| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

ইরাবতী পুনর্পাঠ : রমাপদ চৌধুরী’র গল্প : বড়বাজার

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

কেউ বোধ হয় আমার পিঠে হাত দিয়ে আমার নাম ধরে ডেকেছিলো। 
আমি ভয় পেয়ে কিংবা অবাক হয়ে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলাম। ছায়ার মতো লোকটি তখন টেবিলের ওপর পটপট শব্দ করে তিনটি টাকা টিপে টিপে রেখে দিলো, দিয়ে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে অদশ্য হয়ে গেল।
বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে, আলকাতরার মতো বৃষ্টি, কারণ বাইরে একটুও আলো ছিলো না। এবং ঘরের মধ্যেও অন্ধকার ঘন হয়ে আছে। তাই টেবিলের ওপর রাখা টাকা তিনটি দেখা গেল না। শুধু মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে আরো অন্ধকার তিনটি কালো কালো বৃত্তাকার চাকতি পড়ে রয়েছে টেবিলের ওপর। সেগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হলো টাকা তিনটি যেন পিছলে যাওয়ার গতিতে অনেক দূর সরে গিয়ে আলো নিবে যাওয়া রাস্তার বিকল ট্রাফিক সিগন্যালের তিনটি চোখ উপড়ে নেওয়া অন্ধকার গহ্বর হয়ে গেল। 
টাকা তিনটি তখনো সত্যি আছে কি না দেখার জন্যে আমি কৌতুহলী হয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে থেকে তখন বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ আসছিলো। 
আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা দুর্বোধ্য মনে হলো। আমি তাই রেগে গিয়ে টাকা তিনটি মুঠোর মধ্যে নিয়ে বারান্দায় ছুটে গেলাম। এবং টাকা তিনটি সজোরে দূরের বৃষ্টি-ঝরা অন্ধকার রাস্তায় ছুড়ে দিয়ে বললাম, আমি এসব কিছুই চাই না, আমি অন্য কী যেন চাই। কী চাই আমার তা মনে পড়লো না। 
টাকা তিনটি রাস্তায় ছিটকে গিয়ে গড়াতে গড়াতে তিনটি অন্ধকারের শুন্য হয়ে গেল। আর তখনই বৃষ্টি থেমে গেল। 
আমি সেই তিনটি অন্ধকারের শুন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আর আমার চোখের সামনেই সেগুলি একটু একটু করে বড় হতে লাগলো। এবং তখন আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সেই কালো কালো বৃত্ত তিনটি বড় হতে হতে হঠাৎ একসময় নড়ে উঠে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসলো দূরে দূরে এবং পর পর। তখন মনে হলো যেন অন্ধকার রাস্তার মাঝখানে এক লাইনে পরপর থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে তিনটি কালো কালো রাস্তার কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে এমন অলৌকিক আভাস ছিলো যে, আমার গা ছমছম করে উঠলো। কিন্তু কৌতূহলে তখনো আমি সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেষ অবধি বুঝতে পারলাম, না, না, তা নয়, কালো কালো টাকা তিনটি অন্ধকার রাস্তাটার মাঝখানে স্থির হয়ে গিয়ে পর পর তিনটি ম্যানহোল হয়ে গেছে। যেন একটু আগের আলকাতরার বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর কেউ ম্যানহোলের ঢাকনিগুলো খুলে দিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি নেই, রাস্তায় জল নেই, শুধুই অন্ধকার এবং দূরে দূরে ঢাকনি-খোলা তিনটি ম্যানহোলের গর্ত। 
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, আমি এসব কিছুই চাই না। আমি অন্য কিছু চাই। আর তখনই আমার কানের কাছে কে ফিসফিস করে বললো, তুমি তা হলে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো, খুঁজে নিয়ে এসো তুমি যা চাও। দেখছো না, সকলেই বেরিয়ে পড়েছে। 
আমার মনে হলো, ঠিক, ঠিক। আমি ঠিকই দেখেছিলাম। বিকল হয়ে যাওয়া ট্রাফিক সিগন্যালের তিনটি চোখ উপড়ে নেওয়া গহ্বর বলছিলো, লাল কিংবা কমলা রঙ কিংবা সবুজের সংকেত আর জ্বলবে না। দেখছো না, যে যেদিকে খুশি ছুটছে। সব নিয়ম এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। তোমার যেদিকে খুশি তুমি যেতে পারো। 
