Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

যুক্তিচিন্তা-পঞ্চদশ পর্ব : ভাঙ্গা ক্যাসেটের অশ্রুত কান্না!

Reading Time: 3 minutes

অ.

অনন্তকে ভালবাসত অনা। নীলাদ্রী সেনের গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি ক্যাসেট গিফট করেছিল অনন্তকে। অনন্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতেখুব পছন্দ করত। অনা তার পছন্দের কথা ভেবেই ক্যাসেটটি কিনেছিল।

কিছু দিন পর। কোনও এক ঘূর্ণিস্রোতে অনা ভেসে যায় অন্য নদীতে। বেদনার্ত অনন্ত ভেঙ্গে ফেলে নীলাদ্রী সেনের ক্যাসেট, ফেলে দেয় নর্দমায়। এভাবে অনার স্মৃতি থেকে মুক্তি খোঁজে অনন্ত, হয়তো ঘৃণাও প্রকাশ করে। সেই থেকে নীলাদ্রী সেনের গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত অনন্তের সবচেয়ে অপ্রিয় গান।

আ.

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার খোঁজ নিয়েছেন। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

কাছাকাছি সময়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে টেস্ট করানোর উদ্যোগ নেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তার বাসা থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি এই আন্তরিক সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে তাঁর সৌজন্যবোধ হিসেবে দেখেছেন অনেকে। অন্যদিকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে অনেককেই সমালোচনা এমনকি তাচ্ছিল্য করতে দেখা যায়।

ই.

ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতি করতাম। ইচ্ছে ছিল পাশ করে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যুক্ত হব, একটি জেলায় গিয়ে সাংগঠনিক কাজের দায়িত্ব নেব। তারই প্রস্ততির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় একজন নেতার সাথে সেই জেলায় যাতায়াত শুরু করি।

একবার জেলায় এক সাবেক ছাত্রনেতার বাসায় রাতে আড্ডা হচ্ছে। কথা উঠেছে জেলার অতীতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে। পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকের ঘটনা। একজন বামপন্থী কৃষক নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে স্থানীয় নিপীড়ক হিন্দু জমিদার পরাজিত হন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ মুসলিম কৃষকরা সেই নেতার নেতৃত্বে হিন্দু জমিদারের বাড়িতে ঢুকে গরু জবাই করে। এই ঘটনাকে নিপীড়ক হিন্দু জমিদারের পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

আলোচনার এই পর্যায়ে আমি বলার চেষ্টা করি, পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু হয়ে পড়া স্থানীয় দরিদ্র শ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে এই ঘটনাটির অভিঘাত কেমন হতে পারে সেটিও ভেবে দেখা দরকার। তাদের মধ্যে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক মনে হতে পারে, তাদের সংখ্যালঘুত্বের বোধ আরও তীব্র হতে পারে। আমাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে থামিয়ে দেন সেই কেন্দ্রীয় নেতা, নাম-পরিচয়ে যিনি একজন ‘হিন্দু’। তিনি বলেন, তোমাকে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে না।

তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন সম্ভবত এই ভেবে যে, একজন ‘হিন্দু’ হিসেবে এই ‘সংবেদনশীল’ বিষয়ে আমার কথা বলা আমার জন্য বা আলোচনার জন্য ভাল নাও হতে পারে। আলোচ্য বিষয় নয়, আমার জন্মগত ধর্মীয় পরিচয় সেখানে মূল বিবেচ্য ছিল।

ঈ.

উল্লেখিত ঘটনাগুলো আপাততুচ্ছ মনে হলেও আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ায় এই ধরনটি অনেকক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। কোন ঘটনাকে দেখার ক্ষেত্রে, কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে, কোন কিছুর সত্যতা, গ্রহণযোগ্যতা নিরূপনের ক্ষেত্রে আমরা বিষয়ের চেয়ে ব্যক্তির পরিচয়, অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব দেই। কথাটি সত্য, নাকি মিথ্যা; ভাল, নাকি মন্দ; সেটি যাচাই না করে, কথাটি কে বলেছে—তার পরিচয়েরভিত্তিতে সত্যতা নির্ণয় বা মূল্যায়ন করি। বিষয়ের মধ্যে না দেখে উৎস-পরিচয়েরভিত্তিতে সত্যতা বা যথার্থতা বিচারের এই পদ্ধতিকে বলা যায় ‘উৎস-পরিচয়ের ছদ্মযুক্তি’, ইংরেজিতে বলে Genetic Fallacy।

উ.

প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া যন্ত্রণার অনুসঙ্গ হিসেবে নীলাদ্রী সেনের গান অসহ্য লাগে অনন্তের। শিল্পী সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ হয়েও ব্যক্তির অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার দায় তাকে বহন করতে হচ্ছে। এখানে গানকে ব্যক্তির সাপেক্ষে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

অন্যদিকে সৌজন্যবশত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একই কাজ করার জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দুভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন, তাদের আচরণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর পেছনে কাজ করেছে দুজন ব্যক্তি সম্পর্কে মূল্যায়নকারীদের ভিন্ন ধারণা এবং তাদের দুজনের ভিন্নরকম রাজনৈতিক পরিচিতি। এখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিষয়টি নিছক সৌজন্য প্রকাশক আচরণ হিসেবে দেখা হয়নি, তাদের ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক অবস্থান, পরিচিতি এবং মূল্যায়নকারীদের সে সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গীর সাপেক্ষে মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

অত্যাচারী হিন্দু জমিদারের বাড়িতে গরু জবাই করা নিপীড়িতের প্রতিবাদ, নাকি এখানে সাম্প্রায়িকতার উপাদান আছে, আমি সেই প্রশ্নটিই তুলতে পারিনি, কারণ আমার ‘হিন্দু’ পরিচয়। এখানেও বিষয় নয়, ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে।

‘উৎস-পরিচয়ের ছদ্মযুক্তি’র প্রভাবে এরকম কত যে সুরসঙ্গীত থেকে আমরা নিজেদের বঞ্চিত করি, কত যে সত্য আমাদের অধরা থেকে যায়, কত যে প্রসঙ্গ চাপা থেকে যায়, ভুল ব্যাখ্যায় কতবার যে হাবুডুবু খাই—তার হিসাব কে রাখে?

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>