।।অ পূ র্ব বি শ্বা স।।
রমাপদ চৌধুরী নামটা একেবারে ছোটবেলায় শোনা, তবে সেটা কোনো সাহিত্য রচনার সূত্রে নয়, সিনেমার গল্পকার হিসেবে। চলচ্চিত্রকার তপন সিংহের একটি অসামান্য ছবি ‘বালামাটি’। তপন সিংহের একেবারে প্রথম দিকের কাহিনিচিত্র। ছবিটা কিন্তু আজও দেখা হয়নি আমার, এখন আর খুঁজেও পাওয়া যায় না এই ছবির কোনো প্রিন্ট। বাড়ির বড়দের মুখে খুব শুনতাম এই ছবিটর কথা, ছবির গল্পটাও শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কয়লাখনির শ্রমিকদের দুঃসহ যাপন, যন্ত্রণা আর ভালোবাসার কাহিনি। ছবিটা তৈরি হয়েছিল রমাপদ চৌধুরীর ছোট গল্প ‘বিবিকরজ’ অবলম্বনে। কয়লা শ্রমিকদের সন্তানদের পালনের জন্য খনি অঞ্চলে গড়ে ওঠে একটি বেবিক্রেশ – এই বেবিক্রেশেরই অপভ্রংশ ‘বিবিকরজ’। ছবির গল্প শুনতে শুনতেই বুঝতে পারতাম, একটা আশ্চর্য মানবিকতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে এই রচনাটিতে। আছে মনকেমন করা এক বিধুরতা। অনেক বড় হয়ে পড়ছি , ‘বিবিকরজ’।
এরপর কলেজ জীবনেই রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাসগুলো একটার পর একটা পড়ে ফেলি – প্রত্যেক পুজোসংখ্যা পত্রিকায় তাঁর নতুন নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। পিকনিক , খারিজ , যে যেখানে দাঁড়িয়ে, অভিমন্যু, বীজ, বনপলাশির পদাবলী। বেশিরভাগ উপন্যাসই স্বল্পায়তন, দু-এক ঘন্টার মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলা যায়। ‘বনপলাশির পদাবলী’ অবশ্য দীর্ঘ রচনা। যে মধ্যবিত্ত পরিসরে, মূল্যবোধে আমরা বেড়ে উঠেছি, তার পুরো অন্তর্বয়ানটা যেন রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাসে ফুটে উঠতে থাকে এক আশ্চর্য শিল্পিত শৈলীতে।
‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ পুরোনো স্মৃতির উন্মোচনে অসামান্য অভিঘাত আনে। কলকাতার বাইরে ছোটনাগপুরের এক নির্জন প্রান্তে বেড়াতে এসেছে প্রান্তযৌবনের নায়ক স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে। সেখানেই হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার তরুণ বয়সের প্রেমিকার সঙ্গে, সেও সপরিবারে এসেছে হাওয়াবদলের জন্য। দুই পর্যটক পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠা তাৎক্ষণিক সম্পর্ক। ছোট ছোট অবকাশে, আলাপনে প্রায় প্রৌঢ় দুই মানবমানবী হারানো স্মৃতির উন্মোচনে ক্রমশ নিমগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে, দুজনেই বুঝতে পারে তাদের সাম্প্রতিক যাপন, সংসার জীবন সব পেরিয়ে আর পুরোনো সম্পর্কে ফেরা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজের স্বতন্ত্র বৃত্তে বন্দী। এই অসহায়তা, এই দ্বান্দ্বিকতা , এই স্মৃতিময়তা নিয়েই তারা ফিরে যায় তাদের দৈনন্দিনে। রমাপদ চৌধুরী নিবিড় মমতায় অথচ নৈর্ব্যক্তিক এক জীবনবোধ নিয়ে চরিত্রগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন মনস্তাত্ত্বিকতার প্রচ্ছদে।
শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনেরই আরেক বিচিত্র ছবি ধরা পড়েছে ‘এখনই’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসের সব চরিত্রই তরুণ, কলেজ পড়ুয়া। তাদের বেড়ে ওঠা, প্রতিদিনের বেঁচে থাকা, বন্ধুত্ব-প্রেম, পম্পর্কের নানা টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলে কাহিনি। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে উর্মির অসহায়তা, একাকিত্ব, প্রেমে প্রবঞ্চিত হওয়া, আর শেষ পর্যন্ত তার পাশে এসে দাঁড়ানো সহপাঠী বন্ধু অরুণের দায়িত্ববোধ ও সাহসিকতা কাহিনিতে নতুন একটা মোচড় আনে। কিন্তু রমাপদ চৌধুরী কোনো আরোপিত আদর্শবাদ বা নীতিবোধের মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করেননি, বরং সত্তর দশকের সমীপকালীন বাস্তবতাই নির্মোহভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘খারিজ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট আরো একটু বিস্তারিত। কাহিনির বৃত্তে আছে কলকাতার এক মধ্যবিত্ত দম্পতি আর সুদূর গ্ৰাম থেকে আসা গরিবকিশোর পলান। পরপর কদিন ধরে চলা শৈত্যপ্রবাহ, শীতে জবুথবু শহর কলকাতা আর কাজের ছেলে পলানের কুঁকড়ে যাওয়া একেবারে চলচ্চিত্রের অনুপুঙ্খতায় ফুটিয়ে তোলেন
ঔপন্যাসিক রমাপদ। রান্নাঘরের উনুনের ধারে শুয়ে থাকা জানলাহীন বদ্ধঘরে একরাতে পলান মারা যায়। তার মৃত্যু নিয়ে দম্পতির মধ্যে অপরাধবোধ আর আত্মপক্ষ সমর্থনের দ্বন্দ্বই কাহিনিবৃত্ত। রমখপদ চৌধুরীর নির্মোহ বিশ্লেষণে ধরা পড়ে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী, পলায়নবাদী কুৎসিত মুখের উপদ্রুত ছবি। পলানের মৃত্যু আমাদের আহত এবং মথিত করে, যদিও দারিদ্রের প্রতি কোনো আরোপিত আলটপকা সহানুভূতি ব্যক্ত হয়নি।
‘বীজ’ উপন্যাসর গঠনশৈলী একেবারে ভিন্ন। এক অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ় অধ্যাপকের আকস্মিক অন্তর্ধান ঘিরে গড়ে ওঠে তীব্র অনুসন্ধানী কাহিনিবৃত্ত। তার ভরন্ত সংসারে আপাত সুখ, অবকাশ এবং শান্তির আবহ ছিল। তবু কেন এই অন্তর্ধান! অধ্যাপকের ডায়েরির পাতায় পরিজনেরা খুঁজে পায় এক ছাত্রীর নাম। প্রশ্ন ওঠে , তাহলে কি কোনো বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে গৃহকর্তা ঘর ছেড়েছেন? এমন নানা প্রশ্নের সংশয়, অনুমান, প্রশ্নে ভারাতুর এক মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে নিষ্ঠুর ঔপন্যাসিকের জীবনবোধ, মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ, প্রশ্নকাতর আধুনিকতা উপন্যাসটিকে দুর্লভ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
‘পিকনিক’ আপাতভাবে প্রেমের উপন্যাস হলেও রমাপদ চৌধুরী তিনজোড়া যুবক-যুবতীর ভাবনা আর মনস্তত্ত্বকে সময়ের প্রেক্ষায় ধরতে চেয়েছেন। শহর ছাড়িয়ে রূপনারায়ণ নদীর ধারে তাদের সম্পর্কের রসায়ন প্রতিমুহূর্তে বদলে যেতে থাকে। একটা সময় তিন সহপাঠী বন্ধু ইতি-রাখী-নন্দিতা অনুভব করতে পারে, কেবল একটা দিন কয়েক ঘন্টার মধ্যে কোনো গূঢ় মানবিক সম্পর্ক বা বিনিময় তৈরী হয় না। তাই শহরে ফিরে গিয়ে ক্রমশ ফিকে হয়ে যায় এই পিকনিকের সম্পর্ক।
রমাপদ চৌধুরীর লিখনশৈলীও সময়ের প্রেক্ষাপটে আদ্যন্ত আধুনিক। এমন স্বচ্ছন্দ চলিত গদ্যের ব্যবহার, অথচ সেই রীতিরই মধ্যে দিয়ে ব্যঞ্জনাগর্ভী ও লিরিকধর্মী বাক্যবিন্যাস বিস্মিত করে। চরিত্রের সংলাপ রচনায় তাঁর সিদ্ধি প্রায় অতুলন। পড়তে পড়তে মনে হয়, এ যেন নাটকের অথবা চলচ্চিত্রের সংলাপ। তাঁর নির্মেদ লিখনশৈলীর মধ্যে যে অন্তর্বয়ন, সংলাপের যে কথ্যভঙ্গি, তা যেন চলচ্চিত্রের নিপুণ চিত্রনাট্য। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই তাঁর অনেকগুলি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।
‘পিকনিক’, ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’, ‘খারিজ’, ‘এখনই’,‘বীজ’(একদিন আচানক),‘বনপলাশির পদাবলী’, ‘অভিমন্যু’( এক ডক্টর কি মওত)। তপন সিংহ এবং মৃণাল সেনের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালকেরা তাঁর নাম একাধিক কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যেগুলো বিপুলভাবে সমাদৃত।
রমাপদ চৌধুরী গ্ৰামীণ সমাজ ও মানুষের সম্পর্কের অন্তর্বয়ন নিয়ে দু-একটি উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বার্থে নাগরিক মননের কথাকার। বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজ নিয়ে তাঁর নির্মোহ অন্তর্তদন্ত কেবল শিল্পিতই নয়, সমাজ বীক্ষণেও অতুলন। তার স্বল্পায়তন, নির্জর, নির্মেদ রচনাগুলি অতিকথন ভারাক্রান্ত বাংলা উপন্যাসের পরিসরে নতুন সংযোজন। বাজারশোভন বানিজ্যিকতা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তিনি কথাশিল্পে যে নতুন একটি পথ নির্মাণ করতে ব্রতী হয়েছিলেন, তার সদর্থকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উচ্চারিত হতে পারে না।