| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রাইনার মারিয়া রিলকে ও তাঁর দুইনো এলিজি

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

 “Shouting like mad and clapping my hands…”

I howI at the moon with all my heart and put the blame on the dogs.”

(উন্মত্তের আর্তনাদে, দুই হাতে বাজিয়ে করতালি— চাঁদের দিকে মুখ তুলে আমি ঘেউ ঘেউ করি হৃৎপিন্ড নিংড়ে,

আর দোষ চাপাই মিছিমিছি কুকুরদের ঘাড়ে ॥)

 “Stimmen…stimmen. Hore, mein Herz…wer, wenn ich schriee, horte mich den aus der Engel Ordnungen?”

(কণ্ঠস্বর, কণ্ঠস্বর! শোনো, হে আত্মা আমার!

..যদি আমি কেঁদে উঠতাম,

শ্রেণিবদ্ধ দেবদূতগণ,

তোমাদের মাঝে কে আমার শুনতে পাবে বলো?)

অশ্রুতপূর্ব সে কিংবদন্তি তবে আবার শোনা যাক। সবটাই ছিল যেন এক ঘোর অমল কমল বীণাবাদন। কবি রাইনার মারিয়া রিলকে তখন ত্রিয়েস্তের কাছে সমুদ্রের পাশে এক শৈলবাসে (দুইনোয়) বসবাস করছিলেন। একদিন সকালে দুর্গের উঁচু প্রাকারবেষ্টিত ছাদের ওপর দিয়ে হাটতে হাটতে  ঝোঁকের মাথায় ছাদ বেয়ে সোজা নেয়ে এলেন- যেখানে সমুদ্রের খাড়া ঢেউ অবিচল আছড়ে পড়ছে সহিষ্ণু পাথরের শরীরে। ডেভিড ইযং, ‘দুইনো এলিজির’ তৃতীয় ও আধুনিক ইংরেজি সংস্করণের (১৯৭৮ ৮৩১ ৯১২, ISBN ০-৩৯৩-৩০৯৩১-২) অনুবাদক তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মুখবন্ধে আমাদের জানাচ্ছেন, ত্রিয়েস্তের সমুদ্রের পাশে সেই সকালে রিলকের অবস্থা ছিল যেন খানিকটা ডেনমার্ক দেশীয় যুবক হ্যামলেটের মতো, ভূতের সঙ্গে লড়াইয়ে যে প্রস্তুত অথবা স্বগতোক্তি রোগে পেয়ে বসা বৃদ্ধ রাজা লিয়ার, বৈকল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যে বৃদ্ধ মানব-অীস্তত্বের প্রশ্নে সরব হয়ে ওঠেন (“Is man no more than this? Consider him well.” ডেভিড ইয়ং আমাদের আরো জনাচ্ছেন, সমুদ্রের তীরে সেই সকালে উত্তুঙ্গ সামুদ্রিক বাতাস বইছিল এবং বাতাসের সেই গর্জন-শব্দের ভিতর থেকেই রিলকে শুনতে পেলেন এক কণ্ঠস্বর: “Wer, wnen ich schriee…” (Voices, voices. Listen, my heart…If I cried out, who would hear me up there, among the angelic orders”?)

শব্দগুলো পরপর নোটবুকে লিখে ফেললেন রিলকে। অর্থাৎ ‘দুইনো এলিজি’র প্রথম চরণ। অতঃপর ঘরের ভিতর ঢুকলেন ও শুরু করলেন ‘দুইনো এলিজি’ রচনা যা এই শতাব্দীর প্রধানতম সাহিত্যিক কর্মসমূহের একটি ‘দুইনো এলিজি’র প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি একাধারে একটি দীর্ঘ কবিতা ও কাব্য। এই কবিতায় অস্তিবাদী চেতনার এক সূক্ষ্ম কণ্ঠস্বর সর্বব্যাপ্ত, যে কণ্ঠস্বর কখনো কবির হয়ে কথা বলে, কখিনোবা এক নাটকীয় চরিত্রের মতো নির্ধারিত ‘সংলাপ’ বলে যায়। এই বলাটা কবির নিজের জন্য যেমন তেমন আমাদের জন্যও। হ্যামলেট ও লিয়ারের মতোই। ‘দুইনো এলিজি’র এই সর্বব্যাপ্ত কণ্ঠস্বর প্রায়শঃ তার সর্বনা বদল করে চলে। সে কখনো রিলকের হয়ে কথা বলে, রিলকের সঙ্গেই কথা বলে- অধিকাংশ সময়ই সে অবশ্য এক কুহকী শক্তি ও তীব্রতায় আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে আমরা যারা মানুষ, নিজেদের নিছক ‘মানবীয় অস্তিত্বে’র কারণে যারা একই সঙ্গে সংহত অথচ বিভ্রান্ত! দীর্ঘ এ কবিতা কোনো পাঠকের পক্ষেই পড়ে ওঠা সম্ভব নয়, যতোক্ষণ না সে এই কবিতার কণ্ঠস্বরটিকে বুঝতে পারছে। যে কণ্ঠস্বর একইসঙ্গে আত্মগত ও নৈর্ব্যক্তিক: রিলকের স্বর, লিয়ারের স্বর, বাতাসের স্বর, আমার ও আপনার স্বর! গভীর অথচ আতঙ্কজনক যে বিচ্ছিন্নতা ও নির্বাসনের ভিতর প্রতিটি ব্যক্তিসত্তার বাস, সেই ব্যক্তিসত্তার কথনকে প্রত্যেকের কথন করে তুলতে পারাটাই রিলকের সাফল্য। দুইনো এলিজি একই সঙ্গে যেমন লিরিক্যাল তেমনি স্বরূপ সত্তা (oneself) ও অপরাপর সত্তার (othersefl) দ্বন্দ্বে দীর্ণ এক ভয়াবহ নাটকীয় কবিতাও বটে। যে ক্যাথেড্রাল শ্রেণী রিলকের মানসকে ঝজু করে তুলেছিল, সেই ক্যাথেড্রালসমূহের মতোই রিলকের কবিতা আজো আমাদের ভিতর তার স্বচ্ছ যতো পরিরেখ, মিড়-এর কারুকাজ, অন্তরঙ্গকতা ও রাজসিকতায় সমুজ্জ্বল।

যদিও সামুদ্রিক বাতাসের গর্জন রিলকেকে শুনিয়েছিল, দুইনো এলিজি-র প্রথম চরণখানা, তবু দুইনো এলিজি-কে সম্পূর্ণ করতে ১৯১২-২২, ঝাড়া ১০টি বছর সময় লেগেছিল এই কবির।  জীবন ও শিল্পের কোনোদিকই সহজে কি আয়াসে পেতে চায়নি রিলকে। ১৮৭৫ সালে প্রাগ শহরে, এক অষ্ট্রীয় সেনা অফিসার পিতার গৃহে তার জন্ম। এক জটিল শৈশব অতিক্রমণের পর কবিতাকেই জীবনের একমাত্র কর্ম হিসেবে বেছে নেন। পড়াশোনা করেছেন প্রাগ, মিউনিখ ও বার্লিনে। ১৮৯৮ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘Leben und Lieder’ প্রকাশ। পরবর্তী সময় অবশ্য কবি এ গ্রন্থের পুর্নমুদ্রণ কোনোমতেই করতে দেননি। ফলত বইটি আজ বিরল। অবশ্য এই ১৮৯৮ সালেই তাঁর আরো দুটো কাব্য সঙ্কলন ‘Larenopfer’ I ‘Traumge Kront’ প্রকাশিত হয়। এ বছরই তিনি প্রথম ইতালি ভ্রমণে যান, যান রাশিয়ায় এবং তলস্তয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের ফল হলো তাঁর “Die Geschichten vom Lieben Gott” (ঈশ্বরের গল্পসমূহ)। ওরপসোয়েদের বসবাসকালীন তিনি র‌্যদিনের ছাত্রী ক্লারা ওয়েস্থফকে বিয়ে করেন। প্যারিসে তাঁর বসবাসের দীর্ঘ ২৫ বছর সময় তিনি র‌্যদিনের বন্ধু ও সেক্রেটারি হয়ে উঠেছিলেন। জুলাই ১৯১৪ পর্যন্ত প্যারিসে বসবাসের এ দীর্ঘ ২৫ বছর সময়কালেই রিলকের কবি জীবনের বড়োসড়ো কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত Dos Stundenbuch (The Book of Hours) 1907 Neue Gendichte (New Poem) Ges S Die Aufzeichnungen des Malte Laurids Brige (The Notebooks of Malte Laurids Brigge) | দুটোই তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। এ সময় তিনি ইতালি, স্পেন, মিসর, সুইডেনসহ নানা দেশ বিস্তর ঘুরে বেড়িয়েছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রিলকে ফ্রান্স ছাড়তে বাধ্য হন। যুদ্ধের সময়টা মিউনিখেই বাস করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তিনি সুইজারল্যা-ে যান। সুইজারল্যা-েই জীবনের শেষ দুই কাব্য, ‘দুইনো এলিজি’ এবং ‘সনেটস টু অর্ফিয়ুস’ শেষ করেন। প্রয়াত হন ১৯২৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর। রিলকের জীবন ও কাব্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সমালোচকরা প্রায়ই বলে থাকেন যে, যদিও নিরন্তর ভ্রমণ, অধ্যয়ন ও নিজস্ব লেখালেখি সম্পর্কে অনিশ্চয়তাবোধে ঠাসা এক ব্যস্ত জীবনই কেটেছে রিলকের, প্রচুর বন্ধু-বান্ধবও ছিল তার- তবু সত্তার কেন্দ্রস্থলে তিনি ছিলেন ভয়ানক নিঃসঙ্গ। সত্যি বলতে নিঃসঙ্গতা তাঁর আরাধ্য ছিল; যেন নিজের ভিতরের তীর্থযাত্রাটি সমাপ্ত করা যায়। ত্রাস, উল্লস ও বিচ্ছিন্নতায় ভরা এই তীর্থযাত্রা। রোমান্টিসিজম, এ´প্রেশনিজম ও প্রতীকবাদের সমসাময়িক নানা আন্দোলনের ভিড়ের মধ্য থেকেই সযতেœ নিজস্ব লিখন-রীতিটি তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯১০ সালে The Notebooks of Malte Laurids Brigge নামক নিরীক্ষামূলক গদ্যকর্মটির (স্মৃতি, কল্পনা ও মানবীয় অস্তিত্ব যতো নিকৃষ্টতম ভয় উৎপাদন করতে পারে, সেই তাবৎ ভয় নিয়েই এই গদ্যকর্মটি রচিত) পর তার ধারণা হয়েছিল যে, লেখার ক্ষমতা সম্ভবত চিরতরে শেষ হয়ে গেছে তাঁর। দুটো হতাশ ও বন্ধ্যা বছরের পর ‘দুইনো এলিজি’র সেই দৈব কণ্ঠস্বর কানে এলো তাঁর। কবি তখন উচ্চারণ করলেন: “Solitude is a true elixir”!  ১০ বছর ধরে এক দৈব কণ্ঠস্বরের সান্দ্র যতো উচ্চারণ কবি শুনতে থাকেন। জীবন ও মৃত্যুর প্রান্তসীমায় দাঁড়ানো, ক্ষোভ ও উল্লাসে পরিপূর্ণ কণ্ঠস্বর। যথার্থই বলেন ডেভিড ইয়ং, … পরম শক্তি ও সততার সঙ্গে রিলকে তাবৎ মানবীয় শর্তকেই (Human Conditions) ছুঁয়ে যান। আমাদের আত্মজাগরণের পঙ্গু ও বিশিষ্ট যতো প্রতিবিম্ব ও আমাদের নিজেদের কাছ থেকে নিজেদেরই বিয়ুক্তি তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়। সন্তান ও তাদের পিতামাতা, বীর ও বীররস, শিল্প ও শিল্পী, সবাইকে ছুঁয়ে যায় তাঁর কবিতা। কলা ও কল্পনা, আত্মপ্রতারণা ও ভয়ের ভিতর দিয়ে শিল্পিত অতিক্রমণই তাঁর উদ্দেশ্য”|

বিশ্বজুড়ে ‘দুইনো এলজি’র আজো অক্ষুন্ন গরিমান প্রধান কারণ হয়তো এই কবিতায় অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য প্রবল সাহসের সঙ্গে মৃত্যু বা মানবীয় নশ্বরতার কথা বলা হয়েছে বারংবার। শুধু মৃত্যুই নয়। একই সঙ্গে হারানো, পরিবর্তন, ক্ষত, অসুস্থতা, অপূরনীয় দুর্গতি, নৈশ-ভয়, চৈতন্যের প্রতিনিয়ত তাড়না, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বর্বরতার বীজ, আতঙ্কদায়ক বিশুদ্ধতা ও দেবদূতগণের নির্লিপ্তে রিলকীয় কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ।

দুইনোর ১০টি এলিজি যেন এক আদিবাসী তাঁত-যে তাঁতে অ্যাক্রোবেটিকস, গল্প, ঐতিহাসিক চরিত্র, পুরাণ, ভাস্কর্য, নগরী, ল্যান্ডস্কেপ, পশু, কার্নিভাল, দেবদূত, শব্দপুঞ্জ, গ্রীষ্মের সকাল, মৃত শিশু ও এমনি নানা বর্ণিল প্রতীকপুঞ্জ বুনন হয়ে চলেছে। তাঁত উঠেছে-নামছে! মাকুর খটখট শব্দ: ঐ শব্দটিই যেন মৃত্যু। রহস্য। দূর অথবা অদূর। পুষ্টি! রক্ত চলাচল। কোনো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, ছেঁড়া কাপড় অথবা হৃদয়ের অস্থি বিপণি (bone shop of the heart), কোনো দার্শনিকের মধু চন্দ্রিমা অথবা দেবদূতের আয়না। পোলিশ অনুবাদককে লেখা এক চিঠিতে কবি জানাচ্ছেন: Affirmation of life AND death appears as one in the ‘Elegies’ …. there is neither a here nor a beyond, but a great unity Transience everywhere plunges into a deep being.

রিলকের এ বক্তব্য দান্তে সম্পর্কে রুশ কবি ম্যান্দেলস্তেমের লেখা “কবিতার অন্তদৃষ্টি ও অন্তর্যাত্রা” সম্পর্কিত ভাষণের সঙ্গে মিলে যায়। দুইনোর দ্বিতীয় এলিজি থেকে চতুর্থ এলিজি পর্যন্ত ছত্রে ছত্রে অজস্র চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন রিলকে: বৃক্ষ, অভিবাসী পাখি, সিংহ, প্রেমিক-প্রেমিকার কুঞ্জবীথি, থিয়েটারগৃহে অপেক্ষা, একজন নর্তক, পুতুল নাচ, পিতার সঙ্গে কবির সম্পর্ক (যা স্থানিক দূরত্বের নির্দেশবাহী) এবং সবশেষে আবার পুতুল নাচে ফিরে আসা। দেবদূতের সুতোর বাঁধা পুতুল নাচ। এভাবেই দুইনোর প্রথম এলিজি পর্যন্ত প্রতীক ও চিত্রকল্পের এক নিরন্তর রূপান্তর আমরা দেখতে পাই। নিয়ত রূপান্তরের এ প্রক্রিয়া যেন সত্তার অসীম উড্ডীন পথটিকে, সম্পূর্ণ উড্ডয়নকেই (flight) মূর্ত করে তোলে। আর এখানেই রিলকেকে কেন্দ্র করে কৌতুহল দানা বাঁধে; শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ‘চৈতন্য’, কোয়ান্টাম ফিজিক্সে বর্ণিত পদার্থের Spirit বা চৈনিক ‘তাও’ বাদীদের ‘তাও’ (পথ).. মানব-চৈতন্যের এককতম এই বিচ্ছুরণসমূহকে নিয়ে যে কবি এতো স্বচ্ছন্দে খেলা করলেন, ভাসালেন শব্দের নৌকা; তাঁর সম্পর্কে তার সময়ের মানুষেরা কি ভাবতেন? ‘নার্সিসিষ্ট’ বা ‘আত্মপ্রেমী’ অভিধায় ধিকৃত হয়েছেন তিনি, কারো সঙ্গেই দীর্ঘদিন সুসম্পর্ক বজায় রাখতে না পারার বদনাম আছে তাঁর এবং তাঁর অপরিমেয় অহঙ্কার…। তবু স্তেফান স্তাইগ তাঁর গ্রন্থে পল ভালেহি, এমিল ভের্হারেন ও ফ্রান্সিস জেমস প্রমুখ কবি ও শিল্পীদের সম্পর্কে আলোচনা করার সময় রিলকে সম্বন্ধে মন্তব্য করেন:

Ò… এই তাবৎ ব্যক্তিত্বের মাঝে রিলকের মতো শান্ত, নিভৃত ও বলতে গেলে অদৃশ্যমান জীবন আর কেউ যাপন করেননি। অথচ এমনও নয় যে, এই নৈঃশব্দ্য তাঁর ইচ্ছাকৃত চেষ্টা বা নিজের ওপর জোর করে কোনো আরোপণের ফল। জার্মানির স্তেফান জর্জ যেমন ছিলেন; নৈঃশব্দ্য যেন রিলকের চারিদিকে বন্য উদ্ভিদের মতো গজিয়ে উঠতো, যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই নির্জনতা তাঁকে ঘিরে ধরতো। যেহেতু চতুস্পার্শে¦র কোলাহল এড়িয়ে চলতেন তিনি, নিজস্ব খ্যাতির ঝনৎকারকেও ভুল বোঝাবুঝির সমষ্টি বা যোগফলই হলো খ্যাতি একবার বলেছিলেন তিনি; এ কারণেই রিলকের নামটিকে কেন্দ্র করে অলস কৌতুহলের যে বুদ্বুদ বিভিন্ন সময় ভাসতে দেখা গেছে, ব্যক্তি বা মানুষ রিলকেকে কেন্দ্র করে তার অনুমাত্র হয়নি। কোনো ঘর ছিল না রিলকের, কোনো নির্দিষ্ট আস্তানা বা ঠিকানা যেখানে কেউ কাকে খুঁজে পাবে কি কোনো অফিস। পৃথিবীর মেঠো পথের অশ্রান্ত পথিক ছিলেন তিনি, নিজেও জানতেন না কোন পথের কোন বাঁকটি তার সামনে এসে দাঁড়াবে।”

শুধুই জলকে নখে আঁচড়ানোর মতো বা বাতাসে জাল পেতে রাখার মতোই অনিকেত অণিমায় তৈরি করেছেন একটি গোটা নক্ষত্রলোক। রিলকে ও তাঁর মহত্তম দুই সৃষ্টির অন্যতম দুইনো এলিজি-র অনির্বচনীয় ভাষা সম্পর্কে রিচার্ড এক্সনারের মতামত হলো:

 … এ এক নতুন ভাষা যা চিন্তন ও আবেগের অবিচ্ছেদ্যতা দিয়ে তৈরি। হাজার হোক, আবেগগত অভিজ্ঞাতসমূহ যৌক্তিক প্রত্যয়েই প্রকাশ করাটা নিয়ম এবং আবেগগত ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা করে যুক্তি। রিলকে কখনই তাঁর পাঠকদের বলেননি যে, আমি তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবো। তিনি শুধু বলেছেন যে, ‘প্রশ্নগুলোকে ভালোবাসো এবং তাহলেই তুমি উত্তর খুঁজে পাবে।’ প্রকৃতপক্ষে, কাব্যানুরাগী জার্মান প্রিন্সেস মেরি ভন থার্ন আন্ড ট্যাক্সিস-হোহেনলহর আমন্ত্রণে দুইনো প্রাসাদে বেড়াতে গিয়ে দশ বছর ধরে যে কাব্য বা কবিতাটি রিলকে রচনা করেছেন তার অনুভূতিগত পরিসর বা প্রতীকপুঞ্জের বিস্তার একক কোনো প্রবন্ধে বর্ণনা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবু নিচে দুইনোর ১০টি এলিজির মূলগত ভাব ও প্রতীকপুঞ্জ (theme & Metaphors) সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

প্রথম এলিজি

মূলগত ভাব: কবি এখানে মৃতদের পৃথিবীর কণ্ঠস্বর শুনতে চাইছেন। মৃতদের আমাদের জন্য কি বলার আছে কবি তা জানতে চান। মৃতদেহ কাছে জীবিতদের কোনো প্রয়োজন না-ও থাকতে পারে, কিন্তু জীবিতদের জন্য মৃতদের প্রয়োজন আছে। কেননা, প্রাচীন দিনের শোক থেকেই বিষাদের জন্ম।

হ্যবহৃত চিত্রকল্পসমূহ: শ্রেণীবদ্ধ দেবদূতদল (অবশ্য খ্রিষ্ট ধর্মের দেবদূত নন এরা; কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য বরং আছে ইসলামের ফেরেস্তাদের সঙ্গে), গাসপারা স্তাম্পা (ষোড়শ শতকের ইতালীয় নারী কবি যিনি তাঁর প্রেমিকের দ্বারা পরিত্যাক্ত হয়েছিল, তবে সেই বিষাদকে তিনি উত্তীর্ণ করেন কবিতায়), ভেনিসের সাস্তা মারিয়া ফরমোসা চার্চ ও লিনোস, এক উদ্ভিদ-দেবতা।

দ্বিতীয় এলিজি

গ্রীক অন্ত্যেষ্টিক ভাস্কয © (funerary sculpture) মানবীয় নশ্বরতাকে তার গঠনগত মর্যাদা ও নিয়ন্ত্রণে স্বীকার করে নিয়েছে; তেমনি কবিও মৃত্যু  স্বীকার করে নিচ্ছেন। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহসী যে প্রেমিক যুগল অস্বীকার করতে চায় মৃত্যুকে, মৃত্যু তাদেরও অর্ফিয়ুস-ইউরিপিদিসের মতো বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

চিত্রকল্প: তোবিয়াস। তোবিত রচিত সংশয়বাদী পুস্তক (apocryphal book), যেখানে দেবদূত রাফায়েল এক দুঃসাধ্য যাত্রাপথে তোবিয়াসকে পথনির্দেশ করে চলেন, যদিও তোবিয়াস তাকে চিনতে পারেনি।

তৃতীয় এলিজি

প্রেমের আলাপন এই এলিজিতে অব্যাহত। পাশাপাশি নতুনতর মোটিফ হিসেবে শিশুর প্রতিমা এখানে আঁকা হয়েছে। ফ্রয়ডীয় মনস্তত্বের আবরণে রিলকে এখানে পাতাল-প্রবেশের মহাকাব্যিক প্রপঞ্চসমূহের বিস্তারে মনোযোগী। এই অন্তর্যাত্রায় শিশু, মা, যুবক ও যুবতীর পারস্পারিক বর্ণণে কোমলতা ও তিক্ততার এক অনবদ্য মিশ্রণ হয়ে উঠেছে এই এলিজি।

চতুর্থ এলিজি

পুনর্বার প্রতীকপুঞ্জ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে প্রেমিক যুগল, অন্তর্গত ল্যান্ডস্কেপ, শিশু ও পিতা। এই এলিজিতে তির্যক দৃষ্টিসম্পন্ন বালক হলো রিলকের কাজিন ইগন, যাকে রিলকে যি‘সনেটস টু অর্ফিয়ুসে’ (১১,৮)- ও স্মরণ করেছেন। এলিজিতে বালকের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত জার্মান শব্দ ‘Puppe’ বা ‘পুতুল’ খেলনার পৃথিবীর সঙ্গে বালকের সম্পর্ক (উল্লেখ্য, রিলকের কাজিন এই ইগন খুব অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিল) গড়ে ওঠার বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলে। এ যেন অসুস্থ বা মৃত কোনো শিশুর সঙ্গে পুতুলের পৃথিবীর সংযোগ। পাঠক, সদ্য প্রয়াত আকিরা কুরোসাওয়ার “Dreams”- এ জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন বালক কুরোসাওয়ার সঙ্গে পিচ কাঠের তৈরি খেলনা পুতুলদের কথোপকথন ও কথোপকথনের শেষে পিচ কাঠের পুতুলরা যখন মানুষের কেটে ফেলা বিলুপ্ত পিচ-বাগানে কান্নারত বালককে শান্তি দেওয়ার জন্য শেষবারের মতো নৃত্যে উজাড় করে দেয় নিজেদের, যে নৃত্যের মাধ্যমে তারা মূলত পিচগাছে আত্মার আবাহন করেছিল, মনে পড়ে আপনাদের? বড়ো শিল্পীরা মূলত তাদের ভাবনায় এক।

পঞ্চম এলিজি

১৯১৫ এর গ্রীষ্মে ফ্রাউ হার্থা ভন কোয়েনিগের অ্যাপার্টমেন্টে পিকাসোর Les Saltim Banques চিত্রকর্মটিতে সারিবদ্ধ ভাঁড়দের D আকৃতির বিন্যাস থেকে রিলকের মনে হয় D প্রতিনিধিত্ব করে ‘Dasein’ শব্দটি, ইংরেজীতে যার অর্থ ‘existence’, অস্তিত্ব।

ষষ্ঠ এলিজি

অকাল মৃত্যু যাদের বরণ করতে হয়েছে সেইসব প্রেমিক, শিশু ও অ্যাক্রোব্যাট শিল্পীদের পাশাপাশি রিলকে এখানে বাড়তি যোগ করেছেন বীর-এর রূপকল্পকে। পাশাপাশি কারনাকে স্থিত প্রাচীন মিসরীয় মন্দিরসমূহের বর্ণনা করেছেন তিনি।

সপ্তম এলিজি

এই এলিজিতে এক গ্রীস্মপ্রভাতের উজ্জ্বলতা ধরতে চেয়েছেন রিলকে। পাশাপাশি, মানবীয় কল্পনাজাত যতো অর্জন যেমন সঙ্গীত, স্থাপত্য ও প্রেমের জন্য মৃতদের আর্তি প্রকাশিত হয়েছে।

অষ্টম এলিজি

অন্যান্য পশু হতে মানুষ যে ত্রয়ীচৈতন্যের কারণে (সময়- চেতনা, আত্মন চেতনা ও মৃত্যু চেতনা) লক্ষণীয়ভাবে পৃথক, সেই ত্রি-চৈতন্যেই অষ্টম এলিজির প্রতিপাদ্য। রিলকে বিশ্বাস করেন যে, পশুও  অস্তিত্বের সঙ্কটে মাঝে মাঝে বিড়ম্বিত বোধ করে, কেননা মাতৃ জরায়ুর অভ্যন্তরস্থ ভ্রুণাবস্থার স্বাচ্ছন্দ্য ও জন্মপরবর্তী কোলাহলমুখর পৃথিবীর উদগার- এ দুয়ের বৈপরীত্য  পীড়াদায়ক। মাতৃ-জরায়ুর ঐ অন্ধকার ভালোবাসি বলেইতো আমরা দিনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমাই। নিদ্রা ও মৈথুনে মত্ত হয় মানুষসহ তাবৎ প্রাণী। মশার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীরাই বাতাসে শরীর ভাসিয়ে সুখী হতে পারে। এই এলিজিটি কবি উৎসর্গ করেছেন অষ্ট্রিয়ান কবি রুডলফ কানসারকে।

নবম এলিজি

সপ্তম এলিজির যন্ত্রণা ও উল্লাসের তাঁতটি নবম এলিজিতেও প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

দশম এলিজি

এই এলিজিতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শৈল্পিক ঝুঁকি নিয়েছেন রিলকে। কবি এখানে বিচিত্র এক মেঠোপথের ভিতর দিয়ে আমাদের গোলক ধাঁধায় ঘোরান- এ এক অজানা দেশ, অনেকটাই প্রাচীন মিসরের মতো। মিসর যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে মৃত্যু-অন্বিষ্ট (death oriented) সভ্যতা– যেখানে দৃশ্য অদৃশ্য সবচেয়ে বেশি একীভূত। এলিজির শেষ পর্যায়ে স্ফিঙ্কসের রাজমুকুট থেকে বৃদ্ধ পেঁচা অতিকায় মুখ তুলে একটিমাত্র ডানায় উড়ে যায়। আর এভাবেই মৃত্যুর দেবতা স্ফিঙ্কসের মুকুট থেকে পেঁচার উড়ে যাওয়ার মাধ্যমে জীবন ও মৃত্যুকে ছড়িয়ে তৃতীয় কোনো ভুবনে (‘ভুবন’এখানে ‘চৈতন্যের স্তর’ বা ‘State of Being’ ‡K †evSv‡”Q) রিলকে প্রবেশ করেন। বৌদ্ধধর্মে একই বোধ করি নির্বাণ বলা হয়। আমাদের পূর্বপুরুষ যতো চর্যাকার, সেই লুইপাদ, কাহ্নপাদ বা ভুসুকু মনে হয় একেই বলেছেন নৈরাত্মাদেবী বা  নৈরাত্মামণি-র সঙ্গ। আত্মা যখন জীবিত নয়, আত্মা যখন মৃতও নয়। আত্মা যখন নির্বাণপ্রাপ্ত অর্থাৎ নৈরাত্মা। নিচে পাঠকদের সুবিধার্থে দশম এলিজির শেষ তিন-চার পৃষ্ঠার ভীষণ কাটছাঁট একটি অনুবাদ এখানে পেশ করা হলো:

দ্যাখো সে যন্ত্রণা-নগরী:

তার যত ঘিঞ্জি গলি-পথ

আর ঐ বুঝি সান্তবনার হাট-বাজার?

পেছনে গীর্জের চূড়ো

নগদা-নগদি কেনা-বেচা যত!

দ্যাখো ডাকঘর

যেমত নিশ্চল রবিবারে

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ:

টাকার শরীর-বৃত্তিয় বৈধতা

সবকিছু সত্য বুঝি?

শিশুদের খেলা

দয়িত-দয়িতার আলিঙ্গন

কুকুরের কুত্তামি

লামেন্ত তরুণীকে ভালবাসে তবু

ঐ যুবকটি …

তরুণীর পেছন পেছন

হেঁটে চলে যুবা শস্যক্ষেত ধরে

‘কে তুমি?

যুবকের প্রশ্নে

সে ছেঁড়ে নৈশ্যব্দ্যের নেকা

‘আমি লামেন্ত কন্যা

পিতা-মাতামহ

খনির মজুর ছিলেন,’

মৃত মেয়ে উত্তর করে:

চন্দ্রাহত তাঁত আহা

পূণ্যসমাধি

নীলনদ পার হয়ে

দীর্ঘমুগু ষ্ফিঙ্কস

এ সেই রাজকীয় মস্তক

নক্ষত্রের তুলাদ-ে

মানবীয় মুখ যে পরিমাপ করে

ছেলেটির চাহনি ছিল

ঘোরাটে ভীষণ

তরুণীর চোখে ছিল

অশনি খরতা

ভয়ার্ত পেঁচা উড়ে যায়

মুকুটের কিনারা ছেড়ে

পাখিও ডানা ঝাপটাল

মৃত্যুর সহগামী ডানা

উন্মীলিত বইয়ে পৃষ্ঠা

ওপরে নক্ষত্রবীথি

অন্তর্গত স্বরে মৃত মেয়ে

নাম বলে যায়:

‘ঐ দ্যাখো রাইডার নক্ষত্র

এই তারাটি নাম দ-

দূরে নীল কনষ্টেলেশেনপুঞ্জ

ওরা তাকে ফলমাল্য নামে ডাকে’

পুনর্বার ফিরে আসে

ধ্রুবতারা:

আহ্ দোলনা, হেটে চলা পথ

জ্বলন্ত বইয়ের পাতা

পুতুল, বাতাস।

অথচ দক্ষিণের আকোশে

বিশুদ্ধ হাতের মুঠোয়

জ্বলছে অক্ষর ‘ম’

পৃথিবীর মায়েরা যত আছো ….”

এদিকে বৃদ্ধ লামেন্ত

হেঁটে চলেন

যতদূর প্রসারিত গিরিখাত

যেখানে ঝরনার জল

ঝকঝক চাঁদ

মৃত মেয়ে কলধ্বনি করে:

“মানুষী পৃথিবীতে,

চেন না কি?

এই সে জীবনদায়ী জল।”

পর্বত

সানুদেশে দাঁড়িয়ে থাকে

তরুন-তরুণী

মৃত মেয়ে আলিঙ্গন করে

আহ্

রুপোলি অশ্রু

প্রথম যন্ত্রণার পর্বত

যুবক বেয়ে চলে

খাড়াই শীর্ষ

শব্দহীন নিয়তি তার

মুছে যাওয়া পায়ের শব্দ

শূন্য ঝাড়গাছ

অথবা কালোমাটি ফুঁড়ে

বাসন্তী বৃষ্টির প্রথম স্বরাজ ॥

নভেম্বর, ১৯৯৮

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত