যুক্তিচিন্তা-ত্রয়োদশ পর্ব : আমরা ব্যাচেলর না, চাকরিজীবী!
শৈশবে বাবার গা ঘেঁষে বসে শোনা গল্পগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সঞ্চয়। সেই স্পর্শ, ঘ্রাণ, উত্তাপ এখনও প্রাণের ছোঁয়া হয়ে জেগে আছে। আর জেগে আছে বাবার সেই গল্পগুলো। জীবন্ত। বাবাকে হাত দিয়ে ছুঁতে পারি না তেত্রিশ বছর। বাবার বসার সেই টুল, সেই বারান্দা, সেই বকুল গাছ, সেই হিজলঝোলা পুকুর, পশ্চিমবাড়ি, এক কোনায় হরিণের শিং লাগানো চারচালা টিনের ঘর—সব হারিয়ে গেছে বাবাকে হারানোর বছর দুয়েক আগেই।
নিভৃত নিকলা গ্রামের এক ঝিঁঝিঁময় জোনাকসন্ধ্যায় বাবার কোলঘেঁষে শোনা একটি গল্প আজ টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে একটি লেখা পড়তে গিয়ে মনে পড়ল।
অ.
অনেককাল আগে হিন্দু ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন চার পণ্ডিত—বেদ, স্মৃতি, গীতা ও ব্যাকরণ পণ্ডিত। মর্যাদার ক্রমানুসারে বেদের পণ্ডিতের জন্য সবচেয়ে উচ্চমানের আসন এবং ব্যাকরণ পণ্ডিতের জন্য ছিল সবচেয়ে নিম্নমানের আসন। ব্যাকরণ পণ্ডিত অনুষ্ঠানস্থলে সবার আগে এসে ভুলক্রমে বেদের পণ্ডিতের আসনে বসেছেন। এমন সময় অন্য তিন পণ্ডিত এসে বেদের পণ্ডিতের জন্য নির্ধারিত আসনে ব্যকরণ পণ্ডিতকে উপবিষ্ট দেখে বিব্রত বোধ করেন। সর্বাপেক্ষা সম্মানীয় বেদজ্ঞ পণ্ডিত অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ব্যাকরণ পণ্ডিতকে তাঁর নিজ আসনে গিয়ে বসার জন্য অনুরোধ করেন। ব্যাকরণ পণ্ডিত নিজের ভুল বুঝতে পারলেও আসন থেকে উঠে যাওয়ার বিষয়টিকে অপমানজনক মনে করেন। তিনি বেদের পণ্ডিতকে বলেন, মহাশয়, আপনার উচ্চারিত বাক্যটি ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ নয়। কোন অশুদ্ধ বাক্য আমার পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। এরপর তিনি বক্তব্যের ব্যাকরণগত দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করেন এবং সঙ্গত কারণে বেদের পণ্ডিত ব্যাকরণ পণ্ডিতের সাথে বিতর্কে পেরে ওঠেন না। এদিকে ব্যাকরণ পণ্ডিতও আসন ত্যাগ করেন না।
বাবা সম্ভবত এই গল্পের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, কারও মর্যাদা যেমনই হোক, বিশেষ ক্ষেত্রে তাকে যোগ্যতা দিয়েই নিজের অবস্থান অর্জন করে নিতে হয়। হয়তো চেয়েছিলেন, তাঁর ছেলেটিও আপন যোগ্যতা বিকশিত করে ভবিষ্যতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। বাবার সেই চাওয়া ব্যর্থ হয়েছে, সুযোগ্য হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে তাঁর ছেলে যায়নি।
আমি ভাবছিলাম অন্য কথা, ব্যাকরণ পণ্ডিতের আসন ধরে রাখার পেছনে যোগ্যতা নয়, বরং মূল ভূমিকা রেখেছে কৌশল। তিনি যুক্তিতে পেরে উঠবেন না জেনে বেদের পণ্ডিতের সাথে ব্যাকরণের বিতর্ক শুরু করে করেছেন। এভাবে কৌশলে নির্ধারিত আসনে বসার প্রসঙ্গটিকে ধামাচাপা দিয়ে তিনি সফলভাবে আলোচনাটিকে নিজের সুবিধামতো ভিন্ন প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
আ.
একবার ঢাকায় বাসা খুঁজছি, আমি আর এক সহকর্মী বড়ভাই। দুজনই অস্ত্রীক। যে বাসাটিই আমাদের পছন্দ হয়, বাড়িওয়ালা ব্যাচেলর শুনে সাথে সাথে বিদায় করে দেন। এ অবস্থায় কাটাসুর কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাট আমাদের পছন্দ হল। বাড়িওয়ালা যথারীতি জানতে চাইলেন, ফ্যামিলি, না ব্যাচেলর? আমি অবিকল মনে করতে পারছি, আমার সহকর্মী উত্তরে বললেন, আমরা ওমুক প্রতিষ্ঠানে, তমুক বিখ্যাত অধ্যাপকের সাথে কাজ করি। তাৎক্ষণিক প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার সুফল মিলেছিল সেদিন, আমরা বাসার ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ই.
কথায় জেতার কৌশল হিসেবে এরকম প্রসঙ্গ পাল্টানোর অজস্র উদাহরণ আমরা প্রতিদিন দেখে থাকি। যুক্তিবিদ্যার বিবেচনায় এই কৌশলকে বলা যায় ‘প্রসঙ্গচ্যুতির ছদ্মযুক্তি’, ইংরেজিতে বলে Red Herring Fallacy বা Irrelevant Conclusion Fallacy, যা লাতিন Ignoratio elenchi থেকে এসেছে। কোন একটি আলোচনা বা বিতর্কে মূল প্রসঙ্গে না গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কোন বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে মূল প্রসঙ্গটিকে আলোচনার বাইরে ঠেলে দেওয়া র মাধ্যমে ‘প্রসঙ্গচ্যুতির ছদ্মযুক্তি’র চর্চা করা হয়।
কথিত আছে যে, সুস্বাদু রেড হেরিং মাছের ঘাণ খুবই আকর্ষণীয়। শিকারী কুকুরের প্রশিক্ষণের সময় সে তার নির্ধারিত শিকারের দিকে না গিয়ে যদি রেড হেরিং মাছের সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে সে দিকে ছুটতে শুরু করে, তাহলে বুঝতে হবে তার প্রশিক্ষণ যথাযথ হচ্ছে না। মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ভিন্ন লক্ষ্যের দিকে ছোটার উদাহরণ হিসেবে ‘প্রসঙ্গচ্যুতির ছদ্মযুক্তি’র নাম দেওয়াহয় Red Herring Fallacy।
কবি ও লেখক