Categories
রাজলক্ষ্মী দেবীর কবিতাগুচ্ছ
আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
রাজলক্ষ্মী দেবী – ২৩ মে,১৯২৭ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলায়। তিনি ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে দর্শন-এ সাম্নানিক স্নাতক হন। এর পর দর্শনশাস্ত্রেই প্রাইভেটে এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ভারতের পুণে শহরে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “হেমন্তের দিন” (১৯৫৭), “ভাব ভাব কদমের ফুল” (১৯৬৭), “এই আলোকে এই আঁধারে” (১৯৭০) প্রভৃতি।
ইজিচেয়ার
দেখেছিলাম তােমার বারান্দায় বিছানাে আছে ইজিচেয়ার।
তােমার বারান্দায় একশাে পাওয়ার আলাে, –
বাইরের রাস্তায় অন্ধকার ।।
হেঁটেছিলাম অন্ধকারের রাস্তা দিয়ে, ইচ্ছাকে শাসন করে ।
তােমার বারান্দায় বুজ ইজিচেয়ার। উজ্জল আলাে।
আর, শাদা একটা ঢাকনা ছিলাে ইজিচেয়ারের মাথায়।
সেইদিন থেকে আমার আর কোন বাসা নেই ।
আমি হয়ে গেছি এক জাহাজ, যার নেই কোন বন্দর।
আমি ঝড়ের সমুদ্রে বাক খেয়ে বেড়াই সেই দিন থেকেই।
শাদা-ঢাকনা-দেওয়া ইজিচেয়ারটা দেখার পর –
তােমার উজ্জ্বল আলাে-জ্বালানাে বারান্দা দেখার পর –
তােমার বাসা ছাড়া কোথাও আমার বাসা নেই।
আমার আর আশা নেই ॥
ভালোবাসা এক নির্জনতা
ভালোবাসা এক নির্জনতা,- তা বুঝি জানো না!
বিস্তীর্ণ আকাশে শুধু একটি তারা-র প্রস্তাবনা।
এ রজ্জু টানানো আছে একপার থেকে অন্যপারে,
অপ্রেম আঁধার হতে প্রেমের গরিষ্ঠ অন্ধকারে।
অট্টালিকা যদি দুর্বিষহ, তবে অরণ্যে দুর্যোগ।
সপ্তকাণ্ড বিচ্ছেদের শেষে চিরবিরহের শ্লোক।
অস্তিত্বের এলাকাটি বিভোর, ঘুমন্ত পড়ে থাক্,
ভালোবাসা নিদ্রাহীন চৌকিদার দিয়ে যাবে হাঁক।
বঁধুয়ার আঙিনায় পাখা ঝাড়ে ঝড়ে-ভেজা কাক,
সে-ই লাক্ষণিক ভালোবাসা। তবে এ-ই শেষ কথা,
ভালোবাসা এক মানবতা মাত্র – এক দরিদ্রতা।
একাকিত্ব থেকে অন্য একাকিত্বে উত্তরণ প্রথা।
এই কৃষ্ণচূড়া এবং পলাশ
এই পলাশ কবে হৃদয়কে সেধেছিল সুরা,
মনে নেই। মন্ত্র দিলো বৈরাগিণী এই কৃষ্ণচূড়া,
বসন্তে সন্ন্যাসী হবে যৌবনের প্রগলভ মাতাল,
কাষায়ে, গৈরিক বুঝি ছেয়ে দেবে পলাশের ডাল,
সংকল্প জ্বলবে শুধু অতন্দ্র আগুন প্রতীক্ষায়,
পলাশ অসহ্য রং সামলাবে সানন্দ দীক্ষায়।
এবং পলাশ কবে হৃদয়কে করে কৌতূহলী,
বলেছিলো, – চলো খেলি মুঠো মুঠো কৌতুকের হোলি,
মনে পড়ে। কৃষ্ণচূড়া একান্তে শিখছে অনুরাগ,
হোলি ভাঙবে না আর, – আকাশ রাঙবে না ব্যর্থ ফাগ।
পলাশ আবীর আনে – সিঁদূরে সেজেছে কৃষ্ণচূড়া।
বসন্ত চিন্তিত : নেবে একতারা,- না কি তানপূরা ?
যদি স্পর্শ করি
যদি স্পর্শ করি,- তবে সহস্র বর্ষের ব্যবধান, –
অগ্নিবলয়ের মতো,-একে একে পার হবো আগে।
যেন স্পর্শে হৃদয়ের মূল ধ্রুবপদখানি থাকে,
– বিশ্বাস করি না আমি বিবিধ ঝংকার, ঐকতান।
ঋজুচোখে দেখতে যদি পাই হৃদয়ের মেরুদেশ,
অকম্পিত পদে হাঁটি হৃদয়ের বিষুবরেখায়,
যদি না লুণ্ঠিত হই শত বত্সরের পরিখায়,
– যদি ছেড়ে দিতে পারি বিবিধ ভণিতা, ছদ্মবেশ।
ততোদিন মুক্ত তুমি, ততোদিন ফেরো ইচ্ছাসুখে,
ততোদিন প্রৌঢ়া হও বাসনার রসদ কুড়িয়ে।
স্পর্শগুলি আস্বাদন করতে হয় সস্নেহে জুড়িয়ে,
এমন উত্তাপ আছে প্রত্যেক রোমকূপের মুখে।
যদি স্পর্শ করি, তবে সহস্র বর্ষের যোগফল
শূন্য হবে । পার হবো স্বর্গ-নরকের মধ্যপথ।
সূর্য-চন্দ্রে ব্যবধান, সে তো শুধু অংগুলিবিঘত।
যদি স্পর্শ সত্য হয়,- সোনা হবে লোহার শিকল।
ভালোবাসা বিদেশী বাউল
যতক্ষণ দু’গোলাপ থাকে,
ততক্ষণ ভালোবাসা তোমার দুয়ারে
শানাই বাজাবে।
কিন্তু যেই ঝরে যাবে ফুল,
চলে যাবে ভালোবাসা বিদেশী বাউল।
“দাঁড়া ভালোবাসা। থেমে থাক্ ভালোবাসা।
ঘর বেঁধে দেব তোকে, দেব দু’ বেলায় ভাত।”
যদি থেমে থাকে, তবে যাবে তার জাত।
তবে সে পাঙক্তেয় হবে সারিভোজনের দলে,
দেখা যাবে তার গলায় চেনা পৈতা ঝোলে।
যতক্ষণ আকাশে সুরভি থাকে,
ততক্ষণ ভালোবাসা স্বলক্ষণ, শুদ্ধ সুরে
শানাই বাজাবে।
তারপরে কেন বাঁধা যাবে ?
ঝরে গেলে বকুল পারুল,
চলে যাবে ভালোবাসা বিদেশী বাউল।।
স্বপ্নজাল
অনেকবার এরূপভাবে আমি
সবুজ বনে পাখীর পাখা দেখে,
স্বপ্ন, না কি সত্য, তার ফেরে, –
গোঁসাই, – ভারি ভেজালে পড়েছিলাম।
দেড়-আঙুলে কাঠুরেটির হাতে
রক্তপূত বিজলী-হেন কুঠার।
হাতেম তাই, সিন্ধবাদ দেখে
মুকুরে মুখ। গাওনা জমে ভূতের।
ছায়াচ্ছন্ন স্বপ্ন-অন্ধকারে
খচাং চিমটি লাগাই হাতে পায়ে।
বেঁচে আছি, না ম’রে আছি, তা জানার
সেটাই নাকি অকৃত্রিম উপায়।
কিন্তু আমি স্বপ্ন ভেঙে জাগি
অন্যতর স্বপ্নেরই শয্যায় ;
ছাড়াই স্বপ্ন খোসার পর খোসা,
পৌঁছুই না বাস্তব মজ্জায়।
স্বপ্ন আছে স্বপ্নেরই কৌটায়,
স্বপ্ন-প্রর্দা ঢাকছে স্বপ্ন-পট।
রজনীদিন এমনিভাবে যাবে
জানলে – আমি করব না ছট্ ফট্ ।।
দ্রব্যগুণী
দ্রব্যগুণী, অস্তিত্বের শুকনো ঘাস দু-হাতে চাপড়িয়ে
যে সুগন্ধ ব্যপ্ত করলে, আত্মাকে করলে অভিভূত,
তার জন্য কী কী দ্রব্য লাগে — বলো, কোন্ মাপ দিয়ে
একত্রিত করলে, এই দিব্যগন্ধ! সে কোন বিদ্যুৎ
তোমার মন্ত্রের ডাকে সৃষ্টি করে — আহা, দ্রব্যগুণী,
তাকে কেন চিরস্থায়ী করবে না? কেমন অন্যায়,—
তোমার সুগন্ধ যদি উবে যায়। মানবাত্মা, শুনি
মারমুখো প্রকৃতির মাঝখানে প্রধান সহায়।
দ্রব্যগুণী, গুপ্ত ইচ্ছা শোনো। যদি হেন দ্রব্য লাগে :
গ্রহনক্ষত্রের ধুলো, চন্দ্রের শিকড় — অনায়াসে
এনে দেব। চিরস্থায়ী দিব্যগন্ধ তবু যদি জাগে
বিশিষ্ট মাপের গুণে প্রাকৃতিক এ সমস্ত ঘাসে।
সন্তানেরা
সন্তানেরা শাল-সেগুনের চারা, এখনো বাড়ে নি।
এখনো রোদ্দুরে ক্লিষ্ট, বৃষ্টিতে নড়বড়ে হয়ে, মুখে
চেয়ে থাকে। পোকা-কাটা উচ্ছন্নের সূচিকা অসুখে
করুণ অপেক্ষা রাখে। শাকাহারী শৃংগীদের শ্রেণী
দূরে রেখে বলয়িত দিগন্তে বেঁধেছি তাই বেড়া
শাল-সেগুনের চারা বাঁচাতে। সূর্যের আলো গায়ে,
পায়ে পলিমাটি, আর আশ্চর্যের বাতাস লাগায়ে
দিনে দিনে বাড়ে, যেন গোকুলে রাখাল-বালকেরা।
পরিকল্পনা-রা জানে শতাব্দীর অত্যল্প মেয়াদ।
শাল-সেগুনের চারা হয়তে বয়স্ক হবে কাল।
এবং আজকে যারা বর্ষায় গুনছে পরমাদ,
ঝড়ের সমুদ্রে তারা হেলায় উড়িয়ে দেবে পাল।
সাধের পালঙ্ক হবে, পালিকী হবে, কড়ি-বর্গা-ছাদ।
প্রাণের সবুজ রং আহ্লাদে, আশ্বাসে হবে লাল।
কাঁকুলিয়া রোডের বেহালাদারকে
ও বেহালাদার, তুমি এ-সব কঠিন তান
ছড়ে-ছড়ে টেনো না এখনই।
হিমাদ্রি-পর্বত যার ত্রিকোণ গাঁথুনি,— সেই নিরাকৃতি ধ্বনি
ব্যক্ত করবে আজই ? কিছু ঊহ্য রাখো,—
কিছু রাখো অসম্পূর্ণ, দূর।
ও বেহালাদার,— হালকা জীবনের উত্সবেই
ঢালবে তুমি এই সব সুর!
ও বেহালাদার, আমি দেখেছি সমস্ত গেলে
ঘাসের সবুজ রং থাকে,—
শ্লেট-মোলায়েম হাওয়া, ছপছপে অন্ধকার
ছোঁয় এসে নিভৃত আত্মাকে।
মীনাক্ষী-মন্দির যার চৌকোণ গাঁথুনি,—
সেই নিরাকৃতি ধ্বনি
চিরকাল থাকে। তুমি ছড়ে-ছড়ে সব তান
টেনো না এখনই।
ও বেহালাদার, আছে মৃত্যু আছে, দুঃখ আছে আছে অন্ধকার।
কার হাত ধরে আমি সমস্ত বাধা এড়িয়ে
সে-প্রশস্ত তীর্থ হবো পার?
কার হাত ধরে আমি সহস্রেক সিঁড়ি ভেঙে
সহসা দেখবো সূর্যপীঠ
ঝিলিঝিলি মিনারের জানালায় ?—
ঊহ্য রাখো, তুলে রাখো তোমার সংগীত।
তাদের বাজাতে দাও,— তিনটে শব্দের মিলে
তারাফুল ঝরায় না যারা.—
শব্দের পায়ের নিচে কান পেতে
কোনোদিন শোনেনি নিঃস্তব্ধতার ধারা।
কৃত্রিম ফুলঝুরি দিয়ে তাদের সাজাতে দাও
জীবনের অলীক রাত্রিকে।
ও বেহালাদার,— তুমি ছড়ো টান দিয়ো,
যদি ফুল দেবে মৃত্যুর যাত্রীকে।
এখনকার কবিতা
[১৯৬৩ সালে প্রকাশিত, কবি বিষ্ণু দে সম্পাদিত “এ কালের কবিতা” কাব্যসংকলনের কবিতা।]
. এক
হাসির ভিখারী আমি—নুয়ে-পড়া, ক্লান্ত মন নিয়ে
তাই ছুটে-ছুটে আসি। কত কথা বলি যে বানিয়ে,
—কোমল আঙুলে ছুঁই—কালো চুলে দুই ঠোঁট গুঁজে
মৃত্যুকে দুহাতে যুঝি। স্নান করি চুমোর সবুজে।
তোমার হাসিতে বাঁচি।
. কতো যে বেদনা, আত্মা জানে—
নাই-বা জানলে তুমি। কান্নার চেয়ো না কোনো মানে
উজ্জ্বল রৌদ্রের মতো হাসি চাই। তাই নিয়ে আসা
সাত সমুদ্রের প্রীতি—ঘুম-ভাঙা স্পর্শের কুয়াশা।
. দুই
ভালোবাসি ?—হয়তো বা তোমাকেই আমি ভালোবাসি
তা নইলে এ-কুটিরে, এ-উনুনে আমার কি কাজ ?
সন্দেহ করো না তুমি,—এ হৃদয় হবে না সন্ন্যাসী।
—কাল সে বানাবে বসে, ভেঙে যা ছড়িয়ে দিলো আজ।
এ সমুদ্রে ঢেউ নেই। জানালায় টুকরো আকাশ
কতোটুকু! তবু মন এখানেও বাঁচে—কথা বলে।
সামান্যের ধূপে জ্বলে অসামান্য পাওয়ার সুবাস
নিঃশব্দ আমার ঘরে। দোলনায় ছোট শিশু দোলে।
. তিন
এই তো বসন্ত, প্রিয়তম। সারা বছরের দেনা
একটি ফুলের অর্ঘ্যে শুধবে সে—কিছু শুধাবে না।
পিছনে চেয়ো না ফিরে। সেখানে মেঘলা দিনে, রোদে,
পূর্ণিমায়, অন্ধকারে—কী দেখাবে ? জীবনের হ্রদে
কতো জল কি চঞ্চল! অঞ্জলিতে যা ওঠাবে, তার
রূপ নেই, মান নেই। মানে আছে এই মোহনার!
এ মিলন—এ সংগম—এতে আছে সমুদ্রের স্বাদ।
পিছনের কথা তুলে আজকে কি করবে বিবাদ ?
. চার
যে-রাত্রিতে তুমি নেই। আর সব আছে।
আছে বই নির্জন ঘন্টার সঙ্গী। জানালার ঘষা কাঁচে
আলোর নিস্তাপ হাসি। ড্রেসিং টেবিলে আয়নায়
যতবার দেখি—ক্লান্ত চোখে মেয়েটি তাকায়।
সেলায় মূর্ছিত সূচী। খোকাখুকু ঘুমের অতলে।
সব আছে। তুবু যেন কিছু নেই। ছেয়ে সারা মন
একটি উত্কণ্ঠা শুধু—ঘণ্টি বেজে উঠবে কখন ?
ঘুম পাড়ানি
[১৯৮৮ সালে প্রকাশিত, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কবি এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত “পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা” কাব্য সংকলনের কবিতা।]
রাত ঝুম্ ঝুম্, স্তব্ধ নিঝুম্, হাওয়ায় ফাঁদ
জানালার পাশে মিটিমিটি হাসে হলদে চাঁদ।
ঘুমোও খুকুন, য়্যাত্তটুকুন গল্প বাকি?
তারাগুলো সব নিথর, নীরব দেখছ তা কি?
আইভিলতায় রাত ঘুম যায়, ঘুমোয় লতা,
ঘুমে অচেতন সবাই, এখন কিসের কথা?
চাঁদ ডুবে যায়, আঁধার ঘনায়, ঝিমোয় হাওয়া
খুকুন ঘুমোয়, লক্ষ চুমোয় অধর-ছাওয়া।
জানালার পাশে তারাগুলি হাসে চিকচিকিয়ে
রাতের আকাশ বার বার ওঠে ঝিকমিকিয়ে।
জুজুবুড়ী যতো আজকের মতো পালাও তবে,
রাক্ষস, ডান, দাও পিঠটান এবার সবে।
খুকুর শিয়রে থাক যত পরী হালকা পাখা,
মিষ্টি যাদের পরশ, চাঁদের জ্যোছনা-মাখা।
সারারাত তারা সজাগ পাহারা রাখবে ওকে
স্বপনের ডালি দেবে ভরে খালি ঘুমেল চোখে।