| 20 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

শরণ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comঠান্ডার প্রকোপে হাত পা শীতল হয়ে আসছে। শীত জাঁকিয়ে বসায় উপত্যকা জনশূন্য।জনশূন্য পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা ভয় গ্রাস করতে থাকে সুনাথকে। ভয় তার পদগতি দ্রুত করে।এদিকে দিনের আলো শেষ হয়ে আসছে। দিনের আলো পুরোপুরি শেষ হয়ে আসার আগে কোথাও একটা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছুতে হবে তাকে। এপথ তার অজানা। তবে এই পথ অতিক্রম করে আসা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মুখে শুনেছেন এই পথের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।তবে এই পথে বেশ কদিন কাটিয়ে ফেললেও তাকে সেরকম কোন খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। সমভূমি ছেড়ে যত উঁচুতে উঠেছেন প্রকৃতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, সেইসঙ্গে বেড়েছে তার সৌন্দর্য সুধা। অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সুনাথ ভেবেছেন তবে কি প্রত্যেক ভয়ঙ্করতার মধ্যেই এক অদ্ভুত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে? গতকাল রাত্রি অবসানের জন্য একদল বণিককে পেয়েছিলেন সুনাথ।আজ এখনো পর্যন্ত সে রকম কাউকে নজর পড়েনি। তবে আশা কেউ না কেউ জুটে যাবে। তবে বণিকদল জুটে যাবার  সম্ভাবনা বেশি। কারণ এই পথ মূলত বাণিজ্য পথ।স্বর্ণ, পশম, কাঁচের পরিবর্তে চীন থেকে ভারতবর্ষে রেশম আমদানি হয় এইপথে। চীনা রেশমের চাহিদা রয়েছে ধনী পরিবার গুলিতে। শুধু রেশম নয় এই পথ দিয়েই যুগ যুগ ধরে আদান-প্রদান ঘটেছে ধর্ম, জ্ঞান, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির। বাহিত হয়েছে মারণ রোগও। পথে বিপদ আছে জেনেও প্রত্যহ শত সহস্র জনকে জীবন ও জীবিকার স্বার্থে বেরিয়ে পরতে হয় পথে।

তবে সুনাথের এই পথে আসার পিছনে কোন ব্যক্তি স্বার্থ নেই। স্বার্থ আছে তাঁর ধর্ম রক্ষার।রাজনৈতিক পরিবর্তন তাঁর বৌদ্ধ ধর্মকে অস্তিত্বের সংকটের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।শত শত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মঠ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন তিব্বতের পথে। একদিন এই পথেই বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছেছিল তিব্বতে।আজ সংকটের এই চরম মুহূর্তে তিব্বতকেই আশ্রয় করতে চান বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। সবই ঠিকঠাক চলছিল। সাঁচির বৌদ্ধ মঠে কোন অশান্তি ছিলনা। বুদ্ধকে স্মরণ করে দিন অতিবাহিত করতেন নির্বিবাদী বৌদ্ধ শ্রমনেরা।

বিপত্তি ঘটে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর।মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের সেনাপতি পুষ্যমিত্র।তাঁর কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট ছিলেন সম্রাট।পুষ্যমিত্র ছিলেন উচ্চাকাঙ্খি পুরুষ। এই উচ্চাকাঙ্খা পছন্দ করতেন না বৃহদ্রথ।সেনাপতি থেকে সম্রাট হবার স্বপ্ন ছিল দু’চোখে। তখন ঘুণ ধরেছে মৌর্য সাম্রাজ্যের ভেতরে। সেনাপতি হিসাবে সেনাবাহিনীকে কব্জায় আনতে অসুবিধা হয় নি তাঁর। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন পুষ্যমিত্র।তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে সবে সকালের কুঁচকওয়াজ শুরু হয়েছে। সম্রাট টের পেয়েছিলেন পুষ্যমিত্রর অভিসন্ধি। এই অভিসন্ধি ভেঙ্গে দেবার জন্য বৃহদ্রথ নিজে উপস্থিত ছিলেন কুঁচকওয়াজএ। কুঁচকওয়াজ এ নকল যুদ্ধে লিপ্ত সম্রাট আর সেনাপতি কখন যে আসল যুদ্ধে মেতে উঠেছিলেন টের পায় নি কেউ। যখন টের পেল তখন দেরী হয়ে গেছে অনেক। সম্রাট তরবারি বিদ্ধ হয়েছেন পুষ্যমিত্রর হাতে।খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সকলে। সিংহাসনে বসে পুষ্যমিত্র ঘোষণা করেন, ‘আতঙ্কিত হবেন না। একটা মরচে পড়া সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ।সম্রাট সবল হলে প্রজারা সুখী হয়। আমি আপনাদের সুখী করবো। ‘সুখী হয়েছিল যারা সম্রাট পুষ্যমিত্রকে তোষণ করতে পেরেছিল।বাকিদের রেয়াত করেন নি সম্রাট। সবার প্রথমে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন বির্ধমী বৌদ্ধদের প্রতি।তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা ছিল ‘প্রজারা হবে রাজ ধর্মের অনুসারী। যারা রাজআনুগত্য দেখাবে না। তারা বির্ধমী।বির্ধমীদের স্থান হবে না এই সাম্রাজ্যে।’

-কিন্তু মহারাজ অন্যধর্মের প্রতি সহনশীলতাও রাজধর্ম। বলেন কোন কোন পদাধিকারী।

-আমি তা বিশ্বাস করি না। সদর্পে ঘোষণা করেন পুষ্যমিত্র। সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমি মনে করি ধর্ম রাজনীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না হলে বিরোধী ধর্ম বিরুদ্ধ মতের জন্ম দেয়।যা রাজতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক। ‘স্বভাবতই শাসকের ধর্ম অনুসারে অন্য ধর্মের উপর পীড়ন শুরু হলো। অভিঘাত নেমে এলো বৌদ্ধদের প্রতি। ধ্বংস হলো বৌদ্ধবিহার।হত্যা করা হলো বৌদ্ধ শ্রমণদের। সম্রাট ঘোষণা করলেন বৌদ্ধ বিহারের প্রধান সন্ন্যাসীর কর্তিত মস্তক নিয়ে আসতে পারলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে।রাজআনুগত্য এবং পুরস্কারের লোভ হত্যৃ বাড়ালো। ভীত হয়ে পড়লেন নিরিহ বৌদ্ধ শ্রমণের দল। ভয়ে দলে দলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পাড়ি দিলেন তিব্বতের পথে।সেই পথে পা বাড়াতে বাধ্য হলেন সুনাথ, ‘মহাসালা বৌদ্ধ বিহারের প্রধান সন্ন্যাসী।’

তিব্বতে পৌঁছতে হবে তাকে। এদিকে আঁধার নামছে। আজ রাতের মতো একটা আশ্রয় চাই। কিন্তু এই পার্বত্য প্রদেশে নিরাপদ আশ্রয় মিলবে কোথায়? পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যায় একদল ঘোড়সওয়ার। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সুনাথ। বোঝার চেষ্টা করেন এরা কারা? দস্যুদল, পুষ্যমিত্রর সৈন্য, বণিক দল? এপথে আর হাঁটতে পারেন না সুনাথ। চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন একটা আশ্রয়ের জন্য।নজরে পড়ে কিছু দূরের এক গুহামুখ। গুহামুখে লেগে থাকা আলোর আভা স্বস্তি জাগায় মনে। মনে হয় নিশ্চয়ই মনুষ্য রয়েছে ঐ গুহায়। হাঁটতে থাকেন গুহা মুখ লক্ষ্য করে। তবে থমকে দাঁড়ান গুহা মুখের সামনে এসে। দস্যু ও তো থাকতে পারে এ গুহায়? কিন্তু বুঝতে পারেন এই ছাড়া কোন আশ্রয় জুটবে না আজ রাতে।তাই ইতস্তত মন নিয়ে প্রবেশ করেন গুহা অভ্যন্তরে। তবে গুহায় প্রবেশ করে চিন্তামুক্ত হন।বুঝতে পারেন এটি একটি বৌদ্ধবিহার।তবে চিহ্ন প্রতীয়মান করে এটি নারী সংঘ।বুদ্ধ বেঁচে থাকতেই এই নিয়ম বদ্ধ করেছিলেন নারী ও পুরুষ বিহার ভিন্ন হবে। নারী সংঘ বলে সুনাথ বুঝতে পারলেও, বুঝতে পারেন না এই বিহার এতো নির্জন কেন? তবে কি এই বিহার পরিত্যক্ত? যদি তাই হবে তবে দেওয়ালের শিখা গুলি জ্বালালো কে? উত্তর খোঁজার জন্য গুহার গভীরে প্রবেশ করে ডাক দেন,’কেউ আছেন? ‘সাড়া না পেয়ে আবার ডাকেন, ‘কেউ আছেন? ‘তার ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। প্রত্যুত্তর আসে না। এমনিতেই ক্লান্ত তিনি। শ্রান্ত শরীর আরাম চায় গুহার নিরাপদ আশ্রয়ে।বসে পড়েন।নামিয়ে রাখেন তার ভার। মনে মনে জপতে থাকেন ত্রিশরণ মন্ত্র “কর্মং শরনমঃ গচ্ছামী/কর্মং শরনমঃ গচ্ছামী/বুদ্ধঃ শরনমঃ গচ্ছামী।” ধ্যানস্থ সুনাথ ধ্যানভঙ্গ করে তাকাতেই দেখতে পান সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনি কে। দেখেই চমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। এই চোখ মুখ যে তার ভীষণ চেনা। কিন্তু ইনি এখানে কেন? সন্ন্যাসিনীও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন সুনাথের দিকে। হয়তো একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর মনেও। মৌনতা ভঙ্গ করেন সুনাথ, ‘তোমাকে এখানে এইভাবে দেখবো আশা করি নি’

-হয়তো এটাই প্রভুর ইচ্ছা। সন্ন্যাসীনি কে দেখে মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে সুনাথের। একি দশা হয়েছে রাজকুমারীর?

মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছোট রাজ্য কজঙ্গলা। সেখানকার সুন্দরী রাজকুমারী সুনয়না। রাজ্যের গুপ্তচর বাহিনীর প্রধান কমলাক্ষের পুত্র সুনাথ। অর্থের বিনিময়ে রাজ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন কমলাক্ষ। ধরা পড়ে প্রাণদণ্ড হয় তার। কমলাক্ষের অসহায় স্ত্রী রাজার কাছে হাজির হন শিশুপুত্র সহ,’ মহারাজ এই শিশুটিতো কোন দোষ করে নি? পিতার অপরাধের শাস্তি এ কেন পাবে? ‘শিশুটিকে দেখে মন নরম হয় রাণির। প্রাসাদে থাকার অনুমতি দেন তিনি। সুনাথ বড় হতে থাকেন রাজকুমারী সুনয়নার সাথে। বয়সকালে সুনয়নার নয়ন থেকে চোখ সরাতে পারতেন না সুনাথ। সুনয়নাও তৃপ্তি খুঁজতেন সুনাথের সাহচর্যে। তাদের জীবনের এই বসন্ত সমাগম দৃষ্টি এড়ায় না প্রাসাদ রক্ষীদের। সুনাথ কে রাজসভায় ডেকে পাঠান কজঙ্গলা রাজ।সরাসরি বলেন, ‘সেদিন তোমাকে আশ্রয় না দিলে আজ আমাকে এইদিন দেখতে হতো না।’

-পিতা ভালোবাসা কী অন্যায়? জানতে চায় সুনয়না। উত্তর দেন রাণী স্নিগ্ধবতী, ‘সম যোগ্যতার না হলে তার সাথে ভালোবাসা অন্যায়।’ সুনাথ আমাদের আশ্রিত। একজন আশ্রিত পুরুষ কিভাবে তাঁর স্ত্রী কে সংসার সুখ দিতে পারে। সর্বোপরি আশ্রয়দাতার সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ করে অন্যায় করেছে সে।সাজা পেতে হবে তাকে। সেই অন্যায়ের সাজা শুনিয়েছিলেন কজঙ্গলা রাজ ‘আগামীকাল সকাল হবার আগে তোমাকে যেন এই রাজ্যের সীমানার মধ্যে না দেখতে পাই। ‘ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে সুনাথের।ভেবে পায় না কি হবে ভালোবাসাহীন হয়ে বেঁচে থেকে। ঝাপিয়ে পড়েছিলেন কুশী নদীর জলে প্রাণ বিসর্জনের  জন্য। অচৈতন্য অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন মহাসালা বৌদ্ধ বিহারের শ্রমণগণ। বোঝান পার্থিব আকাঙ্ক্ষা দুঃখের কারণ। এর থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় ভগবান বুদ্ধের শরণ নেওয়া।বুদ্ধের শরণে নিজেকে সঁপে দিয়ে মনে শান্তি পেয়েছিলেন সুনাথ। কিন্তু সুনয়নার এখানে তো আসার কথা ছিল না, সে এখানে কেন?

-সবই ভাগ্য। বলে সুনয়না শুনিয়েছিলেন তার জীবনের গতিপথ। ‘তুমি রাজ্য ছেড়ে চলে যাবার পর দুর্যোগ নেমে আসে রাজ্যের উপর। মহানগরের রাজা বিক্রম আঘাত হানেন কজঙ্গলার উপর। ঐ আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা পিতার ছিল না।যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারান পিতা। দস্যু স্বরূপ বিক্রম লুন্ঠন করে কজঙ্গলা রাজ্য। লুন্ঠন কালে তুলে নিয়ে যায় আমায়। কপাল ভালো মন্দ যাই বলো সুনাথ, নেশাগ্রস্ত বিক্রম আমাকে নিয়ে সরস্বতী নদী পেরোবার সময় বন্যার তোড়ে ঘোড়া সহ ভেসে যায়। আমাকে উদ্ধার করেন থেরী মায়া। বৌদ্ধবিহারে স্থান হয় আমার। থেরী মায়ার সাথে চিন যাত্রাকালে এই বিহারে আশ্রয় নিয়ে ছিলাম আমরা। এখানেই মৃত্যু হয় মায়ার।তাঁর মৃত্যুর পর পাকাপাকি ভাবে থেকে যাই এই সংঘে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সুনাথের ভেতর থেকে। জানতে চায় ‘কিন্তু তুমি একা?’

-হ্যাঁ। পুষ্যমিত্রর আক্রমণের কথা ছড়িয়ে পড়তেই সংঘ মাতার নির্দেশে সকল সন্ন্যাসীনিরা নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় তিব্বত রওনা দিয়েছে।কিন্তু বুদ্ধের চরণে দীপ জ্বালানোর জন্য আমি একাই থেকে গেছি। রাত শেষ হয়ে গেছে।ঊষা কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে গুহা মুখেও। তবুও সুনাথের পথে বেরোনোর তাড়া নেই আজ। দুজনেই হাত জোড় করে বসেন বুদ্ধ মূর্তির পাদদেশে।তারপর একসাথে উচ্চারণ করেন-

“বুদ্ধং শরনমঃ গচ্ছামী/ধর্মং শরনমঃ গচ্ছামী/ কর্মং শরনমঃ গচ্ছামী।”

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত