আধুনিক মানুষের কাছে দুর্গম আর কিছুই নেই। পৃথিবীর জল, স্থল,মরু-তুষার সব জয় করার পর তার বাইরের গ্রহগুলিও মানুষ তার আয়ত্বের ভিতর নিয়ে আসতে চাইছে। পৃথিবীও তাকে ধরা দিয়েছে হৃদয় খুলে। তবু মানুষের স্বস্থি নেই। সে জানতে চেয়েছে ইতিহাস,জানতে চেয়েছে আদিম জাতি সত্তার কথা। নিখিল ইতিহাসকে অতীতের ভিতর থেকে টেনে বের করতে চেয়েছে। তবু তার মনে হয়েছে,এখানে সে সম্পূর্ণ নয়। সে নিজেকে বিশ্লেষন করে নিজের আত্মিক উন্মোচন করতে চেয়েছে। তারপর বুঝতে পেরেছে,এই আত্মিক উন্মোচনও যথেষ্ট নয়। মন কোথাও সংকীর্ণতায় বাধাগ্রস্থ,কোথাও বিকৃতিতে। সে তখন বিশ্ব প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে নিজের আত্মিক সত্যের সাথে বিশ্বের সত্যকে মেলাবার চেষ্টা করেছে। মন কিভাবে আবিষ্ট হয়, কিভাবে কোন্ সত্যকে স্পর্শ করে, তা আমরা জানিনা। তবে যখন কোনো কবিতার পংক্তিতে পাই এক অনির্বচনীয় আনন্দ, তখন ওই পংক্তিটির হাত ধরে নিজের ভিতরও আবিস্কৃত হয় এক পরম সত্য। ঘোর লাগে। আনন্দের ঘোর, বিষাদের ঘোর, ভাবের ঘোর। পংক্তিটি রয়ে যায় মনের গভীরের এক গভীর সত্তার সাথে, এক গভীর সত্যের সাথে।
দুহাজার পনেরো সনের দিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম কাশ্মীর। এত সুন্দর! যেদিকে চোখ যায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার কথা মনে পড়ে। যেন স্বর্গের মধ্যে দিয়ে পথ চলছি। প্রকৃতি নিজের মত করেই পূর্ণ হয়ে আছে সেখানে। চলছিলাম ঘোরের মধ্যে। অসাধারণ সব লেক, পাহাড়ী ঝর্ণা দেখার পর গুলমার্গ দেখতে এলাম। সেখানে ভীষণ উঁচু-নিচু সর্পিল পাহাড়ী পথ ধরে এগোবো। রোপ ওয়ে আছে, আছে স্থানীয় ঘোড়া। দেখলাম পর্যটকরা অনায়াসে ঘোড়ায় উঠছে, দেখছে, উপভোগ করছে। তাদের দেখাদেখি, আমি ও আমার সঙ্গী ছয়শ রুপি দিয়ে এক ঘন্টার জন্য ঘোড়ায় উঠলাম। কিন্ত আমার ঘোড়াটি প্রচন্ড অনিচ্ছুক ছিল। সম্ভবত ভোর থেকে তাকে অনেক খাটানো হয়েছে। সে যেতে চাচ্ছেনা বলে, ঘোড়ার মালিক তার পিঠে দু-ঘা বসিয়ে দিল। সুন্দরের ঘোরের ভিতর হঠাৎ এই দৃশ্যটি আমার মনোবেদনার কারন হয়ে উঠল। তাৎক্ষণিকভাবে আমি ঘোড়ার মালিককে পুরো টাকা বুঝিয়ে দিয়ে নেমে পড়ি। আমার সঙ্গীটিও তাই করে। পরে ঘোড়ার পরিবর্তে রোপওয়েতে চড়ে আমরা গুলমার্গের দৃশ্য দেখেছিলাম। কিন্ত সেই থেকে বিভিন্ন সময়ে ও একান্ত মুহূর্তেঘোড়ার সেই তীব্র দুঃখ আমাকে অসহায় করেছে। মানবতার পরাজয়ের এক ভয়াবহ দৃশ্য যেন আমি ঘোড়াটির অভিব্যক্তিতে দেখতে পেয়েছিলাম।
দীর্ঘদিন পর, রণজিৎ দাশের‘ অসমাপ্ত আলিঙ্গন’ বইটির কবিতাগুলি পড়তে পড়তে, একটি কবিতা আমাকে রীতিমত চমকে দেয়। কবিতাটি আমাকে নিয়ে যেন ছুটে যেতে চায় এক তীব্রতর রসায়নে। আমি যেন দীর্ঘদিন পর নিজের ভিতর থেকে আমাকে আবার আবিষ্কার করি। কবিতাটির প্রতিটি শব্দে আমি নিঃশ্বাস নিতে থাকি। আমার বুকে এতদিনের জমে থাকা পাথর যেন একটু একটু করে গলতে থাকে।
ঘোড়াদের বিষন্নতা
ঘোড়াদের বিষন্নতা বোঝে কেউ? পাকদন্ডী পথে
তাদের ক্ষুধা ও ক্লান্তি, বেত্রাঘাতে কম্পিত কেশর
বোঝে কেউ? পর্যটক, পুলিশ, নক্ষত্র, মেঘ, পাইনের বন?
তীর্থযাত্রী পিঠে নিয়ে অনন্ত খাদের পথে
ঘোড়াদের বিশ্বস্ত চলন-
দেখি আর মুগ্ধ হই,
দেখি আর পাহাড়ি বিষাদে
স্তব্ধ হয়ে যাই।
এত রূপবান প্রাণী,অথচ কি সৎ!
বিশ্বাস হয় না। এই সুন্দর ছলনাময় গ্রহে
ঘোড়া কি অলীক প্রাণী? ঘোড়াই কি আসল বিগ্রহ –
সৌন্দর্য ও সততার অচ্ছেদ্য মিলনে?
এমনই ইশারা দেখি
ভন্ড তীর্থযাত্রীদের পিঠে নিয়ে ঘোড়াদের চলনে –
ভন্ডতর দেবতার উচ্চতর মন্দিরের দিকে।
নাস্তিকতা শুরু হয় ঘোড়াদের বিষন্নতা থেকে।
কী বলব এই কবিতাটিকে! যখন সে দীর্ঘদিন আমার নিজের ভিতরেই ছিল, দীর্ঘদিন পর উঠে এল আমার সব অনুভবকে ছুঁয়ে এক বিষন্নতর স্বরে ও সত্যে। কবিতাটি পড়তে পড়তে বেঁচে থাকাকে এক তীব্র ভয়ের ব্যাপার মনে হয় আমার। আমার ভিতরের গাঢ় সংশয় কবির পর্যবেক্ষণের সত্য ও লেখার সত্যের ভিতর স্তব্ধ হয়ে থাকে। কবির প্রচন্ড শক্তিশালী বোধকে বুঝতে পেরে বিস্মিত হই। কবিতাটিতে তেমন কোনো প্রতীক নেই! বেশি শব্দের ঘনঘটাও নেই। তবু অনুভবের এক প্রবল সত্য মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীর সব আলো মরে গেছে। এই পৃথিবী শুধুই এক ছলনাময় গ্রহ। সৌন্দর্য ও সততা যা কিছু আছে এই বোবা প্রাণীটির ভিতর। অমানবিক পৃথিবীতে বিশ্বাস হারাতে হারাতে আমরা সকল ধার্মিক আর ভন্ডদের সুন্দর ও সততার পিঠে চড়ে বসতে দেখি। তারা এগোতে থাকে উচ্চতার দিকে। আমাদের আত্মিক বিশ্বাস অস্পষ্ট হতে থাকে, বিষন্নতা এগোতে থাকে নাস্তিকতার পথে।
২০১৩ সালে ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত ‘ধানক্ষেতে বৃষ্টির কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির অনেকগুলো কবিতাকে আমার মনে হয়েছে ‘মিউজিক অব পোয়েট্রি’। কখনও সুগন্ধ ঘেরা, কখনও অন্ধকার, কখনওবা আকস্মিক ঝাঁ চকচকে ফোয়ারা। কবিতার ছায়া কেমন টান টান হয়ে থাকে, দম আটকানো সময়ের ভিতর। এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির কথাই বলছি।
বিনা প্রেমে
বিনা প্রেমে নাহি দেব সূচ্যগ্র শরীর।
লঙ্ঘন কোরো না সীমা, পাবে ছাই শ্মশানভ‚মির।
যদি স্পর্শ করো, আমি মরে যাব অপ্রেমের বিষে
তোমারই থাবার নীচে, সন্ধ্যার শপিং মল-এ,আটটা তিরিশে
মত্ত নিশিনিলয়ের ডান্স ফ্লোরে মৃতদেহ ছুঁড়ে দিও, বীর!
কবিতাটির প্রথম লাইনটি ,যেন একটি সিদ্ধান্ত। প্রেমের স্পর্শে জীবন যে তাৎপর্য পায়, তার অনিবার্যতা প্রথম লাইনটিতে স্পষ্ট। তারপরে একটি স্পেস। যেন নির্দিষ্ট বক্তব্যটির পর বক্তব্যটির আর্তি ছড়িয়ে আছে স্পেসটিতে। এক নিথর চুপচাপ। যেন কিছু না- বলার মধ্যে দিয়ে আরও সুনিশ্চিতভাবে ব্যক্ত হচ্ছে বলবার সব প্রয়াস। দ্বিতীয় পংক্তিতে এসে, আরও নির্দিষ্ট ও স্পষ্টভাবে প্রথম বক্তব্যটিকে প্রতিষ্ঠা করা হলো। প্রেমহীনতার জ্বলনে ছাই হয়ে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণা, বিপন্নতার আর্তি,অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে এক হাহাকার। যেখানে প্রেমের আভাসমাত্র নেই, সেখানেই সবটুকুই মৃতদেহ। এক তীব্র অসম্পূর্ণতার বেদনা, অন্তরস্থিত জ্বলন শরীরী স্পর্শের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তর ব্যবধানের মতো থমকে আছে যেন। প্রেমের শিকড়টিকে উদ্ভাবন ও অন্বেষণের চেষ্টায় কবিতাটির আর্তি ছড়িয়ে আছে কবিতাটির শেষ লাইনটি পর্যন্ত।
‘তোমার তন্ডুল নিয়ে বসে আছি বৃক্ষতলে; ধূলির শয্যায়
তোমারই প্রতীক্ষারত -পূর্ণ প্রেমে সমগ্র শরীর!
চুম্বনের আগে একটি রক্তগোলাপ দিও বীর’
…প্রকৃতি, মানুষ, প্রেম ও গভীর সত্তার একটি সরলরেখার মতো সর্বজীব জীবনের চেতনার স্তরে নিঃশব্দে ব্যাপ্ত থাকে। প্রেমময় মিলন সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। হৃদয় জেগে ওঠে,সমস্ত বিশ্ব কাঁপে থরোথরো। প্রেম ও সৌন্দর্যের দীপ্তিতে জেগে ওঠে সমস্ত কাঙ্খিত বোঝাপড়া। একমাত্র প্রেমই পারে শরীর সর্বস্বতা থেকে, শুধুমাত্র জৈব আকাঙ্খার ফাঁস থেকে বের হয়ে আত্মপরিচয়ের সবটুকুকে তুলে আনতে।
সহজভাবে, খুব অনায়াসে গভীর কথাগুলো এই কবিতায় বলা হয়েছে। আর কবিতাটি পড়তে পড়তে তা সঞ্চারিত হয়ে যায় চেতনার অন্দরমহলে। এই কবিতাটির মগ্নতে একবার লিপ্ত হয়ে গেলে তীব্রভাবে এর অদেখা সুরটি বাজতে থাকে বুকের ভিতর। শাপভ্রষ্ট মানুষ অসংখ্য দৈহিক মিলনেও আবিষ্কার করতে পারে না, নিজের মনকে। বিন্দুমাত্রও উপলব্ধি করতে পারে না, জীবনের সারসত্য। তাই নারীর গোপন কান্না কখনো কখনো দ্রোহ হয়ে ওঠে। প্রেমের কাছে এক অনিঃশেষ সমর্পণে নতজানু নারীর আকাঙ্খার সঙ্গে মিশে যায় প্রেম, কল্যাণবোধ ও সৌর্ন্দযতৃষ্ণা।
শীর্ণ ছায়া
সমস্ত মুক্তির পথে অন্ধ ভিখারীর মতো
ভালবাসা ঠায় বসে থাকে।
পথের ওপরে তার ক্ষুদ্র,শীর্ণ ছায়া
নিঃশব্দে ডিঙিয়ে যেতে হয়।
সমস্ত মুক্তির পথে এইটুকুই ,মূল পরিশ্রম।
এক সকালে জানালার পাশে বসে শরতের আকাশ দেখতে দেখতে কবিতাটি পড়ছিলাম। এত কম শব্দ ব্যবহার করার পরেও কবিতাটিতে ব্যক্ত হয়েছে এক ব্যাপক ও অন্তর্নিহিত সত্যের উপলব্ধি।ছেঁড়া- ছেঁড়া তুলোর মতো ভেসে যাওয়া মেঘ দেখতে দেখতে, আলো দেখতে দেখতে, ভালবাসাকে ডিঙিয়ে যাবার বিপরীতবর্তী অন্ধকারকেও মনশ্চক্ষে দেখতে পাই। আর শুনতে পাই এক নির্মোহ স্বর। এক একটি সম্পর্ককে নির্মম অবহেলায় ফেলে যাবার দুঃসাহস দেখাতে পারেন বলেই তিনি কবি। এক মুক্ত পুরুষ সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে সহজ ভাষায় নির্মম কথাটি উচ্চারণ করে গেলেন। জীবনের এই তরঙ্গধারায় ভালবাসা শব্দটি অনেক বেশি মায়াময়। সে মায়াময় অথচ তার শীর্ণ ছায়াকে নিঃশব্দে ডিঙিয়ে যেতে কোথাও কী কুঁকড়ে কাঁপে দ্বিধাগ্রস্থ পা! ধাঁধাঁ লাগে। গভীর বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়। মুক্তির পথে এই ব্যাথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।
নির্বাচিত কবিতার বইতে আরও কিছু কবিতাকে নিবিড়ভাবে আবিস্কার করেছি। ‘সম্বোধন’ ‘প্ররোচনা’ ‘গাছকে লেখা চিঠি’ ‘ডায়েরি থেকে’ ‘ডায়েরি থেকে -২’ ইতিহাস’ ‘ডিম’ ‘নৈশ ছাদের প্রহেলিকা প্রভৃতি। কবিতাগুলো স্বাভাবিকভাবেই আমার মধ্যে মানসিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। নর-নারীর সম্পর্ক, সত্য কথন, সোজাসাপটা জীবনদর্শন, মানুষের ইতিহাস, প্রাকৃতিক উপাদান আর মানুষের সর্ম্পক, অনির্দিষ্ট যাত্রা… এই সবকিছুতেই অবিরাম কবিতাগুলো জেগে থাকে। সামান্য কথায়, শব্দের যাদুতে রেখে যায় বিস্ময়, সময়ের ছায়া, কিছুটা ভার, কিছুটা তীব্র সংবেদন।
অনুসরণ
মাটি ও সূর্যের মধ্যে যে ক্ষুদ্র শেফালিশাখা, তাই বেয়ে বেয়ে
শুয়াপোকাটির সঙ্গে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তারই মতো
স্থুল ও মন্থর, ও পাখিদের খাদ্য হয়ে, আত্মবিষ সহ
যদি তার মতো কোনও অবিশ্বাস্য রূপান্তর পেয়ে যাই, শুধু এই লোভে—
দার্শনিক কান্টের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ল, ‘ম্যান ইজ আ ক্রুকেড টিম্বার’। মানুুষ নামক এই গাঁটমারা কাঠটি প্রতিনিয়ত অলৌকিক উদ্ভাসে ম্যাজিকের মতো এক অবিশ্বাস্য রূপান্তরে পরশপাথরে পরিণত হতে চায়। নিজ চেতনার মধ্যে এক যন্ত্রণাময় উপলব্ধি মনোজগতের জটিলতায় আক্রান্ত মানুষ স্পষ্টভাবে টের পায় । কিন্তু এই ব্যথার কাছে সে অসহায়। আর এই আত্মিক সংকটে সে চায় অবিশ্বাস্য রূপান্তর। শুঁয়োপোকা যেমন করে হঠাৎ প্রজাপতি হয়ে পাখা মেলে দেয় নানা রঙে ও রূপে। বন্দী জীবনের আনুগত্য পালন করা বিষন্ন মানুষ তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ভাঙার জন্য ভেতরে ভেতরে এক রূপান্তর বা ছদ্মবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।
জোড়া রাজহাঁস
আশীর্বাদ করি আজ, পৃথিবীর মানুষেরা, তোমাদের
সব্জির বাজার যেন সবুজ পালংশাকে ভরে ওঠে,যেন
তোমাদের জিভ, দাঁত, লালা ও ঢেঁকুড় অন্ন ও মাছের স্বাদে
তৃপ্ত থাকে; গৌতম বুদ্ধের হাতে তোমাদের নারী যেন
সোনার কাঁচুলি খুলে তুলে দেয় জোড়া রাজহাঁস -এই
কোমল শিল্পের চাপে যেন তাঁর নির্বানের মোহ ভেঙে যায়।
অক্টাভিও পাস লিখেছিলেন,কবিতা হচ্ছে ইতিহাস ও সত্যের মধ্যে একটা ব্রিজ কিন্তু এদিকে বা ওদিকে চলে যাওয়ার পথ নয়, সমস্ত চঞ্চলতার মাঝখানে স্থির অবলোকন। এই অবলোকনে একটি আপাত সত্যের মাঝে নিকটতম সত্যটি ধরা পড়ে। পৃথিবীর সর্বত্র যে জীবনের উল্লাস তার বাধ্যতায় তিনি গৌতম বুদ্ধকে আশীর্বাদ করছেন,কোমল শিল্পের চাপে যেন তাঁর নির্বাণের মোহ ভেঙে যায়। স্পন্দিত জীবনের সহজ আনন্দের মধ্যেও যে শিল্পের গভীরতর স্তর রয়েছে তাকে স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণভাবে জানিয়ে দিলেন যেন। জীবনের প্রাত্যাহিকতা থেকে উদ্ভ‚ত তীব্র উচ্ছ্বাস মধু ও আনন্দের প্রতি কবি হৃদয়ের তীব্র স্বীকারোক্তিটুকু সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় এই কবিতায়।
এতক্ষন বেশ কিছু কবিতার কথা বললাম। যে কবিতাগুলির স্বর আমাদের নিয়ে যায় ব্যক্তিগত উপলব্ধিতে। নিষ্প্রাণ যন্ত্র পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত অবস্থান,কান্না ও আত্মিক বিপন্নতা ও জীবনের গূঢ় অর্থ উপলব্ধির কাছে। রণজিৎ দাশের আরও অনেক কবিতা আমার খুবই প্রিয়। শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধুর কিছু লেখা’। তাতেও রয়েছে কিছু অসাধারণ কবিতা যার অনেকগুলোতেই রয়েছে প্রতীকধর্মীতা। কবিতাগুলোতে বিচরন করতে করতে এক জাদুটান টের পাই। মানবজীবনের গভীর পরিণাম ও আধুনিক জীবনের দ্বা›িদ্বক পটভুমি কবিতাগুলোতে চমৎকার ভারসাম্য রেখেছে।
রণজিৎ দাশের ‘বিয়োগপর্ব’ উপন্যাসটি না পড়লে তাঁর একটি অভূতপূর্ব সৃষ্টি সম্পর্কে জানাই হতো না। জীবনের টানাপোড়েন, সমসাময়িক সমাজ,সামাজিক জটিলতা ও বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে কেমন করে অনুভবগুলি বিয়োগ হয়ে যায়, তাই নিয়েই বিয়োগপর্ব। মানুষের মানবিক অনুভব যখন প্রশ্নের সম্মুখীন, মানুষ যখন খুঁজে বেড়াচ্ছে তার স্বর ও সত্তা – সেই মানুষটি এক একলা মানুষ। এক গুরুত্বহীন একা মানুষ ,যে স্পষ্ট দেখতে পায় বলে, সমাজের জঘণ্য চক্রান্তের শিকার হয়ে পড়ে। নিঃসঙ্গতার করাল গহ্বরে বিয়োগপর্বের দুই নায়ক অনুপম ও তমাল ক্রমেই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমরা হঠাৎ দেখতে পাই, অনুপম যোগ করতে ভুলে যায়। প্রেম করে বিয়ে করার পরও তার দাম্পত্য অসুখী। সে ছিল এক বানিজ্যিক সংস্থার হিসাব রক্ষক। মানসিক বিপর্যয়ের কারনে সে ভুলে যায় যোগ করা। সে পরাজিত হতে থাকে দক্ষতার স্থানে। তার স্ত্রী শম্পার ভোগবিলাসী জীবন অনুপমের অস্তিত্বের শিকড়ে ক্রমাগত টানাপোড়েন তৈরি করে। পরাজিত অনুপম অনুভব করে-‘বিহাইন্ড এভরি আনসাকসেসফুল ম্যান, দেয়ার ইজ অ্যা ওম্যান’
‘সত্যি কথা বলতে কী, কতদিন কোথাও কোনো মা-ই দেখি না। শুধু সাজগোজ করা আধুনিকা পরীদের দেখি।’-অনুপমের এই গভীর আর্তি নারীর অকৃত্রিম ভালবাসার প্রতি।
শেষপর্যন্ত অনুপম পাগল হয়ে যায়,কাউকে চিনতে পারে না। ধাবিত হয় মৃত্যুর দিকে। যদিও সে বাঁচবার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ, বাঁচতে চেয়েছে সুরের মাধ্যমে –তবু তার সকল চেষ্টার বাইরে তীব্র বিপন্নতা তাকে ঠেলে দেয় পরাজয়ের দিকে। তমাল চরিত্রটিও এখানে প্রধান চরিত্র। যিনি অনুপমের বন্ধু, কিন্তু একসঙ্গে বেড়ে উঠলেও চিন্তার ক্ষেত্রে ভিন্ন। তমাল আধুনিক চিত্রকলার একজন সেলিব্রেটি, কিন্তু সেও অন্তঃসারশূন্য। অনুপম, তমাল শম্পা, সুদেষ্ণা, পিন্টু -এইসব চরিত্র সব মিলিয়ে মানসিক অবসাদ আক্রান্ত পৃথিবীর এক নির্মম চিত্র।
‘একটি কুকুরছানা কাঁদছে,শুনতে পাচ্ছো সুদেষ্ণা?’ সুদেষ্ণা উত্তর দেয়, ‘না, ওটা কুকুরছানার কান্না নয়, গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ’।
‘আরেকটু বেশি রাতে, যখন হিমাদ্রি এবং সুদেষ্ণা দুদিক থেকে ধরে তমালকে নিয়ে গাড়িতে তুলল, তখন ইন্দ্রনীলের বাড়ির উঁচু নিমগাছটার মাথায় একটা মস্ত বড় চাঁদ উঠেছিল।’
বিয়োগপর্ব উপন্যাসটি সমস্ত সম্পর্কের বিয়োগচিহ্নকেই দেখিয়েছে,সঙ্গে দেখিয়েছে বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে আমাদের সমাজব্যবস্থার অবক্ষয়িত রূপ। দেখিয়েছে তীব্র সংবেদনশীল মানুষেরা, তীব্র অনুভব ধারনকারী মানুষেরা কেমন করে হারিয়ে যায় সমাজের করাল গ্রাসে।
কবিতা ও উপন্যাসের পাশাপাশি রণজিৎ দাশের লেখা যে দুটি প্রবন্ধের বই আমি পড়েছি,তার একটি হল ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’ আর অন্যটি‘ কবিতার দ্বিমেরুবিশ্ব। প্রথম প্রবন্ধটির শুরুতেই নারীর খোঁপার ফুল সুন্দর ও সত্যের এক নান্দনিক উপস্থাপন। তারপর ক্রমেই এগোতে থাকি সৌন্দর্য্য কি সত্যের প্রকাশ! না মূলত সত্যের প্রতিদ্ব›দ্বী! আলোচনা মোহিত করে রাখে,জন্ম দেয় প্রশ্নের পর প্রশ্ন। পরের প্রবন্ধে আসে পরমানন্দের সন্ধান ও ব্যর্থতা। বইটি পাঠকের মনে এক অপূর্ব মায়াজাল তৈরি করে,একবার পাঠের পরে আবার সেই মায়াবী প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়তে হয়।
কবিতার দ্বিমেরুবিশ্ব রণজিৎ দাশের দ্বিতীয় প্রবন্ধগ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে বিষ্ণুদের কবিতার আলোচনা ও বিনয় মজুমদারের কবিতার আলোচনা রয়েছে। এছাড়া মাতৃভাষার সংকট ও বিজ্ঞান ও দর্শন প্রসঙ্গে চমৎকার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও একটি মনোজ্ঞ রচনা রয়েছে এখানে। আলোচনাগুলো সরস,তাই তা আমাদের মেধাকে ভারাক্রান্ত করে না। জীবনজিজ্ঞাসার ভিতর দিয়ে কবিতার পথ কতটা নান্দনিক,কতটা ক্ষত জড়িয়ে থাকে শিল্পের উচ্চাকাঙ্খার সাথে- নানারকম উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সমস্ত দ্বন্দর ভিতর থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে কবিতার আলো।
রণজিৎ দাশের সকল লেখাই খুব চেনা জিনিসের কথাই বলে। কবিতার ভিতর ঢুকে পড়ে চেনা মানুষ, পাগল, মদ, বেশ্যা, ভিখারী, জুতোচোর ও ইশ্বর। কিন্তু এক অসাধরণ নিমগ্নতায় আবহমানের দ্বন্দগুলি কবিতায়, উপন্যাসে ও প্রবন্ধে এক নতুন জিনিস হয়ে ওঠে। তিনি নিরন্তর দেখে চলেন, সমাজ, পৃথিবী, দুইয়ের চক্রান্ত, চাঁদ, কীট, ফুল, ভুল ও সমগ্রতা। কবিতায় দেখান প্রক্রিয়া প্রতিক্রিয়া- ও নানা প্রবণতা। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে নিজেরও রূপান্তর ঘটে যায়।
জন্ম কুমিল্লায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, লেখালেখি করছেন দীর্ঘকাল ধরে। মূলত গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন। প্রথম উপন্যাস অতঃপর নিজের কাছে প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, একুশে বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাস, দিগন্ত ঢেউয়ের ওপারে প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে । ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি। নভেলা যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্রঝিনুক ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। লেখালেখির বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে সংগীতচর্চা তাঁর অন্যতম সংরাগ।