| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

রমাপদ চৌধুরীর ছোটগল্প: রাঙা পিসীমা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বেলেঘাটার অনাদি দস্তিদার লেনের সতেরোর এক বাড়িটা আপনারা কেউ দেখেছেন কি না জানি না। যদি কোনো দিন বেলেঘাটায় যান, হাতে সময় থাকলে অনাদি দস্তিদার লেনের খোঁজ করবেন। তারপর অনাদি দস্তিদার লেনে ঢুকে বা দিকের ফুটপাথ ধরে পরপর সতেরোটা নম্বর পার হয়ে এসে বাগানওয়ালা প্রকাণ্ড একখানা বাড়ি দেখতে পাবেন।
পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নির্জন বাড়িটার দিকে তাকালে দিনের বেলাতেও আপনার গা ছমছম করবে। একটু লক্ষ করলে দেখবেন বা দিকের দেয়ালে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা আছে সতেরোর এক, কিন্তু ফটকের ডান দিকে দেখতে পাবেন একটা মারবেলের ফলক। ফলপাতা-আঁকা নামটা লেখা আছে তার ওপর। নাম অনাদি-নিবাস।

অনাদি-নিবাসের পাঁচিল অবশ্য ধসে পড়েছে এখন, লোহার ফটকে জং ধরেছে। আর । বাগান? হ্যা, এককালে বেশ সাজা্নো বাগানই ছিলো। এখন চোরকাটার ঝোপের মধ্যে শুধ, একটা মারবেলের মতি। অনাদি-নিবাসের জানলাগুলো আজ সাত বছর খোলা হয়নি, প্লাস্টার খসে খসেই ইট বেরিয়ে পড়েছে, বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে দেয়ালে শ্যাওলা জমে এমন চেহারা হয়েছে যে ভুতুড়ে বাড়ি বলেই মনে হবে।পাড়ার লোক নাকি মাঝরাতে ও-বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতে শুনেছে। কেউ কেউ বলে, সাদা ধবধবে থান পরে একটি পরমাসুন্দরী মেয়েকে নাকি জ্যোৎস্না-রাতে ও-বাড়ির ছাদে ঘুরে বেড়াতেও দেখা যায়। সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে সন্ধ্যের পর অনাদি-নিবাসের পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে যেতেও সাহস পায় না।

এত বড় একটা বাড়ি, অথচ কেউ নাকি কোনো দিন অনাদি-নিবাসে আলো জ্বলতে দেখেনি, মানুষ ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি। শুধু কার্নিশের ওপরে বসে একরাশ পায়রা বকম বকম করে, আর কার্নিশের নীচে চামচিকের রাজত্ব। তাই গাড়িবারান্দার ঠিক উপরে দুটো পরীর মাঝখানে যদিও ইংরেজীতে লেখা আছে ১৯০২, তবে বাড়ির চেহারা দেখে মনে হয় সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে ক্লাইভের যুদ্ধ হওয়ার সময়েই বুঝি অনাদি-নিবাসের পত্তন। আমি একসময় এই অনাদি-নিবাসের, এই সতেরোর এক অনাদি দস্তিদার লেনের বাসিন্দা ছিলাম। আরও দুটি কলেজের ছাত্রের সঙ্গে আমিও সেদিন আশ্রয় পেয়েছিলাম রাঙা পিসীমার কাছে। বাড়ির সরকারমশাই থেকে শুরু করে আমরা সবাই তাকে রাঙা পিসীমা-ই বলতাম। আশ্রিত লোক ও-বাড়িতে তখন কম ছিলো না। আত্মীয়ের মধ্যে রাঙা পিসীমার এক বিধবা ননদ, যাকে আমরা বুড়ীদি বলতাম; রাঙা পিসীমার এক মামা, যাঁকে আমরাও মামাবাবু বলতাম ; আর বড়দির আধ ডজন ছেলেমেয়ে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মেয়েটার নাম ছিলো মিনু।

রাঙা পিসীমা থাকতেন দোতলার একটি ঘরে; বড়দি কিংবা মামাবা্বুর সঙ্গে তাঁর দেখা হতো দু-চারটি কথা হতো, শুধু ভোরবেলায় যখন গঙ্গাস্নানে যেতেন। | রাঙা পিসীমার চেহারা ছিলো পটের প্রতিমার মতো। লম্বা দোহারা গড়ন, ফরসা ধবধবে রঙ, নাকের ওপর গঙ্গা মৃত্তিকার রসকলি। ললিপাড় গরদের শাড়ি পরতেন সব সময়, গায়ে থাকতো একটা নামাবলী। কানের পাশে চুল তাঁর তখনই অর্ধেক সাদা হয়ে গেছে।

রূপ, কিন্তু সরকারমশাই বলেছিলেন, রাঙা পিসীমার মতো দুঃখের জীবন নাকি কারও হয় না।  দুঃখটা কিসের জানতে পারলাম হঠাৎ একদিন। কলেজ থেকে সবে ফিরেছি, মিনু এসে বললে, মামীমা তোমাদের ডাকছে। আমরা তিনজন আশ্রিত বালক সড়সড় করে দোতলায় উঠে গেলাম। গিয়ে দেখি বাক্সবিছানা বাধা হচ্ছে, রাঙা পিসীমা কোথাও যাবেন হয়তো।

বাক্স গুছাতে গুছাতে ফিরে তাকিয়ে বললেন, দু’ দিনের জন্যে কাশী যাচ্ছি, একটু সাবধানে থাকিস তোরা।

সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লাম। আবার বললেন, কিছু অসুবিধে হলে তোদের বড়দিকে বলিস, কেমন ? এবারও ঘাড় নাড়লাম।

তারপর একসময় ফিটনে চড়ে রাঙা পিসীমা চলে গেলেন। আর রাঙা পিসীমা চলে যেতেই মিনু এসে ফিসফিস করে বললে, মামীমা কোথায় গেলেন জনো?

উত্তর দিলাম, কোথায় আবার, তীর্থে।

মিনু, বেণী দুলিয়ে মাথাটা একবার বাঁ দিকে, একবার ডান দিকে হেলিয়ে বললে, উঁহু। কিচ্ছু জানো না।

বললাম, কোথায় গেলেন তবে?

মিনু, ফাজিল মেয়ের মতো হাসি চেপে বললে, বরকে খুঁজতে। আমার ছোটমামা তো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন, তাঁকে খুঁজতে গেলেন।

মিনুর কাছেই সেই প্রথম শুনলাম রাঙা পিসীমার ইতিহাস।

পনেরো বছর বয়সে নাকি বিয়ে হয়েছিলো রাঙা পিসীমার। ভালো ঘরে, ভালো পাত্রে। কিন্তু বিয়ের আগে যেটা ভালো মনে হয়েছিলো সেইটাই হলো কাল। এমন সুন্দরী বউ, এমন রাজার মতো ঐশ্বর্য, কিন্তু রাঙা পিসীমার স্বামীর নাকি এসবের দিকে টান ছিলো না।

টান ছিলো এক তান্ত্রিক গুরুর দিকে। পুজো-আর্চা করতেন, তারপর হঠাৎ এক-এক দিন উধাও। আবার ফিরে আসতেন দু-দশ দিন পরে।

প্রথম প্রথম সবাই খোঁজাখুঁজি করতো, কিন্তু তারপর তাও বন্ধ হলো। সকলেই জানতো দু দিন পরই ফিরে আসবেন। কেউ বলতো, মাথায় ছিঁট আছে; কেউ বলতো ও জন্মবৈরাগী, গেরুয়া দেখলেই ওর মন ঘর ছেড়ে পালাতে চায়। ও ঠিক সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাবে একদিন। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। বিয়ের পর তিনটে বছরও কাটেনি তখন, হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হলেন রাঙা পিসীমার স্বামী।

রাঙা পিসীমা ভেবেছিলেন, মাসখানেক পরেই ফিরে আসবেন। কিন্তু মাস থেকে বছর কেটে গেল, তবু ফিরে এলেন না। তখন সরকারমশাইকে পাঠানো হলো তারকেশ্বরে সেই তান্ত্রিকের আশ্রমে।

সরকারমশাই মুখ কালো করে ফিরে এলেন। না, পাওয়া যায়নি দুজনের একজনকেও। না তান্ত্রিককে, না রাঙা পিসীমার স্বামীকে।

মুখ শুকিয়ে গেল রাঙা পিসীমার, সবাই বিব্রত হয়ে উঠলো। চিঠির পর চিঠি গেল। আত্মীয়স্বজনদের নামে, কেউ যদি হদিস দিতে পারে। কিন্তু কেউ খবর দিতে পারলো না।

গয়া, কাশী, বৃন্দাবন-তীর্থে তীর্থে ঘুরে এলেন রাঙা পিসীমা, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে কি হারানো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় ? রাঙা পিসীমার মুখের হাসি নিবে গেল। সেই যে পুজোর ঘরে ঢুকলেন, তারপর থেকে শুধু নামকীর্তন আর পুজোপার্বণ। বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথাবার্তাও একরকম বন্ধ হয়ে গেল। মেলামেশা বন্ধ হলো আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে।

ফিসফিস করে রাঙা পিসীমার ইতিহাস বলেছিলো মিনু, সমবেদনায় ওর গলার স্বরও বুঝি ভারি হয়ে এসেছিলো। এমন সময় হঠাৎ বলে উঠলো, এই রে, সরকারমশাই…।

বলেই ছুটে পালালো।

সরকারমশাই ঘরে ঢুকেই পটপট করে জামার বোতাম ক’টা খুলে দিয়ে হাতপাখাটা নিয়ে। বুকে হাওয়া করতে শুরু করলেন।

তারপর হঠাৎ যেন নিজের মনেই বললেন, এই নিয়ে বোধহয় দুশো পু্রো হলো। বুঝতে না পেরে তাকালাম তার মুখের দিকে।

উত্তর এলো দুশো বার এমনি উড়ো খবর এসেছে। আত্মীয়স্বজন কেউ গয়া কি বৃন্দাবন বেড়াতে গেছে, আর সেখান থেকে চিঠি লিখেছে, সাধুদের আড্ডায় দেখলাম, মনে হলো যেন অমুক। রাঙা পিসীমাও তেমনি মানুষ, যে যা বলে বিশ্বাস করে বসেন। আর যত ঝামেলা আমার, ‘সরকারমশাই, ব্যবস্থা করে দিন, যাই একবার, স্বচক্ষেই দেখে আসি।’

জিগ্যেস করলাম, এবারও বুঝি খবর পেয়েই গেলেন?

সরকারমশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ। দুশো বারই খবর পেয়ে গেছেন, কিন্তু কখনো হয়তো সা্ধুর হদিসই মেলেনি, কখনো গিয়ে দেখেছেন, সম্পূর্ণ অন্য লো্ক। এবারেও দেখো, তাই হবে।

সরকারমশাই যা বলেছিলেন তাই হলো। দিনকয়েক পরেই থমথমে মুখ করে ফিরে এলেন রাঙা পিসীমা। পাওয়া যায়নি। পাওয়া যে যাবে না তা যেন সকলেই জানতো। জানতেন না শুধু রাঙা পিসীমা।

আগের মতোই আবার তেমনি নামাবলী গায়ে দিয়ে নাকে কপালে গঙ্গামাটির তিলক কেটে গনগন করে গান শুরু করলেন সকাল থেকে সন্ধ্যে।

হঠাৎ একদিন দেখি কি, দোতলার বারান্দায় একজন জ্যোতিষীর সামনে বসে একমনে কি যেন শুনছেন রাঙা পিসীমা।

সরকারমশাই হেসে বললেন, ওই তো কাজ। একবার শুনলে হলো অমুক জায়গায় ভালো জ্যোতিষী আছে, অমনি হুকুম হবে, ‘যান তো সরকারমশাই, একবার নিয়ে আসুন তাঁকে।’

সেদিনও এমনি রাগে গজগজ করতে করতে সরকারমশাই এসে হাজির হলেন। বললেন, আমার হয়েছে যত ঝামেলা। কে খবর দিয়েছে বাশবেড়েতে ভালো গনৎকার আছে, তাঁকে আনতে হবে এখন।


আরো পড়ুন: ভারতবর্ষ । রমাপদ চৌধুরী

সরকারমশাই চলে গেলেন, আর মিনুর কাছে শুনলাম ব্যাপারটা। দিনের পর দিন এমনি একজন-না-একজন জ্যোতিষী আসে। নিজের আর স্বামীর দুখানা কুষ্ঠী মেলে ধরে আলোচনা হয়। আজেবাজে অনেক কথা বলে যায় গনৎকার কিন্তু সেদিকে কান থাকে না রাঙা পিসীমার। শুধু, একসময় ফিসফিস করে জিগ্যেস করেন, দেখু্ন তো ভালো করে উনি কবে ফিরে আসবেন।এক-একজন এক-একটা তারিখ বলে, তা শুনে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন রাঙাপিসীমা। হয়তো পাঁজি দেখে দিন গোনেন, তারপর সে তারিখ পার হয়ে যায়। কেউ আসে না। ফিরে আসে না রাঙা পিসীমার স্বামী।  তখন আবার নতুন জ্যোতিষীর খোঁজ পড়ে। এমনিভাবেই বছরের পর বছর কেটে গেছে রাঙা পিসীমার, এমনিভাবেই বছর কেটে চলে। কখনো স্বামীর খোঁজে তীর্থে তীর্থে ছুটে বেড়িয়ে, কখনো জ্যোতিষীর দেওয়া তারিখের দিকে তাকিয়ে। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো রাঙা পিসীমার, স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছিলো তাঁর আঠারো বছর বয়েসে। তারপর তার পথ চেয়ে অপেক্ষা করতে করতে কখন তাঁর কানের পাশে চুল সাদা হয়ে গেছে, মুখে বয়সের রেখা পড়েছে, তা বোধ হয় রাঙা পিসীমা বুঝতেও পারেননি। এমন সময় হঠাৎ একদিন ভোরবেলায় হইচই হট্টগোল শুনে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দ শুনে ভেতর-বারান্দায় ঢুকে দেখি ঝি চাকর সরকারমশাই সবাই আনন্দে হইচই জুড়ে দিয়েছে। আর হাসিমুখে প্রৌঢ় গোছের একটি গেরুয়া-পরা লোক গাড়ুর জলে পা ধুচ্ছে। সকলেই যেন লোকটাকে তোয়াজ করতে ব্যস্ত। কেউ জলের জন্যে ফরমাশ করলো, কেউ তোয়ালে এনে দিলো, কেউ বা আসন পেতে দিলো।

সরকারমশাইকে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে বললাম, কে উনি, নতুন জ্যোতিষী বুঝি? একগাল হেসে সরকারমশাই বললেন, বড়বাবু গো, রাঙা পিসীমার স্বামী। ফিরে এসেছেন? বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন দপ করে উঠলো। তা হলে শেষ পর্যন্ত স্বামীকে ফিরে পেলেন রাঙা পিসীমা? আনন্দ সমস্ত শরীর যেন থরথর করে কেপে উঠলো। এ যেন শু্ধু, রাঙা পিসীমার আনন্দ নয়, আমাদেরও আনন্দ। খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এলো বড়দি। ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বললে, এতকাল পরে আমাদের মনে পড়লো দাদা!

রাঙা পিসীমার স্বামী আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাত তুলে লজ্জার হাসি হাসলেন। মামাবাবুও ছুটে এলেন, পরস্পর পরস্পরকে কুশল প্রশ্ন করলেন।

মিনুরা আধ ডজন ভাইবোন ভয়ে ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো বুড়ীদির ইশারায় তারা একে একে এসে প্রণাম করলো।

এমন সময় সরকারমশাই বলে উঠলেন, আরে, আসল লোকই যে আসেনি। রাঙা পিসীমাকে খবর দিয়েছো?

তাই তো! রাঙা পিসীমা কি এখনো ঠাকুরঘরে? কিছুই জানেন না ? সরকারমশাই আমাকেই কাছে পেয়ে বললেন, যাও, যাও, খবর দিয়ে এসো।

ছুটে গেলাম। এমন একটা শুভ সংবাদ জানাবার ভার পেয়ে যেন খুশী হলাম। কিন্তু সিড়িতে পা দিয়ে ওপরে তাকাতেই চমকে উঠলাম।

পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাঙা পিসীমা। ঠিক সিঁড়ির মাথায়। আমাকে দেখতে পেয়েছেন মনে হলো না। মুখের ভাব বদলালো না একটুও।

ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলাম, কিন্তু রাঙা পিসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভয়-ভয় করতে লাগলো।

কাছে গিয়ে দাঁড়াতে রাঙা পিসীমা বললেন, চল। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন রাঙা পিসীমা। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সবাই দূরে সরে গেল। স্থির চোখে গেরুয়া-পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন রাঙা পিসীমা। তারপর বললেন, এ কে? এ কে সরকারমশাই? আমি তাে চিনতে পারছি না।

সকলেই চমকে উঠলো। সরকারমশাই বললেন, চিনতে পারছেন না কি রাঙা পিসীমা! বড়বাবু, বড়বাবু আমাদের। রাঙা পিসীমা গম্ভীর গলায় বললেন, না। বুড়ীদি চিৎকার করে উঠলো দাদাকে চিনতে পারছো না? তেমনি গভীর গলায় উত্তর এলো ‘না’।

মামাবাবুও কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই রাঙা পিসীমা চিৎকার করে উঠলেন, না, না, সে নয়, সে নয়। দুর করে দাও ওকে, দুর করে দাও।

বলেই ছুটে দোতলার সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন রাঙা পিসীমা। সশব্দে কপাট বন্ধ করে দিলেন। গেরুয়া-পরা লোকটার মুখখানা ম্লান দেখালো। অভিমানের স্বরেই চলে যেতে চাইলেন তিনি। বুড়ীদি, মামাবাবু সরকারমশাই অনেক বোঝালেন, তারপর নীচের একখানা ঘরে বিছানা পেতে দিলেন তাঁর জন্যে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

রাঙা পিসীমা কিন্তু কপাট খুললেন না সন্ধ্যে পর্যন্ত। সন্ধ্যেবেলায় একা একা গিয়ে টোকা দিলাম দরজায়। কপাট খুলে দিলেন রাঙা পিসীমা! দেখলাম, দেখে শিউরে উঠলাম। এক বেলার মধ্যে এ কি চেহারা হয়েছে রাঙা পিসীমার ! বুঝলাম, সারাটা দিন কেঁদছেন পড়ে পড়ে। রাঙা পিসীমা চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলেন, চলে গেছে ? চলে গেছে সে? বললাম, না।

চিৎকার করে উঠলেন রাঙা পিসীমা।—চলে যেতে বল চলে যেতে বল এখনি। যেন রাগে ফেটে পড়লেন।

বললেন, যার কথা সারা জীবন ভেবেছি, যার খোঁজে সারা জীবন কেটে গেছে, সে যদি সত্যিই একদিন এসে হাজির হয় একেবারে অন্য চেহারা নিয়ে, সত্যিই যদি ফিরে আসে, সে যে কি অসহ্য তোরা বুঝবি না, তোরা বুঝবি না। ওরে, আজ বুঝতে পেরেছি, তাঁর কথা ভাবতে চাই, তাঁকে চাই না আর।

বলে আবার বিছানার উপর লুটিয়ে পড়লেন রাঙা পিসীমা।

রাঙা পিসীমাকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম, বিছানার ওপর বড় একখানা ফটো পড়ে রয়েছে। দেখেই বুঝলাম, রাঙা পিসীমার স্বামীর ছবি। একুশ-বাইশ বছরের একটি সুন্দর মুখ সে ছবিতে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আপনা থেকেই। বুঝতে পারলাম, যে চলে গিয়েছিলো তার সঙ্গে, যে ফিরে এসেছে তাঁর মিল নেই। কোনো মিল নেই। মানুষটাই শুধু এক।তবু গেরুয়া-পরা লোকটাকে, রাঙা পিসীমার স্বামীকে, বড়দি, মামাবাবু সরকারমশাই ধরে রাখলেন।

সকলেরই বিশ্বাস ছিলো রাঙা পিসীমার রাগ পড়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করতে সেই যে বেরিয়ে গেলেন রাঙা পিসীমা, আর ফিরে এলেন না। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে সরকারমশাই বেরিয়ে গেলেন রাঙা পিসীমার খোঁজে।

আত্মীয়স্বজনদের কাছে চিঠি লেখা হলো থানায় খবর দেওয়া হলো কিন্তু হদিস মিললো না রাঙা পিসীমার।

মাসখানেক পরে পরীক্ষা পাস করে জব্বলপুরে চলে গিয়েছিলাম একটা চাকরি নিয়ে। বহু বছর বাদে সেদিন হঠাৎ গিয়ে দেখি, লোহার ফটকে একটা বড় তালা ঝুলছে, মরচে ধরে গেছে তালাটায়। ও বাড়ির খবর জিগ্যেস করতে চোখ কপালে তুললো আশপাশের লোক। বললে, সে কি, ও বাড়িতে লোক ছিলো নাকি কখনো? ও তো ভুতুড়ে বাড়ি! কেউ বললে, মাঝরাতে কান্নার শব্দ ভেসে আসে অনাদি-নিবাস থেকে; কেউ বললে, জ্যোৎস্না-রাতে ও বাড়ির ছাদে ফটফটে একটি মেয়ে সাদা থান পরে ঘুরে বেড়ায়।

কিন্তু আমি জানি, ও বাড়ির হাওয়ায় যদি কোনো নারীর প্রেতাত্মাও থাকে, তাকে মানুষ ভয় পাবে না, তার দুঃখে চোখে জল আসবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত