবির মতে, নেতিবাচক ছাড়া আর কিছু নয়। কোনও পণ্য কোনও বিশেষ এলাকায় উৎপন্ন বা সৃষ্ট বলেই তার বর্জন জরুরি, এ-ধরনের রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছন্দবোধ করতেন না। ১৯২৫ সালের একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। তাঁর এই মনোভাবের তীব্রতম প্রকাশ ‘ঘরে ও বাইরে’ উপন্যাস, যেখানে গান্ধীবাদী আন্দোলনের সমালোচনাই করা হয়েছে। অনেক সাহিত্য সমালোচকের মতে, এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট এবং খোলামেলা রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি অন্য কোথাও দেননি। যদিও এই কটাক্ষ যে গান্ধীবাদীরা খুব ভালোভাবে নেয়নি।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি প্রাঙ্গণে বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা, যদিও তার জন্য রবীন্দ্র চিন্তায় বদল এসেছিল বলে প্রমাণ নেই। ফলস্বরূপ, যে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সূচনা কবি নিজে করেছিলেন রাখিবন্ধন প্রচলনের মাধ্যমে, পরবর্তীকালে তিনি নিজেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান ও সরে আসেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কবিতা রচনা করেছিলেন এবং পথে নেমে সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন একের পর এক দেশাত্মবোধক গান। যেমন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল…’। তাঁর গানে অথবা কোনো কোনো কবিতার মধ্যেই স্বদেশিরা খুঁজে পেয়েছিলেন দেশের জন্য আত্মদানের উদ্দীপনা। এ আন্দোলনের সময়েও রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেছে সাংস্কৃতিকভাবে সোচ্চার হতে। গীতবিতান’র স্বদেশ পর্যায়ের বেশির ভাগ গানই সেই সময়ে লেখা ও গীত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ যখন স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তখন ভারত সরকারের মুখ্যসচিব চিঠি দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তৃতা দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের একটা পর্যায়ে গান্ধীকে লেখা খোলা চিঠিতে অহিংস আন্দোলন সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখনী থেকে উঠে এসেছিল―‘আপনার শিক্ষা বিধাতার সাহায্য নিয়ে অহিংসার পথে লড়াইয়ের শিক্ষা। কিন্তু, এমন লড়াই শুধু নায়কদের জন্য সম্ভবপর, সাধারণের জন্য নয়। সাধারণ মানুষ মুহূর্তের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত হয় বারবার। তাই, অন্যায়ভাবে সে উদ্যম প্রতিহত হলে অপমানজনক সন্ত্রাস আর হিংসা সহজেই সেই লড়াইয়ের পথ হয়ে উঠতে পারে।’
১৯২০-এ প্যারিসে লিখিত একটি পত্রে জানা যাচ্ছে―
দেখছি অসহযোগ নিয়ে আমাদের দেশের লোকেরা উগ্রভাবে মেতে উঠছে। এই আন্দোলনও বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনের একটা কিছু হয়ে দাঁড়াবে। এরকম ভাবে আবেগকে যদি ভারতব্যাপী স্বাধীন প্রতিষ্ঠা গড়ে তোলার কাজেই বিশেষ করে লাগানো যেত কত ভালো হত। মহাত্মা গান্ধীই এ কাজে সত্যিকারের অধিনায়ক হোন। বিশেষভাবে দেশসেবার আহবান, আত্মত্যাগের আবেদন তিনি জানান। তারই প্লাবনে প্রেম ও সহযোগের আদেশ যদি তিনি দেন, আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে তাঁর কথা মত কাজ করতে রাজী আছি। ক্রোধের আগুন জ্বেলে দিয়ে তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেবার কাজে আমার পৌরুষের ক্ষয় কিছুতেই করব না। রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিক অর্থে একজন সচেতন ও ইতিবাচক লেখক ছিলেন, যিনি তাঁর আদর্শকে কখনোই ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করেননি। গান্ধীর সঙ্গে ভারত স্বাধীনতায় অংশগ্রহণ তাঁর জনপ্রিয়তাকে অনেকটা উচ্চে তুলে ধরতে পারতো, একথা জেনেও তিনি সে পথে যাননি।

১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড দু’জনকেই মর্মান্তিক আঘাত করেছিল। ঘটনাটির প্রতিবাদে, ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লর্ড চেমস্ফোর্ডকে তিনি জানালেন, ‘আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি’। কংগ্রেসের নিরবতা, এমনকি সেই সময়কার প্রধান রাজনীতিবিদদের পিছিয়ে যাওয়ার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সাংস্কৃতিক ও রুচির দিক থেকে অনন্য। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ও গান ‘একলা চলো রে’ রাজনৈতিক রচনা হিসেবে জনমানসে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের লিপিকা―গদ্যে রচিত হলেও বুদ্ধদেব বসু তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন শুরু করেন ‘লিপিকা’ দিয়ে, যেখানে বুদ্ধদেবের ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথ নতুন করে জন্ম নিয়েছিলেন’। ‘লিপিকা’র প্রথম রচনার শুরু হয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কবি-কর্তৃক সরকারি খেতাব প্রত্যাখ্যানের পর দিন ভোরে।

১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ মস্কো পৌঁছলেন। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ যার কবিতাগুলি রচিত হয়েছে তাঁর সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণের পরবর্তীকালে। তিরিশের দশকের বাংলা কবিতার মোড় ফেরার যথার্থ যাত্রাবিন্দু এই ১৯৩২ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ।
তারপর ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপ থেকে ফিরে, কলকাতায় তিনি প্রায় চার ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন গান্ধীর সঙ্গে। অনেকের মতে অবশ্য, সেই দীর্ঘ আলোচনায় বিশেষ কোনো ফল হয়নি। কারণ তারপর-পরই, অসহযোগ আন্দোলনে বের হন গান্ধী। এবং রবীন্দ্রনাথ মন দেন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে। তবে গান্ধীর সঙ্গে সেই বৈঠকের কয়েক মাস পরেই ‘মুক্তধারা’ রচনা করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২২ সালে লেখা এই নাটকটি ‘রূপক-সাংকেতিক ধারা’ সৃষ্টি করেছিল বলে মনে করেন বহু রবীন্দ্র সমালোচক। অনেকেরই ধারণা, এ নাটকে সমকালীন ব্রিটিশ-ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সে সময় (১৯২০-১৯২২) ভারতে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন, মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলন এবং শহরের শ্রমিক ধর্মঘটসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক সংগ্রাম এক পর্বতশিখর অবস্থায় পৌঁছেছিল। স্বাভাবিক কারণেই, এসব আন্দোলন এবং বিদ্রোহ নির্মম ও হিংস্রভাবে দমন করছিলো ব্রিটিশ সরকার। চলছিলো কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনও। একে একে আটক হয়েছিলেন মতিলাল ও জওহরলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশসহ কংগ্রেসের হাজারো নেতা-কর্মী। এরপর একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চাষীরা একটি থানা পুড়িয়ে দিলে, তাঁর ‘অহিংস’ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন গান্ধী। মার্চে তাঁকেও গ্রেপ্তার করার হয়। আর তারই পটভ‚মিতে ‘মুক্তধারা’ সৃষ্টি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার গল্পটি হলো এরকম―উত্তরকূট হয়ে শিবতরাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মুক্তধারা নামের একটি নদী। যা ছিল মানুষের জীবনসম। সে যাই হোক, দুর্ভিক্ষের কারণে দু’বছর যাবৎ উত্তরক‚টের রাজা রণজিৎ-কে খাজনা দিচ্ছিল না শিবতরাইয়ের মানুষ। আর সেই খাজনা আদায় করতেই যুবরাজ অভিজিৎকে নিয়োগ করা হয় সেখানকার শাসনকর্তা হিসেবে। কিন্তু প্রজাদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল হয়ে অভিজিৎ বাকি খাজনা তো আদায় করলেনই না, বরং কৃষকদের জন্য খুলে দিলেন একটি গুপ্ত বাণিজ্য-পথ। যেই পথে স্থানীয় পশম বিদেশের বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন শিবতরাইবাসী। স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন রাজা। বন্ধ করে দেওয়া হয় মুক্তধারার গতিপথ। সৃষ্টি করা হয় এমন এক বাঁধ, যা শিবতরাইবাসীদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে উদ্যত হয়। এতে অভিজিৎ-এর হাত রয়েছে মনে করে, কৃষকরাও যায় তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু, যুবরাজ অভিজিৎ অস্ত্র নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই বাঁধ ভেঙে ফেলেন। মুক্তধারার তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাঁকে।
এ নাটকে কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন কেমন হওয়া উচিত―সে সম্পর্কে একটা ইঙ্গিত থাকলেও, হিংসাত্মক কর্মকান্ড সমর্থন করেননি কবি। সুনজরে দেখেননি সন্ত্রাসবাদকে। এমনকি ‘দেশহিত’, ‘পথ ও পাথেয়’ ইত্যাদি প্রবন্ধে বিপ্লবীদের পরোক্ষভাবে ভৎসনাও করেন তিনি। তাই অভিজিৎ নিপীড়িত পক্ষের হয়ে আত্মবিসর্জন দিলেও, রবীন্দ্রনাথের কাছে সে ছিল ‘মারণেওয়ালাদের’ ভেতরের পীড়িত মানুষ। অর্থাৎ ইংরেজ পক্ষের। কবির নিজের কথায়, ‘নিজের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য সে প্রাণ দিয়েছে।’ অতএব প্রাণ দিয়েই মারণ-যন্ত্রকে ভেঙেছে অভিজিৎ, যন্ত্র দিয়ে নয়। আর অহিংসবাদী গান্ধীর সমান্তরালে কবি সৃষ্টি করেছেন ধনঞ্জয় বৈরাগীকে। যেন প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে নিজেরই সর্বনাশ বয়ে এনেছে ইংরেজ-রাজ। অবশ্য ‘মুক্তধারা’-র মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশ সম্পর্ক প্রতীকায়িত হওয়ার বিষয়টিকেও নাকচ করা যায় না। এমনকি সে সময়ের পত্র-পত্রিকাতে অসহযোগ আন্দোলনকেন্দ্রিক নাটকই বলা হয়েছে ‘মুক্তধারা’-কে। যেখানে, অনেক অমিল সত্ত্বেও গান্ধীর অত্যন্ত কাছাকাছি এসে পড়ছেন রবীন্দ্রনাথ। বেছে নিয়েছিলেন শুদ্ধ শুচি, রুচিমন্ডিত অহিংসার পথ। রবীন্দ্রনাথের দেশের প্রতি ভালোবাসা কারোর থেকেই বিন্দুমাত্র কম ছিল না, তবে তাতে পথ ও মতে ভিন্নতা ছিল।

পাঁচ.
‘সভ্যতার সংকট’ এবং অন্য অনেক লেখাতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর মূল রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দর্শনের মূল কথা হল আন্তর্জাতিকতাবাদ। ‘মনুষ্য’ নামক জাতিটি যখন ধরাধামে আবিভর্‚ত হয়, তখন ছিল না দেশ-মহাদেশের সীমা। দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবই মানুষের সৃষ্টি এক কাল্পনিক বিভেদ। তাই এর উপর ভিত্তি করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া অথবা বিভেদের বীজ বপন করা অর্থহীন। ঠিক একই কথা সমাজতন্ত্রের মহানায়ক লেনিন বলেছিলেন―‘আমরা জাতিতে জাতিতে হিংসা ও বিদ্বেষের বিরোধী, আমরা হলাম আন্তর্জাতিকতাবাদী’। তৎকালীন সময়ে বহু উগ্রবাদী মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কমিউনিস্টদের সঙ্গে এক জায়গায় বসাতে চাইলেও কবি তা মানেননি, বরং লেনিন ও তাঁর দলের ক্ষমতায় আসার পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।
‘তলস্তয়ের স্মৃতি’ পাঠের পর যে রবীন্দ্রনাথ গোর্কির নাম অপ্রসন্ন বিরূপতায় প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬ সালের ১৬ আগস্ট নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের ডাকে বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ কর্তৃক আশুতোষ কলেজ হলে অনুষ্ঠিত গোর্কি-স্মৃতিসভায় এক বাণী পাঠিয়ে গোর্কি-সম্পর্কে তাঁর জীবনে দ্বিতীয় এবং সম্ভবত শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বললেন : ‘ম্যাক্সিম গোর্কি স্বীয় মানবপ্রেম ও সাহিত্য-সৃষ্টি দ্বারা বিশ্বসাহিত্য ক্ষেত্রে অমর কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন। তাঁরা স্মৃতির প্রতি আমি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করিতেছি’।
এই সময়কালে, স্পেনের বৈধ রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হলে, ১৯৩৬ সালের ২০ নভেম্বর ফ্যাসিস্ট-বর্বরতাকে প্রতিহত করার জন্য রোমাঁ রোলাঁ বিশ্ববাসীর কাছে এক আকুল আবেদন জানান। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে মডার্ন রিভিয়্যু-তে প্রকাশিত রোলাঁর সেই আবেদন ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলে অভ‚তপূর্ব সাড়া জাগায়। ওই বছর মার্চ মাসেই গড়ে ওঠে ‘লীগ এগেনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়্যার’-এর সর্বভারতীয় কমিটি। রবীন্দ্রনাথ এই সময় কলকাতায় ছিলেন। বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরো কেউ কেউ এই কমিটির প্রেসিডেন্ট-পদ গ্রহণের অনুরোধ নিয়ে কবির কাছে উপস্থিত হলে তিনি সেই প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি প্রদান করেন। স্পেনে অনুষ্ঠিত অমানুবিক ফ্যাসিস্ট বর্বরতায় রবীন্দ্রনাথের মন তখন ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। তিনি ফ্যাসিস্ট-বর্বরতার তীব্র নিন্দা ও ভৎসনা করে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে সাহায্য করার জন্য এই সময় তাঁর স্বদেশবাসীর উদ্দেশে এক আহ্বান জানান। সর্বভারতীয় এই কমিটিতে রবীন্দ্রনাথ হলেন সভাপতি।
১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, কলকাতায় আশুতোষ কলেজ হলে অনুষ্ঠিত হলো নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের দ্বিতীয় সম্মেলন। সম্মেলনের শুরুতে পাঠ করা হয় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রেরিত একটি বাণী। ১৯৪১ সালে গঠিত হলো ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’। সমিতির পক্ষ থেকে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে আর্শিবাদ চাইলে তিনি এই সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমিতির পৃষ্টপোষক হতে সম্মতি দিয়েছিলেন।

ছয়.
বৈপরীত্যের দ্বান্ধিকতা দিয়েই রবীন্দ্রনাথের কাব্যচেতনার শুরু এবং শেষ। শুরুতে রয়েছে সন্ধ্যাসংগীত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সন্ধ্যাসংগীত হইতেই আমার কাব্য স্রোত ক্ষীণভাবে শুরু হইয়াছে’। এ গ্রন্থের ‘আশার নৈরাশ্য’, ‘সুখের বিলাপ’ এবং ‘অসহ্য ভালোবাসা’-কবিতা তিনটিতে বৈপরীত্যের সহাবস্থান জোরালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ তিনটি শিরোনামের উচ্চারণের মধ্যেই দ্বন্ধ প্রতিধ্বনিত হয়। প্রশ্নÑআশা থাকলে নৈরাশ্য কেন থাকবে? সুখ থাকলে বিলাপ কেন থাকবে? ভালোবাসা অসহ্য হবে কেন? কিন্তু বাস্তবে এমন হয় এবং এটাই হলো জীবন ও জগতের দ্বান্ধিক রূপ। কবি এটাই বলতে চেয়েছেন। কবি বলেন, আশার অবস্থা হলো দীনদশা, কবির ভাষায়, ‘নিরাশার মতো যেন’। আশা থাকে নিরাশার মধ্যে। আমি মনে করি, আশা-নিরাশার এমন দ্বন্ধের কারণেই ঘটে সুখের বিলাপ। সুখ আছে, ভালোবাসা নেই, সুখ শুধু বিলাপ করে। সুখের মধ্যে দুঃখের এই সহাবস্থানই হলো আশা-নিরাশার দ্বান্ধিক বাস্তবতা। কিন্তু ভালোবাসা পেলেই কি এই দ্বন্ধ দূর হবে? তা নয়, বরং সেটা হয়ে যেতে পারে ‘অসহ্য ভালোবাসা’।
আশার নৈরাশ্য, সুখের বিলাপ এবং অসহ্য অতি ভালোবাসা মিলেই আমাদের জীবনের বাস্তবতা ষোল আনাই দ্বন্ধে পরিপূর্ণ। রবীন্দ্রকাব্যে সূচনা হয়েছে দ্বন্ধবাদের এ প্রতিফলন দিয়ে। সন্ধ্যাসংগীত-কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যের প্রথম পরিচয় বলে উল্লেখ করলেও তিনি দ্বন্ধবাদের পরিচয়কে প্রকাশ করেছেন পাঠকের পরিমন্ডলে।
বাস্তবতার সাথে বাস্তবতার ভাব বা কল্পনার প্রকাশের পার্থক্য এবং এ দু’য়ের সমন্বয়ের দিকটি রবীন্দ্রবিরোধী সমালোচকরা বুঝতে পারেননি এবং তারা এখানে একটি দ্বন্ধ দেখেছেন। এ বিষয়ে চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে লেখা এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘… আমার ইতিহাসে আর তোমাদের ইতিহাসে এইখানেই বাদপ্রতিবাদ হবেই …’। এখানে রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস হলো হলো বাস্তবের সময় এবং সেই বাস্তবের ভাবকে প্রকাশের সময়―এ দুইয়ের মিলিত ইতিহাস। সমালোচকরা দেখেছেন বাস্তবের ইতিহাসকে। কিন্তু ইতিহাসের অতীতকে মনের ভাব যে ধরে রেখে বর্তমানের ভিন্ন সময় তাকে তুলে ধরতে পারে, সমালোচকরা এটা বোঝেননি। রবীন্দ্রনাথ বাস্তবতা ও ভাবের দুটো দিক দেখেছেন-সেখানে দ্বন্ধ ঘটেনি বরং সম্ভাব্য দন্ধের সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর বিরোধীরা কেবল একটি দিককে দেখেছেন, অন্য দিকটি দেখতে পাননি বলে দুইয়ের সমন্বয় ঘটাতে পারেন নি, কেবল দ্বন্ধের মধ্যেই রয়ে গেছেন। জ্ঞানের ইতিহাসে ভাববাদ এবং বাস্তববাদের মধ্যে যে দ্বন্ধ বিরাজ করেছে, ভারতীয় দর্শনে শংকর এবং রামানুজের মতার্দশে এ দু’য়ের দ্বন্ধ ছিলো, ‘সোনার তরী’―চিন্তায় অনরূপ দ্বন্ধের সমি সহাবস্থানের প্রতিরূপ আমরা লক্ষ্য করি। রবীন্দ্রকাব্যে দার্শনিক দ্বান্ধিকতার প্রতিফলনের এটি একটি জোরালো দৃষ্টান্ত। এই প্রতিফলন রবীন্দ্রকাব্য গুরুত্ব দিয়েছে। দুই ধরনের দ্বন্ধের উল্লেখ করেছি। প্রথমটি হলো জীবনবোধমূলক, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় কবির তরুণ বয়সের কবিতায়; দ্বিতীয়টি হলো জগতপ্রেক্ষিতমূলক, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ‘সোনার তরী’ কবিতায়। কবির মধ্য বয়সের কবিতায় দ্বান্ধিকতার এমন দৃষ্টান্ত আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। ‘দুই বিঘা জমি’-এমনই একটি কবিতা। কবি লিখেছেন,
শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভ‚স্বামী, ভ‚মির অন্ত নাই―
চেয়ে দেখ মোর আছে বড়োজোর মরিবার মতো ঠাঁই।’

কার্ল মার্কসের দ্বান্ধিক বস্তুবাদের মধ্যে যে দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে এখানে তারই কাব্য-রূপ পাওয়া যায় । উল্লেখ্য যে, মার্কস তাঁর Das Kapital লেখা শেষ করেছিলেন উনিশ শতকের শেষদিকে, যার তৃতীয় খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালে। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটিও প্রকাশিত হয় ঠিক সে সময়টাতেই, ১৩০২ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে। মার্কসকে অনুসরণ করে মার্কসবাদের চর্চা এবং অনুশীলন শুরু হওয়ার আগে মার্কসের চিন্তার সমসাময়িক এই রবীন্দ্র চিন্তা ঐতিহাসিক গুরুত্বের আলোতে উজ্জ্বল। ধনী-দারিদ্রের বৈষম্য, দারিদ্রদের শোষণ করা এবং এই বাস্তবতার বিপক্ষে প্রতিবাদ করা-এই সবগুলো দিকই এ কবিতাটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। দার্শনিক দ্বান্ধিকতা সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে রবীন্দ্রকাব্যের শেষ সময়ে। কিন্তু বার্ধক্যের পরিণত বয়সে লেখা একই কবিতায় জগতপ্রেক্ষিতমূলক এবং জীবনবোধমূলক, এই দু’প্রকার দ্বন্ধের দৃষ্টান্ত একই সাথে লক্ষ্য করা যায়। ‘পৃথিবী’ শিরোনামে কবিতায় পৃথিবীর যে পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানে রয়েছে দ্বন্ধ; পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রাণের যে পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানেও রয়েছে দ্বন্ধ। এ কবিতার শুরুতেই কবি বলেন,
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা
বিপরীত তুমি ললিত কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষ নারীতে;
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্ধে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চ‚র্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্ট বিদ্রুপে;
দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎ জীবনে যার অধিকার।

এই উদ্ধৃতির প্রতিটি পঙ্তির মধ্যেই রয়েছে বৈপরীত্যের সহাবস্থান এবং এর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব হল পৃথিবীর প্রকৃতিবিষয়ক এবং মানুষের জীবনবিষয়ক। কবিতাটিতে আরো যে দ্বন্দ্বের কথা আছে তার মধ্যে রয়েছে দানব এবং দেবতার দ্বন্দ্ব, শুভ এবং অশুভের দ্বন্দ্ব, মেঘালোক উধাও পৃথিবীর সাথে মৌন ধ্যাননিমগ্ন পৃথিবীর বৈপরীত্য। পৃথিবীকে কবি একই সাথে বলেছেন, স্নিগ্ধ এবং হিংস্র, পুরাতনী এবং নিত্যনবীনা। এসবই সত্য এবং বৈপরীত্যের এই সহাবস্থান দ্বন্দ্ববাদের প্রতিফলন। জীবন ও জগতের বৈপরীত্যের সহাবস্থান ও দ্বন্দ্বের সার্বিক রূপ এবং চিরায়ত সত্যকে দার্শনিকগণ তুলে ধরেছেন তাঁদের দর্শনচিন্তায়। গ্রিক দার্শনিক যেনো এর সূচনা করেন এবং জার্মান দার্শনিক হেগেল এবং মার্কস এই চিরায়ত সত্যের বিকশিত রূপ তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে এই একই কাজ করেছেন। কবি হিসেবে এখানেই তাঁর মহত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।

 


আরো পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বাণিজ্য মনস্কতা

 

ছয়.
‘অগ্রণী’-র প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায়, ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, প্রগতি লেখক সংঘের অধিবেশনে পঠিত বুদ্ধদেব বসু-র রচনাটিকে আক্রমণ করেই সম্ভবত শুরু হয় বাংলার মার্কসবাদীদের শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রথম মতাদর্শগত সংগ্রাম। বুদ্ধদের বসু তাঁর রচনায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে চরম হতাশা প্রকাশ করেও মধ্যবিত্তের উপর শেষ পর্যন্ত আস্থা স্থাপন করে যে বক্তব্য উপস্থিত করেন, সুরোজকুমার দত্ত ‘ছিন্ন কর ছদ্মবেশ’ নামক নিবন্ধে সেই বক্তব্যের অসঙ্গতিকেই মূলত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিদ্ধ করেন। এছাড়া বুদ্ধদেব বসু এ রচনায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আভাসে-ইঙ্গিতে যে কটাক্ষ করেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করে এই সময় অমিয় চক্রবর্তীকে একটি চিঠি লেখেন। সেটি ১৩৪৬ সালের বৈশাখ মাসে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘শনিবারের চিঠি’ ও ‘পূর্বাশা’ পত্রিকাতেও বুদ্ধদেব বসুর মতামতের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয় তীব্র সমালোচনা। ১৯৩৯-৪০ সালে প্রকাশিত হয় বিনয় ঘোষ-এর ‘শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ’ এবং ‘নূতন সাহিত্য ও সমালোচনা’ নামে দু’টি গ্রন্থ। নতুন মার্কসীয় চেতনার আতিশয্যের ফলে বিনয় ঘোষ-এর সমালোচনায় বিদ্ধ হন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে ও সমর সেন। আর রবীন্দ্রনাথকে তিনি চিত্রিত করলেন―‘ভাববাদী বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রবক্তা’ এবং ‘আন্তর্জাতিক কল্পনাবিলাসী, সৌখীন সাহিত্যের স্রষ্টা’ রূপে। ফলে, বিনয় ঘোষ-এর বক্তব্য মার্কসবাদী শিবিরে যেমন বিতর্কের সূচনা করে, তেমনি অমার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মনকেও তা রূষ্ট করে তোলে। এইভাবে প্রগতি-সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের ভিতরে ও বাইরে সেইসময়ে শুরু হয় এক মতবাদের লড়াই।
প্রগতি-শিবিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ‘পরিচয়যোগোষ্ঠী’র লেখকেরা প্রায় সবাই ছিলেন বিনয়বাবুর বক্তব্যের বিরুদ্ধে। আর রবীন্দ্র স্নেহধন্য সাহিত্যিক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক অমল হোম ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন বিনয় ঘোষ-এর রবীন্দ্র-বিরোধিতায়। এর প্রতিবাদে তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘কেরাণী রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধে অমল হোম বিনয়বাবুকে তীব্র আক্রমণ করে লিখলেন, ‘সাম্যবাদী সমালোচকেরা জানাতে চান যে, যেহেতু রবীন্দ্রনাথ চোখে ডায়্যালেকটিকসের ঠুলি এঁকে সাহিত্যের ঘানি টানেন না, সেইহেতু তাঁর সাহিত্য সেই তেল যোগাতে পারছে না, যার অভাবে আজকের দিনে মানুষের ঘরে নাকি আলো আর জ্বলবে না।’
মার্কসবাদীদের মধ্যেও এই নিয়ে মতান্তর দেখা দেয়। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং আরও দু-একজন বিনয়বাবুর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধীতা করেন। পক্ষান্তরে, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সুধী প্রধান, সরোজ দত্ত এবং অনিল কাঞ্জিলাল মোটের উপর সমর্থন করেন বিনয় ঘোষকেই। গোপাল হালদার ও চিন্মোহন সেহানবীশ এ ব্যাপারে একটু ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ থেকে গোপাল হালদারের সম্পাদনায় প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়, যার লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লেখেন, ‘Himself a true poem’রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে ‘কল্লোল’ এবং ‘শনিবারের চিঠি’-র যে তরুণ সাহিত্যিক গোষ্ঠী সাহিত্যের হাটে এ-সময় প্রচন্ড হট্টগোল শুরু করেন তাঁরাও কিন্তু মার্কসীয় চিন্তা-চৈতন্যের অনুগামী ছিলেন না। ‘কল্লোল-যুগ’-এর অন্যতম নায়ক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ভাষায় তাঁরা ছিলেন, ‘উদ্ধত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা, সমস্ত বাধাবন্ধনের বিরুদ্ধে নির্বারিত বিদ্রোহ, স্থবির সমাজের পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আলোড়ন’-এর অংশীদার এবং ভাবনৈতিক সন্ত্রাসবাদী। প্রগতি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা গোপাল হালদার তাঁর সাহিত্য-জীবনে অনুপ্রবেশের স্মৃতিচারণায় তাই যথার্থই লিখেছেন, “‘কল্লোল যুগ’ অচিন্ত্যবাবুর রম্য রচনার রটনা―ইতিহাসের ঘটনা নয়। …সজনী যদি হয় ‘গরঠিকানা কল্লোলী’, কল্লোল-যুগটাও কিন্তু ‘যুগ’ নয় হুজুগ’’।
১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর কবি নজরুল ইসলাম, মুজফফর আহমদ ও তাদের সহযোগীরা ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন, তখন ঠিক হয় রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী চাওয়া হবে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন―রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ‘লাঙলের’ জন্য আশীর্বচন যোগার এর ভার পড়ল আমার উপর। একদিন সকালবেলা রবীন্দ্রনাথের কাছে পেশ করলুম আমাদের আর্জি। তিনি তৎক্ষণাৎ্ লিখে দিলেন-জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল /প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।
‘লাঙলে’র প্রচ্ছদপটে তাঁর ঐ আশীর্বচন থাকত।
ওই লাঙল পত্রিকা প্রকাশের সূত্রে কমিউনিস্টরা জোড়াসাঁকোর বাড়ি ও কিছুটা রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসেন। পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায় ১৯৮৩, ২১ জানুয়ারি ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকায় লেখেন―
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিচের তলায় নেপু ঠাকুরের ঘর ছিল তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কেন্দ্র। সে ঘরে কমরেড হালিমের সাথে আমি বহুবার গেছি। সোমনাথ লাহিড়ীও যেতেন, রণেন সেনও যেতেন। আব্দুল হালিমের সঙ্গে আমি ছ’সাতবার ওখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম। আব্দুল হালিম বীরভ‚মের মানুষ-তাঁকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ স্নেহ করতেন। তাই আমাদের আলাপ ভালোই জমত। একবার আমরা তাঁর তীব্র সমালোচনা করে বললাম-আপনার ‘রাশিয়ার চিঠি’র কয়েক জায়গা আমাদের ভালো লাগে নি। আমরা ‘‘সর্বহারার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ শীর্ষক একটা পুস্তিকা প্রকাশ করছি। তিনি বললেন, তা তোমরা কর, কিন্তু মোটামুটি ভালো চিঠি লিখি নি? আমি তো আর তোমাদের মত কমিউনিস্ট নই। আমরা বলি ঠিকই তো, আপনি যা লিখেছেন তাতে তো দারুণ কাজ হয়েছে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যা অপপ্রচার চলছে তাঁর মোক্ষম জবাব আপনি দিয়েছেন।
গোলাম কুদ্দুসের কথায়―১৯৩৮ সাল। রানীগঞ্জের কাছে বল্লভপুর পেপার মিলে শ্রমিক ধর্মঘট-তাতে পিকেটিং জোরদার করতে হবে। কর্মীরা সবাই জড় হয়েছে। ইউনিয়নের তরুণ নেতা কমিউনিস্ট কর্মী সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে একজন বললেন―‘সুকুমার, আজ একটা গান করুন না’। চায়ের পেয়ালা এক চুমুকে শেষ করে গান ধরলেন―‘যাও ,যাও, যাও গো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও।’

সাত.
ধর্ম, বর্ণ, জাত, জাতীয়তাবাদের নামে মানুষকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি ছিল তাঁর, তিনি মনে করতেন কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ মনুষ্যত্বের উন্নতি ঘটাতে পারে। তাঁর সংশয় যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ। তাঁর এই মনোভাবের সর্বোৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ গোরা উপন্যাস, যেখানে মূল চরিত্র গোরা নিজে এক গোঁড়া হিন্দু ও চরম ভারতীয় হিসেবে বড়ো হয়, কিন্তু আদতে যে স্কটিশ দম্পতির সন্তান। উপন্যাসের শেষলগ্নে যে নিজের জন্মরহস্য জানতে পারে এবং বোঝে তার পালিতা মা-ই ভারতীয়ত্তে¡র মূর্ত প্রতীক, যিনি নিজে ধর্মপরায়ণ হিন্দু পরিবারের সদস্য হলেও খ্রিষ্টান ইউরোপীয় দম্পতির অনাথ সন্তানের দায়িত্ব নেন নির্দ্বিধায়, মানবিকতার খাতিরে। তাই তো গোরা অকপটে স্বীকার করে নিতে পারে, ‘মা, তুমিই ভারতবর্ষ’। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ যে অন্য সম্প্রদায় বা অন্য দেশের মানুষকে ঘৃণা করতে শেখাতে পারে না, বরং তাদের বুকে টেনে নিতে বলে, এই উপন্যাসটি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
শুধু তাই নয়, তার অধিকাংশ নাটক ও গল্পে সুক্ষ্ম ও সুদৃঢ়ভাবে তার মত ও দর্শন প্রকাশ পেয়েছে। তার নাট্য সংলাপের ভাঁজে ভাঁজে শাসকগোষ্ঠীর অনৈতিক প্রভাব, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে তেজদীপ্ত উচ্চারণ প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন জমিদার, কিন্তু অকপটে সত্য প্রকাশে অবিচল ছিলেন। ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’, ‘কালের যাত্রা’-সহ অন্যান্য একই চিত্রের উন্মেষ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ্য বিদ্রোহের পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সংস্কৃতির বিদ্রোহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে-এই তাবৎ বিষয়গুলোও তাঁর রাজনীতি ভাবনার সরাসরি ফসল। ‘রক্তকরবী’র সেই ফুলের বিদ্রোহ (১৯২৬) পাষাণের মুখোমুখি, নন্দিনীর শান্ত অভ্যুত্থান যক্ষপুরীর রাজার রাজত্বে। কুমু পারে না, নন্দিনী পারে তার মানবীয় শক্তি দিয়ে। এখানে একটা কথা আছে। তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে পুঁজিবাদের মনুষ্য বিরোধিতার সমালোচনা আছে; কিন্তু ওই ব্যবস্থা থেকে মুক্তির যে পথের দিশা, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। কেননা পুঁজিবাদ থেকে বের হয়ে আসতে হলে উন্নততর ব্যবস্থায় যাওয়াটাই হচ্ছে উপায়, শুধু কৃষিসমাজে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়।
নন্দন ও দর্শন-এই দুই মিলেই রবীন্দ্রনাথ। গীতি কবিতায় সুর ও ছন্দের ব্যবহার, নাটক, চিত্রকলা, চিঠি কিংবা ’Nationalism’, ’Religion of Man’, ‘শিক্ষার হেরফের’ অথবা ‘গীতাঞ্জলি’―সব কিছুতেই আমরা আবিষ্কার করি এই মানুষটিকে প্রতিদিন নতুনভাবে। নোবেল পুরস্কার রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কাছে নিয়ে গেছে এবং নিজের দেশেও তিনি নতুনভাবে পরিচিত হলেন, যদিও যাঁরা তাঁর প্রতি আগে কোনো আগ্রহ বা সৌহার্দ্য প্রকাশ করেননি; কিন্তু নিন্দুকও এই নব সৌহার্দ্য প্রকাশের লাইনে শামিল হয়েছিলেন। নোবেল জয়ের পর নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে তখন ইউরোপ, আমেরিকায় ‘এটা কী করে সম্ভব’ জাতীয় খবর প্রকাশের ঢল নামে। রবীন্দ্রপ্রেমী এজরা পাউন্ড, ১৯১৩ সালে তিনি রবীন্দ্রাথের দর্শনের দিককে Superfluous মনে করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতপক্ষে একটাই পরিচয়, তিনি মানবতাবাদী। তাঁর সাহিত্য থেকে রাজনৈতিক দর্শন, সর্বত্রই এর সগৌরব উপস্থিতি। রাজনীতি যে মানুষের জন্যই, ক্ষমতার জন্য নয়―এই উপলব্ধিতে রবীন্দ্রনাথের দেরি হয়নি। এমন কোনও রাজনীতির কথা তিনি মাথায় আনতে চাননি, যাতে বিপন্ন হতে পারে মানবিকতা। তাই সময় সময় তাঁকে কাল্পনিক (ইউটোপিয়ান) রাজনৈতিক দর্শনের সমর্থক বলে ব্যঙ্গ করা হলেও দুনিয়াজোড়া বর্তমান সময়ের অস্থির উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপরীতে তাঁর মতাদর্শ এক অনন্য প্রাসঙ্গিকতার পতাকা বহন করতে সমর্থ হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন নিয়ে আলোচনা একটি প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি এই প্রবন্ধে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি তাঁর চেতনার সূচনা ও সংগঠিত আন্দোলন সম্পর্কেই কেবল একটি রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক কাজে, তাঁকে একটা ফ্রেমে আনাটা দুর্বোধ্য মনে হয়েছে। কেউ কেউ এটা স্পষ্টত বলেন, রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্যেই অনড় ছিলেন। আমার কাছে তা মনে হয় না, তিনি রাজনীতি ও দর্শনের জায়গায় স্থির থাকতে পারেন নি। বার বার নিজেকে পাল্টে ফেলতে চেয়েছেন। পৃথিবীর অনেক বড় মাপের সাহিত্যিকের মতো রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও স্ববিরোধিতা দেখা যায়।

 

 

 

তথ্য নির্দেশ
হায়দার আকবর খান রনো, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয়তা সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি
ধনঞ্জয় দাশ, বাঙলার সংস্কৃতিতে মার্কসবাদী চেতনার সূচনা ও সংগঠিত আন্দোলনের আদিপর্ব
শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, তিরিশ-চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতার ভ‚মিকা
গালিব আহসান খান, দার্শনিক দ্বান্ধিকতা ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা
খোরশেদ আলম, জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ এবং রবীন্দ্র-ভ্রমণ ও চিঠিপত্র
ড. চঞ্চল খান, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও নান্দনিকতা

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত