| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

ভালোবাসার কাহিনী বলে রানি কি ভাভ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সন ১৪৯৮…

ভাগেলা বংশের রাণা বীর সিং ছিলেন দন্ডাই দেশের রাজা,তার রাণী রুদাবাঈ ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী…তাঁর সৌন্দর্যের খবর পৌঁছেছিল দূর দূরান্তে…দন্ডাই দেশ বর্তমান গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। ছোট রাজ্য দন্ডাই দেশের সমস্যা ছিল একটাই,জল…পান এবং ব্যবহারের জলের অভাব। সারা বছর জলাভাবে ক্লান্ত প্রজাদের একমাত্র ভরসা ছিল বৃষ্টি….যে বছর বৃষ্টি কম হতো সে বছর দুর্ভোগ আরও বেড়ে যেত। রাণী রুদাবাঈ এর বাহ্যিক সৌন্দর্য যতটা ছিল,তাঁর মন ছিল তার থেকেও বেশি সুন্দর….প্রজাদের দুর্ভোগে তিনি কষ্ট পেতেন…একদিন রাণা বীর সিংহের কাছে রাণী আবদার করেন যে রাণা তাকে কতটা ভালোবাসেন তার প্রমাণ দিতে হবে…রাণা অসম্ভব ভালোবাসতেন তাঁর সুন্দরী রাণীকে…উনি রাণীকে জানালেন রাণী যেমন প্রমাণ চান,তিনি তা দিতে প্রস্তুত। রাণী তখন বলেন,যদি রাণা তাকে এতটাই ভালোবাসেন তাহলে তাঁর জন্য সাম্রাজ্যের ঠিক মধ্যবর্তী জায়গায়   একটি পাঁচতলা ‘ভাব’ (সোপান কূপ) তৈরি করে দিতে হবে…এবং সেই ‘ভাব’ এ যেন সারা বছর জল থাকে…রাণী আরও বললেন সেটা এত বড় হতে হবে যাতে সেখানে একসঙ্গে অনেক লোক জল নিতে পারেন,আলো হাওয়া প্রচুর থাকতে হবে অথচ সূর্যের আলো সরাসরি সেখানে প্রবেশ করতে পারবেনা….যেহেতু সেখানে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জল সংগ্রহ করতে মানুষ আসবেন,তাই তাদের বিশ্রামের জন্য বিশ্রামাগারটি মনোরম হওয়া প্রয়োজন, তাই সেখানে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি এবং একে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নবগ্রহ স্থাপন করে দিতে হবে…রুদাবাঈ জানতেন এমন ‘ভাব’ রাণা সত্যিই তৈরি করে দিতে পারেন….

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

রাণীর এমন আবদারে রাণা বীর সিং প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও শীঘ্রই রাণীর অভিপ্রায় বুঝতে পারেন,রাণীর প্রতি তাঁর প্রেম দ্বিগুণ বেড়ে যায়…এবং প্রবল উদ্যোমে তিনি ‘ভাব’ তৈরির কাজে লিপ্ত হন। অষ্টভুজাকৃতি কূপ কে ঘিরে বিশ্রামকক্ষ নির্মাণ করেন…এমনভাবে এর নক্সা তৈরি হয় যাতে উন্নত সমতলস্থান গুলোতে এবং বিশ্রামস্থলে আলো হাওয়ার ঘাটতি না হয় এবং সূর্যের আলো সরাসরি না পৌঁছাতে পারে…এভাবেই এই ‘ভাব’ কে ধ্যান জ্ঞান করে নিয়ে রাণা তাঁর রাণীর প্রতি ভালোবাসা প্রমাণ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন…কয়েক মাসের মধ্যেই দ্বিতল ‘ভাব’ তৈরি হয়ে যায়।রাজমিস্ত্রিদের হাতের কাজ এবং পাথরের ওপর খোদাই করা কারুকার্য দেখে রাণী মুগ্ধ হন এবং ‘ভাব’ সম্পূর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন… রাণীর চোখে মুগ্ধতা দেখে রাণা বীর সিং এর কর্মোদ্যম বৃদ্ধি পায় এবং তিনি এই কর্মযজ্ঞে আরও বেশি  ডুবে যান।

ঠিক এই সময় দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে দন্ডাই দেশের ওপর…. প্রতিবেশী রাজ্যের নবাব মাহমুদ বেগাড়া দন্ডাই দেশ আক্রমণ করেন…রাজ্য বিস্তারই তার একমাত্র অভিপ্রায় ছিল না, সভাসদদের কাছে রাণী রুদাবাঈ এর রূপের বর্ণনা শুনে তাঁর প্রেমে পড়েন তিনি।প্রেম এত তীব্র আকার ধারণ করে যে তিনি স্থির করেন তাঁকে পাওয়ার জন্য প্রতিবেশী রাজ্য আক্রমণ করবেন….শান্তিপূর্ণ রাজ্য দন্ডাই দেশ,তাদের সৈন্য আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায়…রাণা নিজেও প্রতিরক্ষার বিষয়ে উদাসীন ছিলেন কিছুদিন যাবৎ….দন্ডাই দেশের সৈন্যরা বেগাড়া সৈন্যদের পরাক্রমের কাছে নতি স্বীকার করে, অবশেষে রাণা বীর সিং নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করবেন বলে মনস্থির করেন…রাণী যুদ্ধের তলোয়ার রাণার হাতে তুলে দেওয়ার সময় মুখে “জয়ী হও” বললেও জানতেন এটাই হয়তো শেষ দেখা তাদের….কপালে তিলক আঁকার সময় হাত কেঁপে যায় রাণীর…বীর সিং বুঝতে পারেন রাণীর মনের অবস্থা….আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন তাঁর প্রিয়তমা রাণীকে…কথা দেন তিনি জয়ী হয়ে ফিরে আসবেন…’ভাব’ সম্পূর্ণ করবেন….কিন্তু কথা রাখতে পারেননি তিনি… যুদ্ধক্ষেত্রে মাহমুদ বেগাড়ার হাতেই প্রাণ হারান রাণা বীর সিং। বেগাড়া তার লক্ষ্যের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবার আনন্দে ফেটে পড়েন উল্লাসে……

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

রাণী রুদাবাঈ এর কাছে এই বিষম দুঃসংবাদ নিয়ে আসেন রাজ পুরোহিত।অশ্রু টইটম্বুর চোখে রাণার মৃত্যু সংবাদ দেন রাণীকে, আর এও বলেন সমস্ত রাজ্য এখন মাহমুদ বেগাড়ার দখলে,তিনি যেকোনো সময় রাজপ্রাসাদে হানা দিতে পারেন…রাণা নেই,এই সংবাদ বজ্রপাতের মতো তাঁর মনে আঘাত করে,শোকস্তব্ধ রাণী নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তাঁর কক্ষের জানলা দিয়ে…দূরে দেখা যায় অসমাপ্ত ‘ভাব’….রাণার কথায় ‘রাণী কি ভাব’….অশ্রুধারা নামে তাঁর দুচোখে…রাজ পুরোহিতের রেখে যাওয়া যুদ্ধক্ষেত্র ফেরত রাণার রক্তিম বস্ত্রের একটি ছিন্ন অংশ বুকে নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন রাণী….প্রধান পরিচারিকাকে খবর পাঠান রুদাবাঈ,তাকে জানান সতী রীতি পালন করবেন তিনি,সেসব ব্যবস্থা যেন করা হয় শীঘ্রই…হাহাকার পড়ে যায় তাঁর সখীকুলে,কিন্তু রাণীর আদেশ মানতে বাধ্য হন তারা।রাণার রক্তমাখা বস্ত্র নিয়ে তিনি প্রস্তুত হন সতীকুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।এদিকে মাহমুদের কাছে খবর পৌঁছোয় রাণীর সতী রীতি পালনের কথা,তার বিজয়োল্লাস থামে,যাঁর জন্য গোটা একটি রাজ্য জয় করে ফেললেন,তাকে না পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে তিনি সদলবলে প্রাসাদ অভিমুখে রওনা হলেন….

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

সতীকুন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলেন রাণী….রাণার মুখ ভেসে উঠলো তাঁর সামনে,সতীকুন্ডে ঝাঁপ দিতে যাবেন,ঠিক সেই মুহূর্তে মাহমুদ বেগাড়া এসে উপস্থিত হন এবং রাণীর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেন আর অগ্নিসমর্পণ থেকে বিরত করেন রাণীকে।ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারান রাণী রুদাবাঈ….রাণীর সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে মাহমুদের হৃদয় বিগলিত হয়, বর্ণনায় যা শুনেছেন তার থেকেও কয়েকগুণ সুললিত অবয়ব রাণীর….পরিচারিকাদের শুশ্রূষায় রাণীর জ্ঞান ফিরলে,মাহমুদ তার প্রেম নিবেদন করেন রাণীর কাছে,বিবাহের প্রস্তাব দেন।

রাণী বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী ছিলেন,এই চরম শোকের সময়ও তাঁর প্রাজ্ঞতম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রাখেন তিনি।সবাইকে বিস্মিত করে রাণী মাহমুদের প্রস্তাবে সম্মত হন….কিন্তু বেশ কিছু শর্ত রাখেন প্রজা অন্তপ্রাণ রাণী তার সামনে।

প্রথমত,রাজ্যে কোন নারী ও শিশুর উপর নির্যাতন যেন না হয়…..

দ্বিতীয়ত, রাজ্যের কোন নিরীহ প্রজাকে হত্যা করা যাবে না….

তৃতীয়ত, যুদ্ধবন্দিদের অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে,এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে…..

চতুর্থত, ‘ভাব’ এর কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে….ভাব এর কাজ সম্পূর্ণ হলেই তিনি বিবাহে সম্মতি দেবেন….রাণীর প্রেমে পাগল মাহমুদ বিনা প্রশ্নে তাঁর সব শর্ত মেনে নেন।

মাহমুদ বেগাড়া রাণীর সব শর্ত পালনের জন্য নির্দেশ জারি করেন।তার রাজ্যের প্রধান পাঁচ রাজমিস্ত্রির ওপর দায়িত্ব দেন ‘ভাব’ এর কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য।সৈন্যবাহিনীর একটি বড় অংশ নিযুক্ত করেন ‘ভাব’ এর কাজে।অহর্নিশ অবিরাম কাজ চলতে থাকলো,মাহমুদ নিজে পরিদর্শন করতে লাগলেন কাজ শেষ হওয়ার এবং রাণীর সঙ্গে বিবাহের স্বপ্ন দেখতে থাকলেন অহর্নিশ।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে গেল ‘ভাব’ এর….আরও তিনটি তলা নির্মাণ করলেন মাহমুদ।প্রথম দু’টি তলায় হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শন থাকলো,আর শেষ তিনটি তলায় ইসলামিক স্থাপত্যের বিন্যাস।ষোলোটি থামের সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীদের উপাসনালয় যা রাণা বানিয়েছিলেন তাতে হাত পড়লোনা মাহমুদের নির্দেশে।ভালোবাসার সঙ্গে ধর্মীয় মেলবন্ধনের এক আশ্চর্য নিদর্শন হয়ে রইল এই ‘ভাব’…..শোনা যায়, ‘ভাব’ টির নির্মাণকারী পাঁচজন প্রধান রাজমিস্ত্রিকে হত্যা করেন মাহমুদ, কারণ তিনি চাননি ঠিক এরকম দু’টি থাকুক এই পৃথিবীতে।

শর্ত পূরণ করেছেন মাহমুদ,এবার রাণী কে বিবাহ করবেন এটাই ছিল শর্ত পূরণের উদ্দেশ্য।রাণীর কাছে মাহমুদের সংবাদ যায় ‘ভাব’   সম্পূর্ণ হয়েছে, এবং তারই সঙ্গে তিনি রাণী কে বিবাহের প্রস্তুতির জন্য অনুরোধ জানান।কিন্তু রাণীর অভিপ্রায় ছিল অন্য।’ভাব’ পরিদর্শনে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি রাজ পুরোহিতকে পুজোর আয়োজন করতে নির্দেশ দেন, ‘ভাব’ শোধন করতে হবে এবং তা উৎসর্গ করতে হবে রাণা বীর সিং এর নামে।পুজো এবং নাম উৎসর্গের সমাপ্তির পর রাণী জানান তিনি ‘ভাব’ এর জলে স্নানাদি সারবেন,অতএব কেউ যেন ওখানে না থাকেন…..তাঁর অত্যন্ত অনুগতা পরিচারিকাও নন….নির্দেশ পালন হলো,রাণী রুদাবাঈ একাকী প্রবেশ করলেন ‘ভাব’ এ….হাতে ধরা ছিল রাণার ছিন্ন বস্ত্র যা তিনি অতি যত্নে নিজের কাজে রেখেছিলেন….’ভাব’ টি জলে টইটম্বুর হয়ে আছে,সেই দিকে দৃষ্টি  নিবদ্ধ রেখে রাণার বস্ত্র বক্ষে ধারণ করে কূপ কে প্রদক্ষিন করলেন তিনবার,রাণার সঙ্গে পুনর্মিলনের আনন্দ অনিমিখে অশ্রুপাতের ন্যায় বয়ে গেল,রাণী রুদাবাঈ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘রাণী কি ভাব ‘ এর গভীরে….রাণা বীর সিং আর রাণী রুদাবাঈ এর প্রেম অমর হয়ে রইল রাণীর সলিলসমাধির সঙ্গে….অগ্নিকুন্ডে নয় রানীর ‘ভাব’ এ সতী রীতিকে পালন করলেন রাণী রুদাবাঈ….

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

অধুনা আদালাজ অবস্থিত ‘,রাণী কি ভাব’ আজও ভালোবাসার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে… এর প্রতিটা সিঁড়ি,প্রতিটা থাম,প্রতিটা কারুকাজ যেন এই অমর প্রেম কাহিনীর সাক্ষী বহন করছে।বীর সিং, রুদাবাঈ এর প্রেম কাহিনী যেমন আছে তেমনই আছে মাহমুদ বেগাড়ার অসম্পূর্ণ ভালোবাসার ইতিহাসও।রাণা বীর সিং তাঁর রাণীর ইচ্ছে পূরণের জন্য ‘ভাব ‘ এর নির্মাণ শুরু করেছিলেন,অথচ ‘ভাব ‘ এর কাজ শেষ হলো রাণীর ইচ্ছেতেই।শেষ করলেন রাণীর প্রেমে উন্মত্ত প্রতিবেশী দেশের সম্রাট, যার হাতেই রাণার মৃত্যু হয়।সব শেষে রাণার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই ‘ভাব’ উৎসর্গ করার পর রাণী এখানেই আত্মাহুতি দেন রাণার সঙ্গে পুনর্মিলনের অভিপ্রায়ে…কোন পূর্ণিমা রাতে আজও হয়তো বীর সিং আর রাণী রুদাবাঈ এর আত্মা প্রেম সম্মেলনে আসেন যার সাক্ষী থাকে এই সোপান কূপ…এই ‘রাণী কি ভাব’…. কারণ আত্মা যে অবিনশ্বর তা সর্বজনবিদিত।

 

 

 

ছবি: লেখক

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত