| 24 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা- দ্বিতীয় পর্ব: অঙ্কের যুক্তি অথবা চিন্তার গণিত

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

হাইস্কুলে আমি কখনোই বীজগণিত করিনি। সূত্র মুখস্থ করা ভাল লাগত না। গণিতে পাশ করার জন্য আমাকে পাটিগণিতের উপর বেশি নির্ভর করতে হত। 

মনে আছে ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করার এক‌টি অংকের সমাধান করা আমার জন্য খুবই জটিল হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, আমি স্কুলে প্রায় যেতামই না, প্রাইভেট পড়তাম না, বাবা গত হয়েছেন ক্লাস সিক্সে থাকতে এবং মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত দুই বড়বোনের কাছে পড়াশোনায় সহায়তা নেওয়া আত্মমর্যাদার জন্য সুবিধাজনক মনে হত না। ফলে অংকের সমাধান করার জন্য আমাকে বিচিত্র সব বুদ্ধি বের করতে হত। ট্রেনের অংকটি সমাধানের জন্য আমি শেষ পর্যন্ত খাতায় বিপরীতমুখি ট্রেন এবং প্ল্যাটফর্মের ছবি এঁকে কম্পাস দিয়ে মেপে শেষ পর্যন্ত সঠিক উত্তর বের করেছিলাম। 

পরবর্তীতে খেয়াল করলাম, এ ধরনের গাণিতিক সমাধান প্রতিটি মানুষ রাস্তা পারাপারের সময় প্রতিবারই করে থাকে। যানবাহনের দূরত্ব, যানবাহনের গতি, ব্যক্তির গতি এবং অতিক্রমণ্য রাস্তার দূরত্ব–ন্যূনতম এই চারটি উপাত্তের গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ রাস্তা পার হয়। আমাদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এই বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে ফলাফলের ভিত্তিতে রাস্তা পার হওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। বিশ্লেষণ যথাযথ না হলে, কোন স্বাধীন চলকের উপস্থিতি ছাড়াও, মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়। আপন মনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে আনমনে রাস্তা পার হতে গিয়ে সিএনজির ধাক্কায় চিৎপটাং হয়ে সলাজে রক্তাক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই আছে।

এই যে রাস্তা পার হওয়ার সময় মস্তিষ্ক নিখুঁত হিসেব করে দিতে পারছে, তার কারণ এ বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আগেই মস্তিষ্কে ঢুকে আছে এবং সমরূপ বিশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের বাস্তব ব্যবহারের মাধ্যমে তার সঠিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঠিক এরই বিপরীত কারণে, অর্থাৎ পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ এবং বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিকতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায়, শিশুদের আমরা হাত ধরে রাস্তা পার করাই, মানে আমাদের মস্তিষ্কের নির্দেশনা তাদের উপর প্রয়োগ করি। এ থেকে তাদের মস্তিষ্ক একই ধরনের হিসেব নিজের আধারে সংরক্ষণ করতে থাকে। মাদক গ্রহণ, অসুস্থতা, নিদ্রা ইত্যাদি কারণে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে হিসেব করতে না পারলেও দুর্ঘটনা ঘটে। 

এভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের মস্তিষ্ক অজস্র গাণিতিক বিশ্লেষণ ও সমাধান করে থাকে। সংখ্যাগত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ বা হিসেব করে ফল বের করার পদ্ধতিকে আমরা গণিত বলি। একইভাবে আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, আচরণ, কাজ বা মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও মস্তিষ্ক সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণ করে নির্দেশনা দেয়। চিন্তন প্রক্রিয়া বা বিশ্লেষণের এই পদ্ধতিকে আমরা যুক্তি বলি। পূর্ব ধারণা, বিশ্বাস, পক্ষপাত, পচ্ছন্দ, স্বার্থ, অনভিজ্ঞতা বা অজ্ঞতা ইত্যাদির ফলে আমরা ছদ্মযুক্তির আশ্রয় নেই বা শিকার হই এবং ফলত ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।

মূলত গণিত হচ্ছে অংকের যুক্তি, আর যুক্তি হচ্ছে চিন্তার গণিত।

গাণিতিক হিসেবে ভুল হলে অংকের ফল মেলে না, রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে, গ্যাঞ্জাম লাগে। যুক্তির হিসেবে ভুল হবে জীবন ও সমাজের হিসেব মেলে না, সামাজিক দুর্ঘটনা ঘটে, গ্যাঞ্জাম লাগে।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত