| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে বিনোদন

সঙ্গীতের রাহুল দেব বর্মণ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

১৯৯৪ সাল, হিন্দি সিনেমার এক স্মরণীয় বছর। এমন দশটা সিনেমা সেই বছর রিলিজ করেছিল যেগুলো মিউজিক্যাল হিটস তো ছিলই, গল্পের যাদুতেও দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছিল। এদের বাইরেও একটা দক্ষিণী সিনেমা ছিল যার গানের সুরগুলো শ্রোতাদের শরীরে একটা নাচন ধরিয়ে দিত। সিনেমাটি হল “হাম সে হ্যায় মুকাবলা”। এতগুলো হিট সিনেমাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হল ১৯৯৪-৯৫ এর ফ্লিমফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। বলিউডের সফলতার সেই বছরে সবাই উদ্বিগ্ন ছিলেন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে! যার সুরে একসময় আসমুদ্র হিমাচল দুলে উঠত সেই লোকটার জীবনের শেষ সিনেমাও সেই বছর রিলিজ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি সেই সিনেমা রিলিজের তিনমাস আগেই ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান। অডিটোরিয়ামে সেদিন তাঁর গানগুলোর হয়তো থাকাই হত না যদি না বলিউডের এক উঠতি পরিচালক ইন্ডাস্ট্রির ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে তাঁর সুরের উপর বিশ্বাস রাখতেন। অনুষ্ঠান শুরু হলে দেখা যায় সমস্ত সিনেমাকে পিছনে ফেলে একটার পর একটা অ্যাওয়ার্ড জিতে চলেছে বিধু বিনোদ চোপড়ার (উঠতি পরিচালক) ১৯৪২-এ লাভ স্টোরি। এবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! রাখী গুলজারের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল সেই বছরের সেরা মিউজিক ডিরেক্টরের নাম,লেট শ্রী আর ডি বর্মন। গোটা ভারতের প্রিয় ” পঞ্চম”দা। রণধীর কাপুর রাখী গুলজারের হাত থেকে পুরস্কারটি নেবার পর চারবার আকাশের দিকে ঝাঁকিয়ে যেন বলতে চাইছিলেন, “দেখ পঞ্চমদা দেখ! এটা শুধু একটা অ্যাওয়ার্ড নয়, এটা হল তোমাকে করা ইন্ডাস্ট্রির অপমানের জবাব যা তোমার কখনোই প্রাপ্য ছিল না। আজ চলে গিয়েও তুমি এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিলে।”

আজ সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুতে গোটা দেশ উত্তাল নেপোটিজম নিয়ে। অথচ ভারতীয় সংগীত জগতে নেপোটিজমের স্বীকার সেই ব্যক্তি যিনি ভারতীয় সংগীতকে আন্তর্জাতিক করেছিলেন। হ্যাঁ, আর ডি বর্মনের হাত ধরেই প্রথম ভারতীয় সংগীতে ঢুকে পড়ে পাশ্চাত্য সংগীত। যখন এই কান্ড তিনি ঘটান তখন ইন্টারনেট দূরে থাক ভারতবর্ষে খুব কম লোকের কাছে বিদেশি গানের রেকর্ড পাওয়া যেত। ১৯৬৫ সালে মেহমুদ সাব “ভূত বাংলা” ছবির মিউজিকের দায়িত্ব দেন অন্তরঙ্গ বন্ধু পঞ্চমের হাতে। মেহমুদ সাব-কে যারা চেনেন তাঁরা জানেন কতটা প্রানবন্ত ছিলেন তিনি এবং তাঁর অভিনয়। পঞ্চম ঠিক করেন এলভিস প্রেসলির দৌলতে সেই সময়ে প্রচন্ড জনপ্রিয় টুইস্টিং নাচের ওপর একটা গান কম্পোজ করবেন, আর যাতে কোমর দোলাবেন মেহমুদ-সাব নিজে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, চাব্বি চেকারের “লেটস টুইস্ট এগেন”-এর অনুকরণে লিখে ফেললেন ” আও টুইস্ট করে”। আর গাইলেন মান্না দে।

বাবা শচীনদেব বর্মন অভিমানে অনেক দিন কথা বলেননি এই গান শুনে। শচীন কর্তার মনে হয়েছিল এই গানের সুর মোটেই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। কিন্তু ততদিনে পঞ্চমকে আর ধরে কে! সংগীতের বরপুত্র ততদিনে বানিয়ে ফেলেছেন “তিসরি মঞ্জিল”- এর বিখ্যাত সব গানের সুর। ‘আজা আজা ম্যয় হুঁ পেয়্যার তেরা’, ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি জানে জাঁহা’ যা ছিল পশ্চিমী ক্যাবারের অনুকরণে বানানো। এর পাশাপাশি আরো দুটো গান ছিল ‘ও মেরে সোনা রে সোনা রে’ ও ‘তুমনে মুঝে দেখা’ যা দিয়ে পঞ্চম মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে প্রথমবারের জন্য সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখেন। তারপর শুরু হয় আর ডি-র যুগ। বাবা শচীন দেব বর্মনের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করেন পঞ্চম। ৬০ এর দশকের শেষ দিকের বলিউড জেনে যায় মাঝারিমাপের চিত্রনাট্যও পঞ্চমের সুরের যাদুতে হয়ে ওঠে মিউজিক্যাল হিটস।

 

পঞ্চমের শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি হয় উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের হাতে। ৭০ এর পঞ্চম শুধু বিদেশি সংগীত নিয়ে পড়ে থাকেননি, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়েও বেশ কিছু কাজকর্ম করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন গুলজার সাহেবের লেখা আর কিশোর কুমারের গলা। আর ডি, গুলজার আর কিশোর কম্বিনেশন বলিউড কাঁপিয়ে দেয় ৭০ এর দশকে। কি সব গান বেরিয়ে এসেছিল এই তিনজনের যুগলবন্দীতে! ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’, ‘ও মাঝি রে আপনা কিনারা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোয়ি’, ‘তুম আ গ্যায়ে হো নুর আ গ্যায়া হ্যায়’, ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায়’। তবে কিশোর কুমারের সাথে একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল আর ডি-র। শুধু রাগপ্রধান গান গাওয়া ছাড়াও কিশোরের গলায় ও রাজেশ খান্নার লিপে আর ডি ভারতবর্ষকে সুরমূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন একটা গোটা দশক। এইসময় বেশকিছু পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে তিনি পিছনে ফেলে দেন তাঁর সমসাময়িক মিউজিক ডিরেক্টরদের। কিছু গানের শুরুতে এমন কিছু আওয়াজ তৈরি করেন যা সেইসময় বসে করা দূরে থাকা ভাবতেও কেউ পারতেন না। কিন্তু তিনি তো সরস্বতীর বরপুত্র। তাই অনায়াসে অমন শব্দ সৃষ্টি করে গেছেন। যেমন ‘শোলে’ সিনেমায় ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানের আগে ফাঁকা বোতলের শব্দ, ‘পড়োসন’ সিনেমায় ‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি’ গানের আগে চিরুনি ঘষার শব্দ, ‘ইঁয়াদো কি বারাত’ সিনেমায় ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কো’ গানের আগে বোতলের গায়ে কাঁটা চামচ ঠোকার শব্দ।
হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে ‘শোলে’ হল এমন একটা সিনেমা যার পর থেকে হিন্দি সিনেমার একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে ছিল। সিনেমার গান নিয়ে কিছু বলার নেই। সব গানের মধ্যে সেরা ছিল ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানটি। গানটি পঞ্চম লিখেছিলেন আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য। কিন্তু আশাজি বেঁকে বসেন ওই চড়া সুর শুনে। তখন নিজেই গানটি রেকর্ড করেন আর সিনেমায় চালিয়ে দেন যা সুপার ডুপার হিট হয়ে যায়। শোলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বানিয়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘গুড ব্যাড আগলি’-র অনুকরণে। আর অমিতাভের লিপের মাউথ অরগ্যানের সেই সুর আজও বহু মানুষের সেলফোনের রিংটোন হিসাবে বেজে চলে। এটাই আর ডি, যার সুর আজকেও ভীষণ ভীষন ভাবে প্রাসঙ্গিক।

সারাজীবনে মোট ৩৩১টি ছবির সুরকার হিসাবে কাজ করেছেন আর ডি বর্মন যার মধ্যে ছিল ২৯২টি হিন্দি, ৩১টি বাংলা, ৩টি তেলেগু, ২টি তামিল, ২টি ওড়িয়া ও ১টি মারাঠি ছবি। এরপরেও একটা মানুষকে ৮০এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হত। একটা সময় ছিল যখন দিনের পর দিন একা একা বসে থেকেছেন নিজের মিউজিক রুমে। এমনিতেই মদ্যপান করতে খুব ভালোবাসতেন, এই ঘটনায় মদ্যপান আরো বেড়ে যায়। তবুও একটা দুটো ছবিতে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই নিজের ছাপ ছেড়েছেন পঞ্চম। ‘শান’, ‘বরসাত কি এক রাত’, ‘রকি’, ‘কালিয়া’, ‘ সত্তে পে সত্তা’, ‘সনম তেরি কসম’, ‘মাসুম’, ‘বেতাব’, ‘জিভা’, ‘সাগর’, ‘ইজাজত’, ‘পরিন্দে’ হল ৮০এর দশকে সৃষ্টি করা পঞ্চমের মিউজিক্যাল হিটস। আজ ২৬ বছর হয়ে গেল আর ডি বর্মন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তবুও আজ সবচেয়ে বেশি রিমিক্স তাঁর সুর করা গানেরই করা হয়। ভারতীয় সংগীত জগতে পঞ্চমের চেয়ে বড় সুরকার আর আসেননি। এমনকি তাঁর বাবা শচীন কত্তা যাকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুরকার মানতেন সেই সলিল চৌধুরী আর ডি বর্মনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন,
“Regal music in Hindi films has come to an end. The contribution of the Burmans to Hindi film music is unique in their own dimensions, very difficult to touch.”

১৯৩৯ সালে আজকের দিনে এই ক্ষণজন্মা সুরকার, গায়ক রাহুল দেব বর্মন জন্মগ্রহণ করেন।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত