| 18 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

নোনা জলের মাছ

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comবিকেলের পড়ন্ত রোদে লুকানো একটা শূন্যবোধ থাকে। ঘরের বাইরে পা রাখতেই মনে হল আমার। ভাদ্র মাসের শেষাশেষি। এখন বিকেল। এক আকাশ ভ্যাপসা গরম। এবছর বৃষ্টি হয়নি সেভাবে। হাওয়া আফিস বলছে সত্তর শতাংশই ঘাটতি। মাঠঘাট জলাশয় সব চাতকের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে। পরিযায়ী পাখির মতো মেঘেরাও হয়তো দিক পরিবর্তন করেছে। এবছর আর তারা ফিরবে বলে মনে হয় না।

আমি সেতু পেরিয়ে চলে এলাম সংগ্রামপুরের দিকটায়। বাঁহাতে কালিবাড়ি। নেমে গেলাম ডান হাতের সরু রাস্তা বরাবর। রাস্তার দুধারে গরিবগুরবো মানুষের ঘরবাড়ি। ন্যাংটা ছেলে মেয়ে। ম্যাড়মেড়ে লাল হলুদ শাড়ি পরা বউ। নদীর সমান্তরালে এই রাস্তা। সামান্য জনবসতি পেরিয়ে ইছামতী আর পথিকের হাত ধরাধরি। বাতাসে আর্দ্রতাজনিত সমস্যা, হাঁটতে অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল জায়গায় জায়গায় মেঘ তৈরির কারখানা গড়ে উঠলে ভাল হত। কিংবা অ্যামাজন থেকে যদি অনলাইন বৃষ্টি অর্ডার করা যেত। আজকাল এইসব হাবিজাবি চিন্তাভাবনাই মাথায় আসে বেশি। বউ রাকা বলে, জায়গার দোষ। এই মহকুমা শহরে সবাই জেগে খোয়াব দেখে। দেখ না রাস্তার মোড়ে মোড়ে লটারির স্টল। আমি মনে মনে হাসি। কে জানে রাকাই হয়তো ঠিক। আমি সরকারি চাকুরে। বদলির তাড়নায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়াই। এই শহরেও কর্মসূত্রেই আমার আগমন। এখানকার মানুষজন তাদের কথাবার্তা, হাঁটাচলা, ওঠা-বসার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ নেই। নেই কোনও আত্মীয়তা। বাজার দোকানে সবাই অপরিচিত। কারও সঙ্গে দৈবাৎ কথা হলেই প্রথমে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। তারপর জিগ্যেস করে, আপনি এখানকার লোক নয় না! আমিও হেসে মাথা নাড়াই। বলতে পারেন। আমার ঘর গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে। ছোট্ট একটা জনপদে। যদিও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই আজ বহু বছর। বলি বটে, তবুও ভাবি। মৌজা থেকে মৌজা, থানা থেকে থানা একটু একটু পালটে যায় মানুষের মুখের ভাষা। কথার টান। আহা! আমার জিভটাও যদি পাল্টাতো সামান্য…। ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যাই নদীর ধারের শেষ বসত বাড়িটা। এখন আমি আর ইছামতী। মাঝে একফালি জঙ্গল। কলা, ক্যাওড়া আর গোলপাতার গাছ। রাস্তাটা শেষ হয় সরু একটা নালার ধারে গিয়ে। ওপারে ইটের ভাটি। এখন বন্ধ। আশ্বিনের শেষাশেষি ধোঁয়া উড়তে শুরু করবে চিমনিতে। চলবে সেই চৈত্র মাস পর্যন্ত।

আমি গিয়ে বসি নালার ঠিক মুখটাতে। জায়গাটা শহরের মধ্যেও নয়। আবার বাইরেও নয়। অদ্ভুত রকম শান্ত। শহরের ক্লান্ত কোলাহল এসে পৌঁছয় না এখানে। এখন ভাটা। বয়স্ক নারী পুরুষের কপালের মতোই চওড়া নদীর দুই পার। পারে বাঁধা সার সার নৌকা। আকাশে পড়ন্ত রোদ। চিকচিক করছে বেলাভূমি। নদী গর্ভ থেকে পাক খেয়ে উঠে আসছে হাওয়া। অর্দ্রতাজনিত অস্বস্তি কমে আসছে আস্তে আস্তে।

আমি তাকিয়ে থাকি ইছামতীর দিকে। শান্ত নীরবে বয়ে চলা একটা নদী। ঘিঞ্জি আর জনবহুল এই শহরে একাকীত্বের খোঁজ করতে করতে হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম জায়গাটা। মাঝে মধ্যেই চলে আসি। কাউকে কিছু না জানিয়ে। চুপি চুপি। ডুব সাঁতার দিয়ে উঠি ইছামতীর এই তীরে।

জলের দিকে তাকিয়েছিলাম একমনে। হঠাৎ কে যেন পাশটিতে এসে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মিলি। আমার ছোটবেলাকার বন্ধু। পাড়ার মেয়ে। অবাক হলাম, তুই এখানে! মিলি বলল, চলে এলাম। জিগ্যেস করলাম, কেমন আছিস! বাপের বাড়ি আসিস টাসিস! মিলি উত্তর দিল, না রে আজকাল যাওয়া হয় না একদমই। বাবা রিটায়ার করল। বাড়ি করে চলে এল শান্তিনিকেতন। পুরোনো শরিকি বাড়িটা কাকারা দিয়ে দিল প্রোমোটারকে। আমি আনমনে একটা ঘাসফুল তুলে নিলাম হাতের মধ্যে। নখ দিয়ে খুঁটতে থাকলাম। বললাম, তোদের পুরোনো বাড়ির সদর দরজায় একটা ইউরোপিয়ান আর্চ ছিল। ওরকম আর্চ আমাদের ওই তল্লাটে আর একটাও দেখিনি। মিলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বাবার এক কাকা করিয়েছিল, কোন জমিদারবাড়ির অনুকরণে। পরবর্তীকালে ওটাই হয়ে উঠেছিল সিগনেচার। সবাই ওটার কারণেই চিনত। তারপর ডাক্তারবাবুদের বাড়িটার কথা ভাব। উড়োজাহাজ বাড়ি। বাড়ির ছাদে জলের ট্যাঙ্কি, মস্ত ডানাওয়ালা এরোপ্লেন। ছোটবেলায় ভাবতাম ওটার পিঠে চেপে উড়ে যাব একদিন। অথচ বাড়িটা যখন ভাঙল…।

আমি ঘাড় নাড়লাম। আমাদের আর কিছু থাকবে না রে। আজকাল ওদিকে খুব প্রোমোটারিরাজ, সিন্ডিকেটরাজ। আমার বাড়িটাও রাখতে পারলাম না। দু’কাঠা জমি। সামনে বেশ খানিকটা উঠোন। বাবা বাগান করেছিল একটা। কেয়ারি করা গোলাপের চারা। গন্ধলেবুর গাছ। জুঁই, টগর। শীতকালে জিনিয়া। আরও কত কী। শেষের দিকটায় আর মেনটেন করা সম্ভব হত না। ধুলো জমত গাছের পাতাগুলোয়। আগাছা ছড়িয়ে পড়ছিল বাড়িময়। প্রোমোটার বিশুদা বলল, ও আর রেখে কী করবি! তোর তো সারা জীবনই বাইরে বাইরে। তার চাইতে টাকা দিয়ে দিচ্ছি কোলকাতার দিকে ফ্ল্যাট দেখে নে। আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম খানিকক্ষণ। বলেছিলাম, ঠিক আছে বাবার সঙ্গে কথা বলি একবার। মিলি জিগ্যেস করল, তারপর! ঘাড় নাড়লাম আমি। যতদিন বেঁচেছিল বলা হয়নি। বিশুদাকে বলেছিলাম, কটা দিন অপেক্ষা করে যাও। বাবার তখন শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। রোজই প্রায় মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকত নিজের ঘরে। বুঝতে পারছিলাম আর বেশি দেরি নেই। বিশুদা অপেক্ষা করল! অবাক হয়ে জানতে চাইল মিলি। একটু দম নিয়ে বললাম, করল। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভাল ছিলাম। পাড়ার সকলে সমীহ করত। হয়ত সেই কারণেই।

তারপর দুজনেই চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। ভাটির টানে নদীতে ভেসে চলল প্লাস্টিক, আবর্জনা, জোয়ারের সময় ঢুকে পড়া সুন্দরী, গরান কাঠ, আরও কত কী। নীরবতা ভাঙলাম আমিই। বললাম, মানুষ আস্তে আস্তে অন্তরীক্ষে পৌঁছে যাচ্ছে। এরপর পৃথিবীতে মাটি বলে কিছু থাকবে না। মিলি বলল, এখনও সময় আছে। শান্তিনিকেতনে দেখতে পারিস। শেষ বয়সে রাকাও কথা বলার লোক পাবে একটা।

মিলির প্রস্তাবটা খারাপ নয়। ভেবে দেখা যেতে পারে। আমি কনুইয়ে ভর রেখে এলিয়ে দিয়েছিলাম শরীরটা। মাথার ওপর খোলা আকাশ। একঝাঁক টিয়াপাখি তির বেগে ছুটে গেল। অফিসের স্ট্যাম্প ক্লার্ক জয়ন্ত রায়চৌধুরি হন্তদন্ত এসে হাজির। স্যার, ঘোজাডাঙা বর্ডারে সোনার বিস্কুট সিজ হয়েছে। সাতক্ষীরে থেকে ঢুকছিল। বি এস এফ ধরেছে। জজ সাহেবের হুকুম এখুনি যেতে হবে আপনাকে। এসবের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। যেন ধ্যান ভাঙাল কেউ। প্রচন্ড বিরক্ত হলাম।

তোমাকে এ জায়গার ঠিকানা দিল কে!

জয়ন্ত বলল, কেউ নয়। আমি নিজে নিজেই সব জানতে পারি, এখানকার ভূমিপুত্র। মাটির প্রতিটা কণা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আমার চেনা। আমি গন্ধ পাই। মানুষ, রাস্তাঘাট, গাছপালা সবকিছুর গন্ধ। নদীর নোনা জলের গন্ধ।   

জয়ন্ত ছেলেটা কাজের। কিন্তু সুযোগ পেলেই অতিরিক্ত বকে। ওকে সময় মতো থামানো দরকার। বললাম, চুপ কর। আজ ছুটির দিন। সোনা, রূপো, হীরে, জহরত কোনও কিছুর জন্যই এখান থেকে নড়ব না। জয়ন্ত বলল, ভুল হচ্ছে স্যার। আপনার কোনও ছুটি নেই। জজ সাহেবের অর্ডার। আপনাকে যেতেই হবে। অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। জয়ন্ত বলল, আপনার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছি স্যার। সেই পিচ রাস্তার মোড়ে। আমার সঙ্গে আসুন। বলে পা চালাল সে। গাড়ি! তাহলে তো আর সব্বোনাশের বাকি নেই কিছু। নিরুপায় অনুসরণ করতে লাগলাম তাকে। ছেলেটা যেমন হুড়ুমদুড়ুম কথা বলে হাঁটা চলাও তেমন। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। আমি ওর সঙ্গে হেঁটে উঠতে পারছিলাম না। বললাম, জয়ন্ত একটু আস্তে চলো। বয়স বাড়ছে। আজকাল পারি না। সে খানিকটা দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, আর একটু স্যার। ওই যে উঁচু মতো জায়গা দেখছেন ওখানেই। ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে অপেক্ষা করছে।

আমি কোনও রকমে পৌঁছলাম। ওমা গাড়ি কোথায়! এ তো আস্ত একটা অটো। প্রচন্ড রেগে জিগ্যেস করলাম, অটো কি হবে! বাপের কালে দেখেছ অফিসার অটোয় করে ডিউটিতে যায়। অফিসের গাড়ি আনতে কী দোষ ছিল শুনি!

অফিসের গাড়ি আজ নেই স্যার। খোলাপোতা গেছে। সার্ভিসিং করাতে। এই ব্যাটা বোটঘাটে দাঁড়িয়েছিল। পাকড়াও করলাম, পাক্কা তিনশো টাকা।

তুমি একটি অকম্মের ঢেঁকি। আর একটু হলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল আমার। জয়ন্ত বলল, তাড়াতাড়ি উঠুন। দেরি করলে সোনার বিস্কুট আর দেখতে পাবো না। সব সীল হয়ে যাবে।

গেলে যাক। আমার কাজ সীলড বক্সের কাস্টডি নেওয়া। ভেতরে ছাইপাঁশ কী আছে না দেখলেও চলবে।মাফ করবেন স্যার। ছোট থেকে ব্রিটানিয়া বিস্কুট খেয়ে বড় হয়েছি। বাবা মাইনে পেলে মাসকাবারি মালপত্তরের সঙ্গে মুদি দোকান থেকে আনত। ওর বাইরে আজ অব্দি চোখে দেখিনি কিছু। এ সুযোগ আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসলাম। এগোতে থাকল অটো। সংগ্রামপুর থেকে ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার প্রায় সাত কিলোমিটার। আমি চুপচাপ বসে রইলাম অটোর পেটের ভেতর। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। জয়ন্ত ধারাবিবরণী দিয়েই চলল। এই হচ্ছে ঢ্যামঢেমি মোর। এরপর ইটিন্ডাঘাট, কলবাড়ি তারপরই বর্ডার। আপেল, মাছ, পেঁয়াজ সব এই রাস্তা দিয়ে পার হয়। পাথরও। বীরভূমের খাদান থেকে রাতের বেলা সার দিয়ে লরি আসে। এই ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার পেরিয়ে সোজা ঢুকে যায় বাংলাদেশ। আর একটু এগোলেই দেখবেন দুহাতে বিরাট বিরাট লরি পার্কিং জোন। দু’দেশের লরির মেলা বসেছে। ইঞ্জিনের গর্জন, খালাসিদের হাঁকডাক, দালালদের ছোটাছুটি। সব মিলিয়ে বিরাট এক ব্যস্তবাগীশ জায়গা। আমি চুপ করে বসেই ছিলাম। একতরফা বলে যাচ্ছিল ও। ইন্টারন্যাশানাল বর্ডার স্যার। মানি এক্সচেঞ্জ, কাস্টমস অফিস, বি এস এফ সব দেখতে পাবেন। তার ওপর সোনার বিস্কুট। গেলেই দেখবেন গা’টা কেমন ছমছম করছে।

ছমছম করবে কেন! আমরা কী ভূতের সিনেমা দেখতে যাচ্ছি! বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করলাম।

জয়ন্ত গায়ে মাখল না বিরক্তিটা।

কী যে বলেন, ছমছম করবে না! ভারত বাংলাদেশের সীমানা। কত ইতিহাস ভূগোল জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। সেই র‍্যাডক্লিফ লাইন। বইতে পড়েছি। তারপর স্বাধীনতা, দেশভাগ, পূর্ব পাকিস্তান, উদ্বাস্তু সমস্যা, একাত্তরের যুদ্ধ, একুশে ফেব্রুয়ারী আরও কত কী। এসব কোনও কিছুই চোখে দেখিনি। তাতে কী! বাপ ঠাকুরদার মুখে তো শুনেছি। সাতক্ষীরের মাটি, টাকীর লাঠি, ধানপীরে বাবুদের ধান আর গোবরডাঙার মান। আচ্ছা আপনিই বলুন পূর্বপুরুষদের চোখে দেখা আর নিজে চোখে দেখার মধ্যে পার্থক্য থাকে কিছু!   

কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ সোনার বিস্কুটের সমস্যা মিটিয়ে আবার ফিরে এলাম ইছামতীর তীরে। দেখলাম শেঠ আর তাতাই এসেছে। আমায় দেখেই সেই চিরপরিচিত হাসিটা হাসল ওরা। হাসিতে রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়ে পড়ল। আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়। আমি বুকে টেনে নিলাম দুজনকেই। ওরা জিগ্যেস করল, কেমন আছ! কেমন আছ প্রশ্নটা শুনলেই বুকের ভেতর গুড়গুড় করে। বললাম, ভাল নেই। নিজের ঘর বাড়ি শহর ছেড়ে এও তো এক বিদেশ বিভূঁই। যত বয়স বাড়ছে তত দেশ ঘর ভিটে মাটির অভাব অনুভব করছি। তাতাই বলল, অনেক দিন আড্ডা হয়নি। সবাই ব্যস্ত। সেদিন ফোন করে শেঠকে বললাম, চল বাবুনদার কাছ থেকে ঘুরে আসি। জায়গাটা দেখাও হবে। আড্ডাও হবে জমিয়ে। আমি বললাম, ভাল করেছিস। তা আসলিই যখন বাড়িতে গেলেই পারতিস। রাকা খুশি হত। শেঠ সিগারেট ধরাল একটা। বলল, সে হবে খন। আপাতত চলো তিন জনে ঘুরে আসি কোথাও থেকে।

কোথায় যাবি! এখানে দেখার কিছু নেই। টাকী যাওয়া যেতে পারত। তবে ওখানে এখন প্রচুর ভিড়। দোকান কাছারি, খাওয়া দাওয়া, হই চই, গানবাজনা, সিনেমার শুটিং সব মিলিয়ে মচ্ছব যাকে বলে। নদীটাই দেখা যাবে না নির্বিঘ্নে।

শেঠ বলল, ওরকম নয়। উদ্দেশ্যহীন। ঠিক যেমনটা গ্রীষ্মের বিকেলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। এ রাস্তা সে রাস্তা। এ গলি সে গলি। তাতাই বলল, সাইকেল কোথায় পাওয়া যাবে! একটা নয়, তিন তিনটে। আমি বললাম, যেতে যদি হয় তাহলে এই নদীর ধার ধরেই চল। জল ছুঁয়ে হাঁটার মধ্যে আনন্দ আছে একটা।

আমরা একজন একজন করে পেরিয়ে গেলাম নালা। এখন ইটভাটির প্রান্তে। সামনেই বিরাট ডক। লকগেট। জোয়ারের সময় নদীর জল হুড়মুড় করে ঢুকে যায় এই ডকের মধ্যে। তারপর কাদা থিতিয়ে পড়লে লকগেট তুলে বের করে দেওয়া হয় জল। ওই থিতু হওয়া নদীর পলি থেকেই ভাটার মালিক তৈরি করে ইট। সেই ইট আগুনে পুড়ে নৌকা বোঝাই হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশ দেশান্তরে। তাতাই জিগ্যেস করল তুমি এত কিছু জানলে কী করে! এখানে ইটের ব্যবসায় নাম লিখিয়েছ নাকি! আমি মৃদু হাসলাম। ইটের ব্যবসা নয় রে। এ হল ইট গাঁথার ইচ্ছে। এক জায়গায় থিতু হয়ে বসার ইচ্ছে।

আমরা এগিয়ে চললাম নদীর ধার বরাবর সমুদ্রের দিকে। শেঠ বলল, অনির্বাণদা আসলে ভাল হত। গান ধরতে পারত জমিয়ে। সেবার বড়ন্তি গিয়ে ভোররাত পর্যন্ত একাই যা গাইল। আমি বললাম, অনির্বাণ এখন দিল্লিতে। না হলে ভাটার টানে ভাটিয়ালি জমে যেত এতক্ষণে। রাজকুমারটা আসলেও মন্দ হত না। ওর ভান্ডারেও নানান সব মজার ঘটনা, মনে করালো তাতাই। রাজকুমারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই অনেক দিন। শুনেছি ইনসিওরেনসের কাজে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। আচ্ছা এদিকে কি একবারও আসে না! এসে থাকলে একবার দেখাও তো করে যেতে পারে। নিদেনপক্ষে একটা ফোন। হঠাৎ অভিমান জমে উঠল মনের মধ্যে। চুপ করে গেলাম। ইদানিং প্রায়ই এমন হয়। বাচ্চা ছেলের অভিমান। বলা নেই কওয়া নেই শরতের মেঘের মতো হাজির। আবার ভেসে চলেও যায় কিছুক্ষণের মধ্যে। আমার এখন আটচল্লিশ। কোথায় যেন পড়েছিলাম, বয়স যত বাড়ে স্মৃতিরা তত ঘিরে ধরে। একটা ভুলভুলাইয়া তৈরি করে মানুষের ভেতর। মানুষ হাতড়ে মরে, কিন্তু হাত পায় না। থাক ওসব কথা। এগিয়ে চলছিলাম আমরা। একটা ছেলে মাঝনদীতে খুটি পুঁতে দাঁড়িয়েছিল জলের ভেতর। স্রোতের বিপরীতে তার জাল। শেঠ বলল, সমুদ্র বেশি দূরে নয়। জোয়ারের জল ঢোকে তাই এখনও আছে নদীটা। না হলে এ মৃত নদী। উৎসমুখ বলে কিছু নেই। সেদিনই খবরে দেখছিলাম, পাবাখালি থেকে ফতেপুর বিস্তীর্ণ এলাকা ধানচাষ হচ্ছে নদীর বুকে। কোথাও কোথাও তো আবার ট্রাক্টরও চলছে। আমি বললাম মানুষের জীবনও তাই রে। জীবন জীবিকার টানে ছিন্ন হতে হয় উৎসমুখ থেকে। আর ছিন্ন মানেই তো মৃত। এই আমার মতো।

হঠাৎ কলকল শব্দে জল ঢুকতে লাগলো নালার ভেতর। বুঝলাম জোয়ার আসছে। পারে বাঁধা নৌকোগুলো দুলে উঠছে এক এক করে। মাঝ নদীতে জাল ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাও এবার উঠে আসবে। হাঁড়িতে তোলা বাগদার পিনগুলোকে পারে বসে ঝিনুকের খোলায় বাছবে। তারপর যাবে বাজারে বেচতে। আমি বসেই রইলাম। হাঁটুতে থুতনি রেখে। সূর্য কখন ডুবে গেছে খেয়াল নেই। অন্ধকার এসেছে। গাঢ় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে জগৎ সংসারে। আকাশে চাঁদ নেই। আজ অমাবস্যা। বহু দূরে এক আধটা আলো টিমটিম করে জ্বলছে। রাতের অতিথিরা সব বেরিয়ে পড়েছে শিকারের সন্ধানে। কেউ আকাশ পথে। কেউ বা আবার মাটিতে বুক ঘষে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় শব্দ তুলে। আমার চারপাশের মানুষজন ঘরে ফিরে গেছে যে যার। আমি একলাই নদী আকলে বসে আছি প্রেতের মতো।

জয়ন্ত রায়চৌধুরী ফিরে এল আবার। বলল, অমাবস্যার রাতে এভাবে নদীর ধারে বসে থাকতে নেই। ভাদ্র মাসের অমাবস্যা। ষাঁড়াষাঁড়ির গোণ। এই গোণে জলকরে যেতে হয়। আমি অবাক তাকালাম। জয়ন্ত বলল, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত জলকর। অমাবস্যা, পূর্ণিমায় কাতার দড়ির মতো পিন ছাড়া হয় মাছের। দোর ফেলে তোলা হয় মাছ। সে এক দেখার মত জিনিস। না দেখলে বিশ্বাস করা দায়।  

আমি উঠে দাঁড়ালাম। দুজনে হাঁটতে লাগলাম জলকরের দিকে। জয়ন্ত বলেই চলল, প্রথমে স্যার জমিটা শুকিয়ে ফেলতে হবে। তারপর পয়ান দিয়ে ঢুকিয়ে নিতে হবে গোণের জল। আমি শহুরে মানুষ। পয়ান জিনিসটা জানা ছিল না। জিগ্যেস করলাম সেটা কী! জয়ন্ত উত্তর দিল, নদীর সঙ্গে জলকরের যোগ। অমাবস্যা পূর্ণিমায় ইছামতীর জল ফেঁপে উঠলে পয়ান দিয়ে ঢুকে পড়ে জলকরের মধ্যে। প্রথমে ওই জলকে বাধা হয় জমির এক প্রান্তে। পলিথিন ফেলে ঘিরে রাখা হয় মাটি দিয়ে। রোদ্দুরের তাপে নদীর নোনা জল গরম হয়ে ওঠে। তখন ওই জলের মধ্যে ছাড়া হয় মাছের পিনগুলোকে। তারপর একটু বড় হলে সপ্তাহ দুই তিন বাদে সেগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয় পুরো জমিতে।

কথা বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেলাম জলকরের ধারে। পাকা রাস্তা ছেড়ে উঠে পড়লাম পারের ওপর। মাইলখানেক অন্তর ছোট ছোট টোঙ। জলের মাঝে মাচার ওপর খড়ের ঘর। ঘরে ঘরে হ্যারিকেনের আলো। জয়ন্ত বলল, সবগুলোতে পাহারা আছে স্যার। ওরা রাতচরা। লাঠি বল্লম পাইপগান অনেক কিছুই পাবেন। নোনা এই জলের সঙ্গে অন্ধকারের নিবিড় যোগ। যে কোন সময় অ্যাকসান হয়ে যেতে পারে। মাছ লুঠ। দু’চারটে লাশ পড়া। জলকরে এসব কোন ব্যাপার নয়। প্রতি গোণেই কোথাও না কোথাও ঘটে থাকে। শুনতে শুনতে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল আমার। জয়ন্ত আমার মধ্যে ভয়ের গন্ধ পেল। বলল, ভয় নেই স্যার। আমাদের কিছু হবে না। ছিপ নৌকা করে আমরা চলে যাব মাঝ জলে। একবার মাঝজলে পৌঁছে গেলে আর চিন্তা নেই।

জয়ন্তর কথা মতো আমরা একটা ছোট নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকা পারি দিল যেন অনন্তের উদ্দেশ্যে। চারদিকে শুধু জল আর জল। অন্ধকারে দেখা যায় না পরিষ্কার। তবে অনুভব করা যায় স্পষ্ট। নিঝুম প্রকৃতি। জলকরের মতোই শান্ত। কথা বলছিল কেবল জয়ন্ত। মাছের পিন গুনে গুনে ছাড়তে হয় স্যার। বলা হয় গুনতিতে ভুল হলে পরের গোণে আর মাছ পাওয়া যায় না।

ভাসতে ভাসতে আমরা দোরের দিকে এগোই। মাছ ধরার জন্য প্রতি গোণে পাতা হয় বাঁশের দোর। ভাঁটায় জল নেমে গেলে আহ্লাদি মাছেরা মিছিল করে ছুটে আসে এই দোরের মধ্যে। আনন্দে খলবল করে। নৃত্য গীত করে সবাই মিলে। আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে আসতেই জয়ন্ত গলার স্বর নামায়। বলে, স্যার কান পেতে শুনুন। শুনতে পাচ্ছেন কিছু! আমি কান খাড়া করি। বলি, হ্যাঁ ক্ষীণ একটা আওয়াজ। ঝনঝন করে কিছু বাজছে মনে হচ্ছে।

মাছেদের গীতিনাট্য।

আরও কিছুটা এগিয়ে আসতে স্পষ্ট হয় শব্দটা। যেন কেউ জলতরঙ্গ বাজিয়ে চলেছে একমনে। আর সেই সুর জলে জলে ছড়িয়ে পড়ছে ঘুমন্ত পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সাক্ষী থাকছে রাতের আকাশ, বহু দূরের গাছপালা আর একলা শুয়ে থাকা কালো পিচের রাস্তা। জয়ন্ত বলে, মন দিয়ে শুনুন। জীবনের স্পন্দন। আপনি আমিও ওই মাছেদের মতোই। কখনও ইছামতীর বুকে, কখনও দোরের মধ্যে। এক জল থেকে কেবল ভেসে বেড়াই আর এক জলে।  

বিষ্মিত আমি ফিরে তাকাই জয়ন্তর দিকে। ও আনন্দে দুহাত তুলে নাচতে শুরু করে হঠাৎ। বলে মাছেদের সঙ্গে যোগ দিন স্যার। গোণে গোণে ওদের উৎসব। আজ ভাদ্রমাসের অমাবস্যা। ষাঁড়াষাঁড়ির গোণ। মাছেদের মিলনমেলা।

জয়ন্তর কথায় কি ছিল জানি না। হঠাৎ আবিস্কার করি আমিও দুহাত তুলে নেচে চলেছি সেই কখন থেকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

One thought on “নোনা জলের মাছ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত