যুক্তিচিন্তা-তৃতীয় পর্ব : কদবানুর মায়ের অরিজিনাল কান্না বনাম শাবানার ছদ্মকান্না
অ.
বয়স বাড়লে মানুষের নাকি অতীতের কথা মনে পড়ে। আমার হয়েছে সেই দশা। প্রায়ই মনে পড়ে, মাকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে রাত কাটানোর সেই প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। ক্লাস নাইন, ১৯৯০। চার বছরের বড় এক বড়ভাই কাম বন্ধুর সাথে দিন কাটে। ঘোরাঘুরি, আউটবই পড়া আর উদ্ভট সব আড্ডা-প্ল্যান। স্কুলের পড়া, ক্লাসে যাওয়ার বালাই নেই।
এরকমই একদিন বিকেলে ফিরব বলে টাঙ্গাইল শহরে গিয়ে আর ফেরা হয় না। পাকুল্যা গিয়ে গ্রামের এক মেয়ের শশুরবাড়ি খুঁজে বের করি। ট্রাক ড্রাইভার গ্রামতো দুলাভাই রাতে জামুর্কি বাজারে নিয়ে যান শ্যালক আপ্যায়নের অংশ হিসেবে সিনেমা দেখাতে। বাড়িতে না জানিয়ে প্রথমবার বাইরে রাত কাটানো আমি উদ্বেগ এবং উত্তেজনায় কিছুটা অস্থির।
হলের সেকেন্ড ক্লাসের ছারপোকার সাথে মিলেমিশে দেখি ‘ঝিনুক মালা’। আহা, কী মায়াময় সিনেমা! নায়ক ফারুক মায়ের দেখা পাওয়ার জন্য বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। ভেতরে কাঁদছেন মা, স্বামীর আদেশ, ছেলের মুখ দেখা যাবে না। এদিকে ছেলের খোঁজ না পেয়ে বাড়িতে কাঁদতে থাকা আমার মায়ের মুখ মনে পড়ে যায়। আমিও কান্না আটকাতে পারি না, হলের অন্ধকার সেদিন আমার ইজ্জত বাঁচায়!
আমি জানি, অভিনয়ের এই কান্না কোন বেদনা থেকে নয়, নিতান্তই পরিচালকের নির্দেশে। তবুও অভিনয় অনেক সময় ছদ্মবাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের মনে বাস্তবতার অনুভব সঞ্চারিত করে। তাইতো পাশের বাড়ির কদবানুর মায়ের অরিজিনাল কান্না দেখে হেসে ফেলা অনেকেই শাবানার ছদ্মকান্না দেখে চোখের জল আটকাতে পারে না।
আ.
যদি জানতে চাই, এই সময়ে পৃথিবীর মানুষ কিসের জন্য অপেক্ষা করছে, সম্ভবত একটাই উত্তর পাওয়া যাবে, করোনাভাইরাসের টিকা। টিকা ছাড়া এই করোনাক্রান্তিকাল থেকে মুক্তির আশা নেই। সারা দুনিয়া জুড়ে তাই টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে।
টিকা কী করে? টিকা হচ্ছে মৃত বা নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা জীবাণুর অক্ষম অংশ, যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সুপ্ত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলে। তারা ছদ্মজীবাণুকে আসল জীবাণু মনে করে তাকে হত্যার জন্য পুরো সমরসজ্জায় প্রস্তুত হয় এবং কীভাবে জীবাণুশত্রুকে দমন করতে হবে তার নিঁখুত যুদ্ধপরিকল্পনা তৈরি করে ফেলে। ভূয়া শত্রুর বিরুদ্ধে এবারের যুদ্ধপ্রস্তুতি কোন কাজে না লাগলেও এই অভিজ্ঞতা এবং পরিকল্পনা স্মৃতিতে থেকে যায়, যার ফলে পরবর্তীতে আসল জীবাণু শরীরে আসা মাত্রই ধ্বংস করে দিতে পারে।
এভাবে ছদ্মজীবাণুকে আসল বলে চালিয়ে দিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উত্তেজিত করে কাজে লাগানো এটাই হচ্ছে টিকার গোপন রহস্য।
ই.
আপনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমান? আজ রাতে একটিও ঘুমের ওষুধ নেই? কোনও চিন্তা নেই, ‘নিলাজ ফার্মা’র বানানো খাঁটি আটার ঘুমের ঘুমের বড়ি আমার কাছে আছে। এক ডোজ খেয়ে দেখুন, নিশ্চিত নিরুপদ্রব ঘুম হবে আপনার। বিফলে মূল্য ফেরৎ!
বিশ্বাস করুন, আটা দিয়ে বানানো সম্পূর্ণ নকল ওষুধ কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে না জানিয়ে খাইয়ে দিলে আসল ওষুধের মতো কাজ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকে বলা হয় ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’। ছদ্মওষুধকে আসল ওষুধ হিসেবে চালিয়ে দিলে কিছু ক্ষেত্রে শরীরে তা আসল ওষুধের মতোই রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও নানা অপচিকিৎসায় ছদ্মওষুধের এই প্লাসিবো ইফেক্ট কাজে লাগানো হয়।
ঈ.
এখনো তো সবাই মো. সাহেদকে নিয়ে কত কথা বলছেন। তিনি যখন মানবদরদি বড় ব্যবসায়ী, জনসেবক এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তখন সমাজে তার কতই না গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কত কত ছবি, ভিডিও তার সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই যে তার ছদ্মপরিচয় আসলের চেয়েও কত শক্তিশালী, কত কার্যকর ছিল, আসল পরিচয় উন্মোচনের পরই তা জানা গেল। প্রতারণা বা ছদ্মপরিচয় ব্যবহার করে মহানুভব সাজা মো. সাহেদ নিশ্চয়ই প্রথম ব্যক্তি নয়, শেষ তো নয়ই।
উ.
অভিনয়ের ছদ্ম-আবেগ, টিকার ছদ্ম-জীবাণু, চিকিৎসা গবেষণা বা অপচিকিৎসার ছদ্ম-ওষুধ বা হালের বাংলাদেশের ছদ্ম-সাহেদের মতো কতযে ‘ছদ্ম-কত কী’ প্রতিদিন আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কত কী করিয়ে নিচ্ছে, আমরা তা টেরও পাচ্ছি না।
আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, সিদ্ধান্ত, আচরণের পেছনে যে সকল যুক্তি কাজ করছে, তার কোনগুলো সঠিক যুক্তি আর কোনগুলো ‘সাহেদযুক্তি’ বা ছদ্মযুক্তি (ফ্যালাসি) তা ঠিকঠাক চিনতে না পারলে ভূয়া করোনা রিপোর্টের মতো ভূয়া ফলাফলে জীবন চলে যায়। মো. সাহেদের মতো মতো প্রবল প্রতাপে মানুষকে বোকা বানানো ছদ্মযুক্তিগুলোকে সকাল সকাল চিনে নেওয়া তাই একটা অত্যন্ত দরকারি কাজ।
আগের পর্বগুলো ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
কবি ও লেখক