| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রাহুল সাংকৃত্যায়ন আজীবন মহাপরিব্রাজক । আলোর পথযাত্রী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
আলোর পথযাত্রী
বিশিষ্ট ভুগোলবিদ সুনীল মুন্সী, যার আরেক ভাই বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ নীহার মুন্সী, একদিন ‘কালান্তর’ পত্রিকা দফতরে গল্পচ্ছলে বলছিলেন, “স্বাধীনতার কয়েক বছর আগের কথা। আমরা তখন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী। বোম্বের পার্টি (সিপিআই) অফিসে গিয়েছি। লাইব্রেরি ছিল নিচের তলায়, আলো খুব কম। সেখানে দেখি এক প্রবীণ প্রায়ান্ধকার ঘরে একমনে কতগুলি বই নিয়ে পড়ছেন, কিছু নোট করছেন। বেশ কয়েকদিন দেখেছি, উনি একইভাবে পড়ে চলেছেন। কেমন একটা গম্ভীর কিন্তু শান্ত চেহারা। পরে জেনেছিলাম, উনি বিশিষ্ট পণ্ডিত রাহুল সংকৃত্যায়ন।”
সুনীল মুন্সীর এই স্মৃতিচারণার আগেই রাহুল সংকৃত্যায়নের ‘ঘুমক্কর শাস্ত্র’ (বাংলায় ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’) আর কৈশোরের সেরা বই ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ পড়ে ফেলেছি। অদম্য আকর্ষণ রাহুলের প্রতি। যা পাই, গোগ্রাসে গিলি। গত শতকের নয়ের দশকের শুরু। পাটনা থেকে জগন্নাথ সরকার সম্পাদিত ‘জনশক্তি’ পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে এল। রাহুলের ‘দর্শন দিকদর্শন’ নিয়ে অসাধারণ একটি আলোচনা পড়ে আক্ষরিক অর্থে ‘ফিদা’ হয়ে গেলাম। মানুষটাকে জানার ইচ্ছা ক্রমেই বাড়তে লাগল। ১৯৯৩-তে ‘কালান্তর’-এ রাহুলজী কে ‘মহাপরিব্রাজক’ আখ্যা দিয়ে প্রবন্ধ লিখি। তাঁর প্রতিলিপি আজ আমার কাছে আর নেই। তবু মনে হয়, ভুল করিনি।
পরিব্রাজক মানে যিনি পরিব্রাজনকেই জীবনের লোকক্ষয় করেছেন, কিন্তু নেহাৎ বেড়াতে নয়। কিছু একটা লক্ষ্য নিয়েই তাঁর পথ চলা। কেউ কেউ সামান্য সময় চলেই থেমে যান, তিনি সফরকারী। যিনি আরও দীর্ঘদিন বা বেশ কয়েক বছর চললেন, তিনি পরিব্রাজক। আর, যিনি সব থাকা সত্ত্বেও সারা জীবনই চললেন নিজেরই লক্ষ্যের সাধনে, তিনিই মহাপরিব্রাজক। রাহুল আক্ষরিক অর্থেই তাই। তাঁর সারা জীবনই এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে যাওয়া, এক নাম ছেড়ে আরেক নাম গ্রহণ, এক স্ত্রী ছেড়ে আরেক স্ত্রীতে গমন, এক রাজনীতি থেকে আরেক রাজনীতি, এক দেশ থেকে আরেক দেশ —- চলা শুধুই চলা। তৃপ্তি নেই। যা খুঁজছেন, তাঁকে পূর্ণ রূপে পেতে চেয়েছেন। এবং সেখানে মনে প্রশ্ন ভেসে আসলে, তার উত্তরের খোঁজে ফের চলেছেন। সত্যের শেষ সীমা পর্যন্ত যেতে বলেই তাঁর জীবনে শুধুই “বন্দরের বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ। পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা. আর চলিবে না।”
শুরু তাঁর শৈশব দিয়েই। ১৮৯৩-এর ৯ এপ্রিল তৎকালীন যুক্ত প্রদেশের আজমগড়ের পান্ধা গ্রামে মামাবাড়িতে জন্ম হয় কেদারনাথ পাণ্ডের। কানিলা চকরপানুর গ্রামের শাক্ত ব্রাহ্মণ গোবর্ধন পাণ্ডে ছিলেন তাঁর বাবা। কেদারনাথের যখন ৯ বছর বয়স, তখন নিকটবর্তী গ্রামের পাঁচ বছরের মেয়ে সন্তোষীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ে, না পুতুল খেলা! প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র কেদারনাথ নিজেই জানতেন না, সন্তোষীর তো কথাই নেই। একদিনও ঘর করেননি বউয়ের সাথে, তবু সেই বিয়েই তাঁকে ১০ বছর বয়সে ঘরছাড়া করল। পালিয়ে চলে এলেন নালন্দায়।
নালন্দায় তখন অনেকগুলি বৈষ্ণব মঠ, যেগুলি চালাতেন ভূস্বামীরা। তিনি সেখানে এসে দেখলেন, তাদের পারিবারিক শাক্ত মতের সঙ্গে অনেক ফারাক নালন্দার বৈষ্ণবদের। অথচ, উভয়েই দাবি করেন, তারা হিন্দু। কেদারের মনে প্রশ্ন জাগে, কিসের ফারাক? কেন? শুরু করলেন মঠে বৈষ্ণব শাস্ত্রের পাঠ। এভাবে চলল বহুদিন। মঠে থাকাকালীন তাঁকে যন্ত্রণা দিল কৃষকদের উপর মঠের মালিক ভূস্বামীদের নিপীড়ন, কিষাণদের সঙ্গে প্রতারণা। যন্ত্রণা অনুভব করতেন নিজের ভিতরে, খুঁজছেন পথ, কীভাবে কিষাণদের জীবনকে বদলে দেওয়া যায়।
মঠের সন্ন্যাসী হিসাবে তাঁকে যেতে হয় কিষাণদের ঘরে ঘরে, শোনেন তাঁদের জীবনযন্ত্রণার কথা। ভিতরে রক্তাক্ত হন। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মঠাধ্যক্ষদের কথা শুনে। মঠের মালিকদের দল কংগ্রেসের সমর্থক হলেন। ইতিমধ্যে দেশে স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। মুজফফরপুরে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকির ঘটনা ও ক্ষুদিরামের ফাঁসি, দিল্লিতে লর্ড কার্জনের উপর বোমার হামলা, আফগানিস্তানে প্রবাসী ভারত সরকার (হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ) গঠন, পেশোয়ার থেকে মিরাটের সেনাশিবিরে অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা, কলকাতার কাছে বজবজে কোমাগাতা মারু জাহাজ যাত্রীদের গণহত্যা এবং ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনা ঘটেছে। শেষ ঘটনা তাঁকে নাড়িয়ে দিল। ১৯২০ সালে চম্পারণ সত্যাগ্রহের পর ১৯২১-এ তিনি যোগ দিলেন কংগ্রেসে। কংগ্রেসের আন্দোলনে ভাষণ দেওয়া, সন্ন্যাসী বেশে রাজনৈতিক কাজে সালেমপুর যাওয়া, পারসায় রাজনৈতিক কাজ সংগঠন, রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বন্যাত্রাণ, কৃষকদের সভায় ভোজপুরী ভাষায় ব্রিটিশ-বিরোধী ভাষণ দিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করে চললেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে বক্সার জেলে ছমাস বন্দি রাখল। ১৯২২ সালে জেল থেকে বেরিয়ে হলেন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি।
আবার রাজনীতিতে, কিন্তু তাঁর মনের ভিতরে অজস্র প্রশ্ন উঠছে। শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বও মেটেনি। হিন্দু ধর্মের দুই ধারার মধ্যে তাঁর প্রশ্নের সমাধান না পেয়ে ঝুঁকলেন কিষাণ আন্দোলনের গেলেন সংগঠক বন্ধুপ্রবর আর্যসমাজের স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর কাছে। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে যোগ দিলেন আর্যসমাজে। না বদলে হল রামা উদার সাধু। আন্দোলনের কারণে তিন বছর জেল খাটার সময়ে জেলে বসেই সংস্কৃতে অনুবাদ করলেন তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিহারে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। কিন্তু কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়েও মনে নানা প্রশ্ন। কংগ্রেসের একদল তখন স্বরাজ পার্টি করেছে, আবার কংগ্রসের মধ্যেই একটা সমাজবাদী শিবির গড়ে উঠছে। একই দলে এত ভিন্ন মত, অথচ তাঁদের মাথারাই কিষাণদের নিপীড়ন করে!
কৃষকদের নিয়ে কাজে সঙ্গে পেলেন কার্যানন্দ শর্মা, আচার্য নরেন্দ্র দেবের মতো নিবেদিতপ্রাণ মণীষীদের। একসঙ্গে তারা মুঙ্গেরের এক ঘরে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন কৃষকদের সংগঠন গড়বেন। জমির উপর চাষীর অধিকার ও জমিদার-ভূস্বামীদের হামলা ঠেকাতে ১৯২৯ সালে এঁরাই তৈরি করলেন বিহার প্রাদেশ কিষাণ সভা। ভারতের প্রথম কৃষক সংগঠন। এর পাঁচ বছর পর তৈরি হল কংগ্রেস সোস্যালিস্ট ফোরাম। তিনি সেখানে এন জি রঙ্গ, ইএমএস নাম্বুদিরিপদের সঙ্গী। তারা দক্ষিণ ভারতের কৃষক আন্দোলনের নেতা। সিদ্ধান্ত হল, একটা সর্বভারতীয় কৃষক সভার জন্ম দেওয়া যাক। ১৯৩৬-এ লখনউতে বসল কংগ্রেস অধিবেশন। সেখানেই গড়ে উঠল ‘সারা ভারত কৃষক সভা’ (এআইকেএস), যার সভাপতি হলে আর্যসমাজের স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। নেতৃত্বে এলেন কেদারনাথ ওরফে রাম উদার, রঙ্গ, নাম্বুদিরিপদ, কার্যানন্দ শর্মা, আচার্য নরেন্দ্র দেব, যদুনন্দন শর্মা, রামমনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ, বঙ্কিম মুখার্জি প্রমুখ। কৃষক সভার পিছনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছলেন ১৯২৫ সালে তৈরি কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন। ১৯৩৭-এ কেদারনাথ ওরফে রাম উদার যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪০ সালে মতিহারির কৃষক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর কিছুদিন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তাঁর পার্টি সদস্যপদ বাতিল হয়। কিন্তু তিনি পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে লেগে থাকেন, সে কারণে দেউলি ও হাজারিবাগ জেলে বন্দীও থাকেন। পরে তিনি আবার পার্টির সদস্যপদ ফিরে পান।
ইতিমধ্যে তাঁর মনে আবার প্রশ্ন জাগছে আর্যসমাজের দর্শন ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে তখন তিনি নামী হিন্দুদের কাছেও ব্রাত্য, আর্যসমাজেও নানা সীমাবদ্ধতা। ব্যবহারিক জীবনেও দর্শনের প্রয়োগে ধর্মাচারীদের বিপরীত কাজ তাঁকে সন্দিহান করে তুলেছে। নানা প্রশ্নের জবাব, যা শাক্ত মতে পাননি, বৈষ্ণবে পাননি, আর্যসমাজেও অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। এই সন্ধানের গতি তাঁকে নিয়ে গেল অন্য দিশায়। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। মনের ভিতরে অনেকদিন ধরে সুপ্ত বহু প্রশ্নের উত্তর পেলেন। ধর্ম পরিবর্তন করে হলেন বৌদ্ধ। এবার নাম নিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। রাহুল অর্থাৎ বুদ্ধ-পুত্র। সাংকৃত্যায়ন, যিনি কিছু সৎ কাজ, ভাল কাজ করতে চান। একদিকে মার্কসীয় বস্তুবাদ, অন্যদিকে বৌদ্ধদর্শনকে পুঁজি জ্ঞানতপস্বীর জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষু হননি। চেয়েছেন, বৌদ্ধদর্শনের মূলতত্ত্বকে পরের প্রজন্মের কাছে তুলে দিতে। মুক্তচিন্তক বলে ধর্মীয় গোঁড়ামিও তাঁকে ছুঁতে পারেনি।
শাক্ত থেকে বৌদ্ধ হওয়া এবং কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট হওয়ার এই যাত্রাই তাঁর একমাত্র পরিব্রাজন নয়। বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে জ্ঞানার্জনে তিনি চারবার পদব্রজে তিব্বত গেছেন। একবার গিয়েছেন ভয়ঙ্কর মৃত্যুশঙ্কুল ভ্যালি অফ ডেথ পেরিয়ে, জীবন বাজি রেখে। যতবার গিয়েছেন, ততবার নিয়ে এসেছেন বিপুল বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশি। চারবার তিব্বত যাত্রায় তিনি আবিস্কার করেন ৩৬৮টির মত পুঁথি, যার অনেকগুলিই তিনি ভারতে এনেছেন। এছাড়া ৫৫টির মত পুঁথির আলোকচিত্রও তুলে এনেছেন। তিনি তিব্বত থেকে যেসব বই এনেছিলেন, সেগুই কোনও না কোনও সময়ে ছিল নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ। সেই সব পুঁথি ও দস্তাবেজ আনার জন্য তাঁকে ২২টি গাধা ভাড়া করতে হয়েছিল বলে জানা যায়। এই সব পুঁথি ও নথি আছে পাটনা মিউজিয়ামে ‘রাহুল’ বিভাগে। তিব্বত থেকে তাঁর নিয়ে আসা মূল্যবান সামগ্রীগুলি আছে পাটনা মিউজিয়ামে, ‘রাহুল’ বিভাগে। আছে সিংহ সেনাপতি বইটির মুল নথি। পালি ভাষা থেকে অনেকগুলি বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ করেছেন রাহুলজি, যার মধ্যে বসুবন্ধু রচিত ‘অভিধর্ম কোষ’, ‘খুদ্দক পাঠ’, ‘গুনপ্রভ রচিত ‘বিনয় সূত্র’, ‘মহাপরিনির্বানসূত্র’ অন্যতম।
পালি ভাষা তিনি পড়তে পারতেন জলের মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখেছিলেন উর্দু ও সংস্কৃত। প্রথাগত শিক্ষাজীবনের সেখানেই ইতি টানলেও নিজের উদ্যোগে পালি ছাড়াও শিখেছেন হিন্দি, বাংলা, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি, রুশ, সিংহলি ভাষা। বিহারে থাকা ও রাজনীতি করার সময়ে ভোজপুরী ভাষা আত্মস্থ করেছিলেন এবং পরে এই ভাষায় ‘জাপানীয়া রাছছ’, ‘ই হামার লড়াই’, ‘দেশ রচ্ছক’ এর মতো আটটি নাটকও লিখেছিলেন। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় যাওয়াও তাঁর অনবরত জ্ঞানান্বেষণের নিদর্শন।
তার ৭০ বছরের জীবনে মাত্র ১০টি বছর কেটেছেতাঁর পৈতৃক ভিটেয়। বাকি ৬০ বছরের মধ্যে দেশ ও বিদেশ ভ্রমণের কেটেছ ৪৫ বছর। এর মধ্যে আছে শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, ইউরোপের নানা দেশ, চিন, নেপাল আর চার চারবার তিব্বত সফর। ভারতের বাইরে প্রথম যান রাশিয়ায়, তারপর শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ শাস্ত্র পড়াতে। কয়েক মাস পড়ানোর পর তাঁর এই পেশা ভাল না লাগায় ফিরে আসেন। বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বহু ক্ষেত্রে গিয়ে অধ্যয়ন ও নিজস্ব খোঁজ চালাতে থাকেন। ডাক পড়ে সমাজবাদী রাশিয়া থেকে, পার্টির অনুমতি গেলেন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায়। এটি ছিল দ্বিতীয় সফর।

আরো পড়ুন: গোত্র বিশ্বাসের আদি কথা

অধ্যাপনা শুরু পর আলাপ হল লোলা ওরফে এলেনা নারভের্তোভনা কোজেরভস্কায়া নামে এক বিদূষীর, যিনি কেবল ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, সংস্কৃত ও ইংরেজী জানতেন তাই নয়, লিখতে পারতেন সংস্কৃতে। রাহুল তাঁর সহযোগিতায় তিব্বতি-সংস্কৃত অভিধান রচনা করার সময়ে সখ্যতা প্রেমে পরিণত হয়, বিয়ে করেন। সন্তান হয় ইগর। ইতিমধ্যে রাহুলজির প্রোজেক্টের কাজ শেষে, দেশে ফেরার সময় আসে। কিন্তু স্ট্যালিনের নেতৃত্ব লোলা-ইগরের ভারতে আসায় আপত্তি জানায়। চোখের জলে বিদায় নিয়ে আসতে হয় রাহুলজীকে। রাহুলের লেখা একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে ‘উত্তরপুরুষ’। বইটি এখন পাওয়া যায় না। কখনও কোনও সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের স্তুপে পেলে পড়ে দেখবেন। রাহুলজী বুঝি নিজের এই জীবনের চিত্র এতে আছে।
রাশিয়া থেকে ফিরে একবার পায়ে হেঁটে তিব্বত গেলেন। সেখান থেকে ফেরার পর দেশ ঘুরতে লাগলেন। গেলেন ইরান। সেখান থেকে ফেরার পর চতুর্থবারের জন্য গেলেন তিব্বত। নেপাল হয়ে ফেরার সময়র দার্জিলিং-এ এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই সময় তাঁকে দেখভাল করেছিলেন কমলা নামে এক তরুণী অধ্যাপিকা। বহুদিন লেগেছিল রাহুলজির শারীরিকভাবে সুস্থ হতে। লোলাকে ফেলে আসার পর মনের ক্ষত থেকেই গিয়েছিল। কমলা সেই ক্ষতে ভালবাসার প্রলেপ দিলেন, প্রেমে ভাসলেন রাহুল, বিয়ে করলেন। তাঁদের তিন সন্তান – দুই পুত্র জেতা ও জয়ন্ত এবং কন্যা জয়া।
এই যে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘোরা, সন্তোষী থেকে লোলা হয়ে কমলায় থামা – এ সবের পিছনেও তাঁর সেই এক খোঁজ। অজানার উত্তর তাঁকে পেতে হবেই, অতৃপ্তির অবসান ঘটাতে হবেই। খোঁজ, খোঁজ আর খোজ। অনুসন্ধান জ্ঞানের, দর্শনের। হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য পথ একা মাইল মাইল হাঁটা শুধু বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশির সন্ধানে – অতীশ দীপঙ্করের পর আর কেউ করেননি। ইরান থেকে বর্তমান বাংলাদেশের কিছু এলাকায় ঘরসংসার ফেলে কেউ চষে বেড়াননি।
রাহুলজির লেখা বইয়ের তালিকা নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। একটি বইয়ের কথা শুধু বলার। বইটির নাম ‘সিংহ সেনাপতি’। রাহুলজি নিজেই লিখেছেন, বইটি তাঁর লেখা নয়, তিনি আক্ষরিক অনুবাদক মাত্র। লেখকের নিজেরই না সিংহ। লিচ্ছবি গণের এক শিশু সন্তান সার্থদের (বণিক) সঙ্গে কীভাবে তক্ষশীলায় গেলেন অস্ত্রশিক্ষার জন্য, সেখানকার গুরুগৃহের পরিবেশ, রীতিনীতি, তৎকালীন জনজীবন, গুরুকন্যাকে বিয়ে করে সিংহর ফেরার পথের নানা সঙ্কট, ফিরে এসে লিচ্ছবি গণের একজন সাধারণ সৈনিক হওয়া থেকে সেনাপতি হয়ে ওঠা—- এই হল এই বইয়ের কাহিনী। শেষ পর্বে সেনাপতি সিংহকে সেই গণরাজ্যের প্রধান অর্থাৎ ‘গণেশ’ পদে আরোহনের অনুরোধ আসছে। সেই সময় স্ত্রী রোহিনীর অনুরোধে দ্বিধাগ্রস্ত সিংহ যাচ্ছেন পাশের এলাকার আমবাগানে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনায়। সেই সন্ন্যাসী রাজকার্যেও অভিজ্ঞ বলে সবাই বলেছেন। সেই সন্ন্যাসীই স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ। পোড়া মাটির টালির এক একেকটিতে ৩৯টি করে শ্লোক লেখা ১৬০০ টালি রাহুলজি নিজেই মাটির তলা থেকে আবিস্কার করেছেন। আক্ষরিক অনুবাদের পর সেগুলি দান করেছেন পাটনা মিউজিয়ামে। ইউরোপের কোনও দেশে হলে শুধু এই জন্য রাহুলজিকে মানুষ মাথায় করে রাখতো। আমাদের এই বাংলার বিদ্বজনের অনেকেই এই বইটির কথাই জানতেন না, আজও জানেন না।
একদিন পণ্ডিত রামশরণ শর্মা তাঁর ঘনিষ্টমহলে রাহুলজিকে নিয়ে আলোচনায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহরু পর্যন্ত রাহুলজিকে সমীহ করে চলতেন। নেহরু জানতে পারেন, সাঁচির স্তুপের এক কক্ষে প্রায়াপোবেশনে অধ্যয়ন করে চলেছেন রাহুলজি। চোখে ভাল দেখেন না। সময়টা সম্ভবত ১৯৬০ কি ১৯৬১। অন্ধকার ঘরে একটি আলোর নিচে পড়েই চলেছেন। কখনও কেউ খাদ্য দিলে খান। নেহরু ভাবলেন, কিছু অর্থ তাঁকে দেওয়া যাক। তিনি সাঁচি পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। যাওয়ার সময় নিজের লেখা ‘ডিস্কভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইটি সঙ্গে নিলেন। সাঁচি স্তুপে সরকারি সফরের পর জিজ্ঞাসা করে রাহুলজি যে ঘরে, সেখানে গেলেন। রাহুলজি বিস্মিত। পণ্ডিত নেহরু তাঁকে প্রণাম করে নিজের লেখা বইটি দিয়ে বলেছিলেন, “পড়ে দেখবেন। ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দিলে উপকৃত হবো’। নেহরু ফিরে আসার পর রাহুলজি বই খুলে হেসে ফেলেন। বইয়ের কিছু কিছু পাতার ভিতরে একশো টাকার নোট সযত্নে রাখা। একথা জানিয়ে রামশরণ শর্মা বলেছিলেন, পণ্ডিত নেহরুও সরাসরি আর্থিক সাহায্য করার প্রস্তাব দিতে সাহস পাননি। তাই, ১৯৬৩-তে রাহুলজিকে পদ্মভূষণ-এর প্রস্তাব করে যান।
ঘটনাচক্রে, পদ্মভূষণ সম্মান পাওয়ার আগেই গুরুতর অসুস্থ হন রাহুলজি। তাঁকে নিয়ে আসা হয় দার্জিলিং-এর কাছারি রোডে রাহুল নিবাসে। পদ্মভূষণ গ্রহণ করার কিছুদিন পর, ১৪ এপ্রিল মারা যান রাহুলজি, আর পরের বছর জুলাইতে চলে যান নেহরুও।
( আমার লেখায় আর্যসমাজি রাহুলজির নাম রামাবতার সাধু লিখেছিলাম। হবে রাম উদার সাধু। সংশোধন করলাম। ১১/৪/২০২০)
সূত্র
১) অধ্যাপক সুনীল মুন্সীর সঙ্গে সাক্ষাতকার
২) মহাপরিব্রাজক রাহুল সংকৃত্যায়ন, কালান্তর, ১৯৯৩
৩)সারা ভারত কিষান সভার ইতিহাস
৪) রাহুলজি, দর্শন অউর দিকদর্শন, জনশক্তি, পাটণা, ১৯৯৩
৫) সিংহ সেনাপতি, চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা
৬) রাস্মশরণ শর্মার স্মৃতিচারণ, কলকাতা, ১৯৯০-৯১
৭)রাহুল সাংকৃত্যায়ন – একটি বর্ণময় জীবন, গল্পের সময়
৮) ইউকিপিডিয়া

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত