| 29 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

ধান ফুল

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comসকালের ধান জমি যেন মায়ের মত। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় সালেম। এই খেতের কাছে এলেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সতেজ সবুজএই খেত। সে বাতাস দেয়। সবুজ গন্ধ দেয়। আবার সে পেট পুরে খাবারও জোগান দেয়।  তাহলে এই ধান জমি মা নয়তো কি?সালেম মনে মনে বলে কথাটা।

যার চৌদ্দ পুরুষের আদি শিকড়টা পোঁতা আছে এই জমির অনেক গভীরে। ছেঁড়া যাবে না কোনো কালেই। আলে দাঁড়িয়ে ভাবছে ও।

সকাল হতেই সে ছুটে আসে মাঠে। খেত গুলো দেখে। জমিতে জল লাগলে অজয় নদীর ক্যানেল কেটে জল দেয়। এবার বর্ষা ভালো হলেও ধান ফলাবার সময় একেবারেই বৃষ্টি নেই। তাই ক্যানেলের জলই তাদের শেষ আশ্রয় চাষের জন্য। এবারের  চাষটা কোনো রকমে উঠে গেলেই তারা বাঁচে। বছরে একবারই এ মাঠে ফসল হয়। অন্য সময় পড়েই থাকে জমি। সারা বছর অন্য কাজ করতে হয় সালেমকে। তবে সে ভালো ভাবে সংসার চালাতে পারে না। বুকের উপর আইবুড়ো মেয়ে। তার বিয়ে দিতে পারলে সে বাঁচে। গতবার তেমন ধানের ফলন হয়নি বলে সে বিয়েতে দাঁড়াতে পারেনি। তবে এবারে খোদা মুখ পানে চেয়েছে। ঠিক সময় মতো ফসলটা উঠলেই সব বেচে কিনে আলম জানের বিয়েটা সে দিয়ে দেবে।  পাত্র ঠিক হয়ে আছে। শুধু নগদ কিছু পাওনা দিতে পারলেই সে পার পেয়ে যাবে। ছেলেটিও ভালো কাজে কমে’। তবে যা চেয়েছে তা কি এই ধান বেচে দিতে পারবে ও?

চিন্তার একটা ভাঁজ পড়ে সালেমের কপালে।  প্রতিদিন সে মাঠে আসে আর ধানগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে। হাত দিয়ে শিশির ঝরিয়ে দেয়। কত সাধের তার ধান।  তার রক্ত ঘাম মিশে আছে এই ধানে।

যেবার ভালো বর্ষা হয় না সে বার ভালো ফসলও হয় না। বছরটা কোন রকমে চলে। এই বংগো ছত্রের মানুষের বড়ই কষ্ট হয় তখন। বাইরে কোথাও তেমন কাজও  পায় না। সংসার চালাতে বড় দায় হয়ে পড়ে। সালেমক কখনো কখনো বোলপুরে গিয়ে কাজ খুঁজে। তেমন কাজ পেলে সে করে। রাত্রে বাড়ি ফিরে আসে। পেট পুরে রাতের খাবার জোটে না। ভুখ নিয়েই শুয়ে পড়ে। খোলা আকাশের চাঁদটা শুধু ড্যাব ড্যাব করে দেখে সালেমের মুখ। বংগোছত্রের মানুষের মুখ। তাদের একমাত্র সাক্ষী রাতের এই বোবা চাঁদটা। যে রাতে ঘুম আসে না সে রাতে সালেম চাঁদটাকে চেয়ে চেয়ে দেখে। এই চাঁদটা কে কোন কবি রুটি ভেবেছিল। তদের জন্য চাঁদ নয়। তাদের জন্য শুধুই খেত। যে খেত ওদের রুজি জোগায়। মুখে অন্ন তুলে দেয়। সকলের মুখে হাসি ফোটায়। সে খেত ছাড়া যে কিছুই চেনে না। খেতই ভালোবাসা। ভালোবাসার সুখ।

সকাল হয়ে এসেছিল। সালেম আলে দাঁড়িয়ে দেখছে সবুজ ধানক্ষেত। শিশিরে ভিজে গেছে তার পা। আজ কেমন এক হিমেল বাতাস বইছে। ধানগাছ ফাঁক করে দেখে গোড়ায় জল নেই। ও এগিয়ে যায় ক্যানেলর কাছে। ক্যানেল থেকে জল ছেড়ে দেয়। ওর জমিতে জল ডুকছে কুল কুল শব্দ করে। এমন সময় কাদির চাচা ওকে দেখতে পেয়ে বলে, আরে! ছালের নাকি? তুর জমিটাতে ভালো ধান হয়েছি। বেটির তাহলে এবার বিয়া দিবি তো?

দেবো -চাচা, দোয়া করো খোদার কাছে। এই ধান  যেন আমার কুল রাখে।

সরকার ধানের দাম বাড়ালি তবে না!  কাদির চাচার কথায় ওর বুকটা কেঁপে উঠে।ধানের দাম না উঠলে যে সে মারা পড়বে। ওর সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। সে আলম জানের দুহাত এক করে দিতে পারবে না। আইবুড়ো বিটি ঘরে থাকলে যে পাপ হবে। খোদার কাছে সে কি জবাব দেবে? ও ভেবে পায় না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কাদির চাচার মুখের দিকে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। কেমন একটা চিন্তা ওকে পেয়ে বসে। ক্যানেলের জল গড়িয়ে চলে। কিরে ছালেম, বাড়ি যাবি না?

সালেম কাদির চাচার কথা শুনতে পায়না। বাতাসে কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। সে যেন বাড়ি ফিরতে পারবে না। কেমন যেন সব অবশ হয়ে  আসছে। গোটা মাঠটা যেন সে ঝাপসা দেখছে। এ বছর এমন হলে সে যে সে বাঁচবে না। এমনিতেই ধার দেনা করে এবারের বর্ষার চাষটা করেছে। ধানের দাম না পেলে যে সে পথে বসবে। আলম জানের কী হবে? কেমন ভেতরে ভেতরে ঘেমে ওঠে।

আঁজলা ভরে ক্যানেলের জল চোখে মুখে দেয়। শীতল জলে সে একটা স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু চিন্তাটা মাথা থেকে গেল না। কাদের চাচা যা বললো, তাতে এ বছর ধানের দাম বাড়বে বলে মনে হয় না। বংগো ছএের মানুষ বেশির ভাগই এই ধানের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। ধানের দাম না পেলে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাবে। কত স্বপ্ন নষ্ট হবে। এদের অন্য কোন উপার্জন নেই। কৃষি কাজই একমাত্র ভরসা। বছরে একবারই ধান হয়। আর এই ধানকে কেন্দ্র করে বহু মানুষ বেঁচে। বেলা  হয়ে এসেছে। সালেম ক্যানেলের কাছে দাঁড়িয়ে জল দেখছে। তির তির করে জল বয়ে চলেছে ওর ক্ষেতের মধ্যে। এ বছর সব থেকে ভালো ফলন হয়েছে। শুধু সময় মতো মা লক্ষী ঘরে তুললেই হয়। দুচোখ ভরে সে ধান দেখছে। ধান জমি থেকে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। মনটা শীতল হয়ে যায় ওর। মাটির সোঁদা গন্ধ মিশে বাতাসে। ধানের গাছেরও একটি মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এই গন্ধ সে বহু কাল থেকে পেয়ে আসছে।  তার মনের  প্রতিটি তন্ত্রিতে মিশে আছে এ গন্ধ। জীবনের গন্ধ। ঘামের  গন্ধ। চাষি এই নিয়েই তো বেঁচে থাকে। তার লাঙল জোড়া আর আর বিস্তৃর্ণ মাঠ তার আপনজন।

চাষ দিতে দিতে একদিন পাকা চাষি হয়। ফসলের সঙ্গে মিশে থাকে তার জীবনের গান। বড় হবার ভাষা। তার বাপ দাদা এ ভাবেই চাষ করেছে জমিতে। জমি কখনো  তাদের ফিরিয়ে দেয়নি। গোলা ভর্তি’ হয়েছে সোনার ধানে। কিন্তু সেই সোনার ধান এখন যেন তার কোন মূল্য নেই। সরকারের উপর নির্ভর করছে সব। ভালো দাম পেলেই তবেই বাঁচবে তার পরিবার। সালেম আর ভাবতে পারছে না। জল দেওয়া হয়ে গেলে সে বাড়ি ফিরে আসে। মাটির দাওয়ায় বসে একটা বিড়ি ধরায়। একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়াতে কেমন আবছা দেখে তার বউয়ের মুখটা। সে যেন চিনতে পারে না তার বউকে।  সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার কাছে। না সে আর ভাবতে পারছে না।বিড়িটা এক সময় ছুঁড়ে ফেলে দিল উঠোনে। ওর এই মন মরা অবস্থা দেখে জমিলা জিজ্ঞেস করে, তুমি, অমন মন মরা কেন গো? কিছু হয়েছে বুঝি? সালেম কোনো কথার উত্তর দেয় না। তার কেমন ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। সে মাটির দাওয়ায় গা এলিয়ে দেয়। মাটির শীতল স্পর্শে সে এক সময় ঘুমিয়ে যায়।

দুই

সালেম আজ বোলপুরে গিয়েছিল। মহাজনরা এখন ধান কিনছে না।ধানের দাম নেই।   সরকার কোনো ব্যবস্থা না করলে যে তারা মারা পড়বে।

বেশ রাত করেই সালেম বাড়ি ফেরে। ওর সঙ্গে গ্রামের অনেকেই গিয়েছিল বোলপুর।মহাজনরা ওদের ফিরিয়ে দিয়েছে। অপেক্ষা করতে বলেছে। কিন্তু সালেম যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। বুকের ওপর একটা বড় পাথর যে চেপে বসে আছে। সে পাথর কিছুতেই সরাতে পারছে না সে। আলম জান কে দেখলেই তার বুকের কষ্টটা বাড়ে। মেয়েটিকে সে বিদায় করতে পারলে বাঁচে। কিন্তু তার যে কোন উপায় নেই। বড় অসহায় বোধ করে সালেম। এমনিতেই ফকরুলের বেটা ওর বাড়ির পাশে ঘোরাফেরা করে। স্বভাব চরিত্র ভাল না ছেলেটির। তার খপ্পরে পড়লে মেয়েটি নষ্ট হয়ে যাবে। সেই চিন্তায় তার আরো ঘুম আসেনা। মেয়েটিকে সে আর কত আগলে রাখবে। রাতে খেতে বসে সে খেতে পারল না। কেমন এক চিন্তা ওকে পীড়া দিচ্ছে। শুতে গিয়েও ঘুম আসছে না। বুকের কাছে একটা গরম বাতাস পাক খাচ্ছে। তার যেন    স্বস্তি নেই।

ওর বউ জিজ্ঞেস করে, কি- গো তোমার ঘুম আসছিনি? এমন করলে যে রোগে ভুগবা।

সালেম কোনো কথার উত্তর দেয় না। রাত বাড়তে থাকে। দূরের খেতে কোথায় একটা শিয়াল থেকে উঠে। ওর বুক কেঁপে যায়। হঠাৎ কারা যেন চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।সালেম কান্না শুনে ধড়পড় করে উঠে বসে বিছানায়। কালুচাচা তাহলে চলে গেল। মানুষটা সারা জীবন কষ্টই করে গেল। বেশ কিছুদিন থেকে অসুখে পড়েছিল। সামর্থ্য না থাকায় অসুখ দেখাতে পারেনি। তার গোলায় ভরতি ধান। সে ধান বিক্রি হয়নি। মানুষটির কাছে গেলেই বলত, ছালেমরে, মা লক্ষী, কখনও কখনও গলার কাঁটাও হয়রে ছালেম!

চোখ দুটো জলে ভরে যেত। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সালের দাঁড়াতে পারেনি তার সামনে। চলে এসেছে।

কালু চাচা তাহলে…!

সালেমের ইচ্ছা করছে ডুকরে কাঁদতে। কিন্তু সে পারছে না। গলার মধ্যে পাক খাচ্ছে কান্না। রাত গড়িয়ে চলে। কালু চাচার বাড়ি থেকে কান্নার সুর ভেসে আসছে। সালেম বসে থাকে অন্ধকারের দিকে চেয়ে।

তিন

বংগো ছত্রের মাঠে সকালেই বহু মানুষ জড়ো হয়েছে। খবরটা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। সালেম খবর পেতেই ছুটে আসে। সঙ্গে ওর বউ জমিলাও আসে। কাটা ধানের খেত কেমন খাঁ খাঁ করছে। হেমন্তের হিমেল বাতাস সারা মাঠে পাক খাচ্ছে। পুব আকাশে সূর্যর লালি উঁকি দিচ্ছে। সালেম ছুটে আসছে। ওকে দেখে মানুষজন সরে দাঁড়ায়। ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়ে সালেম আর ওর বউ।  মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আলম জান। ওর শরীরের বেশির ভাগটাই দেখা যাচ্ছে। রক্তের ছোপ গোটা গায়ে। ছিন্ন বস্ত্র।  আলম জান বেঁচে নেই।

সালেম গর্জে ওঠে। তারপর সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মেয়ের পাশে। ডুকরে কাঁদতে থাকে। জমিলা কাঁদতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। মানুষজন ওকে ধরে নিয়ে যায় বাড়িতে। কেউ বলতে পারে না তাকে কারা তুলে এনেছিল।

সালেম কাঁদতে কাঁদতে বেটি, তুর বিহা দেব।ধান বেচব। তুই যে আমার সব-রে…! সালেম চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। যে আলম জান কে সে বড় আদরে মানুষ করেছে। ফুলের মত মেয়েটি ঝরে গেল এই মাটির বুকে।

রাশি রাশি আগড়া ধান যেন তার স্বপ্নকে মুছে মুছে দিয়ে গেল।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত