ভাসাবো দোঁহারে: রামী-চন্ডীদাস মিথ না সত্যি । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চতুর্দশ শতকের অন্যতম মধ্যযুগীয় বাঙালি কবি হলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা চন্ডীদাস। জাতপাত সব ভুলে যিনি লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি“ “শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।”
অথবা কীর্তন গানের ভণিতায় আশ্রয়ে সেই সুললিত পদ? “কহে চণ্ডীদাস, কানুর পীরিতি – জাতিকুলশীল ছাড়া।”
মথুরা-বৃন্দাবনে যেমন কানু বিনে গীত নাই, তেমনি পশ্চিমবাংলার নানুর মানেই চণ্ডীদাস! এ নেহাত মিথ নয়,মিথ্যেও নয়। নানুর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের জীবন, যাপন, সাহিত্য চর্চা আর প্রেমকথা।
বাংলা সাহিত্যের একাধিক চণ্ডীদাস নামের কবির পরিচয় নিয়ে আধুনিক পণ্ডিতরা দ্বিধাগ্রস্ত। এঁদের একজন বাঁকুড়ার ছাতনার অধিবাসী অন্য জন বীরভূমের নানুরের। আবার অনেকে বলেন, এই দুই চণ্ডীদাসই এক।
সেকালের নানোর বা অধুনা নানুরে চণ্ডীদাসের জন্ম আর তাঁর পদবি ছিল ‘বাঁড়ুজ্জে’ বা ‘বন্দোপাধ্যায়’৷ তাই বুঝি তিনি বড়ু চণ্ডীদাস আখ্যা পান ৷ অভাবের তাড়নায় নানুরের ভিটেমাটি ছেড়ে বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। সেখানে পণ্ডিতগিরি করে সামান্য কিছু অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পেট চালাতেন ৷
বৈষ্ণব সাহিত্যে দ্বিজ চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস এবং বড়ু চণ্ডীদাস নামে ৪ জন পদকর্তার উল্লেখ সব চেয়ে বেশি মেলে। কোনও সাহিত্যের গবেষক আবার বলেন, চারজনই নাকি একই ব্যক্তি।
কারোর মতে যে পদকর্তার বিভিন্ন রচনায় নানুরের কথা ঘুরে ফিরে এসেছে তিনিই নানুরের চণ্ডীদাস। আজ সেই চণ্ডীদাসের জনশ্রুতি নিয়ে লিখছি যার সঙ্গে রামি এবং নানুরের ছিল গভীর সংযোগ।
নানুরের চণ্ডীদাসের স্বতন্ত্র পরিচিতি ঘটেছে রামি চণ্ডীদাসের প্রেম কাহিনীর মাধ্যমে। তাঁদের গল্প আখ্যায়িত হয়েছেন নানা জনের লেখায়। স্বভাবতই কবির পাশাপাশি তাঁর প্রেমিকাকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন এলাকার মানুষ।বিখ্যাত হয়েছে নানুর। ধন্য হয়েছে বীরভূমির মাটি।
বীরভূমের এক প্রত্যন্ত নানুর গ্রাম হ’ল চন্ডীদাসের পিতামহের বাস্তুভিটে। অভাবের তাড়নায় কিছুকাল বাঁকুড়া জেলার ছাতনা বা ছত্রিনা গ্রামে বাস করেন তিনি। চরম অভাব সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী পদ্মজা তাঁকে ছেড়ে নানুরের অদূরে কীর্ণাহার গ্রামে পিত্রালয়ে চলে যান। চন্ডীদাস তখন গৃহত্যাগ করে পদ লিখে কথকতা করে বেড়ান ।
মাধুকরী হয় তাঁর উপজীবিকা । দিনের শেষে নিজেই ফুটিয়ে নেন ভিক্ষার অন্ন । কিন্তু তার ফাঁকে নিজের জন্মভিটে নানুরের প্রতি তাঁর অদম্য টান।
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন রাজ দরবারে নিজের ভুর্জ্যপত্রের পুঁথিখানি খুলে বিনা প্রস্তুতিতে ঝুমুর গান শুনিয়ে রাজাকে তৃপ্ত করেন। আর তখনি রাজার কুলদেবী বিশালাক্ষী বা বাশলী দেবীর মন্দিরে পৌরোহিত্য করার ভার দেন তাঁকে। মন আর প্রাণ এক করে চন্ডীদাস তখন শ্রীকৃষ্ণকথার পরপর পর্বগুলির পদ আওড়ান মনেমনে আর সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলতে থাকেন। রাজানুগ্রহে আশ্রয় পান মন্দির সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঘরে।
এই সেই টিলা যার ওপরে এখন শিমূল গাছ। কথিত আছে চন্ডীদাসের ভিটে এই টিলার নীচে বসে গেছে কালের স্রোতে।
একদিন ঘোর অমাবস্যা তিথির করাল অন্ধকারে কবি চন্ডীদাস স্বপ্নাদেশ পেলেন বাশলীদেবীর কাছ থেকে ।
তারপর তুলে নিলেন বহুদিনের অব্যবহৃত কর্ণিকাখানি । একটুকরো ভুর্জ্যপত্র প্রদীপের আলোয় ধরে পদ লিখতে শুরু করলেন।
“বন পোড়ে আন বড়ায়ি জগজনে জাণী
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী।
আন্তর মুখাএ মোর কাহ্ন-অভিলাসে
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে।”
এ যাবতকাল পদরচনায় যে ভাটা পড়েছিল রাজার অনুগ্রহে আশ্রয় এবং অন্নের চিন্তা করতে না হওয়ার কারণে পুনরায় কাব্যচর্চার পরিস্ফূরণ হতে লাগল মনের সুখে।
সেইথেকে আবার শুরু হয়ে গেল নিয়মিত কাব্যচর্চা । একের পর এক লিখে চলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখন্ড, ছত্রখন্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালীয়দমনখণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখন্ড, বাণখন্ড এবং বিরহখন্ড।
নানুরের প্রাচীন মন্দিরে বাশলীদেবীর বিগ্রহ তখন পুজো করতেন চন্ডীদাস স্বয়ং।
কারোর মতে স্থানীয় গ্রাম্য কন্যা রজকিনী রামি বা রামিণী ছিলেন বাশলী মন্দিরের এক দেবদাসী। অপূর্ব মুখাবয়ব, বিদ্যুতলতার মত তনুশ্রী তার। কুয়ো থেকে প্রতিদিন সকালে জল তুলে মন্দির ঝাঁট দেয় সে । ঠাকুরের বাসনকোসন ঝকঝকে করে মাজে। মন্দিরের ভোগ নিতে এসেছিল একবেলায়। তখনই তথাকথিত ‘অছ্যুত’ ধোপানির সঙ্গে চন্ডীদাসের আলাপ হয়ে যায়।
আধুনিক কালে তাঁদের যুগল মুর্তি নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ সব হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। যে ঘাটে রামি কাপড় কাচতেন সম্প্রতি স্থানীয় বিধায়কের এলাকা উন্নয়নের টাকায় সেটিও মর্যাদা পেয়েছে। পুকুরঘাটের নাম হয়েছে রজকিনীর ঘাট। যে পাটাতে রজকিনী কাপড় কাচতেন সেটিও সযত্নে রাখা আছে, পুকুরপাড়ে, ঘাট লাগোয়া রক্ষাকালী মন্দিরের পাশে। যেটি WBTDC রক্ষণাবেক্ষণ করছে এখন।
কথিত আছে, রামী যখন ঘাটে কাপড় কাচতেন, তখন ছিপ হাতে পুকুর পাড়ে বসে থাকতেন চণ্ডীদাস মাছ ধরার অছিলায়। রামিণীর অস্বস্তি হওয়ায় তিনি বলতেন, দেবীর ভোগের জন্য মৎস্য ধরছেন… এই ঘনিষ্ঠতা অবশ্য জমিদার এবং সেই সময়ের সমাজপতিরা ভাল চোখে দেখেন নি। কবি রামীকে ত্যাগ না করলে চণ্ডীদাসের বাবার সত্কার করতে পর্যন্ত অস্বীকার করে সে সময়ের সমাজ। কিন্তু রামীকে ত্যাগ করেননি চণ্ডীদাস। দু’জনের এই অনুরাগ দেখে অবশেষে রামীকে চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন সবাই।
কেউ বলেন নানুরের অদূরে তেহাই গ্রামে সেই রজকতনয়ার বাস। পিতৃমাতৃহীনা (মতান্তরে রামি একজন বাল্য বিধবা) জমিদারের নির্দেশে গ্রামদেবী বিশালাক্ষীর মন্দিরে পরিচারিকার কাজে বহাল হন। এই রামিণির প্রতি সেই থেকেই ভালোলাগা এবং তার পরিণতি সার্থক প্রেমে। তখন বাশলীদেবীর পুজো করতে গিয়ে চণ্ডীদাসের সেই মূর্তির মুখাবয়ব দেখলেই মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় সেই রজকিনী রামির মুখ। যেন অবিকল এক মুখশ্রী! আশ মেটেনা রামিকে দেখে। এত রূপ আছে, এত যৌবন মেয়ের কিন্তু কর্মে কখনো অনীহা নেই । হাসিমুখে মন্দিরের কাজ করে চলে অদ্ভুত পারিপাট্যে।
ভোরের পুবের আলোতে রামির রূপ একরকম। চাঁদের জ্যোত্স্নায় তাকে দেখলে সর্বাঙ্গ অবশ করা এক অনুভূতি হয়। আবার অমাবস্যার অন্ধকারে সেই নারীমূর্তি যেন আচ্ছন্ন করে রাখে কবি চন্ডীদাসকে। রামি যেন তরতাজা কৃষ্ণকলি ফুল। কালো মেয়ের এতরূপ! কাজলকালো আঁখি, নিটোল কোমল পেলব গড়ন। আর চেহারায় যেন কী একটা যাদু আছে। চন্ডীদাস দিনে দিনে ক্রমশঃ উপলব্ধি করেন রামির এই রূপ রহস্য। এই মেয়েকে দেবীমূর্তির মত মনে হয় তাঁর । দেবী বাসলী এবং রামিণী দুইই যেন তাঁর চালিকা শক্তি।
লিখে ফেলেন…
রজকিনী-রূপ কিশোরী স্বরূপ কাম-গন্ধ নাহি তায়
রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম বড়ু চন্ডীদাস গায় ।।
কখনো এই নারীমূর্তিকে তাঁর মনে হয় নিজের সৃষ্ট বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধিকা আবার কখনো তাকে মনে হয় বাশলি দেবীর প্রতিমূর্তি। এক একদিন রাতে স্বপ্ন দেখেন তাঁর। তীব্র কামপিপাসা জাগে শরীরে। স্ত্রী পদ্মজাকে কিছুই দিতে পারেননি তিনি। মনের দুঃখে চলে গেছে তাকে ছেড়ে।
বহুদিন নারীসঙ্গ বিবর্জিত একঘেয়ে জীবন তাঁর। অথচ পূর্ণ যৌবন তাকে এখনো ছেড়ে যায়নি। পদ্মজা রূপবতীও ছিলনা। তবুও তো সতীলক্ষ্মী ছিল । তাকে ভুলতেও পারেন নি কবি। নিজের দোষে ক্ষমা চেয়ে নেন দেবীর কাছে। কিন্তু সেরাতের স্বপ্নে একবার আসেন রামি একবার অসেন স্বয়ং দেবী।
কেন এমন হয়?
তাই বুঝি লিখেছিলেন
“ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন, কেহ না জানয়ে তারে।
প্রেমের আরতি যে জন জানয়ে সেই সে চিনিতে পারে।।”
কাপড় কাচার পাটার মত চন্ডীদাসের ভিটে সংলগ্ন পনেরটি টেরাকোটা শিব মন্দির রয়েছে এখনো সরকারি তত্ত্বাবধানে। অভিনব টেরাকোটা স্থাপত্য এখনও অমলিন। সুতরাং সব মিথ মিথ্যে নয়।
আর মিথ্যে নয় সেই সব সুলতিত পদ
“মরম না জানে, মরম বাথানে, এমন আছয়ে যারা।
কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহুন তারা।
আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে – ভিতর দুয়ার খোলা।”
কবির হৃদয়ের একুল ওকুল সব উথালপাথাল। ভোর হতেই ঝাঁটা হাতে রামিণিকে দেখেই বোবার মত হতভম্ভ হয়ে যান কবি। দেবীর পুজোয় বসার ক্ষণ ভুলে যান। রজকিনিকে বলেন কাছে আসতে। কৃষ্ণের এমনি হয়েছিল তবে? তাঁর হ্লাদিনী শক্তি রাধা কে দেখে? রাধা নয় গৌরী ছিলেন কিন্তু কৃষ্ণা রামির রাই-অঙ্গের ছটা লেগে এ শ্যামও আজ তবে পুলকিত, বিস্মিত, শিহরিত ! দুহাত বাড়িয়ে স্বল্প বসনা রামির আলগা বাহুকে ছুঁয়ে আলিঙ্গন করতে গেলেন।
রজকিনী বলে উঠলেন ”ও মা, ছি ছি, এ কি গোঁসাই? একি করছেন আপনি? আমায় ছুঁলেন? আপনি যে পুজোয় বসবেন এখুনি। কেউ দেখতে পেলে, রাজা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না জানেন সে কথা?”
কবি বললেন,
“ওসব জাতপাত মানুষের তৈরী। আমি মানিনা। লোকে কী বলল তাতে আমার কিচ্ছুটি এসে যায় না রামি।
আজ থেকে এই মন্দিরের সব অধিকার তোমায় দিলাম। বাসলীদেবীর বেদীস্পর্শের, দেবী বিগ্রহকে ছোঁবার, ভোগ নিবেদন করার সব অধিকার তোমার”
লিখলেন
“প্রণয় করিয়া ভাঙ্গয়ে যে। সাধন-অঙ্গ পায় না সে।”
কুন্ঠিত, লজ্জিত রামিণি মনে মনে ভাবলেন নীচুজাতের মেয়ে হয়ে আমার এ কি সৌভাগ্য হল ঠাকুর? ধোপার ঘরের মেয়ে বলে পাড়ায় কেউ তাদের হাতের জল খায়না। পাড়ার লোকে যদি একঘরে করে দেয় তার গোঁসাইকে। সে পড়ল দোটানায়। আজ নয় কবি এমন বলছেন সত্যিসত্যিই তাকে প্রকৃত ভালোবাসবেন তো? না কী কেবল তাঁর শরীরের আকর্ষণেই বারবার তার কাছে আসছেন, এভাবে প্রেমনিবেদন করতে। সুন্দরীর এমন ছোটোখাটো অভিজ্ঞতা আগে যে হয়নি তা নয়। সে বরং এড়িয়ে চলে পুরুষদের তারপর থেকে।
এই দোলাচলে রামি অবশেষে বলেই ফেলল
না, না, সে হয়না গোঁসাই। লোকলজ্জাকে আমি ভয় পাই। যেদিন তুমি আমাকে সত্যি সত্যি নিজের করে ভালোবাসবে সেই দিন এই শরীর আমি তোমায় দেব, কথা দিলাম। আরও আরো লেখো তুমি কবি। মনসংযোগ করো লেখায়। যৌবন চলে গেলে এত সুন্দর পদ রচনায় ভাটা পড়বে যে। তোমার কাব্যের স্বতস্ফূরণ আর তখন হয়ত ঘটবেনা। তখন রাজামশাইও আর তোমাকে থাকতে দেবেন না এখানে।
অর্থাৎ রামিও সেই অনুভূতির স্বীকার। ঠিক সেই রাধার মত প্রেম জেগেছে তারও। তবুও ভয় সমাজের। ভয় একঘরে হবার।
“কি লাগিয়া ডাকরে বাঁশী আর কিবা চাও।
বাকি আছে প্রাণ আমার তাহা লৈয়া যাও।”
চন্ডীদাস মনে মনে বুঝলেন “এ সব বাশলি দেবীরই ছলাকলা। আরো ডাকতে হবে তাকে। আরো রচনা করতে হবে রাধা কৃষ্ণের পদ। তবেই এই দেবী তার একান্ত আপনার হবে। দেবীই রামির মুখ দিয়ে যেন বলিয়ে নিলেন কথাগুলি। সত্যিই তো ঠিকই বলেছে রামি।
শুন রজকিনী রামি
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া
শরণ লইনু আমি ।।
এভাবেই সহজ সাধনের সঙ্গিনী রামির প্রেম এবং বাশলিদেবীর আশীর্বাদ দুয়ে মিলে যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন তা আজো বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ ।
হার কঙ্কন বড়ায়ি সুন্দর কহ্নাঞি বাঁশী বাএ সুললিত ছান্দে ।।
হার কঙ্কন বড়ায়ি সব তেয়াগিবো সুণী তার বুক কেবা বান্ধে ।।
চলি জাইতে চাহোঁ পাহ নাহি চলে হারায়িলোঁ সখিজন সঙ্গে।।
এবে বাঁশীনাদ সুণী দেহ কাহ্ন আনী গাইল চন্ডীদাস বাসলীচরণে ।।
(বানান অপরিবর্তিত)
রামি-চন্ডীদাস আর নানুর এই শব্দবন্ধের ত্রহ্য স্পর্শে আজও অনুরনিত হয় এই মন্দিরতলার আশপাশ।
এই যশস্বী কবির লেখনীতেই উঠে এসেছিল যে পদ?
“ভেবে দেখ মনে, এ তিন ভুবনে
কে আছে আমার আর।
বাশুলী আদেশে কহে চণ্ডীদাসে
ধোপানী চরণ সার।।”
পরবর্তী কালে রচিত বাউলগানেই তো পাই সেই একই কথার অনুরণন।
… “সে এক ব্রাহ্মণের ছেলে, আপনি গীত গেলে, পীরিত করে ধোবার মেয়ের পা ধুয়ে খেলে…” অতএব রামী-চন্ডিদাসের প্রেম মিথ। মিথ্যে হবার নয়।
কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে বেঁচে রইল তাঁদের প্রেম। পুকুরঘাটের সিঁড়ি তে কাপড়কাচা শেষে কাঁখে কলসি নিয়ে সিক্ত বসনে রামীর শরীরি বিভঙ্গদেখে চণ্ডীদাস লিখে ফেলেছিলেন যে পদ সে তো মিথ্যে হবার নয়। রাধাকৃষ্ণ মিথ হতে পারে কিন্তু তাদের কিংবদন্তী প্রেমের অবতার হয়ে রইলেন যে রামী- চণ্ডীদাস? সে প্রমাণ তো নীচের পদটি।
“রাই তুমি সে আমার গতি।
তোমার কারণে রসতত্ত্ব লাগি
গোকুলে আমার স্থিতি।।
নিশিদিশি সদা গীত আলাপনে
মুরলী লইয়া করে
যমুনা সিনানে তোমার কারণে
বসিয়া থাকি তীরে।।”
এই চণ্ডীদাসের জন্মের মতোই মৃত্যু নিয়েও নানা মত আছে। স্থানীয় মানুষদের জিগেস করে জানতে পারি, বাংলার তদানীন্তন পাঠান সুলতান কিরগিজ খাঁ জোর করে বিয়ে করেন এক হিন্দু কন্যাকে ৷ একদিন বাশলি মন্দিরের আটচালায় কীর্তণে বিভোর ছিলেন সাধক কবি। এদিকে সুলতানের স্ত্রী চণ্ডীদাসের প্রেমে পড়ার কথা নিজমুখে স্বীকার করে নিয়েছেন। সুলতান এক সন্ধেয় নিজ স্ত্রীকে বাসগৃহে আটকে রেখে চণ্ডীদাসের কীর্তনের আসরে আচমকা কামানের গোলাবর্ষণ করেন৷ ঘটনাস্থলেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যান চণ্ডীদাস। ধ্বংস হয় বাসুলীদেবীর মন্দির৷
রামি সহ উপস্থিত অনেক গ্রামবাসী ধংসস্তূপে চাপা পড়ে মারা যান সেদিন। আজও সাক্ষী সেই স্তূপ। পুরাতত্ব সংরক্ষণ বিভাগ এই স্তূপকেই চণ্ডীদাসের সমাধি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাধিক্ষেত্র এবং বাশলি বা বিশালাক্ষী মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের ভারও এখন তাদের।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আবিষ্কারক, ভাষাতাত্ত্বিক ও গবেষক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের কথায় সে প্রমাণও মিলেছে।
আবার দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, প্রথম খণ্ড (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ) গ্রন্থে রয়েছে মন্দিরের কাছে কীর্তন দলের নাট্যশালায় চণ্ডীদাসের ভাবে বিভোর হয়ে উন্মত্ত নৃত্যের উল্লেখ রয়েছে। এ ছিল বুঝি গৌড়ের নবাবের পরিকল্পিত চাল। রাজসভায় গান গাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করতেই সেখানে স্বয়ং গেছিলেন চণ্ডীদাস। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ভক্তি-প্রেমের কীর্তন শুনে নবাবের বেগম মুগ্ধ হয়ে যান এবং তিনি চণ্ডীদাসের গুণের অনুরাগিণী হয়ে পড়েন। নবাব ক্রোধের বশে চণ্ডীদাসকে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেন। আত্মীয় বন্ধুবর্গের সামনে চণ্ডীদাস হস্তিপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে নিদারুণ কশাঘাত সহ্য করে প্রাণবিসর্জন দেন। তাঁর বেগম সেই দৃশ্য দেখে শোকে মুর্চ্ছিতা হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণবিয়োগ করেন।
নানুরে রামী-চণ্ডীদাসকে ঘিরে এমন অজস্র গল্প-গাথা আনাচে-কানাচে। তবে প্রাচীন নিদর্শনগুলি অনেকাংশেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
ছবি সূত্র: লেখক
তথ্যসূত্র
পুরুষ ও প্রকৃতি (প্রতিভাস) গৌতম ঘোষদস্তিদার
বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, প্রথম খণ্ড (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ) দীনেশ চন্দ্র সেন
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডীদাস
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।