| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

চিনুয়া আচেবের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

আহমেদ বাসার

চিনুয়া আচেবের লক্ষ্যভেদী মন্তব্য – তাঁর নিজের জবানিতে, ‘সত্যকে অবিকৃতভাবে তুলে ধরতে হবে’ – যা থেকে তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর প্রভাবশালী রচনা ‘থিংগস ফল এপার্ট’ আফ্রিকান ট্রিলজির মধ্যে প্রথম, যা খ্রিস্টান মিশনারিদের ‘সভ্যকরণ’ প্রকল্প নিয়ে আগমনের পূর্বে উনিশ শতকের শেষদিকের নাইজেরিয়ার আদিবাসীদের জীবনযাপনের বৈধতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আচেবে তাঁর রচনায় গ্রামজীবনের ছবি এঁকেছেন,যা তীক্ষ্ণ, প্রাণবন্ত ও মর্মভেদীও বটে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, একজন বর্ণনাকারী হিসেবে তিনি সমাজচিত্রণে পুরোপুরি সফল – যেখানে সামাজিক লোকাচার, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গুরুত্ব পেয়েছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের গ্রামে আগমন ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাকে চাপিয়ে দিয়ে তাদের পুরনো জীবন থেকে সজোরে উৎখাত করার প্রসঙ্গটিও তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও এক্ষেত্রে তিনি এদের জীবনযাপনের নিষ্ঠুরতার দিকটিও চিহ্নিত করেছেন।

আচেবেই প্রথম কোনো আফ্রিকান লেখক যিনি আদিবাসী জীবনের ‘নন-রোম্যান্টিক’ ছবি এঁকেছেন। এক্ষেত্রে তিনি এর খারাপ দিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি কিংবা ভালো দিকেরও প্রশংসা করেননি। হ্যাঁ, আফ্রিকার আদিবাসী গোষ্ঠী খুব শক্তিশালী ও কার্যকর। কিন্তু খ্রিস্টান মিশনারিরা এমন কোনো ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি, যেখানে অন্যায়-অবিচার, জাতিগত বৈষম্য ও ধর্মীয় গোঁড়ামিসহ নানাবিধ অসন্তোষ ছিল না।

আচেবের লেখা গতানুগতিক সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের মতো কিছু নয়। তিনি অভিযোগের সুরে কথা বলেছেন। কিন্তু এই সত্যকে এইভাবে খণ্ডন করা যায়, সাদা চামড়ার মানুষদের আগমনের পূর্বে আফ্রিকা ছিল ‘সভ্যকরণের উর্বর ভূমি’। যখন পশ্চিমারা এখানে পুরোপুরি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজত্ব করতে লাগল তখন কী ধরনের পরিবর্তনটা এলো? এখানে প্রথা ও আধুনিকতার এমন একটা অসম মিশ্রণ তৈরি হয়েছে, যার সমাপ্তি ঘটেছে গভীর ট্র্যাজেডিতে।

সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের কাছে আচেবের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনা তাঁর ট্রিলজির দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘নো লংগার এট ইজ’; যা তীব্রভাবে এমন একটা ক্ষেত্র তৈরির জটিলতাকে উপস্থাপন করেছে, যেখানে কেউ একজন পশ্চিমা সেক্যুলার শিক্ষা, মূল্যবোধ ও বিশেষাধিকার – যা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট – ভোগ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির বিশ্বাসের কাছে দায়বদ্ধ। ‘থিংগস ফল এপার্ট’-এর মূল চরিত্রের নাতি ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর নাইজেরিয়ার সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়। কিন্তু তার নিজ পরিবারের লোকাচার থেকে মুক্ত হতে পারে না। ফলে সে আধুনিক ট্র্যাজেডির এক মুখ্য চরিত্র হয়ে ওঠে।

ট্রিলজির তৃতীয় উপন্যাস ‘অ্যারো অফ গড’-এ আচেবে রাজনৈতিক অস্থিরতার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। এবং দেখিয়েছেন যে, গ্রামের মানুষের ভূমি, কৃষি ও অস্তিত্বের সঙ্গে ধর্ম কতটা গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। যখন নতুন ঔপনিবেশিক প্রশাসকগণ নতুন কাউকে পৌরোহিত্যের দায়িত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তখন তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিদ্রোহ ও ধর্মীয় দাম্ভিকতার মধ্যে তিনি চাষাবাদ ও মাঠে ইয়াম চাষে অবহেলার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছেন। যা দুর্ভিক্ষকে ত্বরান্বিত করেছিল। যার ফল হয়েছিল বহু লোকের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষালাভ।

এটা পরস্পরবিরুদ্ধ মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজব্যবস্থায় দুটি দ্বান্দ্বিক রাজনৈতিক ধারার প্রায়োগিক জটিলতাসমূহের একটি সরল আখ্যান। এখনও এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে প্রাচ্যের সর্বরোগীর ক্ষেত্রে সর্বরোগের মহৌষধ হিসেবে পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

এই আফ্রিকান ট্রিলজি এখনও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। পাশ্চাত্য হস্তক্ষেপের অজুহাত হিসেবে নৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক গোলযোগকে তারা সামনে আনে। এবং এভাবে পাশ্চাত্য ধারার শাসনতন্ত্র আরোপনের চেষ্টা চালায়। আমাদের বর্তমান ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যবস্থায় সভ্যতার অহমিকা আসলে লোকদেখানো নিরাপদ ধারণার আলখাল্লা ছাড়া কিছু নয়। এর মধ্যে আছে গণতন্ত্রের প্রসারতা, আত্মনির্ভরতা ও নারীর স্বাধীনতা প্রভৃতি গালভরা বুলি।

আচেবের স্মৃতিকথা শুরু হয়েছে এই ইগবো প্রবাদ দিয়ে – ‘যে ব্যক্তি জানে না কোথায় বৃষ্টি তাকে ভেজাতে পারে, সে জানে না কোথায় তার শরীর শুকাবে’। তাঁর রচনা ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার সূচনায় যে বড় রকমের ধাক্কা লেগেছিল তা থেকে পৃথক হতে সচেষ্ট। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে, যদি আমরা ‘সভ্যকরণ’ প্রকল্প থেকে বেরিয়ে উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি স্বাধীন স্বনির্ভর পথ নির্মাণ করতে চাই।

চিনুয়া আচেবে ছিলেন এমন একজন স্বাপ্নিক, যিনি সাংস্কৃতিক ঔদ্ধত্য ও যথেচ্ছাচারের অমানবিক দিকগুলের অধুনা ট্র্যাজেডির চিত্র অঙ্কনে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ আমরা দেখি, কীভাবে ইরাক ও আফগানিস্তানে পশ্চিমারা মানবিকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শুষ্ক প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি, মিশনারিরা এখনও গ্রামে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

[সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান ]

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত