পার্থসারথী পান্ডা
লিখতে গিয়েছিলেন আত্মজীবনী, হয়ে উঠল ‘পিতৃস্মৃতি’। রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনটি ছিল এমনই পিতৃকেন্দ্রিক। তিনি ছিলেন নীরবকর্মী, মুখচোরা মানুষ। পিতৃচিন্তা এবং পিতার দেওয়া দায়িত্ব নিষ্ঠা ভরে পালন করাই ছিল তাঁর প্রধান কর্তব্য। সেই কর্তব্যের মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর শিল্পী-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক মনটি। কমে গেছে সৃজনশীলতার সময়। পত্নী মৃণালিনী এবং পুত্র শমীর অকালমৃত্যু কীভাবে যে রবীন্দ্রনাথকে দুঃখী ও অসুখী করে রেখেছিল, তা রথীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই কবিকে সমস্তরকমভাবে সুখী করাটাই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবির চাওয়াকেই নিজের চাওয়া বলে মেনে নিয়েছিলেন।
রথীন্দ্রনাথ চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। হতে পারতেন সাহিত্যিক। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই নির্মেদ, প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সুললিত গদ্য লেখার দক্ষতা তাঁর ছিল। ‘পিতৃস্মৃতি’ এবং স্মৃতিমুখর ‘On the Edges of Time’-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পদ্যও তিনি কিছু রচনা করেছিলেন। রান্নায় অসম্ভব পটু ছিলেন। শান্তিনেকতনে আসা বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য নিজের হাতে জ্যাম-জেলি তৈরি করতেন। প্রয়োজন পড়লে রান্না করতেন বিভিন্ন ধরনের স্বাদু পদ। সুগন্ধি পাউডার এবং ভালো সেন্ট তৈরি করতে পারতেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের একজন। ভালো করে সংস্কৃত শিক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাঞ্জল বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। চামড়ার ওপর সুন্দর নকশা করতে পারতেন। আর জানতেন বাটিকের কাজ। শান্তিনিকেতনে এই দুইয়েরই প্রবর্তন হয় তাঁর হাত ধরে। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক দারুশিল্পী। নানা রঙের কাঠ সংগ্রহ করে, সেইসব কাঠের নিজস্ব রঙ অক্ষুন্ন রেখে খোদাই করে কত না অসামান্য শিল্পকর্ম করেছেন তিনি। আসবাবের অভিনব সব নকশা তৈরি করেছেন। বলতেন, ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের; কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।’ প্রথাগতশিক্ষায় স্থপতি না-হয়েও শান্তিনিকেতনের অজস্র বাড়ির নকশা তৈরি করেছেন। যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। ছবি আঁকতে পারতেন। বিভিন্ন ফুলের ছবি আঁকায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তারপরও তিনি কৃষিবিজ্ঞানী হলেন রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেপূরণের জন্য।
আসলে জমিদারী দেখভাল করার ভার হাতে নেওয়ার পর একটু কাছ থেকে গ্রামাঞ্চলকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে তিনি দেখেছিলেন যে, গ্রামের মানুষ সেই প্রথাগত সনাতনপন্থায় কৃষিকাজ ও পশুপালন করে চলেছেন, অথচ লাভের লাভ তেমন কিছু হচ্ছে না। তখন তাঁর মনে পল্লিউন্নয়নের চিন্তা ঢুকল। কাজেই ছেলেকে পাঠালেন আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক কৃষিবিদ্যা এবং গো-পালন বিষয়ে পড়তে। রথীন্দ্রনাথ শিখে এসে গ্রামের মানুষকে শেখাবেন, এই হল তাঁর ভাবনা। মনে পিতৃবন্ধু জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, বাবার ইচ্ছেপূরণ করতে ছেলে বেশ আগ্রহ নিয়েই আমেরিকা গেলেন। কারণ, নতুন কিছু শিখতে, নতুন কিছু করতে রথীন্দ্রনাথের চিরকালই প্রবল আগ্রহ।
আমেরিকা থেকে ফিরে শিলাইদহে উন্নতমানের কৃষিযন্ত্রপাতি নিয়ে একটি কৃষিফার্ম গড়ে তুললেন। চাষিদের আলু, টমেটো আর আখের চাষ শেখালেন। মাটি পরীক্ষার জন্য ল্যাব তৈরি করলেন। শেখালেন ট্রাক্টরের ব্যবহার। নিজে ট্রাক্টর চালিয়ে তাদের জমি চাষ করে দিলেন। পতিসর ও সুরুলেও এই ধরনের উন্নয়নে হাত দিলেন। এদিকে যখন এইসব কর্মকাণ্ড চলছে, তখন ওদিকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন। একা হাতে তা সামলাতে রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই ছেলেকে তিনি ডেকে নিলেন এই কর্মযজ্ঞে। পিতার ডাক অগ্রাহ্য করার শিক্ষা রথীন্দ্রনাথের ছিল না। তবে, গ্রামের কৃষিজীবনের সঙ্গে তাঁর যে আন্তরিক একটা যোগসূত্র ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে আসতে তাঁর ভারি কষ্ট হয়েছিল। তিনি লিখেওছেন সে কথাঃ ‘সেই শিলাইদহ—যার কুঠিবাড়ির চারদিকে গোলাপ ফুলের বাগিচা, একটু দূরে সুদূর বিস্তারী ক্ষেত, যা বর্ষার দিনে কচি ধানে সবুজ, শীতকালে সরষে ফুলের হলদে রঙে সোনালি; সেই পদ্মা নদী… এই সব যা–কিছু আমার ভালো লাগত—সেইসব ছেড়ে আমায় চলে যেতে হল বীরভূমের ঊষর কঠিন লাল মাটির প্রান্তরে।’
প্রিয়ভূমি ছেড়ে এসেও রথীন্দ্রনাথ নিশ্চেষ্ট রইলেন না। শান্তিনিকেতনে পিতার দেওয়া দায়িত্বভার মাথায় তুলে নিয়েও উদ্যানপালনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যে শান্তিনিকেতনের মাটিতে গোলাপ ফুটতে চাইত না, সেখানে তিনি হরেক রকমের গোলাপের বাগান করলেন। লতানো আমের আশ্চর্য এক বাগান তৈরি করলেন। তার সঙ্গে ছবি আঁকা-শিল্পচর্চাও অব্যাহত রইল। এরইসঙ্গে বিশ্বভারতীর জন্য তাঁর ত্যাগেরও অন্ত রইল না।
১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হল বটে, কিন্তু তার ব্যয় চালানোর মতো সামর্থ্য রবীন্দ্রনাথের তখন কমে এসেছিল। ঋণের দায়ে জমিদারি যেতে বসেছে। হাতে শুধু বইয়ের রয়্যালটির টাকা। কাজেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর তখনও পর্যন্ত লেখা সমস্ত বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব লিখে দিলেন বিশ্বভারতীকে। সেটাই হল সবেজাত প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র সম্বল। লিখে না-দিলে এই রয়্যালটির উত্তরাধিকারী হতেন রথীন্দ্রনাথ। তিনি এই লিখে দেওয়ার ব্যাপারটিতে আপত্তি জানাতেই পারতেন, কিন্তু জানাননি। দাবি করতে পারতেন নিজের অধিকার। কিন্তু, করেননি। প্রথমত, তাঁর মানসিক গঠনই সে-রকম ছিল না; দ্বিতীয়ত, তিনি তো রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীতেই ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। জীবনের শেষ ক’টি বছর ছাড়া তিনি প্রায় আজীবন পিতার স্বপ্নের বিশ্বভারতীতে বিনা বেতনে কাজ করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারির মধ্যেই একটি সমবায় ব্যাঙ্ক ছিল। সমবায় ব্যবস্থাকে উৎসাহ দিতে ও গ্রামীন ঋণজর্জরিত চাষিদের সুবিধের জন্য নোবেল প্রাইজে পাওয়া সমস্ত টাকা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর নামে গচ্ছিত রাখলেন সেই ব্যাঙ্কে। এর সুদে চলতে লাগল বিশ্বভারতীর খরচ। ব্যাঙ্কটি সম্পর্কে অনেক শুভানুধ্যায়ীর অনুযোগ সত্বেও রথীন্দ্রনাথ পিতার সদিচ্ছেকেই সমর্থন করলেন। বলাবাহুল্য, ক’বছরের মধ্যেই ব্যাঙ্কটি ফেল করল। কিন্তু, রথীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বভারতীর ক্ষতি হতে দিলেন না। জোড়াসাঁকোর একটি বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকার ক্ষতিপূরণ করলেন।
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথের হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন একজোড়া চটিজুতো। সেই হল রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিসংগ্রহের সূত্রপাত। মৃণালিনী দেবীর পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাময়িকপত্রে প্রকাশিত রবীন্দ্রসম্পর্কিত লেখার কাটিং সংগ্রহ করে তুলে দিলেন বিশ্বভারতীর হাতে। নিজের জন্য বানিয়েছিলেন, নিজেরই নকশায় মনের মতন একখানা বাড়ি, ‘উদয়ন’। আশ্রমের অনেকেই বাঁকা চোখে তাকে বলত, ‘রাজপ্রাসাদ’। রথীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন আজীবন এখানেই বাস করবেন। কিন্তু, করলেন না। তাঁর সেই প্রিয় বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সঙ্গে গড়ে তুললেন, রবীন্দ্র সংগ্রহশালা। খুলে দিলেন রবীন্দ্র-গবেষকদের জন্য।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটি অনায়াসে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর রথীন্দ্রনাথ নিজে গেলেন দিল্লি, নেহেরুর সঙ্গে দরবার করে গানটি জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত করে তবেই ফিরলেন বাংলায়। রচনা করলেন বাঙালির জন্য এক গৌরবের ইতিহাস।
রথীন্দ্রনাথ শেষ-জীবনে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব ছেড়ে দেরাদুনে গিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন। তারই মধ্যে এগিয়ে এসেছিল রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। রবীন্দ্রনাথের পুত্র হয়েও, আশ্রম-বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র হয়েও, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হয়েও বিশ্বভারতী কবির যে জন্মশতবর্ষের আয়োজন করল, তাতে ডাক পেলেন না। ডাক পেলেন সুদূর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য কবির জন্মশতবার্ষিকীপালক কমিটির কাছ থেকে। কর্মভূমি ও পিতৃতীর্থে আমন্ত্রিত না-হয়েও তিনি গেলেন সেখানে। আঘাত পেয়ে ফিরে এলেন দেরাদুনে এবং তার অল্পদিন পরেই তিনি মারা গেলেন। নিরলস নীরবকর্মী ও অসামান্য প্রতিভাবান এই মানুষটিকে বিশ্বভারতী বা বাঙালি, আমরা কেউই যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারিনি, শ্রদ্ধা জানাতে পারিনি আজও…