| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ কথা রাখেননি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কথা ছিল হুয়ান রামোন হিমেনেছ এবং তার বিদুষী স্ত্রী সেনোবিয়া কামপ্রুবির আমন্ত্রণে স্পেনে যাবেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে। ইংরেজিভাষী দেশ ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কথা বাদ দিলে স্পেনই সেই দেশ যেখানে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রথম কৌতূহল ও আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। সেই ১৯১২ সালেই, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই, স্পেনের গালিসিয়া অঞ্চলের প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক বিসেন্তে রিস্কো ম্যাকমিলান থেকে ১৯১২ সালে প্রকাশিত Evelyn Underhill -এর লেখা Mystic way বইটির উল্লেখ করেছিলেন যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং তার লেখার কথা আলোচিত হয়েছিল। এরপর ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবার পরপরই আতেনেও দে মাদ্রিদ (Ateneo de madrid) নামক এক ইনস্টিটিউট-এ তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। এতটাই রবীন্দ্র-মগ্ন ছিলেন তিনি যে তাঁকে সেখানকার লোকজনরা ‘স্পেনিশ টেগোর’ বলে অভিহিত করতেন। যদিও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, এমন কি রবীন্দ্র-নিন্দুকে পরিণত হয়েছিলেন শেষ দিকে। ১৯১৩ সালেই ইংরেজিভাষী দেশে রবীন্দ্রনাথের Gitanjali কাব্যগ্রন্থের প্রতি আগ্রহের কথা নিয়ে স্পেনের আরেক লেখক পেরেস দে আইয়ালা La Tribuna পত্রিকায় লিখলেন। তিনিও এক সময় রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। স্পেনের আরেক সম্মানিত লেখক রামিরো দে মেয়াৎসু রবীন্দ্রনাথের লেখা স্প্যানিশ ভাষায় ১৯১৫ সালে অনুবাদের আগেই, Sadhana গ্রন্থটির সমালোচনা করে লিখলেন ‘নুয়েবো মুন্দো’( Nuevo Mundo) নামক এক পত্রিকায় ১৯১৪ সালের ৫ই মার্চে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে প্রায় সূচনা থেকেই রবীন্দ্র-প্রীতি ও রবীন্দ্র-নিন্দার দুটি ধারার উৎসার ঘটেছিল। রবীন্দ্র-প্রীতির প্রধান স্তম্ভ অবশ্যই সেনোবিয়া কাম্প্রুবি এবং হিমেনেছ; এই দলে পরবর্তীতে এসে যুক্ত হয়েছেন গ্রেগ্রোরিও মারানঞন ও ওর্তেগা ই গাসেৎ-এর মত দার্শনিকরা। অন্যদিকে, নিন্দুকদের দলে ছিলেন ঔপন্যাসিক এমিলিও পার্দো বাজান এবং ইউহেনিও দোরস্। যে-হিমেনেছ রবীন্দ্রনাথের বিপুল রচনা রাশি অনুবাদ করলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কখনো কোনো প্রবন্ধ লেখেননি, তিনি এসব নিন্দায় বিরক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে–তার মূল প্রবণতার বাইরে গিয়েই–গদ্যে এক জবাবে বলেছিলেন: “আমরা বিশ্বাস করি প্রাচ্যীয় গুণাগুণসহই রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিদের একজন। স্পেনে কিছু অজ্ঞ যে প্রচারণা ছড়িয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই (কেবল) রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেই পরিচালিত নয়। যাইহোক, আমাদের পাশে আছে সব জায়গার নান্দনিক আভিজাত্য, যেমন ইয়েটস, জিদ (The kindred voice: Reflections on Tagore in Spain and Latin America, ED: Shyama Prasad Ganguly, JNU, New Delhi, December 2011, P 58-59)”। তবে এটা ঠিক যে প্রবল নিন্দুকদের মধ্যে লেখক হিসেবে এমিলিও পার্দো বাজানই ছিলেন নজরে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব; যেহেতু কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অবহেলা করার মতো ছিল না। কিন্তু হিমেনেছ-দম্পতি এসব নিন্দাকে উপেক্ষা করেছিলেন সারা জীবন।
রবীন্দ্র-রচনার প্রথম অনুবাদ তারা শুরু করেছিলেন ১৯১৫ সালে এবং ১৯৫৮ সালে হিমেনেছের মৃত্যুর পর তাদের অন্তত আরও চারটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে হিমেনেছের সমগ্র রচনার এক তৃতীয়াংশই ছিল রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদ।
আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কী প্রবল অনুরাগ আর নিষ্ঠা দিয়ে লেখক-জীবনের প্রায় সমগ্র কালপরিধি জুড়ে রবীন্দ্রনাথকে তারা আগলে রেখেছিলেন পুনঃসৃজনের উষ্ণ পরিমন্ডলে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে কি এই স্পেনিশ উষ্ণতা অনুভব করেছিলেন?
আজ অবদি যত তথ্য পাওয়া যায় তাতে করে নেতিবাচক ধারণারই সমর্থন মেলে। যদিও আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের সাথে হিমেনেছ-দম্পতির চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছিল, ১৯১৮ সালের ১৩ আগস্ট থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাদের কয়েকটি চিঠির জবাবও দিয়েছিলেন। তবে আমি নিশ্চিত যে স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের সাফল্য ও পরবর্তী অভিঘাত সম্পর্কে খুব পরিস্কার কোনো ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা সেনোবিয়ার দীর্ঘ প্রথম চিঠির জবাব তিনি দিয়েছিলেন খুবই সংক্ষিপ্তভাবে। সেনোবিয়া তার চিঠিতে এক জায়গায় বলেছিলেন:
“ভারতবর্ষ ও আন্দালুসিয়ার অনুভূতি ও অবস্থার মধ্যে এমনই বিরাট মিল যে আন্দালুসিয়ার সবাই মনে করে আপনি যেন তাদের ঘরের কথা বলছেন।” (শাশ্বত মৌচাক, শিশির কুমার দাশ ও শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, প্যাপিরাস, ১৩৯৪ শ্রাবণ এক, পৃ ৫৭)
ঠিক এই কথার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন:
“I believe there is something in the atmosphere and in the physical aspects of your motherland somewhat similar to those in ours which bring my lyrics close to your hearts. And this inspires in me a strong desire to visit your country if I am ever able to come to Europe when the war is over.” (শাশ্বত মৌচাক, শিশির কুমার দাশ ও শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, প্যাপিরাস, ১৩৯৪ শ্রাবণ এক, পৃ ৫৯)

এই উত্তর থেকেই আমরা বুঝতে পারছি রবীন্দ্রনাথ নিজেই অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই স্পেন সফরের কথা ভেবেছিলেন।
RabindranathTagore_Letters
পরে আরও চিঠি চালাচালির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের স্পেন সফর নির্ধারিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ২৮ এপ্রিলে। স্পেনের মাদ্রিদে এসে পৌঁছুবেন তিনি প্যারিস থেকে। কিন্তু ২৩ এপ্রিল হঠাৎ টেলিগ্রাম করে জানালেন, Forced to Postpone my visit to Spain (শাশ্বত মৌচাক, শিশির কুমার দাশ ও শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, প্যাপিরাস, ১৩৯৪ শ্রাবণ এক, পৃ: ৭০)। সন্দেহ নেই যে এই দুঃসংবাদ কেবল হিমেনেছ-দম্পতিকেই নয়, স্পেনে রবীন্দ্র-প্রেমিক পাঠক-লেখক-বুদ্ধিজীবীসহ সবাইকেই হতবাক করে দিয়েছিল। এমন নিশ্চিত পরিকল্পনা কেন রবীন্দ্রনাথ বাতিল করেছিলেন তার সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। তবে রবীন্দ্র-গবেষক অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় অনুমান করছেন, এর পেছনে তৎকালীন রবীন্দ্র-অনুরাগী ইংরেজ বন্ধু ও সহযোগিদের পরোক্ষ ভূমিকা থাকতে পারে। তবে ভূমিকা যারই থাক না কেন দায় যে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথেরই তা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।

কটা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অবহেলা এবং অজ্ঞতাও আমাদেরকে পীড়া না দিয়ে যায় না, আর সেটা হলো ইংরেজ জাতির বিভিন্ন ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার সমালোচনা তিনি করলেও, তিনি মূখ্যত ইংরেজী ভাষা ও জ্ঞানবলয়ের অন্তর্ভুক্তই ছিলেন। এই বলয় থেকে তিনি যে অন্য জাতি গোষ্ঠীর জ্ঞানের জগতে উঁকি দেননি, তা নয়। কিন্তু তা লক্ষনীয় রকমের গৌণ। আর আমাদের কাছে যেটা আরও বেশি আশ্চর্যের তা হলো এই যে স্প্যানিশ ভাষায়–স্পেন এবং লাতিন আমেরিকা, দুই জায়গাতেই– তিনি এতটা সফল, বহুল এবং দীর্ঘতর সময়ব্যাপী অনূদিত ও চর্চিত হয়েছেন, সেই ভাষা ও তার জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে ছিলেন আশ্চর্য্য রকমে উদাসীন। এমন কি ১৯২৪ সালে আর্হেন্তিনা ভ্রমণ করলেও, তিনি জানতেন যে স্প্যানিশ ভাষায় এতদিনে তিনি অনুবাদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পরিচিত, কিন্তু স্প্যানিশ ভাষার এক সের্বান্তেস ছাড়া, আর কারোর প্রতিই তিনি কোনো আগ্রহ দেখান নি। আর সের্বান্তেসের উল্লেখও ছিল নিতান্ত গৌণভাবেই। স্প্যানিশ ভাষা সংস্কৃতির প্রতি তার এই অবহেলার সঙ্গে স্পেন সফরের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সম্পর্ক কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু তারপরেওতো রবীন্দ্রনাথ আরও দুই দশক বেঁচে ছিলেন, বেঁচে ছিলেন হিমেনেছ-দম্পতিও, কিন্তু স্পেন ভ্রমনের কথা তিনি আর একবারও ভাবেননি। এবং লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই যে ঐ ২১ সালে সফর বাতিলের পর থেকে হিমেনেছ-দম্পতির সঙ্গে আর কোনো চিঠি চালাচালির পরম্পরাও রক্ষিত হয়নি। উভয়দিক থেকে কারোরই আর কোনো চিঠির অস্তিত্ব নেই। হিমেনেছ-দম্পতির পক্ষ থেকে যদি নিরবতা থেকে থাকে তাহলে সেটা তো যৌক্তিক কারণেই আমরা অনুমান করতে পারি যে প্রচন্ড আশাহত হওয়ার পর চিঠি লিখবার মতো মানসিক আনুকূল্য থাকবার কথা নয়। এদিকে রবীন্দ্রনাথের দিক থেকেও কোনো চিঠি নেই। এই পারস্পরিক নিরবতা দেখে মনে হয় যেন ব্যাপারটা ওখানেই চুকেবুকে গেছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ ভালো করেই জানতেন স্পেনে তাকে পাওয়ার আকুলতার কথা। আমাদেরকে যেটা আরও বিস্মিত করে, তাহলো ১৯২৫ সালে আর্হেন্তিনা থেকে ফেরার পথে বার্সেলোনা (সেনোবিয়ার জন্মস্থান) বন্দরে ১০/১২ ঘণ্টার জন্য নেমেও ছিলেন তিনি, অথচ হিমেনেছ-দম্পতিকে তা আগাম জানাবার কোনো প্রয়োজনও বোধ করলেন না। সেখানকার সংবাদ মাধ্যমও জানার সুযোগ পায়নি রবীন্দ্রনাথের এই সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত