আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
রইসউদ্দিন অহন ডাঙ্গর হইছে; লায়েক হইছে। ক্ষ্যাত কোপায়, লেম্বর সাবের (মেম্বার সাহেব) জমিনে ক্ষ্যাত কোপানির কাম। আয় রোজগার খারাপ না। রইসউদ্দিনের মা’র মনে লয়, এইবার আল্লায় রহম করছে। এই এক পোলা ফালাইয়া রইসের বাপডায় মইরা গেল; তারপর চোক্ষে খালি তারাবাত্তি। গতর খাইট্টা নিজের আর পুতের মুখে ভাত জুডায়।
লেম্বর সাব দূর থেইক্যা চাইয়া চাইয়া দেহে; গায়ে গতরে ডাঙ্গর পোলা রইসউদ্দিন তার ক্ষ্যাত কেমুন যত্ন কইরা কোপায়, নিড়ান দ্যায়। চোক্ষের সামনে ভাইসা ওঠে বড় মাইয়্যা, বিয়ার উপযুক্ত। একসময় হিসাব মিল্লা যায়। রইসউদ্দিনেরতো স্বভাব চরিত্র ভালা, শইল্লেও তাগদ আছে। তবে বুড়ি মা লইয়া টানাটানির সংসার, জমি জিরাত নাই। বাপমরা পুত লইয়া বুড়ি এতোদিনে সুখের মুখ দেখছে। রইসউদ্দিনের মা লাউগাছে পানি দ্যায়, রান্ধে বাড়ে, গাছ লাগায়।
এলাকার মেম্বার সাব মানুষডা খারাপ না। বড় মাইয়্যা মাদ্রাসায় আমপারা পড়ছে, হগ্গলের চোখ পড়ে। বিয়া দেওন জরুরি বিষয়। নিজে নিজে কতা কয়, নিজের লগে নিজে পরামশ্য করে। রইসউদ্দিনের ছাপড়া ঘরে হ্যার মায়ের লগে দেহা করে। বড় মাইয়্যা লতিফা বানুর বিয়ার দিনক্ষণ লইয়া পাকাকথা হয়। রইসউদ্দিনের লগে লতিফা বানুর বিয়ার কতা দিয়া বুড়ি গায়ে বেহেশতি হাওয়া লাগায়।
লতিফা বানুর বাপের কাজকাম বহুবিধ। সালিশ দরবার, বিচার আচার সারাদিন লাইগ্যা থাহে। চেয়ারম্যানের ফুট ফরমাশ খাটন লাগে। তার মইদ্যেও ম্যালা সুখ; টাকা পয়সা, সালাম আদাপ। বড়পোলা বউ লইয়া বিদেশ করে, ইনকাম ভালা; মাঝে মইদ্যে টাকা পাঠায়। ছোড ছোড আরো ছয়ডা পোলাপাইন, স্কুল মাদ্রাসায় পড়ে। তবে বড় মাইয়্যারে তার কাছে সবচে বেশী আদরের মনে হয়। মা থুইয়া লতিফা বানু বাপেরে চা দেয়, পান বানাইয়া খাওয়ায়। লেম্বর সাবের বউ লতিফার মা হুরমতী সাজগোজ করে। পাড়া প্রতিবেশী আইলে খাতির কইরা বইতে দ্যায়। কি কামে আইছে হুরমতী আগেই জিগায়। হাইসা হাইসা অল্প বিস্তর বুদ্ধি পরামশ্য দ্যায়। এতোগুলাইন পোলাপানের মা, তবু হুরমতী’র শইলডা টাইট ফিট। পাড়ার মাইনষের মনে লয়, লেম্বর সাবের বউ জোয়ান বেডি।
বাপের কতার অবাধ্য হয় না লতিফা বানু। দেইখা শুইনা খুশীমনে রইসউদ্দিনের কাছে বিয়া বয়। রইসউদ্দিন ক্ষ্যাত কোপায়, সুর তুইলা গান ধরে, “পীরিত রতন পীরিত যতন, পীরিত গলার হার ….।” আস্তে আস্তে বছর যায়, রইসের কাছে বউয়ের থেইক্যা মায়ের সোহাগ বেশী ভালা ঠেকে। লতিফা বানু বুইঝ্যা নেয়, স্বামীরে আঁচলে বান্ধা গেল না। লেম্বর সাব সবকিছু খেয়াল কইরা চুপ থাহে। বড় মাইয়্যার মুখ দেইখ্যা চোখ ছলছল করে। রইসউদ্দিনের মা নাতি নাতিনের মুখ দেহনের লাইগা আল্লার কাছে দোয়া করে, মসজিদে শিন্নী দ্যায়।
ঈদের চান্দে লতিফা বানুর ভাই বিদেশ থেইক্যা হাতঘড়ি আর শাড়ি লইয়া বইনেরে দেইখা যায়। খবর জানছে তার বইনে পোয়াতি অইছে। অনেক খুশি মনে বইনের জামাই’র লগে বিদেশের গপ্পো জমায়। তার বউয়ের সারা অঙ্গে সোনার গয়নাপাতি চকচক করে। ঠোঁট লাল কইরা পান খাইতে খাইতে বলে, আব্বা ও আম্মাজানের লাইগা জায়নামাজ আর তসবিহ আনছি। তোমার গলা হাত এমুন খালি ক্যান? সোয়ামী কাজকাম কইরা ট্যাহা পয়সা কি করে? লতিফা বানুর সামনে রইসউদ্দিন ও রইসউদ্দিনের মায়ের হাসি-খুশি চেহারা ভাইসা ওঠে। রইসের সংসারে তার দম বন্ধ হইয়া নিজেরে ফকির ফাকরা মনে লয়। ভাই আর ভাই-এর বউরে চিতই পিডা আর গরুর দুধের চা বানাইয়া খাওয়ায়।
রইসের কাজ কামে মন উইঠা যায়, বুকের ভিত্তরে চিন্ চিন্ করে। এই কষ্টের কতা কাউরে মুখ খুইলা কইতে পারে না। খালি কান্দন আহে, বুক ফাইট্টা শ্বাস আহে।
এরমইদ্যে রইসউদ্দিনের ছেলেসন্তান হয়; লেম্বর সাবের বউ পোলাপাইন সবাই খুশি। হুরমতী সোনার চেইন লইয়া মাইয়্যার ঘরের নাতি দেখতে আসে। রইসের মা বেয়াইনরে ঘরের ডিমপাতি মুরগী রাইন্ধা মেহমানদারী করে। জামাই বাজারে যাইয়া ভোতা’র দোকানের মিষ্টি আর পান সুপাড়ি নিয়া বাড়িত আসে। লেম্বর সাবের বউ হুরমতী, লতিফা বানুর হাতে পাঁচশ টাকা দিয়া রওনা হয়। রইসউদ্দিন কিছুটা পথ আগাইয়া দিয়া আবার ঘরে ফিরা আসে। পোলার বাপ হইছে ভাবতে ভাবতে মনডা খুশীতে ভইরা যায়, নিজে নিজে হাসে, কয় আলহামদুলিল্লা।
খুশির খবরের মইদ্যে আকাশ ভাইঙ্গা ঠাডা পড়ে । রইসউদ্দিন মা, বউ, পোলাসহ কেমন যেন বেসামাল হইয়া পড়ে। লতিফা বানু বাপের বাড়িত অভাব দ্যাহে নাই। অভাব অনটন আর রইসউদ্দিনের মা বুড়িটারে দেখলেই লতিফা আবোলতাবোল বকে। রইসউদ্দিন খাটে, রোজগার করে; কিন্তু এই মায়ের জন্যই তার সোয়ামীর জমিজমা কিছু হইল না। যা কামাই করে, বুড়ির খাওয়া দাওয়া ওষুদ খরচ এসবেই সব শেষ। নিজের পুত হইছে, তারদিকেও নজর নাই, খালি মা মা। বউয়ের লাইগা আদর সোহাগ নাই, ঘরে আইলেই মুখ কালা চোখ লাল। হারামজাদা ফকিন্নির পুত।
লতিফা বানু এইবার শক্তি অর্জন করে। বাপের বাড়ি যায়। বাবা মা’রে সব খুইলা কয়, এই জীবন থেইক্যা মুক্তি চায়। হুরমতী লতিফারে বুঝায়, বিয়া হইছে বউ হইছস, মা হইছস; মাইন্না ল। মানি লোক, লেম্বর সাব (মেম্বার সাহেব) বিশদ চিন্তা কইরা কোন কূল-কিনারা পায় না। রইসউদ্দিনের সাথে আদরের মেয়েটারে তখন এমন হুটহাট বিয়া দেওয়া খুব বড় ভুল মনে হয়। মনের অজান্তে চোখ থেইক্যা পানি গড়াইয়া পড়ে।
রইসউদ্দিনের বউ এইবার বিভিন্ন সময় রইসকে খোটা দিতে থাকে। নিজের কপাল চাপড়ায়। এই ছোটলোকের সংসারে তার জীবন অসহ্য লাগে। ভাত-কাপড়, ভালোবাসার অভাব আর রইসের মায়ের লাইগা অতিরিক্ত টান তারে প্রতিশোধপরায়ণ কইরা তোলে। লতিফা বানু কখনো আত্মহত্যা করতে, আবার কখনো ঘর থেইক্যা বাইর হইয়া যাইতে চায়। তার কথাবার্তা রইসের কাছে পাগলের লাহান ঠেকে। সে একদিকে মা আর একদিকে লতিফা, নিজেরও কী যে করন বুইঝা ওঠবার পারে না। রাগের মাথায় বউয়ের গায়ে হাত তোলে, কয় আমি বাপমরা মায়ের পোলা, মায়েরে ফালাইয়া থাকবার পারুম না। লতিফা ক্ষেইপ্যা জওয়াব দেয়, আমার বাপের ক্ষ্যাতের কামলা, ফকিন্নির পোলা। এই সংসার আমি করুম না, আমারে ছাড়ান দিয়া মা লইয়া সুখে থাহ। সব সোহাগ নিজের মায়ের লাইগা, আমি কি গাঙে ভাইসা আইছি? আমগো অহন ছেলে সন্তান হইছে, পোলার একটা ভবিষ্যত আছে, হেইডা ভাবন লাগবো। আমার পুতেরে আমি পড়ালেখা হিগাইয়া থানার দারোগা বানামু।
রইসউদ্দিনের মা এক্কেবারে চুপ মাইরা যায়। কি করা উচিত বুইঝা উঠতে পারে না। পোলারে বুঝায়, বউ পোলারে লইয়া এই সংসারই আসল। জীবনে অনেক কিছু মাইনা সংসার করন লাগে। রইসও আস্তে আস্তে জীবনের জটিলতা বুঝবার পারে। লতিফার সবকথা আস্তে আস্তে মাইন্না লয়।বড়লোক মেম্বার সাবের মাইয়্যার তেজের কাছে নিজেরে ছোড ছোড লাগে। নিজের গতরে শক্তি আছে, বউ পোলা লইয়া গেরাম ছাইড়া শহরে কাম কাইজের চিন্তা মনে মনে পাকা করে।
মায়েরে গেরামের ছাপড়া ঘরে, বাপের ভিডায় রাইখা লতিফা বানু আর পোলা লইয়া রইসউদ্দিন এইবার ঢাকা চইলা আসে। ঢাকার শহর, কত্তো কিসিমের মানুষ,কত্তো দালান, গাড়ি, লাল নীল বাত্তি। রইস একটা গাড়ির গ্যারেজে কাম শুরু করে, বউ গার্মেন্টসে। মাঝে মইদ্যে বাড়ি গিয়া মা ক্যামন আছে খবর লয়। মানি অর্ডারে হাত খরচ পাঠায়। মা কান্দে আর কান্দে, লাউ গাছে পানি ঢালে। শরীল আর চলে না, মাঝে মাঝে বুকে চিন চিন ব্যথা। পোলার লাইগা কেমন যেন পরান পোড়ে। রইস মা’র অসুখের খবর পাইয়া বাড়ি যায়। মা’রে ঢাকা আইনা চিকিতসা করাইতে চায়। রইসউদ্দিনের মা পোলার মুখের দিকে চাইয়া কয়, আমার কিছু হয় নাই। তুমি ঢাকা যাও, যাওয়ার আগে আমার কাছে বসো। আমারে আদর কইরা মাথায় হাত বুলাও, পানি খাওয়াও। আমার হাউশের নাতিডারে দেহাইলা না; আমারে কও আমার কি অপরাধ?
রইসউদ্দিন ও লতিফা বানু এতোদিনে বুইঝা লয় মায়ের সময় শেষ। লেম্বর সাব হুরমতীসহ বড় মাইয়্যার সংসারের খবর লয়। বিদেশ থেইক্যা লতিফা’র ভাই আহে, খবর পাতি লয়। রইস আর বইনের সাজানো সংসার বড়ই সুখের মনে হয়। তবুও জামাইরে বিদেশে যাইয়া চাকরির কথা পাড়ে। বিদেশ করলে অনেক টাকা অনেক সুখ বইল্যা খুশিতে খলখলাইয়া ওঠে।
এইদিকে গেরামের ছাপড়া ঘরে রইসউদ্দিনের মা দিনের পর দিন একলা খালিঘরে রোগশোকে বিছানা লয়। পাড়া প্রতিবেশীরা খবর লইয়া লেম্বর সাব’রে রইসউদ্দিনের মায়ের শেষ অবস্থা জানায়।
পেশায় চিকিৎসক কবিতা, গল্প ও অনুবাদকর্মে শৌখিন লেখক ।