আমি তাই দ্রুত বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। বাইরে তখন গভীর অন্ধকার। আমি অন্ধকারের মধ্যে ছুটতে লাগলাম। প্রথম প্রথম আমার একটু ভয়-ভয় করছিলো, কারণ অন্ধকারে তখন কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না, আমি তাই সাবধান হবার চেষ্টা করছিলাম, ছুটতে ছুটতে আমি শেষ অবধি না ঐ ঢাকনি-খোলা কোনো একটা ম্যানহোলের মধ্যে পড়ে যাই। 
আমি তখন প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছি। আমার তখন দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিলো না। আমার চাই, আমার চাই। কী যেন আমায় পেতে হবে। কী পেতে হবে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো না। কিন্তু কিছু পাওয়ার জন্যেই যেন আমি উৎসুক হয়েছিলাম। আমি দ্রুত বেগে ছুটে চললাম সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। আমি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি রাস্তা চিনতে পারছিলাম না। আমি দৌড়চ্ছি, দৌড়চ্ছি, কিন্তু সেটা রাস্তা কি না আমি জানতাম না। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম আমার পায়ের তলা থেকে একটা অসীম অনন্ত তমসার হ্রদ চলে গেছে অনেক দূর অবধি, চোখের নাগালের বাইরে এবং তারপর সেই হ্রদের অন্ধকার যেন হঠাৎ উপচে পড়ে শুন্যে মিলিয়ে গেছে আকাশ হয়ে। সেই আকাশের বাগানে কয়েকটা জুঁইফুল ফুটেছিলো। কিন্তু সেদিকে তাকানোর আমার সময় ছিলো না, সেদিকে তাকাতে গেলে আমাকে থেমে পড়তে হতো, আর তখন পিছনের লোকগুলো আমাকে মাড়িয়ে চলে যেতো। সেই অন্ধকারের মধ্যে যদিও কাউকে দেখা যাচ্ছিলো না, কারো মুখ চেনার উপায় ছিলো না, তবু আমি বুঝতে পারছিলাম অসংখ্য লোক এদিক-ওদিক ছুটে চলেছে, আমার পিছনে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, তারা আমাকে ধাওয়া করেছিলো, কিংবা আমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাইছিলো। আমি দৌড়তে দৌড়তে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইছিলাম আমারও আগে আগে কেউ ছুটে চলেছে কি না। কিন্তু অন্ধকারে আমি কিছুই ঠাওর করতে পারছিলাম না। 
আমার পাশ দিয়ে ছায়ার মতো একটা মানুষ চলে যাচ্ছিলো অন্য দিকে, আমি তাকে ডেকে বললাম, ও মশাই, শুনছেন, এইটেই কি সেই রাস্তা ? এই রাস্তাই তো? 
লোকটা থামলো না। অদ্ভুতরকম হেসে উঠে ফিরে তাকিয়ে বললে, রাস্তা তো অসংখ্য। রাস্তা কখনো একটাই হয় নাকি! 
কিন্তু তখনই কোত্থেকে আরেকজন বলে উঠলো, না, না, আপনি ঘাবড়াবেন না, সবাই তো ঐ রাস্তা ধরেই যায়। ঐ তো সবাই এই রাস্তা ধরেই আসছে। 
আমি আগের লোকটাকে পাগল ভাবলাম, কারণ সে হেয়াঁলি করে কথা বললো। আমি পরের লোকটিকে বিশ্বাস করলাম, কারণ সে মনোমত জবাব দিলো। আমি মনে মনে চাইছিলাম এইটেই যেন সেই রাস্তা হয়। কারণ এখন যদি কেউ বলে বসতো, না, না, এটা ভুল রাস্তা, তা হলে আমাকে আবার এতখানি ফিরে যেতে হতো, এবং তারপর ঠিক রাস্তাটা খুঁজে বের করতে করতে আমার সময় এবং বয়স পার হয়ে যেতো। আমার তাই মনে হলো, ঠিক রাস্তার জন্যে ফিরে যাওয়ার চেয়ে ভুল রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। 
আমি রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চললাম অন্ধকার এবং মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলে এবং যেখানে পুঞ্জ পুঞ্জ কালো কালো ধোঁয়া জমে গিয়ে বলের মতো ঝুলছে সেদিকে মুখ তুলে আমি নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার শ্বাস ফুরিয়ে আসছে, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিলো আমি পৌঁছবার আগেই হয়তো সব ফুরিয়ে যাবে, আমি যে জিনিসটা চাই সেটা আর পাওয়া হয়ে উঠবে না। 
তখনই আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম, আমি কী চাই। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, তুমি তো একটা দুরন্ত ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছো হে, কিন্তু কী তোমার চাই ভেবে দেখেছে কখনো? 
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়লো ভেবে দেখার মতো সময় ছিলো না। আমি শুধু, বুঝতে পারছিলাম আমার চাই। আমার মন বলছিলো, তাড়াতাড়ি না পৌঁছতে পারলে কিছুই পাওয়া যাবে না। 
তুমি তো একটা দুরন্ত ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছো হে, আমি নিজেকে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতখানা খুলে উলটে দিয়ে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ালাম। বললাম, ঠিক বলেছো। দুরন্ত ঘোড়ার মতোই তো, কারণ আমি তখন অনুভব করতে পারছিলাম কে যেন আমার পিঠের ওপর চেপে বসে আছে, কি একটা ভার যেন আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে, কেউ একজন আমার লাগাম টেনে ধরছে এবং একটা সুপুষ্ট বেণী দিয়ে সপাং সপাং করে আমার গায়ে আদরের চাবুক মারছে। 
আমি তাই প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। আমি জানতাম, সেখানে পৌঁছতে পারলে আমি ভেবে দেখার সময় পাবো আমার কি চাই। এখন আমার মনে পড়ছে না, কিন্তু সেখানে পৌঁছলে তো অনেক কিছু দেখতে পাবো, মানুষ যা কিছু চায়, এবং তখন সেই জিনিসটা দেখতে পেলেই আমার মনে পড়ে যাবে আমার কী চাই। 
দৌড়তে দৌড়তে দৌড়তে দৌড়তে আমি যেন একটা বাঁক নিলাম, অমনি আমার চোখ ঝলসে গেল। আমি দেখলাম সমস্ত আলোয় আলো হয়ে আছে, কোথাও কোনো অন্ধকার নেই। আমি দেখলাম হাজার হাজার আলোয় সমস্ত জায়গাটা এমন উজ্জ্বল হয়ে গেছে যে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কারণ আমার চোখ ঝলসে গেছে। আমি অন্ধকারে এতক্ষণ কিছুই দেখতে পাইনি, কারণ সেখানে একটও আলো ছিলো না, এখন আমি আলোয় অন্ধ হয়ে গেলাম, কারণ সেখানে একটুও অন্ধকার ছিলো না। 
আমি ছুটে যাচ্ছিলাম কিচ্ছু দেখতে না পেয়েও, কেননা এতক্ষণ কিছু দেখতে পাইনি, তবু তো আমি ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছেছি। হ্যাঁ, আমার মনে হলো আমি পৌঁছে গেছি। 
আমার সমস্ত শরীর থেকে তখন ঘাম ঝরছে, আমার চোখ দুটো ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে, আমার গলা শুকিয়ে গেছে, আমার শরীর তখন ক্লান্ত অবসন্ন, তবু পৌঁছে যাওয়ার 
আনন্দে আমার প্রতিটি রোমকূপে একটা উল্লাস জেগে উঠলো। আমি প্রচণ্ড বেগে সেখানে ঢুকতে গেলাম, কারণ ততক্ষণে আমি থরে থরে ভিতরে সাজানো সুদৃশ্য জিনিসগুলো দেখতে পেয়েছি। সেই জিনিসগুলো আমি স্পষ্ট চিনতে পারলাম না, কিন্তু আমার মনে হলো ওর মধ্যেই হয়তো আমার চাওয়ার জিনিসটি আছে। 
আমি দ্রুত পায়ে সেখানে ঢুকতে গেলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন ঝনঝন একটা বিকট শব্দ হলো। চতুর্দিকে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়লো। 
কেউ একজন বললে, লোকটা পাগল, শো-কেসের কাচ ভেঙে ঢুকতে গেছে। 
আর সমবেদনায় একটি নারীকণ্ঠ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো, রক্ত, রক্ত। 
আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার সর্বাঙ্গ কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে। 
আমি শুনতে পেলাম, কেউ যেন বলছে, দরজা তো ওদিকে। এদিক দিয়ে কেউ আসে নাকি? 
আমি বোকার মতো তার দিকে তাকালাম। তারপর ক্ষমাপ্রার্থীর ভঙ্গিতে বললাম, কিন্তু দরজায় কী-রকম ভিড় দেখেছেন। ওরা যে আমাকে ঢুকতে দিতো না। অথচ আমাকে তো ঢুকতে হবেই, আমার যে কি যেন চাই। 
অমনি সেই বিরাট ঘরখানার মধ্যে যত লোক ছিলো তারা আমার কথা শুনে অট্টহাস করে উঠলো। সকলে মিলে একসঙ্গে বলতে চাইলো, চাই! এ আবার কি ভাষা আপনার? আমাদের ভাষায় তো ‘চাই’ বলে কোনো কথা নেই। এখানে কিছুই চাওয়া যায় না, আপনি তা-ও জানেন না? 
তা হলে! তা হলে আমি কি ভুল জায়গায় এলাম। আমার চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে আসছিলো। আমার সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কিন্তু তার জন্যে আমার একটুও কষ্ট হচ্ছিলো না। হতাশায় আমি বোকার মতো তাদের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার তখন অন্য কষ্ট। আমি বললাম, কিন্তু আমি যে আশা করে এত দূর থেকে ছুটে এসেছি। আমার চাই, চাই। 
ফিটফাট পোশাক পরা ম্যানেজার গোছের একটা লোক এগিয়ে এলো। সে হাসতে হাসতে বললে, এখানে আশা করার কিছু নেই। সুপারমার্কেটে আপনি কি এই প্রথম এলেন? দেখতে পাচ্ছেন না, এটা একটা বিরাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স। একটা জায়ান্ট শপ, একটা অতিকায় দোকান। এখানে সব কিছুই আমরা বিক্রি করি। আপনার যা খুশি আপনি কিনতে পারেন। এখানে কিছু চাওয়া যায় না, এখানে সকলকেই শুধু কিনতে হয়। 
আমি এতক্ষণে চোখ মেলে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। একটা লম্বা ঝকঝকে কাউন্টার চলে গেছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। তার শেষ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই কাউন্টারের ওপারে থাকে থাকে কত কি সাজানো রয়েছে। কোনোটা রঙিন ফিতে বাঁধা সুন্দর মোড়কে, কোনোটা রাংতা-জড়ানো কার্ড বোর্ডের বাক্সে, কোনোটা কি দিয়ে মোড়া আমি বুঝতে পারলাম না। 
সেই সময় আমার হঠাৎ মনে হলো আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি এক পাশে দেখলাম থরে থরে নানান খাবার সাজানো রয়েছে। আমি দ্রুত সেই কাউন্টারের লোকটির কাছে গিয়ে বললাম, শুনছেন, আমাকে রুটি দিন, রুটি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। 
লোকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। বললে, ডান হাতটা দিন। ঐ হাতখানা এর দাম। বলে কাউন্টারের ওপর একখানা পাউরুটি রেখে দিলো। 
আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। আমি জানতাম না, আমাকে কেউ কোনো দিন বলে দেয়নি যে, এখানে সব কিছুই কিনতে হয়, সব কিছুর দাম দিতে হয়। আমি কোনো উপায় দেখতে না পেয়ে আমার ডান হাতখানা খুলে লোকটিকে দিলাম। 
কিন্তু রুটিখানা বাঁ হাতে তুলে নিয়েই আমি অভিযোগের স্বরে বললাম, বাঃ, বাঃ, বেশ তো নিয়ম। আমি এখন ভালো করে খেতেও পারছি না, তোমরা দেখছো তো? ডান হাতখানা দিয়ে দিলে খাবো কি করে? 
পাশ দিয়ে একজন যাচ্ছিলো, সে হেসে বললে, কেন, আরেকটা হাত তো রয়েছে আপনার। হাসতে হাসতে বললে, এটাই তো নিয়ম, রুটি কিনতে হলে তার দাম দিতে হবে না? দেখছেন না, রুটির মোড়কে দাম লেখা রয়েছে। মাত্র ডান হাতখানা। 
আমি রেগে গিয়ে বললাম, বেশ, তাই, তাই খাবো আমি বাঁ হাত দিয়েই। আপনাদের এখানে যত সব উদ্ভট নিয়ম। ঠিক আছে, আপনারা যতক্ষণ কাউন্টারের ওপারে, আপনাদের নিয়মই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু, শুকনো রুটি কি চিবিয়ে খাওয়া যায় নাকি? একটা কিছু তো সঙ্গে দেবেন? 
পাশের কাউন্টার থেকে একজন সেলসম্যান শব্দ করে হেসে উঠলো। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে আরেকজনকে বললে, “দেবেন’ কথাটার মানে কি রে বাবা। শুনলেনই তো এখানে শুধু বিক্রি হয়। আপনি রুটির সঙ্গে খাবার জন্যে যা খুশি কিনতে পারেন আমার কাছে, আপনি দাম দিয়ে কিনবেন, তারপর আপনিই আমাকে ধন্যবাদ দেবেন। আপনি ধন্যবাদ না দিলেও আমি কিছু বলবো না, কারণ ঐ দেওয়া জিনিসটা আমাদের ভাষায় নেই। আপনার মতো অনেকেই দিয়ে যান দেখেছি, এই পর্যন্ত। 
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে, কত দাম বলুন। কি আছে আপনার কাছে? 
লোকটা বললে, এ কাউন্টারের সব কিছুর দাম আপনার বাঁ হাতখানা। বলে এক টুকরো মাংস আর কী কী যেন কাউন্টারের টেবিলে রাখলো। 
আমি নিরুপায় হয়ে বাঁ হাতখানা এগিয়ে দিলাম। সে সেটা খুলে নিলো। 
আর তখন আমি অবাক হয়ে বললাম, বাঃ বাঃ, আমি তা হলে খাবো কি করে ? দুটো হাতই তো আপনারা নিয়ে নিলেন! 
তখনই সেই ম্যানেজার গোছের লোকটা, যে ফিটফাট পোশাকে ঘরে ঘরে তদারকি করছিলো, সে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। বললে, হাতের জন্যে এত আফসোস কেন আপনার, আপনি তো মুখ দিয়ে খাবেন! 
মুখ দিয়ে খাবো! কি কথা! রাগে অপমানে আমার চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে এলো। আমি কি কুকুর নাকি! কিন্তু তখন প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। আমি কুকুরের মতো মুখ দিয়ে খেতে লাগলাম। 
সেই সময় একটা খুব সুন্দর নরম স্বভাবের মেয়ে, যে এর আগেও একবার করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলো, যে ‘রক্ত’ ‘রক্ত’ বলে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলো, সে আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল এনে খাইয়ে দিলো। আমার মনে পড়লো, আমার সর্বাঙ্গ যখন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো, এই মেয়েটি দূর থেকে আমার দিকে সমবেদনার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। 
আমার সমস্ত ক্ষোভ অন্তর্হিত হলো। আমার সমস্ত বিক্ষুদ্ধ মন জুড়িয়ে গেল। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো লোকগুলো আমাকে কুকুর মনে করছে। কারণ, আমি কুকুরের মতো মুখ দিয়ে খেতে পাওয়ার লোভে আমার দু হাতের পরিশ্রম ওদের দিয়ে দিয়েছি। আর তখনই, কেন জানি না, আমার মনে পড়লো, বৃষ্টি-ভেজা অন্ধকার রাস্তায় সেই কালো কালো টাকা তিনটিকে ছুড়ে ফেলে দেবার পর সেগুলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিলো অন্ধকারে তিনটি কালো কালো কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। 
আমি নিজের পোশাকের দিকে তাকালাম। নোংরা শতছিন্ন পোশাক দেখে দোকানের লোকগুলো নিশ্চয় আমাকে কোনো মর্যাদা দিচ্ছে না। ওরা যে সকলেই খুব ফিটফাট ভালো পোশাক পরেছে। যে মেয়েটি আমাকে জল দিয়ে গেল তার দিকে তাকিয়ে আমার নিজেকে সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন করে তুলতে ইচ্ছে হলো। 
আমি পোশাকের কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারের লোকটি দামী দামী পোশাক নামিয়ে দিলো। বললে, যা খুশি পছন্দ করুন, তার দাম আপনার মগজের আধখানা। 
আমার তখন চিন্তা করার সময় নেই। বললাম, এই পোশাকটা। এই ট্রাউজার্স, এই কোট আর এই নেকটাইখানা। মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নিয়ে নিন। 
সে একটা ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে মাথায় একটা ফুটো করে সিরিঞ্জ দিয়ে মগজ বের করে নিলো আধখানা। মগজ বের করে নিলে এত যন্ত্রণা হয় আমি জানতাম না। রেগে গিয়ে আমার একটা ঘুষি মারতে ইচ্ছে হলো ঐ ম্যানেজার লোকটাকে, কিন্তু আমার তো হাত নেই, শুধু কাঁধের কাছে একটা ঘুষি পাকানোর মতো অনুভতি হলো। তা বুঝতে পেরে কাউন্টারের লোকটা হাসলো। বললে, পোশাকটা পরেই দেখন না, আপনাকে খুব সুন্দর দেখাবে। 
আরে সত্যি, পোশাক বদলে আমি একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। আমাকে আর চেনাই যাচ্ছিলো না, মনে হচ্ছিলো ঐ বিরাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সের ভিড়ের সঙ্গে আমি মিশে গেছি। আমাকে দেখে আর কেউ হেসে উঠবে না। চাওয়ার কথা, দেওয়ার কথা আমি আর উচ্চারণ করবো না। তা হলেই আমি ওদের মতোই ভদ্রলোক হয়ে যাবো। 
আমি দিব্যি লম্বা লম্বা পা ফেলে কাউন্টারগুলো দেখে বেড়াচ্ছিলাম। আর মাঝে মাঝে সেই সুন্দর করুণাঘন মেয়েটির চোখ পড়ছিলো আমার দিকে। সে করুণ অথচ মুগ্ধ চোখে মৃদু মৃদু হাসছিলো, চোখ সরিয়ে নিচ্ছিলো। আর তখন আমার নিজেকে খুব মূল্যবান মনে হচ্ছিলো। 
আমি প্রচণ্ড বেগে রাতের অন্ধকারে এতখানি ছুটে এসেছি, আমার দেহমন তখন ক্লান্ত। আমি দাঁড়াতে পারছি না, শরীর ভেঙে পড়ছে, আমি ঘুরে ঘুরে কাউন্টারগুলো দেখতে পারছিলাম না। আমার কেবলই একটু বসতে ইচ্ছে করছিলো একটু বিশ্রাম নিতে, আমি সেজন্যে আসবাবের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে নানারকমের চেয়ার সাজানো ছিলো, কোনোটা শুধুই কাঠের, কোনোটা বেতের, কোনোটা চমৎকার গদি আঁটা, ভিতরে বোধ হয় ডানলো-পিলো দেওয়া। আমার ইচ্ছে করছিলো তখন-তখনই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়তে। 
আমি বললাম, আমি একটা চেয়ার কিনবো। 
কাউন্টারের লোকটা প্রথমে আমার কথা শুনতেই পায়নি, কারণ তার কাউন্টারে অনেক লোক ছিলো, সকলেই সমস্বরে বলছিলো, আমি একটা চেয়ার কিনবো, একটা চেয়ার কিনবো। 
কাউন্টারের লোকটা বললে, একটা চেয়ার কিনলে এখানে অনেক কিছু, ফাউ পাবেন। একটা চেয়ারের সঙ্গে আপনি একখানা খাট, একখানা আলমারিও পাবেন। আপনি চেয়ারটা নিয়ে গিয়ে আপনার আপিসে রাখবেন, খাট আলমারি আপনার বাড়িতে। দাম কিন্তু খুব সস্তা, আপনার পা দুখানা। 
আমি বললাম, বেশ, বেশ, তাই। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না, আমি ঐ গদি-আঁটা চেয়ার একখানা কিনবো, সঙ্গে কোন খাটটা বলুন, কোন আলমারি। 
লোকটা গদি-আঁটা চেয়ারটা কাউন্টারের এপারে দিয়ে দিলো। বললে, খাট আলমারি আসছে। আপনি বসুন, আপনার পা দুখানা খুলে নিই। 
চেয়ারে বসে কি আরাম। আমি পা দুটো বাড়িয়ে দিলাম, লোকটা দুখানা পা খুলে নিলো। তারপর পাশের লোকটাকে হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বললে, ব্যস, লোকটা আর রেগে গিয়ে চেয়ারটাকে কোনো দিন লাথি মারতে পারবে না। ব্যাটা আহাম্মক। 
আমার ভীষণ মর্যাদায় লাগলো। আত্মসম্মানে। কিন্তু তখন আর আমার কিছু করার নেই। আমি নিরুপায়। আমার হাত দুখানা দিয়ে দিয়েছি, ঘুষি মারতে পারি না। আমার পা দুখানা দিয়ে দিলাম, সত্যিই কোনো দিন আর লাথি মেরে চেয়ারটা উলটে দিতে পারবো না। 
তবু আমি আমার মনকে স্তোক দিলাম। এবার তো আমি খাটের ওপর নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে পারবো। কত দিন আমি ঘুমোইনি, বিশ্রাম পাইনি, সেই যে অন্ধকারের লোকটা আমার পিঠে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলো, বলেছিলো, তিনটে টাকা রইলো, যা আমি ঘৃণার সঙ্গে দূরে ছুড়ে দিতেই অন্ধকার রাস্তায় পড়ে প্রথমে তিনটে কুণ্ডলী-পাকানো কুকুর হয়ে গিয়েছিলো, তারপর ঢাকনি-খোলা তিনটে ম্যানহোল। আমি কিন্তু খুব সাবধান ছিলাম, দৌড়বার সময় না কোনো একটা গর্তে পড়ে যাই। 
আমি চিন্তা করতে চাইলাম, আমি এখানে কেন এসেছি ছুটতে ছুটতে, এত সময় আর বয়স পার হয়ে। কিন্তু আমার মনে পড়লো না, কারণ আমি যে আগেই আমার আধখানা মগজ দিয়ে দিয়েছি। এখন আর সব কথা মনে পড়ে না, এখন আর পর পর যুক্তি সাজাতে পারি না। আমি চারপাশে তাকিয়ে সেই মেয়েটিকে খুঁজতে লাগলাম, কারণ আমি তাকে অনেকক্ষণ দেখিনি। তাকে দেখার আমার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিলো। 
আমার মন বলছিলো, সেই মেয়েটি আবার আসবে, নিজেকে তার জন্যে প্রস্তুত করো। আমি তাই আমার চোখে তাকে আরো সুন্দর করে সাজাতে চাইলাম, এবং নিজেকে তার চোখে। 
আমি কী কী যেন কিনলাম, তার জন্যে কিংবা যে আসবে তার জন্যে। আমার নিজের জন্যেও। পরিবর্তে আমি আমার বুকের পাঁজরা খুলে দিলাম, আমার সাহস। আমি আমার কণ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠস্বর দিয়ে দিলাম। এখন আর আমার আর্তনাদ কেউ শুনতে পাবে না, আমি আর কোনো কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবো না। 
আমি তাকিয়ে দেখলাম, দুরে একটা কাউন্টারে বড় বড় করে লেডিজ’ লেখা রয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, ওটা মেয়েদের কাউন্টার। কাউন্টারের লোকটা হেসে উঠে বললে, ভুল করছেন, এগিয়ে যান, দেখুন, লেডিজ লেখা রয়েছে বটে বড় বড় করে, কিন্তু তার নিচে খুব খুদে অক্ষরে ‘ফর সেল’ লেখা রয়েছে দেখছেন না। আপনি এগিয়ে যান। 
আমি বললাম, রসিকতা করছেন, আমি এগোবো কী করে? 
লোকটি বললে, চেয়ারে চাকা লাগানো আছে, আপনি এগোতে পারবেন, শুধু পিছোতে পারবেন না। 
এগিয়ে গিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। বললাম, মেয়েটিকে চাই, একটি মেয়ে। সে কোনটা? লোকটা হাসলো। বললে, এই তো টাঙানো রয়েছে। আপনি কিনে নিয়ে জুড়ে নিন। । তা হলেই একটি মেয়েকে পেয়ে যাবেন। কোন মেয়েটি তা আমরা কি করে বলবো। 
আমি দেখলাম, সত্যি তো, মাংসের দোকানে যেমন একটা আঁকশিতে পিছনের রান ঝোলে, একটাতে সামনের রান, কোনোটায় পাঁজরা, ফুসফুস, তেমনি এই কাউন্টারেও। আমি সুন্দর সুন্দর জংঘা দেখলাম এক জায়গায়, নিতম্ব বাহু ঝুলছে অন্যত্র, আরেক জায়গায় সুন্দর মুখ একখানা, উরু, রেশমের মতো মাথার চুল, সুগঠিত স্তন। আমার হাত দুটি তো আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি, আমি মুগ্ধের মতো পরম আদরে তাই কল্পনায় একটি মুখের ঠোঁট দুটিতে আঙুল বুলিয়ে দেখলাম, একটি বাহু স্পর্শ করলাম, দুটি কোমল স্তনের ওপর কল্পনার হাত রেখে বললাম, বলুন এবার আমাকে কি দাম দিতে হবে। আমার তো আর কিছুই নেই। 
লোকটি হাসলো। বললে, কি যে বলেন, আপনার আধখানা মগজ এখনো আছে। সেজন্যেই তো আপনার এত আত্মমর্যাদা, এত কষ্ট। আপনি যে এখনো কিছু কিছু চিন্তা করে ফেলেন, এখনো ভাবার চেষ্টা করেন, আপনার যখন পোশাক ছিলো না, আপনার যখন খিদে ছিলো, তখনকার কথা। ঐ যে শতছিন্ন পোশাকে বুভুক্ষুর মতো একটা লোক তখন ঢুকলো, আপনি তো তাকে সাবধান করতে যাচ্ছিলেন। অথচ আপনি বুঝতেই পারছেন, পোশাক বদলানোর পর, চেয়ার কেনার পর আপনি একটু একটু করে আমাদের লোক হয়ে যাচ্ছেন। আপনি চেষ্টা করলে একদিন কাউন্টারের এপারেও চলে আসতে পারেন। 
আমার মনে পড়লো, আমি সেই শতছিন্ন পোশাকের লোকটিকে দেখেছিলাম, কিন্তু সাবধান করতে যাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না, কারণ আমার পা নেই এবং চেয়ারটা পিছনে ফেরানো যাবে না। আর আমি সত্যি সাবধান করতে চেয়েছিলাম কি না আমার মনে পড়লো না। 
আমি চিৎকার করে উঠলাম, ওসব কথা বলবেন না, আমার মনে পড়লে কষ্ট হয়। আমি যে ওর মতো ছিলাম, আমি তা ভুলে যেতে চাইছি। নিন, আপনি বাকী মগজটাও নিয়ে নিন। আমি ঐ টুকরোগুলো কিনবো, জুড়ে নেবো। 
আমি সুন্দর সুন্দর জংঘা,মুখ, আজানু কেশ, স্তন, বাহু, নাভিদেশ এবং উরু পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলাম, আমার মনে হলো, আমি একটি নারীকে পেয়ে গেছি। কিন্তু সেগুলিকে আমি ঠিক পর পর সাজাতে পারলাম না, জোড়া দিতে পারলাম না। কারণ, তখন আমার সবই তো প্রায় দেওয়া হয়ে গেছে, আমার পুরো মগজটাই। কি করে আমি তাকে গড়ে তুলবো আমি বুঝতে পারলাম না। কল্পনা এবং যুক্তি তখন আমি হারিয়ে ফেলেছি। 
উল্লুকের মতো কদাকার একটা লোক হেসে উঠলো, আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, হাঃ হাঃ, লোকটা মগজ বেচে দিয়েছে! সঙ্গে সঙ্গে তার পাশের লোকটা ঐ উল্লুকের হাসিটা থামিয়ে দিলো ধমক দিয়ে। বললে, ব্যাটা উল্লুক, তুইও তো বেচে দিয়েছিস, কিংবা তোর ছিলোই না। যাদের আছে তারা সবাই বেচে দেয়। এখানে, কিংবা অন্য কোথাও। 
তবু আমি কোনো সান্ত্বনা পেলাম না। 
আমার মনের মধ্যে দারুণ একটা যাতনা দানা বাঁধছিলো। আমার বুকের মধ্যে ব্যথা-ব্যথা করছিলো। আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, এ তো সেই মেয়েটি নয়। তা হলে সেই মেয়েটি গেল কোথায়। সে আমাকে তৃষ্ণায় জল পান করিয়েছিলো, সে আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়েছিলো। সে মদু মদু হেসেছিলো এবং লজ্জা পেয়েছিলো আমার দিকে তাকিয়ে। 
কিন্তু ততক্ষণে সেই মাংসের টুকরোগুলো, সেই জংঘা, বাহু, স্তন সব জুড়ে গিয়ে একটা কিম্ভূত নারী হয়ে গেছে, সে তখন কথা বলতে শুরু করেছে। আর আমার মনে হলো, এর মধ্যেই হয়তো সেই মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে। অতএব আমি একে তার মতো করে সাজিয়ে তুলি, এবং নিজেকে এই মেয়েটির চোখে সুন্দর করে। 
আমি এই মেয়েটির জন্যে বিলাস এবং নিজের জন্যে অহঙ্কার কিনতে গিয়ে আমার চোখ দুটি দিয়ে দিলাম। এখন থেকে আমি আর সত্যকে দেখেও দেখবো না। আমি আমার কান দুটি দিয়ে দিলাম, আমি আর এখন থেকে কাউন্টারের ওপারের কোনো ফিসফিস শুনেও শুনবো না। 
হঠাৎ তখনই দেখলাম, সমস্ত লোক শব্দ করে অট্টহাসি করে উঠলো, আরে দেখো, দেখো। মানুষটার কিচ্ছু বাকী নেই, ও এখন শুধু একটা হৎপিণ্ড। ও শুধু কষ্ট পেতে পারবে। কিন্তু ওকে আর এখন কেউ চিনতেই পারবে না। 
তাদের সেই হাসির শব্দ প্রতিধ্বনি তুললে দেয়ালে দেয়ালে, আমি লজ্জায় মরে গেলাম। আমি তখন শুধুই একটা হৎপিণ্ড হয়ে গেছি। আমি তখন চিন্তা করতে পারছি না। আমি শুধু অনুভব করছি, আমি কী যেন চেয়েছিলাম। 
হয়তো সেই সুন্দর মেয়েটিকে যে আমাকে তৃষ্ণায় জল দিয়েছিলো। আমি তাকে চতুর্দিকে খুঁজতে লাগলাম। কোথায় সে, কোথায় গেল। আমি অতৃপ্ত, আমি অতৃপ্ত, আমি কী যেন চেয়েছিলাম। আমার কী যেন চাই মনে হয়েছিলো বলেই তো সময় এবং বয়স পার হয়ে আমি এতখানি ছুটে এসেছিলাম। 
আমি হঠাৎ অনুভব করলাম, এই ভিড় থেকে দূরে সরে গিয়ে নির্জনে এক কোণে সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অভিমান, তার মুখে ব্যথার ছাপ, সে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। 
তখনই সেই ম্যানেজার গোছের লোকটা এসে আমার হৎপিণ্ডটা চেয়ার থেকে ফেলে দিলো। বললে, এই চেয়ারটা চিরকালের জন্যে নয়। কাকে যেন বললে, মানুষটা এখন অকেজো হয়ে গেছে, এখন এ শুধু একটা হৎপিণ্ড, একে আর মানুষ বলা যায় না। 
আর তখন সেই বিরাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সের অসংখ্য সেলসম্যান একসঙ্গে হেসে উঠলো। আর সেই ম্যানেজার গোছের লোকটাও হাসলো। বললে, মজা দেখো, মজা দেখো। তোমরা তো সব নিজেদের সেলসম্যান ভাবো, তোমরা ভেবেছো তোমরা বিক্রি করছে, কিন্তু আসলে দেখো এই মানুষটাই ক্রমে ক্রমে নিজেকে সম্পূর্ণ বিক্রি করে দিয়েছে আমাদের কাছে। এই লোকটাই তো আসল সেলসম্যান। 
আমার তখন আর আত্মমর্যাদায় লাগলো না, আমার তখন আর অপমানবোধ নেই। আমি গড়াতে গড়াতে গড়াতে গড়াতে সেই নির্জনে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। 
তখন সব লোক বলাবলি করছে, হাসছে, দেখুন, দেখুন, একটা হৎপিণ্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারণ ওটা কেউ কিনতে চায় না। 
আমার হৎপিণ্ডের মধ্যে থেকে একটা কান্না ঠেলে বের হতে চাইলো। সে গড়িয়ে গিয়ে সেই মেয়েটির পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর আমার হৎপিণ্ডটা হঠাৎ বলে উঠলো, আমি তো আমার সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে এখন শুধুই একটা হৎপিণ্ড হয়ে গেছি, এখন আর কেউ আমাকে নিতে চাইছে না, তুমি আমাকে তুলে নাও। 
মেয়েটির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়লো। ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বললে, তুমি আমাকে চাইছো কেন? তুমি তো অন্য কিছু চেয়েছিলে। কী চাই তোমার সেটা জানার জন্যেই তো তুমি অন্ধকারে এত সময় আর বয়স পার করে ছুটে এসেছিলে। তুমি তো এসব কিছুই চাওনি, তা হলে তুমি নিজেকে বিক্রি করলে কেন? 
বলে সে আমাকে, আমার হৎপিণ্ডকে পরম আদরে হাতের তালুতে তুলে নিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে তার দু চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু হৎপিণ্ডের ওপর ঝরে পড়তেই সেটা একটা রক্তগোলাপ হয়ে ফুটে উঠলো। 
আমি তখন চিৎকার করে বলে উঠতে চাইলাম, আমার কী চাই. আমি কিসের খোঁজে এসেছিলাম, এখন আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু আমি তো ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছে-ছিলাম। আর তখন তো আমি একটা সম্পূর্ণ মানুষ ছিলাম, আমার সব কিছুই ছিলো, দুটি সবল হাত, আর আমার মগজটাও তখন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারতো.. এখন, তখন এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স, এই সুপারমার্কেটটা আমি কেন দু হাতে ভেঙে চুরমার করে দিলাম না। তা হলে, তা হলে পথিবীর প্রতিটি মানুষ নিজেকে বিক্রি করার জন্যে এখানে ছুটে আসতো না। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত