| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা-ষেড়শ (শেষ) পর্ব : সত্যের মায়ের নাম কী?

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অ.

তখন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে নিয়মিত আড্ডা দেই, পত্রিকা বের করি। এক বৃষ্টির দিনে এমনই এক আড্ডায় শাকিল ভাই বৃষ্টি নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করছিলেন। সম্ভবত আমার কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি আমার মনোভাব জানতে চাইলেন। আমি বলেছিলাম, বৃষ্টি আমার ভাল লাগে না। শাকিল ভাই কিছুটা অবাক হয়ে কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে আমার শৈশবের গল্প শোনাই।

শৈশবের একটা সময়ে আমাদের পরিবার প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে। বাঁশের খুঁটির উপর বাঁশ দিয়ে আটকানো টিনের চালের ছাপড়ায় আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে ছিল মায়ের সংসার। সেই ছাপড়া ঘরের চালে আবার কিছু অংশে টিন ছিল না, বাঁশের উপর পলিথিন দিয়ে রোদ-বৃষ্টি ঠেকানো হত। গ্রামের সবচেয়ে দক্ষিণে ছিল আমাদের বাড়ি, সামনে কয়েক কিলোমিটার খোলা মাঠ। ফলে বৃষ্টি-বাতাস পুরোটা শক্তি নিয়ে আঘাত করত আমাদের নড়বড়ে ঘরে। তখনকার দিনে বৃষ্টি মানেই ঘরের মেঝে ভিজে কাঁদা হয়ে যাওয়া, মায়ের সাথে পলিথিন ঠেলে জল ফেলা। আর ঝড় এলে শুরু হত আতঙ্ক, কখন বা ঘর ভেঙ্গে পড়ে, চালের টিন উড়ে যায়! ঝড়ের দাপটে টিনগুলো লাফাতে থাকত, প্রচণ্ড শব্দ হত আর আমাদের অসহায় মা তার চারটি শিশু সন্তানকে চোকির নিচে ঢুকিয়ে একটা কাঠের পিঁড়ি উঠানে ছুড়ে দিতেন এবং আর্তস্বরে চিৎকার করতে থাকতেন, “দোহাই পবন ঠাকুরের, দোহাই পবন ঠাকুরের, পাটে বইস, পাটে বইস…”।

ফলে বৃষ্টি আমার কাছে নাগরিক রোমান্টিসিজমের বিষয় ছিল না, বরং একটা আতঙ্ক আর অসহায়ত্বের অনুভূতি নিয়ে আসত। একটা বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতের কারণে বৃষ্টি সম্পর্কে আমার এমন মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে, পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে না দেখলে যা ঠিকমতো বোঝা যাবে না। আবার ঝড় থামানোর জন্য ‘পবন ঠাকুরের’ কাছে আমার মায়ের আকুল প্রার্থনা বা ঝড়কে শান্ত হয়ে বসার জন্য উঠানে কাঠের পিঁড়ি ছুড়ে দেওয়া যে কারও কাছে অত্যন্ত হাস্যকর একটি ব্যাপার মনে হতে পারে, যদি ভাঙ্গা ঘরে চারটি শিশু সন্তান নিয়ে একজন অসহায় মায়ের সেদিনের বাস্তবতাটি তার জানা না থাকে।

আ.

জীবনে প্রথমবার স্মৃতিসৌধ দেখি জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। স্মৃতিসৌধে গিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধার অনুভূতি আরও জীবন্ত হয়েছে, স্থাপনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। সেদিন আরও একটি চিন্তা এসেছিল আমার মাথায়। সেখানকার বিশাল এলাকা জুড়ে সাজানো বাগান আর সবুজ জমি দেখে মনে হয়েছিল, “এত জমি ফাঁকা পড়ে আছে? আহারে, কতজন কৃষককেই না জমিগুলো চাষের জন্য দেওয়া যেত!”

আমার দেশপ্রেম বা নন্দনচেতনার নিদারুণ দারিদ্র্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু একটি নিতান্ত দরিদ্র গ্রামের ভূমিহীন কৃষকের গায়ের ঘামের গন্ধ ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা সেদিনের সেই কিশোর, যে জন্মের পর থেকে এক টুকরো জমির জন্য কৃষকেদের হাহাকার দেখেছে, জীবন দিতে পর্যন্ত দেখেছে, তার পক্ষে এতটা ফাঁকা জমি দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে অযৌক্তিক লাগছে না, কারণ আমি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতটা জানি।

ই.

‘যুক্তিচিন্তা’ চতুর্থ পর্বে ‘কুশপুতুলের ছদ্মযুক্তি’ বা Straw Man Fallacy-এর উদাহরণ দিতে গিয়ে ফেসবুকে গালাগাল বিষয়ে একটি পোস্টের সমালোচনার কথা উল্লেখ করেছিলাম। সমালোচক মূল যুক্তির বদলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থান থেকে সমালোচনা করেছিলেন, যা আসলে পোস্টে বলাই হয়নি। কেন এমন হল? এর একটি কারণ হতে পারে, যে সময়ে গালাগাল নিয়ে পোস্টটি দেওয়া হয়েছে, সেই সময়ে সরকারের একজন প্রয়াত সাবেক মন্ত্রীকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করার দায়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে আটকের ঘটনা ঘটেছে। এই বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত গালাগাল নিয়ে লেখা পোস্টটির ভিন্ন একটি অর্থ তৈরি করে সমালোচনাকারীর কাছে, যার ফলে সম্ভবত তিনি মতপ্রকাশের বিষয়টিকে প্রধান করে দেখেন।

আবার ‘যুক্তিচিন্তা’ সপ্তম পর্বে গণপিটুনিতে তাসলিমার মৃত্যুর ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে ‘অজ্ঞানতার সুযোগ নেওয়া ছদ্মযুক্তি’ বা Appeal to ignorance Fallacy-এর উল্লেখ করা হয়। পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় যদি আমরা দেশের সেই সময়ের ছেলেধরা আতঙ্ক, বিচার ব্যবস্থার প্রতি জন-অনাস্থা, মানুষের প্রতি সহানুভূতি হ্রাস পাওয়ার জনমনস্তত্ত্ব ইত্যাদি পরিপেক্ষিতের মধ্যদিয়ে দেখি, তাহলে ওই ছদ্মযুক্তি চর্চার তাৎক্ষণিক বিষয়টিকে আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হলে হয়তো তখন ছদ্মযুক্তিটি একইভাবে কাজ করত না, একটি প্রাণ নিদারুণ মির্মমতায় ঝরে যেত না।

ঈ.

পশ্চিমবঙ্গের একটি গর্ভপাত বিষয়ক মামলার রায়ের সংবাদ দেখেছিলাম। ভারতের আইনে ২০ সপ্তাহের পরে গর্ভপাত বেআইনি হলেও আদালত গর্ভবতী একজন মায়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ সপ্তাহের পরও গর্ভপাতের অনুমতি দেন। “ভ্রূণের বয়স ২৬ সপ্তাহ:‌ গর্ভপাতের অনুমতি পেলেন বাঙালি মা” শিরোনোমে ২০১৭ সালের ৫ জুলাই ‘ডয়েচে ভেলে’তে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, হৃৎপিণ্ডে মারাত্মক সমস্যা থাকায় মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা গর্ভস্থ ভ্রুণটির গর্ভপাতের পক্ষে মতামত দেন চিকিৎসক দল এবং শেষে আদালেতের অনুমোদন নিয়ে গর্ভপাত ঘটানো হয়।

সাধারণভাবে ২৬ সপ্তাহের ভ্রুণহত্যার ঘটনা সমর্থন না করলেও বা বেআইনি হলেও, উল্লেখিত ঘটনায়, গর্ভপাতের উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নিয়ে আদালত সেদিন গর্ভপাতের অনুমতি দেন। মানুষের বিবেকের আদালত বা যুক্তিবোধও কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একইভাবে ঘটনার পেছনের উদ্দেশ্যকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য হিসেবে দেখে থাকে।

মানুষ হত্যাকে সাধারণত মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং একজন খুনী সমাজে ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হন। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে মুক্তিযোদ্ধা সফলতার সাথে পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছেন, তাকে এদেশের মানুষ বীরের সম্মান দেয়। এখানে হত্যার ঘটনাকে বিচার করা হয় উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে, যেহেতু তার উদ্দেশ্যকে মহৎ হিসেবে দেখা হয়, ফলে যুদ্ধে শত্রুসৈন্যকে যে কোনভাবে পরাজিত করাটাই তার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ বলে ধরে নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে শত্রুকে হত্যা করাকে সাধারণ অপরাধমূলক হত্যা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে, এমনকি গৌরবের কাজ হিসেবে দেখা হয়।

উ.

কোন ঘটনাকে বিচার করার ক্ষেত্রে তার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ যেমন জরুরি, একই সাথে এটাও মনে রাখা দরকার যে, অন্ধযুক্তিবোধ অনেকক্ষেত্রেই প্রকৃত সত্য থেকে আমাদের দূরে ঠেলে দিতে পারে। কোনটি সত্য বা কোনটি ন্যায়, তা অনুধাবনের জন্য ঘটনা বা বিষয়ের পেছনের উদ্দেশ্য (Purpose), দৃষ্টিভঙ্গি (Perception) এবং পরিপ্রেক্ষিতকে (Perspective) বিবেচনায় রাখা দরকার। উদ্দেশ্য বা দৃষ্টিভঙ্গিকে একত্রে পরিপ্রেক্ষিতের অংশ হিসেবেও দেখা যায়। যেকোনও সত্যের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিত। পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে কোনও সত্য থাকে না। প্রকৃতপক্ষে স্বয়ংসত্য, একক সত্য বা চিরন্তন সত্য বলে কিছু নেই। দুনিয়ায় সম্ভবত একটিই চিরন্তন সত্য আছে, আর তা হচ্ছে, চিরন্তন সত্য বলে কিছু নেই! দার্শনিক জিওর্দানো ব্রুনোর ভাষায়, “সত্যের পিতা হচ্ছে সময় আর আমাদের মন তার মাতা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত