| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা-একাদশ পর্ব : অন্তরের অন্তঃস্রোতে বয়ে চলে আবেগের নদী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অ.

টিয়া পাখির বাচ্চাটি পড়ে গেছে গাছের ডাল থেকে। অসহায় মা পাখিটা উড়ে উড়ে কাঁদছে। রাস্তা দিয়ে কতজন এল গেল, পাখি মায়ের কষ্টে কেউ সাড়া দেয় না। সবার বড্ড তাড়া।

ছোট্ট পাখির ছানার ছটফটানি আর মা পাখির ব্যাকুল কান্না দেখে স্থির থাকতে পারে না একটি ছেলে, ঠাকুরগাঁয়ের দশ বছরের শিশু লিয়ন। বাবা তার থেকেও নেই, কখনও খোঁজ নেন না, আরেকটি বিয়ে করে থাকেন অন্য জেলায়। নিতান্ত দরিদ্র মায়ের স্নেহের আঁচলে বেড়ে ওঠা লিয়নের প্রাণ কেঁদে ওঠে পাখিমায়ের কান্নার সুরে। সে ছুটে যায়। শিশু লিয়নের মায়াময় ছোট্ট দুটি হাত পাখিশিশুটিকে আদরে তুলে নেয় রুক্ষ মাটি থেকে।

একহাতে পাখির বাচ্চা, আরেক হাতে গাছের ডাল ধরে লিয়ন উঠতে থাকে গাছের মগডালে। পাখির ছানাটিকে বসিয়ে দেয় তার মায়ের বাসায়। পরম মমতায় সে একবার তাকায় পাখিশিশুর ছোট্ট চোখে। গাছের উপরে তখন অস্থির পাখিমা, হয়তো সেও পরম মমতায় তাকিয়ে দেখছে একটি মানব শিশুকে। লিয়নের বুকে ভাললাগার এক শিহরণ খেলা করে!

হঠাৎই তার নরম কোমল হাত পিছলে যায় গাছের ডাল থেকে। চোখে অন্ধকার লিয়নের। মাথায় রক্ত, সারা গায়ে রক্ত। উঁচু গাছ থেকে সে প্রথমে পড়ে একটি ইটের দেয়ালে, সেখান থেকে মাটিতে। অজ্ঞান। জ্ঞান ফেরে না তিন সপ্তাহেও। মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাত, হাত ভেঙ্গে গেছে। চিকিৎসা জোটে না টাকার অভাবে। দুইটি মাস প্রায় বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের হাসপাতালে। অসহায় মা কাঁদে, ভয়ঙ্কর এক আশংকায় বুক কেঁপে ওঠে তার! এত কষ্টের লিয়নসোনা কী আর চোখ মেলে তাকাবে না? মা বলে ডাকবে না?

লিয়ন ভালবেসে বাঁচিয়েছে পাখির ছানার প্রাণ। হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে পাখিমায়ের প্রাণে। লিয়নের মায়ের মুখে হাসি ফিরিয়ে দেয় কিছু মানুষ। ভালোবেসে পাশে দাঁড়ায়। তাদের সহায়তায় উন্নত চিকিৎসা পায় লিয়ন। সে দাঁড়ায়, হাঁটে, হাসে। একটা চশমা আর ঘড়ি কিনে দেওয়ার জন্য মাকে অস্থির করে তোলে!

আ.

একটা পাখির বাচ্চার কষ্টে লিয়নের প্রাণ কেঁদে ওঠা, লিয়নের কষ্টে কিছু মানুষের সহায়তা করতে আসা—এ তো নতুন কোন ঘটনা না। অন্যের বেদনায় বেদনার্ত হওয়া, অন্যের মুখে হাসি ফেরাতে ব্যকুল হওয়া—মানুষের আবেগের এই চিরন্তন মানবিক প্রকাশই সম্ভবত মানুষের সবচেয়ে সুন্দর বৈশিষ্ট্য। আর যদি ভাবি, মানুষের সবচেয়ে অসুন্দর বৈশিষ্ট্য কী? সম্ভবত অন্যের মুখ ম্লান করে সুখ খোঁজা, অন্যের কষ্টের কারণ হওয়া, ঘৃণা, হিংস্রতা ইত্যাদিই সবচেয়ে অসুন্দর।

এই যে ভালবাসা অথবা ঘৃণা, ত্যাগ বনাম দখল, সহায়তা বা ধ্বংস—এসবের পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আবেগ। আমরা কখনও ভালবাসায় উদ্বেলিত হই, উন্মত্ত হই; কখনওবা ঘৃণায়, আক্রোশে আক্রমণাত্মক হই, হিংস্র হয়ে উঠি; স্নেহে, করুণায় বিগলিত হই কখনও। মানবিক আবেগ আমাদের দেবতা অথবা দানবে পরিণত করে।

আমাদের অন্তরের অন্তঃস্রোতে অবিরাম বয়ে চলে এক আবেগের নদী।

ই.

“রাস্তার পাশে আপনার ছেলে আয়ান দেখলাম কাঁদছে, পাশের বাড়ির অনিন্দ্যকেও ওখানে কাঁদতে দেখলাম। মনে হয় দুজনে মারামারি করেছে”—বললেন এক প্রতিবেশী। এবার বলুন দেখি, কে আগে মারামারি শুরু করেছে? নিশ্চয়ই আপনার ছেলে আয়ান না, পাশের বাড়ির দুষ্টু ছেলেটাই আগে মেরেছে আয়ানকে! ঘটনাটি কল্পিত হলেও এরকম অনুমানের ঘটনা অনেক সময়ই ঘটে থাকে। আমরা সাধারণত আমাদের আপনজনকে অপরাধী ভাবতে চাই না।

পরিবার, রাষ্ট্র, ধর্ম, পেশা, অঞ্চল, প্রতিষ্ঠান এরকম নানা পরিচয়ে আমরা একে অন্যের সাথে ভালবাসার আবেগীয় বন্ধনে আবদ্ধ থাকি। এই বন্ধনভুক্তদের আমরা ভাল বা নির্দোষ ভাবতে পছন্দ করি, তাদের অপরাধ উপেক্ষা করতে চাই। এই বন্ধনের বাইরে থাকা ভিন্ন পরিচয়ের মানুষদের প্রতি আমাদের সব সময় একই ধরনের অনুভূতি কাজ করে না। অনেক সময় তাদেরকে দোষী ভাবতে ভাল লাগে, অপরাধী মনে হয়। একই কাজ ‘আমাদের লোক’ করলে আমাদের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, ‘ওদের লোক’ করলে তার থেকে ভিন্ন বা ক্ষেত্র বিশেষে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে সাম্প্রদায়ীক হামলার ঘটনাগুলো খেয়াল করলে এ ধরনের অসংখ্য নজির পাওয়া যাবে। ভিন্ন ধর্মের একজন ব্যক্তি আমার ধর্মকে অসম্মান করেছে, অতএব সেই ধর্মের যে কোন ব্যক্তি বা ধর্মীয় স্থাপনার উপর হামলা করা যৌক্তিক—এ ধরনের চিন্তাপদ্ধতিকে ব্যবহার করে এদেশে, পাশের দেশগুলোতে মূলত সাম্প্রদায়ীক হামলার ঘটনা ঘটানো হয়।

রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ঠাকুরপাড়াতে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে টিটু রায় নামের একজনের ‘ধর্মীয় অবমাননার’ ফেসবুক পোস্ট বিষয়ে প্রচারণার মাধ্যমে। যেহেতু হিন্দু টিটু রায় ইসলামের অবমাননা করেছেন, অতএব হিন্দুদের ওপর হামলা করে এর শোধ নিতে হবে—আক্রমণকারীদের এই ছিল যুক্তি। পরে জানা গেল, টিটু রায় নয়, মুসলিম নামধারী একজন সেই ‘ধর্মীয় অবমাননাকর’ ফেসবুক পোস্টটি দিয়েছিলেন। এই তথ্য জানার পরে ‘আসল অবমাননাকারীর’ উপর আর কাউকে ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়নি। এখানে আবেগীয় সম্পর্কের ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’—এরকম বিভাজন আক্রমণকারীদের হিংস্র হয়ে ওঠার পেছনের যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা এবং সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ, গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ হত্যা, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ, আমাদের দেশের নাসিরনগর, রামু বা ভোলার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এর কাছাকাছি চিত্র পাওয়া যাবে।

অনেক সময় করুণার মানসিকতার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে নির্দোষ ভাবতে পছন্দ করি। “ও যেহেতু অনেক কষ্ট পেয়েছে, তাই হয়তো এই কাজটা করে ফেলেছে। ওর দোষ কোথায় বা ওকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ”–এ ধরনের অনেক উদাহরণ চারপাশে দেখা যায়। ভারতের দস্যু ফুলন দেবীর প্রতি জনমনস্তত্ত্ব এক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।

ঈ.

কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বাস্তব অবস্থার বদলে আবেগ, অর্থাৎ ভালবাসা, ঘৃণা বা করুণা যখন যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে বলা যায় ‘আবেগীয় ছদ্মযুক্তি’। ইংরেজিতে বলা হয় Appeal to emotion fallacyবাAppeal to pity fallacy, যাকে ল্যাতিন ভাষায় বলা হত Argumentum ad misericordiam, ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় Argument to compassion।

ব্যক্তির চিন্তা, বিশ্লেষণ, যুক্তি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আবেগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে। আবেগ ব্যক্তিগত ব্যাপার মনে হলেও তা আসলে সামন্যই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র প্রভৃতি নানাবিধ প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির আবেগ ভাঙ্গা-গড়া ও আবেগের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যক্তি বা জনসমষ্টির আবেগ তাই নানা সময় নানাভাবে ব্যবহৃত হয়, ব্যক্তি কখনও এক্ষেত্রে কর্তা বা কর্ত্রী, অনেক সময় নিছকই ক্রীড়নক মাত্র।

ইতিহাসের বিশাল বিশাল মানবিক নির্মাণ থেকে ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে মানুষের আবেগ অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তাই আবেগকে নিরাবেগ দৃষ্টিতে দেখতে পারাটাও দরকার।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত