| 20 এপ্রিল 2024
Categories
নারী

‘প্রথম লেসবিয়ান নারী’ এ্যান লিস্টারের ‘রগরগে’ ডায়েরি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

“আমি মেযেদের ভালোবাসি, শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই ভালোবাসি, এবং তাদেরই ভালোবাসা চাই।

ইংল্যান্ডের হ্যালিফ্যাক্স শহরের এক স্কুল শিক্ষিকা ১৯৮৩ সালে হঠাৎ করেই খোঁজ পেয়েছিলেন দেড়শ’ বছরের পুরোনো কিছু ডায়েরির, যা ওই শহরেরই এ্যান লিস্টার নামে এক নারীর লেখা।

সেটি লেখা হয়েছে সাংকেতিক ভাষায়, হাতের লেখাটিও দুর্বোধ্য। কিন্তু হেলেনা হুইটব্রেড নামে সেই মহিলার কৌতুহল জাগিয়ে তোলে ডায়েরিটি।

সেই সাংকেতিক ভাষার পাঠোদ্ধার করতে শুরু করে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন হেলেনা। কারণ সেই ডায়েরিতে পাতার পর পাতা জুড়ে লেখা রয়েছে লেসবিয়ান প্রেম ও যৌনতার রগরগে সব বর্ণনা।

এ্যান লিস্টার ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর বহু ভূসম্পত্তির মালিক এক নারী, তবে সেই ডায়েরি প্রকাশের পরই প্রথম জানা যায় যে তিনি ছিলেন লেসবিয়ান, একজন ‘নারী শিকারী’। তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল একাধিক নারীর।

তার সেই ডায়েরি যখন বই হয়ে বেরোলো – তখন পাঠকরাও তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন সে সব রগরগে বর্ণনা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ্যান লিস্টারকেই বলা যায় আধুনিক যুগের প্রথম ‘লেসবিয়ান’ বা নারী সমকামী।

তিনি যখন লেসবিয়ান জীবন যাপন করছিলেন – তখন এই ‘লেসবিয়ান’ শব্দটিরও জন্ম হয় নি।

এ্যান লিস্টারের ডায়েরি সংরক্ষণ এবং পাঠোদ্ধার করেছেন বিশেষজ্ঞরাছবির কপিরাইট.
Image captionএ্যান লিস্টারের ডায়েরি সংরক্ষণ এবং পাঠোদ্ধার করেছেন বিশেষজ্ঞরা

এর আগেকার কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ডে নারীর সাথে নারীর যৌনসম্পর্কের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।

তাই এ্যানের জার্নালে একজন লেসবিয়ানের যে জীবন ফুটে উঠেছে – তাতে অনেকেই ভাবতে পারেন নি যে এগুলো আসলেই বাস্তবে ঘটেছিল । অনেকে মনে করেছিলেন, এই ডায়েরিগুলো ভুয়ো।

যিনি প্রথম সেই সাংকেতিক ভাষায় লেখা ডায়েরির রহস্য উদ্ঘাটন করেছিলেন – সেই হেলেনা হুইটব্রেড ছিলেন একজন শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ। এ্যান লিস্টারের ডায়েরির পাঠোদ্ধার করতে পাঁচ বছর ব্যয় করেছিলেন তিনি।

এ্যান লিস্টার ছিলেন ‘পুরুষালী চেহারার এক নারী’

হেলেনা হুইটব্রেড বলছিলেন, “আমার মনে হয়, এ্যান লিস্টারের জীবনকে বলা যায় হ্যালিফ্যাক্স শহরের ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ – যে কথা ২০০ বছরেও কেউ জানতে পারে নি।”

এ্যান লিস্টারের জন্ম ১৭৯১ সালে, উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টির হ্যালিফ্যাক্স শহরে।

তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী এক নারী। এমন পোশাক পরতেন, এমনভাবে হাঁটতেন যে লোকে তাকে পুরুষ মনে করতো। শহরের লোকেরা তাকে ডাকতো ‘জেন্টলম্যান জ্যাক’ নামে।

এ্যান লিস্টার ছিলেন তীব্র স্বাধীনচেতা – সে যুগের ইংল্যান্ডের অনেক সামাজিক রীতিনীতিকেই তিনি থোড়াই কেয়ার করতেন।

এ্যান লিস্টারছবির কপিরাইট.
Image captionএ্যান লিস্টার

ছোটবেলায় তিনি এমনই দুরন্ত ছিলেন যে তার মা তাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

ওই বোর্ডিং স্কুলে থেকে তিনি গ্রীক ও ফরাসী ভাষা, দর্শন, গণিত, ভূতত্ববিদ্যা এবং মহাকাশবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন, এবং সমসাময়িক মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত হয়ে ওঠেন।

সে সময়ই তার ব্যক্তিত্বের সেই বিশেষ দিকটি প্রকাশ পেতে থাকে – তা হলো: নারীদের প্রতি তার আকর্ষণ।

তার প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হয় ওই স্কুলেরই আরেক ছাত্রী এলিজা রেইনের সাথে।

তারা দু’জনেই তাদের যৌন অভিজ্ঞতার ডায়েরি রাখতেন, এবং সেটা আড়াল করতে ‘ফেলিক্স’ শব্দটি ব্যবহার করতেন।

কিন্তু এ্যান চাইতেন তাদের যৌন সম্পর্কের আরো বেশি বিস্তারিত খুঁটিনাটি ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতে।

সে জন্য তিনি নিজেই তৈরি করলেন এক সাংকেতিক ভাষা – যাতে তিনি ব্যবহার করতেন গ্রীক ও ল্যাটিন শব্দ, গণিত ও রাশিচক্রের নানা প্রতীক।

ইয়র্কের ম্যানর হাউজ স্কুলছবির কপিরাইট.
Image captionইয়র্কের ম্যানর হাউজ স্কুল, এখানেই পড়তেন এ্যান লিস্টার

এ্যান শুধু এলিজাকে পেয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ধীরে ধীরে তার মধ্যে অন্য আরো নারীর জন্য কামনা জেগে উঠলো।

আর এর ফলে এলিজার মধ্যে দেখা দিল বিষণ্ণতা রোগ – যা থেকে তিনি কখনো সেরে ওঠেন নি।

‘এ্যান লিস্টার ছিলেন শুধু লেসবিয়ান নয়, এক শিকারী’

হেলেনা বলছেন: “এ্যানের ভালোবাসার পাত্র ছিলো মেয়েরা। তিনি বার বার মেয়েদের প্রেমে পড়েছেন।”

“যদি এ্যান লিস্টার একবার আপনাকে পটাতে পারেন – তাহলে তা বিছানা পর্যন্ত গড়াক বা চিঠিপত্র পর্যন্তই সীমিত থাকুক – তাহলে আপনি তার প্রতি মুগ্ধতা থেকে আর বেরোতে পারবেন না। তার ডায়েরি পড়ে আমি নিজেই মোহিত হয়ে গেছি” – বলছিলেন হেলেনা।

এ্যান লিস্টার ছিলেন তার বাবা মায়ের ৬ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বাবা ছিলেন একজন সৈনিক। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লড়াই করেছিলেন। হ্যালিফ্যাক্সের নামী পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই লিস্টার পরিবার।

তার ভাইয়েরা মারা যাবার পর এ্যানই ৪০০ একরের পারিবারিক ভূসম্পত্তির মালিক হন।

শিবডেন হলে এ্যান লিস্টারের বাড়িছবির কপিরাইটALEXANDER P KAPP
Image captionহ্যালিফ্যাক্সের শিবডেন হলে এ্যান লিস্টারের বাড়ি

তিনি ছিলেন সুশিক্ষিত, আত্মবিশ্বাসী, এবং বিদগ্ধ এক নারী, তা ছাড়া একজন ভ্রমণকারী।

তিনি তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদ ব্যবহার করেছিলেন তার ইচ্ছেমত জীবন যাপন করার জন্য।

আগস্ট, ১৮২৩ সাল । এ্যান লিস্টার ডায়েরিতে লিখলেন, “আমি জানি আমার মন কি চায়, এবং আমি পুরুষদের চিনি। আমি যে নারীদের দেখেছি – আমি তাদের কারো মতন নই।”

“আমার সেই দু:সাহস আছে অন্য সবার থেকে নিজেকে আলাদা বলে ঘোষণা করার। আমার সেই সব কথা আমি আমার ডায়েরিতে বলতে পারি, কিন্তু আর কাউকে নয়।”

নারী হয়েও কেন তার নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ তৈরি হলো – এ্যান লিস্টার নিজেও অনেকবার তা বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন।

তিনি শারীরবিদ্যার বই পড়ে, তার দেহ-মনকে পরীক্ষা করে উপলব্ধি করলেন, এটাই তার স্বাভাবিক যৌন অনুভূতি। তার ভাষায় – নারীদের ভালোবাসার অধিকার তার কাছে “ঈশ্বরের দেয়া অধিকার।”

তিনি চেয়েছিলেন, পুরুষদের মত তারও একজন ‘স্ত্রী’ থাকবে

এ্যান শুধু নারী সমকামী ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, এবং বহুগামী।

শিকারীর মত এক নারীর পর অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন তিনি।

এ্যান লিস্টারের ডায়েরির একটি পাতাছবির কপিরাইট.
Image captionএ্যান লিস্টারের ডায়েরির একটি পাতা

এলিজার পরে এ্যানের নতুন প্রেমিকা হলেন ম্যারিয়ানা – এক ডাক্তারের মেয়ে, ইয়র্ক শহরের অভিজাত পরিমন্ডলে যার চলাফেরা।

এ্যান ভাবতেন – পুরুষের যেমন স্ত্রী থাকে, তেমনি তারও একজন স্ত্রী থাকবে এবং তিনি ম্যারিয়ানাকে নিয়েই তার ‘সংসার’ পড়ে তুলবেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাতে ঘটলো বিপত্তি।

১৮১৫ সালে ম্যারিয়ানা নাটকীয়ভাবে একজন ধনী পুরুষকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সে যুগের রীতি ছিল: নবদম্পতি যখন মধুচন্দ্রিমায় যেতেন, তখন নববধূর সঙ্গে থাকতেন তার একজন বান্ধবী।

সে অনুযায়ী ম্যারিয়ানার মধুচন্দ্রিমায় সহযাত্রী হলেন তারই গোপন লেসবিয়ান সঙ্গী এ্যান, এবং তার কাছে সেটা ছিল একটা চরম যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা।

ক্রুদ্ধ এ্যান শিবডেনে তার নিজ বাড়িতে ফেরার পর ডায়েরিতে লিলেন, তার সাবেক প্রেমিকা এখন ‘আইনসঙ্গত বেশ্যাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে।’

হ্যালিফ্যাক্সের বাড়িতে এ্যান লিস্টারের শোবার ঘরছবির কপিরাইট.
Image captionহ্যালিফ্যাক্সের বাড়িতে এ্যান লিস্টারের শোবার ঘর

বিয়ের এক বছর পরই তাদের আবার দেখা হলো ইয়র্কে, ম্যারিয়ানার বাবা-মার বাড়িতে।

দাঁতের ব্যথার জন্য ম্যারিয়ানা তার শয়নকক্ষে শুয়ে ছিলেন, সেখানে ঢুকে পড়লেন এ্যান।

ডায়েরিতে রগরগে বর্ণনা

ম্যারিয়ান বললেন, তাদের মধ্যে ‘কিস’ (যৌনমিলনের জন্য তাদের সাংকেতিক শব্দ) হবে কিনা। তাই হলো।

হেলেন হুইটব্রেড বর্ণনা করছেন ডায়েরিতে এ ঘটনাটি কীভাবে লেখা হয়েছে।

“ম্যারিয়ানা বললেন, তুমি দরজাটা বন্ধ করছো না কেন? তাহলে আমরা ‘কিস’ করতে পারি। ততদিনে আমি বুঝতে পেরেছি যে ‘কিস’ শব্দটা এ্যান লিস্টার ব্যবহার করেছেন যৌনমিলন বোঝাতে” – বলেন হেলেন হুইটব্রেড।

“এ্যান লিখছেন, ‘আমি আমার পোশাক খুলে ফেললাম। স্কার্ট তুললাম, তার পর বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম।”

“তার পর আমরা দারুণ একটা ‘কিস’ করলাম। সাত মিনিটেরও কম সময়ে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল। তার পর আমরা এমনভাবে ঘর থেকে বেরোলাম যেন কিছুই হয় নি।”

ম্যারিয়ানা আর এ্যানের প্রেম আবার আগুনের মত জ্বলে উঠলো। পরের কয়েক বছরে তাদের অনেকবার এরকম গোপন সাক্ষাৎ হতো, আর হতো আবেগপূর্ণ চিঠি বিনিময়।

কিন্তু এ্যান ফাঁকে ফাঁকে অন্য মেয়েদের সাথেও সম্পর্ক চালিয়ে যেতেন – যদিও ম্যারিয়ানা চাইতেন, এ্যান যেন আর কোন নারীর সাথে না জড়ান।

এ্যান লিস্টারের স্টাডিছবির কপিরাইট.
Image captionএ্যান লিস্টারের স্টাডি

কিন্তু বেশ কিছুকাল পরে ম্যারিয়ানা নিজেই বললেন, তিনি এ্যানের মতো ‘পুরুষালী চেহারার’ নারীর সাথে প্রকাশ্যে বেরুতে লজ্জা বোধ করেন।

এ্যান কাঁদতে শুরু করলেন, কিন্তু ম্যারিয়ান তাকে কোন সান্ত্বনা দিলেন না।

আমি মেযেদের ভালোবাসি, শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই

এ্যান লিস্টার লিখেছেন, “আমি মেযেদের ভালোবাসি, শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই ভালোবাসি, এবং তাদেরই ভালোবাসা চাই। সেখানে অন্য কারো ভালোবাসা ঢুকে পড়লে আমার আত্মা বিদ্রোহ করে।”

এখানে বলা দরকার। পুরুষদের মধ্যে সমকামিতাও সে যুগের ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল। তবে মেয়েদের মধ্যে শুধু রোমান্টিক বন্ধুত্ব নয়, যৌন সম্পর্কের কোন ধরণের স্বীকৃতির চিহ্নও পাওয়া যায় না।

তাহলে কি উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে ব্যাপারটা সম্পর্কে কেউ জানতো না?

হেলেন হুইটব্রেড বলেন, “সে সময় এ ধরণের সম্পর্ক বর্ণনা করার জন্য কোন শব্দ বা ভাষা ছিল না। তবে চায়ের টেবিলে লোকে যেসব গল্প করে – তাতে এ নিয়ে নানারকম গুজব উড়ে বেড়াতো।”

“এ্যান লিস্টারের কাছের কিছু লোক তাকে জানিয়েছিলেন লোকে তার সম্পর্কে কি বলছে। তিনি সেগুলো আবার তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেছিলেন। লোকের কথায় তিনি বিচলিত হননি। বরং খুশিই হয়েছিলেন।”

এ্যান ওয়াকারের বাড়িছবির কপিরাইট.
Image captionএ্যান ওয়াকারের বাড়ি

এ্যান লিস্টার এসব বর্ণনা করেছেন সবিস্তারে, যাকে বলে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।

তবে তার কথায়, তিনি কখনো জোর করে কোন নারীর সাথে কিছু করেন নি, এবং কোন নারী তাকে প্রত্যাখ্যানও করেন নি।

এক নারীকে বিয়েও করেছিলেন তিনি

এ্যান লিস্টার অনেক দেশে ঘুরেছেন এবং বহু নারীর সাথে তার সম্পর্ক হয়েছে। তবে তিনি চাইতেন একটা স্থায়ী সম্পর্ক – একজন ‘স্ত্রী’।

তা পেয়েছিলেনও তিনি। সেই নারীর নামও এ্যান – এ্যান ওয়াকার, বয়েসে কিছুটা ছোট, আর হ্যালিফ্যাক্সে কাছাকাছিই থাকতেন তিনি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়ে গেল।

এ্যান লিস্টার চাইছিলেন তার বাড়িতেই প্রণয়িনীকে নিয়ে একটি দম্পতির মতো থাকতে। সে প্রস্তাবে এ্যান ওয়াকার প্রথমে রাজি না হলেও পরে তিনি একজন পুরুষের সাথে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন, এবং তার পরিবারকে বললেন, তিনি এ্যান লিস্টারের সাথেই থাকতে চান। দুই পরিবারই তাদের ঘনিষ্ঠতা স্বচক্ষে দেখেছিলেন – তাই কেউই আপত্তি করেন নি।

দু’জনেই তাদের সম্পত্তির উইলে পরিবর্তন আনলেন, এমনটি আংটি বিনিময়ও করলেন।

অবশেষে ১৮৩৪ সালের ইস্টার সানডেতে ইয়র্কের হলি ট্রিনিটি চার্চে তাদের প্রতীকী ‘বিয়ে’ হলো।

বিয়েকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন এ্যান লিস্টার। তার বহু নারীতে আসক্তি সেখানেই শেষ হয়।

তারা ‘মধুচন্দ্রিমা’ করতে ফ্রান্স আর সুইৎজারল্যান্ডে বেড়াতেও গিয়েছিলেন।

দুই নারীর বিয়ের খবর ইয়র্কশায়ারে গোপন থাকে নি। এই ‘কেলেংকারি’ নিয়ে পুরো কাউন্টি জুড়ে শুরু হলো ব্যাপক আলোচনা – ‘পুরুষদের মতো দেখতে সেই মহিলা’ অবশেষে পুরুষের মতোই একটা কাজ করেছে – এক নারীকে বিয়ে করেছে।

হেলেনা হুইটব্রেডছবির কপিরাইট.
Image captionহেলেনা হুইটব্রেড

লিডস মার্কারি নামে এক পত্রিকায় এ নিয়ে একটা বিদ্রুপাত্মক বিজ্ঞাপন বেরুলো – যাতে ছিল ‘ক্যাপ্টেন টম লিস্টার অফ শিবডেন হল’ এবং মিস এ্যান ওয়াকারের বিয়ের ঘোষণা।

তাদের বাড়িতে কিছু বেনামী চিঠিও এসেছিল – তাতে ‘ক্যাপ্টেন লিস্টার দম্পতিকে তাদের আনন্দময় মিলনের জন্য’ অভিনন্দন জানানো হয়েছিল।

১৮৪০ সালে এই নারী দম্পতি রাশিয়ায় বেড়াতে যান। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ ঘুরে তারা দক্ষিণ রাশিয়ার ককেশাসের পার্বত্য এলাকায় এলেন।

সেখানেই ১৮৪০ সালের ১১ই আগস্ট ৪৯ বছর বয়সে এ্যান লিস্টার মারা যান। মনে করা হয়, কোন পোকার কামড়ে তার সংক্রমণজনিত জ্বর হয়েছিল।

তার মৃতদেহ কফিনে ভরে সাড়ে চার হাজার মাইল দূরের হ্যালিফ্যাক্সে ফিরিয়ে আানতে এ্যান ওয়াকারের সময় লেগেছিল আট মাস।

হেলেন কি ভাবে ডায়েরির খোঁজ পেলেন?

এ্যান লিস্টারের ডায়েরিটির সন্ধান পেয়েছিলেন হেলেন হুইটব্রেড হ্যালিফ্যাক্সের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির আর্কাইভে।

সে সময় ইংল্যান্ডের সমাজ ছিল একেবারেই অন্য রকম। সেখানে লেসবিয়ান বা নারী-সমকামী সম্পর্কের কোন স্বীকৃতিই ছিল না।

সাংকেতিক ভাষায় লেখা বলেই এ্যান লিস্টার তার যৌন অনুভুতি, জীবন, সমাজ ও পুরুষদের সম্পর্কে তার মনোভাবের কথা নিশ্চিন্তে কোন কিছু গোপন না করেই লিখতে পেরেছিলেন।

ফলে এই ডায়েরিতে বেরিয়ে এসেছে এমন এক নারী চরিত্র – যার সাথে সে সময়কার ইংরেজি গল্প-উপন্যাসের নারী চরিত্রের অনেক পার্থক্য।

এ্যান লিস্টারের স্মরণে ফলকছবির কপিরাইট.
Image captionএ্যান লিস্টারের স্মরণে ফলক

এ্যান হয়তো ভেবেছিলেন, তার ব্যবহৃত ‘কোড’ কেউ ভাঙতে পারবে না, তিনি কি লিখেছেন তা জানতে পারবে না। সুতরাং তার ডায়েরিতে তিনি প্রেম ও যৌন সম্পর্কের কথা ইচ্ছেমত লিখতে পেরেছেন।

অনেকের কৌতুহল হতে পারে, কি কোড ব্যবহার করেছিলেন এ্যান লিস্টার?

হেলেন হুইটব্রেড বলছেন, “তিনি গ্রীক অক্ষর, কিছু সংখ্যা ও কিছু প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করেছেন যেগুলো তার একান্তই নিজস্ব। তার লেখায় কোন ফুলস্টপ নেই, কোন বড় হাতের অক্ষর নেই। অর্থাৎ কোথায় একটা বাক্য শেষ হয়েছে এবং আরেকটা বাক্য শুরু হয়েছে, বোঝার কোন উপায় নেই।

এ্যানের পারিবারিক বাসভবনে থেকেছেন এমন সবশেষ উত্তরাধিকারী একজন সেই ডায়েরির পাঠোদ্ধার করতে পেরেছিলেন।

সেটা ১৯৩০ সালের কথা। তিনি এ কাজে সাহায্য পেয়েছিলেন আর্থার বারেল নামে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে।

ইয়র্ক শহরের দৃশ্য শিল্পীর আঁকা ছবিতেছবির কপিরাইট.
Image captionইয়র্ক শহরের দৃশ্য শিল্পীর আঁকা ছবিতে

কিন্তু এ ডায়েরি পড়ে তারা এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তারা ডায়েরিটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

ভেবেছিলেন কেউ আর সেটা কখনো খুঁজে পাবে না। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে ডায়েরিটি উদ্ধার হয়, এবং সেটা তুলে দেয়া হয় হ্যালিফ্যাক্সের লাইব্রেরির হাতে।

হেলেনা হুইটব্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, শিক্ষক হয়েছেন – কিন্তু তার আসল স্বপ্ন ছিল লেখক হবার।

“আমি যখন স্থানীয় লোকদের নিয়ে দু’একটা লেখা লিখেছি, সে সময় স্থানীয় একটি পত্রিকার মাধমে আমি এ্যান লিস্টারের নাম শুনি এবং ঠিক করি তাকে নিয়ে লিখবো” – বলেন তিনি।

তখন এ্যান লিস্টারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না হেলেনা। এর পর লাইব্রেরির আর্কাইভিস্টের সাথে যোগাযোগের সূত্রে যখন তিনি এ্যান লিস্টারের ডায়েরি হাতে পেলেন, তখন তিনি তার ৫০টি পাতা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।

শুরু হলো তার সেই সাংকেতিক ভাষা মর্মোদ্ধারের প্রচেষ্টা।

এ্যান লিস্টার লিখেছিলেন অনেক। ৪০ লক্ষ শব্দ। ২৭ খন্ড। এর সবই যে সাংকেতিক ভাষায় লেখা তা অবশ্য নয়।

“আমার পাঁচ বছর লেগেছিল সবগুলোর পাঠোদ্ধার করতে । কারণ তখন আমি স্কুলের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এটা নিয়ে বসতাম” – বলেন হেলেনা হুইটব্রেড।

এ্যান লিস্টারের ডায়েরি পরে বই হয়ে বেরিয়েছে, তার জীবন নিয়ে বিবিসি টিভি ধারাবাহিক টেলিফিল্ম প্রচার করেছে।

 

 

 

 

 

বিবিসি বাংলা

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত