| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক রাজনীতি সময়ের ডায়েরি

যুক্তিচিন্তা-চতুর্থ পর্ব : ব্রুনোকে কেন পুড়িয়ে মারা হল?

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অ.

লোকটাকে শেষ পর্যন্ত পুড়িয়ে মারা হল। হ্যাঁ, গায়ে আগুন নিয়ে পুড়িয়ে মারা হল। সবার সামনে, একটা বড় বাজারের মধ্যে। সবার সামনে বললেও কম বলা হয়, তাকে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখতে পুরো শহর যেন ভেঙ্গে পড়েছিল সেদিন। শুধু উৎসুক জনতা না, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরাও হাজির ছিলেন। লোহার খুঁটির সাথে লোহার শিকলে বেঁধে বেশ আয়োজন করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় তাকে। যাতে তার একফোঁটা অপবিত্র রক্ত পৃথীবির মাটিতে মিশতে না পারে, সেজন্য এই ব্যবস্থা।

আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, তাকে কেন এভাবে হত্যা করা হল? তাঁরা নির্দ্বিধায় জাবাব দেবেন, ঠিক কাজটিই করা হয়েছে, তাকে আরও কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিৎ ছিল! কেন? কারণ, তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন! ব্যাটা নাস্তিক! কত্তবড় সাহস! দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন শাস্তিই তার প্রাপ্য!

আপনি যদি হতভাগ্য লোকটিকে জিজ্ঞেস করেন, আপনাকে কেন এভাবে হত্যা করা হল? আপনি কেন ধর্ম এবং সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেন? সুখে থাকতে আপনাকে কিলাতে গেল কোন ভূত? তিনি একটু মুচকি হেসে বলবেন, কোন ভূত আমারে কিলায় নাইরে ভাই-বহিন! সব দোষ ওই ব্যাটা সূর্যের! আমি শুধু বলেছিলাম, সূর্য ব্যাটা আরামেই আছে, পৃথিবীটা ওর চারপাশে ঘুরছে, পৃথিবীটা বিশ্বজগতের কেন্দ্র না। ব্যস, হয়ে গেল! সবাই মিলে আমাকে মেরে দিল! এবার বুঝুক, লোকজন ওদের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়েই হাসাহাসি করছে! হ্যাঁ, তিনি হয়তো হেসে এভাবেই বলবেন, কারণ মৃত্যুর আগে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে প্রাণ বাঁচানার লোভনীয় অফার প্রত্যাখ্যান করেছন, এমনকি, আগুনে পুড়ে মৃত্যুর সময় একবার টু শব্দটিও উচ্চারণ করেননি! এমনই ছিল তার সত্যের জোর!

লোকটার নাম জিওর্দানো ব্রুনো। ইটালির লোক। চারশ বিশ বছর আগের ঘটনা। আরেকটু জানতে চাইলে গুগল আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করলেই হবে! আমারে জিগাইয়েন না! বংশগতভাবেই আমার আবার বেশি কথা বলার দোষ! এদিকে বেশি কথা বললে লোকজন রাগ করে! 

এই যে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হল, এটি কোন একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজ নয়। সরকার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে হত্যা করে। সাতটি বছর ধর্মীয় আদালতে মামলা চলেছে, যুক্তিতর্ক হয়েছে। এটি ছিল বিচারের রায়, শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড।

ব্রুনো বলেছিলেন, সূর্য নয়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্র নয়। সে সময়কার সমাজের লোকজন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চার্চ, সরকার সবাই খেপে যায় ব্রুনোর ওপর। তখন খ্রীষ্টীয় বিশ্বাস ছিল, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, বাইবেলে এমন বলা আছে। ব্রুনোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল নাস্তিকতার, ধর্ম-বিরোধিতার। যদিও আমরা জানলাম, ব্রুনো ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তা নিয়ে কথা বলেননি, বলেছেন জ্যোর্তিবিদ্যা নিয়ে, পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা নিয়ে।

সবাই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ব্রুনোর মূল কথাটির জবাব না দিয়ে বা তাকে ভুল প্রমাণিত না করে, তার বিরুদ্ধে ভিন্ন একটি অভিযোগ দাঁড় করানো হয়। বলা চলে, তার বক্তব্যকে বিকৃত করে, সেই বিকৃত বক্তব্যকে আক্রমণ করা হয় এবং তার ভিত্তিতেই তার বিচার করা হয়। চিন্তা বা যুক্তিকে মোকাবেলার এই পদ্ধতি সোয়া চারশ বছর আগের ইতালিতেই শেষ গেছে এমন সম্ভবত নয়। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় ধরনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই। 

আ.

ফেসবুকে আমরা অনেককেই সারাক্ষণ গালাগালি করতে দেখি। কারও সাথে ভিন্নমত হলে বা কারও কথা অপছন্দ, ভুল বা ক্ষতিকর মনে হলে ভয়াবহভাবে গালাগাল শুরু করে দেন এমন কিছু মানুষ আছে। তো কেউ একজন বললেন, সামান্য ভিন্নমত বা অপছন্দের কারণে সারাক্ষণ অন্যদের গালাগাল করার কারণ আত্মমর্যাদাবোধের অভাব বা হীনমন্যতা। তার এই কথার সমালোচনা করে আরেকজন বললেন, আপনি তো বাক স্বাধীনতা রোধ করতে চান। এভাবে আপনি সরকারকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আমি আপনার এই অগণতান্ত্রিক মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। 

প্রথমজনের কথায় গালাগালের কারণ নির্দেশ করা হয়েছে, যার বিরোধিতা করে কারণকে ভুল প্রমান করা যেতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয়জন মূল যুক্তির বিরোধিতা না করে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রথম বক্তাকে ভিন্ন একটি বক্তব্যের দায়ে অভিযুক্ত করলেন, যেটি আসলে তিনি বলেননি। বক্তব্যের ভিন্ন অর্থ করার এরকম ঘটনা আমরা সামাজিক মাধ্যমে বা বাস্তব জীবনে হরহামেশাই দেখে থাকি।

ই.

ধরা যাক, আমি বললাম, পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে যে বিপুল ব্যয় হচ্ছে, আর্থিকভাবে তা আমাদের দেশের জন্য লাভজনক হবে না। এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমার এক ফেসবুক বন্ধু বললেন, আরে ভাই, আপনি নিশ্চয়ই জামাত-বিএনপির সাপোর্টার, নইলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করবেন কেন! আপনি তো চান না দেশে উন্নয়ন হোক, মানুষ ভালভাবে যাতায়াত করুক। আপনি সরকারের বিপুল উন্নয়ন কার্যক্রমে ঈর্ষন্বিত হয়ে এসব আবোল তাবোল বকছেন। 

এখানে মূল বক্তব্য পদ্মাসেতুর আর্থিক লাভালাভ-এর বিরোধিতা না করে, বক্তব্যের একটি সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তার সমালোচনা করা হচ্ছে। 

ঈ.

এই যে কোন যুক্তি বা বক্তব্যের বিরোধিতা বা খণ্ডন না করে, বক্তব্যটিকে বিকৃত, অতিসরলীকৃত, অপ্রাসঙ্গিকভাবে অন্য বক্তব্যের সাথে মেলানো বা ভুল ব্যাখ্যা করে বক্তার নামে ভিন্ন একটি বক্তব্য দাঁড় করানো, যেটি প্রকৃতপক্ষে বক্তা বলেননি, সেটির বিরোধিতা, খণ্ডন, সমালোচনা করা বা এর দায়ে বক্তাকে অভিযুক্ত করা, এটি বিশেষ এক ধরনের ছদ্মযুক্তি। এই ছদ্মযুক্তিকে ইংরেজিতে বলে Straw Man Fallacy.  ব্যক্তির বদলে ব্যক্তির কুশপুত্তলিকাকে পেটানোর মতো ব্যক্তির কথাকে নয়, একটি কল্পিত বক্তব্যকে ব্যক্তির নামে চালিয়ে তাকে আক্রমণ করা হয় বলে ছদ্মযুক্তিটির এরকম নামকরণ করা হয়েছে।

জিওর্দানো ব্রুনোর সত্য ঘটনা বা গালাগাল এবং পদ্মাসেতুর কল্পিত বিতর্কে সমালোচনা বা অভিযোগের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, যুক্তির নামে এ ধরনের ছদ্মযুক্তির শিকার যেমন আমরা হই, তেমনি আমরা নিজেরাও এর ব্যবহার করে থাকি। 

নিজের দোষ খুঁজতে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলার মতো বোকা নিশ্চয়ই আমরা নই! আসুন, অন্তত অন্যরা আমাদেরকে কুশপুতুলের ছদ্মযুক্তি বা Straw Man Fallacy ব্যবহার করে ঘায়েল করার চেষ্টা করলে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে একবারে ডেন্টিস্টের কাছে পাঠিয়ে দেই!

 

আগের পর্বগুলো ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত