Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

যুক্তিচিন্তা-চতুর্দশ পর্ব : সাকিব আল হাসানের মা কেন হরলিক্স খেতে বলেন?

Reading Time: 3 minutes

ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, রাজনীতি করব। বাবার কোলঘেঁষে শুনতাম মুঘল, পাঠান থেকে গান্ধী, নেহেরু, মুজিবের গল্প। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গল্পের চেয়ে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের গল্প আমাকে বেশি টানত। তখনও আমরা গ্রামীণ ভূস্বামী। আপাতনিরব এক ঝড়ে হঠাৎ ভূমিহীনে পরিণত হওয়া, বাবার চিরপ্রস্থান এগুলোও হয়তো কিশোর মনে ছাপ ফেলে থাকবে।

সেসময় দারিদ্র্যের বাস্তব যন্ত্রণার চেয়ে দুনিয়াটাকে বোঝার চেষ্টা বেশি তাড়িয়ে বেড়াত। ক্লাস সিক্সের এক‌টি অনুসন্ধিৎসু শিশুর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাবা হঠাৎ হারিয়ে গেলে বই ছাড়া আর কোনও আশ্রয় থাকে না আমার। ফলে স্কুলে যাওয়ার চেয়ে দিনরাত বই পড়াটাই আমার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। একইসাথে পোক্ত হতে থাকে রাজনীতি করার চিন্তা। বাড়তে থাকে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নের টান। জাসদ ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সাথে মেশার সুযোগ হলেও তাদের সংগঠনে যোগ দেওয়ার আহ্বানে নিজের ভেতরে সাড়া পাইনি।

অ.

ক্লাস টেন। ১৯৯১। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা সূত্রে পরিচয় হয় কাস্তে মার্কা নিয়ে ভোটে দাঁড়ানো ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের প্রার্থীর সাথে। ভাল লেগে যায়। প্রতিবেশী এক কাকার নেতৃত্বে নেমে পড়ি নির্বাচনী প্রচারণায়। আমরা অল্প কয়েকজন মানুষ মাইকিং করে, পোস্টার লাগিয়ে, খুব ছোট আকারের মিছিল করে কাস্তে মার্কার পক্ষে ভোট চাই।

আমরা সাধারণত নারী আর দরিদ্র কৃষকদের কাছে ভোট চাইতাম। আমাদের কথাবার্তা শুনে অধিকাংশ মানুষ বলতেন, উনিই তো ফিটেস্ট ক্যান্ডিডেট, ওনাকেই ভোট দেওয়া উচিৎ, কিন্তু জিততে তো পারবেন না। ভোট নষ্ট করে লাভ কী? ভোটাররা আমাদের অল্প কয়েকজন মানু‌ষের গরিবি প্রচারণা দেখেই বুঝতে পারতেন, এই প্রার্থীর সাথে মানুষ নাই।

আমাদের কেন্দ্রে কাস্তে মার্কায় ১৮টি ভোট পড়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, পুরো উপজেলায় আমাদের কেন্দ্রেই তিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন।

মানুষ কাস্তে মার্কায় ভোট দেয়নি, কারণ তারা দেখেছে, কাস্তে মার্কার সাথে মানুষ নেই। ভোটে জেতার জন্য তাই প্রার্থীরা প্রচুর মানুষ মাঠে নামায়, বিশাল বিশাল মিছিল করে। বিষয়টি আমাদের সেই নেতাও বুঝেছিলেন, কয়েক বছর পর তাই তিনি ধানের শীষ মার্কা নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নাকি পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

বেশিরভাগ মানুষ কার পেছনে দাঁড়ায়? যার পেছনে বেশি মানুষ আছে।

আ.

করোনাক্রান্তিকাল একটু হালকা হয়ে এলে এক বন্ধুর ল্যাপটপ কেনার পথসঙ্গী হয়ে আগারগাঁও আইডিবি ভবনে যাই। কয়েকটি শোরুম ঘুরে শেষে সবচেয়ে ভিড়াক্রান্ত শোরুমটি থেকে ল্যাপটপ কেনা হল। সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় দুইটি ঘন্টা করোনা আশংকাময় সময় কাটাতে হল এক‌টি ল্যাপটপ বুঝে নিতে। সেখানে বেচাবিক্রির এতটাই চাপ। অথচ পাশের শোরুমের বিক্রেতারা মারার মতো মাছি না থাকায় চুপচাপ বসে, সম্ভবত, ফেসবুক দেখছিলেন।

কোন্ দোকানে মানুষ বেশি যায়? যে দোকানে মানুষের ভিড় বেশি থাকে।

ই.

গ্রামের কৃষক টিনের ঘর বানাতে গেলে ভাল টিন কীভাবে চিনবে? কেন, আবুল হায়াত, মানে মাস্টার সাব আছেন না! মাস্টার সাবই জানেন কোন্ টিন দামে সস্তা, টেকে বেশিদিন।

আর আপনার শিশুর ঠিকঠাক বিকাশের জন্য কোন ধরনের খাবার প্রয়োজন তা জানেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের মা। যেহেতু তাঁর ছেলে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়, অতএব আপনার শিশুকে অবশ্যই হরলিক্স খাওয়ানো উচিৎ!

ঈ.

কোনটি ভাল, সঠিক বা কোন্ কাজটি করা উচিৎ তা আমরা কীভাবে নির্ধারণ করি? অনেক সময়ই আমরা সিদ্ধান্ত নেই অধিকাংশ মানুষ কী করছে বা কী ঠিক মনে করে—এটাদেখে। আবার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ, শ্রদ্ধাভাজন বা জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, যারা উল্লেখিত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়।

বড় মিছিল দেখে ভোট দেওয়া বা ভিড় দেখে দোকানে ঢোকার পেছনে মূলত জনপ্রিয়তাকে সত্য বা ঔচিত্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করার যুক্তি কাজ করে। অন্যদিকে শিক্ষকের কাছ থেকে টিনের গুণগত মান জানা বা ক্রিকেটারের মায়ের কাছ থেকে শিশুর পুষ্টির পরামর্শ নেওয়ার পেছনে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাকে সত্য বা ঔচিত্যের মানদণ্ড ধরে নেওয়াহয়।

উ.

জনপ্রিয়তা বা জনপ্রিয় ব্যক্তিকে সত্য বা ঔচিত্যের মানদণ্ড হিসেবে ধরে নেওয়ার এই প্রবণতাকে বলা যায় ‘জনপ্রিয়তার ছদ্মযুক্তি’, ইংরেজিতে বলে Appeal to popularity fallacy, যা লাতিন Argumentam ad populum fallacyথেকে এসেছে।

প্রকৃতপক্ষে অনেক মানুষের পছন্দ বা সমর্থন অনেকক্ষেত্রেই সত্য বা ভাল ব্যাপার নাও হতে পারে। যেমন, গণপিটুনি বা সংঘবদ্ধ হামলায় অনেক মানুষ অংশ নিলেও তাকে ভাল কাজ হিসেবে ভাবার সুযোগ নেই। ভারতে নারী ধর্ষণের অভিযোগে বাবা গুরমিত রামরহিম সিং এর আটক বা শাস্তির প্রতিবাদে লাখো মানুষের তীব্র বিক্ষোভ নিশ্চয়ই তাকে মুক্তি দেওয়ার যুক্তি হতে পারে না। যত মানুষই তাকে সমর্থন করুক, তাতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন না।

একইভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা তার যে কোনও বক্তব্যের সত্যতার মানদণ্ড হতে পারে না। শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সম্পর্কে যথাযথ পরামর্শ দিতে পারেন একজন পুষ্টিবিদ, কোনও সেলিব্রিটি ব্যক্তি না। তিনি যত জনপ্রিয় ব্যক্তিই হোন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে তাকে সত্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

কোনকিছুর সত্য-মিথ্যা বা ভালত্ব-মন্দত্ব জনসমর্থন থাকা না থাকা বা কারও সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে না। সত্য, একজন বললেও সত্য; মিথ্যা, হাজারজন বললেও মিথ্যা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>