| 29 মার্চ 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

‘বহ্নিলতা’-এক বনকন্যার আখ্যান । সাদিয়া সুলতানা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের উপন্যাস ‘বহ্নিলতা’ এক বনকন্যার আখ্যান। যে কন্যা শহরের মানুষকে নিমকূট পাহাড় দেখায়যে পাহাড় ঝড়ে উড়ে যায়পাহাড়ের গায়ের নিমগাছও উড়ে যায় আর ভবঘুরে গাছেরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সুশান্ত আর বহ্নিশিখা সেই কন্যার নাম দিয়েছিল ‘বহ্নিলতা।’

গাঙের উপরে মেঘ উঠলে গাঙের রং যেমন হয়’ বা ‘বনের ওপর মেঘ উঠলে বনে যেমন ছায়া ঘনায়’ বহ্নিলতা তেমনি মেয়ে। বহ্নিলতার আরেক নাম ছিল বনলতাএই নামটি দিয়েছিল ওর ঠাকুরদা নিতাই হরি যে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার নিকটবর্তী বড়দলের বাসিন্দা ছিল। দাঙ্গায় ঘর পুড়ে যাবার পর নিতাইহরি সাতক্ষীরা ছেড়েছিল। বিরামপুর ছেড়ে দন্ডক অরণ্যের পাথুরে জমিতে ঠাঁই পেয়েছিল নিতাইহরি। মা পুষ্পরানিবাবা বলাইহরিঠাকুরদাঠাকুমার কাছে ঐ দেশের কথা সব শুনেছে বহ্নিলতা। যেন সে সব নিজের চোখে দেখেছে সব সেই দেশের গাঙের জন্য বহ্নিলতার মন কেমন করে। নোনাজলের মেয়ে বহ্নিলতাকে কেন্দ্র করে দেশভাগনকশাল আন্দোলনমরিচঝাঁপিরুশ বিপ্লবএকে একে সময়ের বিভিন্ন স্তর উঠে এসেছে এই আখ্যানে।

কথাকার লিখছেন, ‘এ যেন ছিপছিপে কৃষ্ণকলি সতের বছরের এক কন্যা নয়এ যেন শত বছরের কেউ। জগতের সব দেখেছে। এই মহাপৃথিবীর জন্মমুহূর্ত থেকেই আছে পৃথিবীতেই। ধারণ করে আছে ক্লেদ আর মৃত্তিকার সমস্ত পূতিগন্ধ আর সৌরভ।’ এ কারণেই হয়তো বহ্নিলতার কাছ থেকে হাসনাবাদবরুনহাটকাটাখালিনন্দীগ্রাম, ঝিঙেখালিযুগীপোতাহিঙ্গলগঞ্জসব গাঁওগঞ্জের মাটির সুধা পেতে পেতে মনে হয়েছে এই আখ্যানের বর্ণনাকারী লেখক নয়স্বয়ং বহ্নিলতাই। অবিরাম ইতিহাসের সঙ্গে বসবাস যেন বহ্নিলতারযেখানে কল্পনার কোনো স্থান নেই। বহ্নিলতার কথাছড়া আর শোলোকের মধ্য দিয়ে লেখক মূলত পাঠককেই কল্পনার ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন আর পাঠক বনকন্যার চোখ দিয়ে দেখছে অতীতের বেদনাবর্তমানের নৈরাজ্য। আখ্যানে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োগ ও অনাচারবিপ্লবের উত্থান ও পতনপার্টির আদর্শ ও আদর্শহীনতার কথাও সমান্তরালভাবে এসেছে তাই পাঠকের কল্পনার অতিরঞ্জন হওয়ারও সুযোগ ঘটেনি।

স্বল্প পরিসরের এই উপন্যাসে ছোট ছোট বাক্যে ঔপন্যাসিক একটু একটু করে এক একটা চরিত্রের খোলস ছাড়িয়েছেন। আসলে এই উপন্যাসে এক বা একাধিক ব্যক্তি নয়দেশ আর প্রকৃতিই প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। আর বহ্নিলতা চরিত্রটি প্রকৃতির কন্যা হিসেবে পাঠকের সামনে এসেছে। যাকে আশ্রয় করে সুশান্ত নিজের অসফল বিপ্লবকে সফল করার স্বপ্ন দেখেছে। বিপ্লবী সুশান্ত একসময় বিশ্বাস করত সিস্টেম ভাঙতে হবেমানুষের মুক্তির জন্য গ্রামে যেতে হবে। বিপ্লবের জন্য ঘর ছেড়ে ছিল সুশান্ত আর ফিরেছিল নিঃস্ব হয়ে। কারণ একসময় পার্টি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে সবাই এক একটি দল হয়ে উঠেছিল যাদের কাজ ছিল পরস্পরকে দোষারোপ করা। এরপর হাসনাবাদের কমরেড বিশ্বনাথ গায়েন সুন্দরবনের অভাবী ঘরের মেয়ে লতাকে সুশান্তর কাছে নিয়ে এসেছিল। সন্তানহীন দম্পতি গাঙে ভেসে ভেসে শহরে আসা বহ্নিলতাকে দেখে যেন বিপ্লবের ব্যর্থতার কথা ভুলে গিয়েছিল।

সুশান্তর বন্ধু অতনু যে সুশান্তর সহযাত্রী হয়ে ঘর ছাড়তে পারেনি সে পারিবারিক দায়দায়িত্বের কথা ভেবে নিশ্চিন্তনিরুপদ্রব এক জীবন চেয়েছিল। তাই অতনু বিপ্লব করেনিজেল খাটেনিসংসারী হয়ে সন্তান মানুষ করেছে। এভাবে বিপ্লবীদের অনেকেই জীবনের আদর্শ বদলে ফেলেছেসরকারি আমলা হয়েছেভূমি অধিগ্রহণের নামে গরীবকে উচ্ছেদ করছে। কেউ আবার লেখক হয়ে নিজের জেলখানার অভিজ্ঞতার কথা লিখছে। যারা একদিন ভেবেছিল সত্তর দশক মুক্তির দশক হবেবিপ্লবের গান লিখবেনিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ‘ইস্পাত’ লিখবে তারা নিজেদের স্বপ্ন সত্যি করার লড়াইটা চলমান রাখতে পারেনি।

আসলে ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধানিরাপত্তাহীনতারাষ্ট্রের প্রত্যক্ষঅপ্রত্যক্ষ ভূমিকা কতকিছুই তো জীবনের গতি বদলানোর নিয়ামক হয়। কালে কালে পৃথিবীর কত রূপ বদলায়প্রকৃতিরও কত অদলবদল হয়। কেবল মাটিলগ্ন মানুষের অভাব আর দুর্গতি একই থাকে। সত্যি ‘কিছু মানুষ জন্মায় অনন্ত দুর্ভিক্ষ নিয়ে। এ তাদের ভবিতব্য। খন্ডন হবে কবে তা কেউ জানে না।’ আবার কিছু মানুষ একই থাকেআদর্শ ভেঙে নিজেকে নতুন করে গড়তে পারে না। এই যেমন জীবনের সুধা মুঠোতে পুরতে না পারলে নিজেদের বদলাতে পারেনি বহ্নিশিখাবিশ্বনাথ আর সুশান্তের মতো মানুষেরা। নিজের বিপ্লবের ধারা ধরে রাখতেই যেন শোলোক বলা কাজলা দিদি বহ্নিলতাকে বুকে তুলে নেয় সুশান্ত।

অভাব ছোট বহ্নিলতাকে তাড়িয়ে এনেছিল কোলকাতা শহরে। প্রথম দিন সে ছটফট করে ভাইয়ের জন্য কেঁদেছেলালবিবির বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছে। এই মেয়েই আবার হঠাৎ হঠাৎ বহ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠেছেবিরামহীন ছড়া বলেছেগল্প বলেছেবহ্নিশিখা আর সুশান্তকে কিছুই বিস্মৃত হতে দেয়নি। বিরামপুর থেকে মরিচঝাঁপিঅযোদ্ধা পাহাড়ের ফুলমনি বেসরাবুড়ি ফুলমনিমথুরাগঞ্জের যমুনারানি মৃধাএমনকি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধদাঙ্গা১৯৬৮ তে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসা এসব কিছু নিজের চোখে না দেখলেও ১৯৯৫ এ জন্ম নেওয়া বহ্নিলতা অনর্গল বলে গেছে সময়ের কথা।

এ মেয়ে যেন তার গতজন্মের কথা শোনায়পিসের হাত ধরে অবলীলায় সিঙ্গুরের তিন ফসলী জমিহারা চাষীদের পক্ষে মিছিলে হেঁটে যায়। সে সকলকে জাগাতে চায়মাটি রক্ষার পথে নামাতে চায়। বহ্নিলতা দেখেছে এই মাটির বুকে অজ¯্র ক্ষতশোষণের চিহ্ন। এই ক্ষত আরও বাড়ানোর জন্য শোষণশাসন চলে নিরন্তর। বহ্নিলতা জানে নিয়মগিরি পাহাড়ের কোলের আদীবাসীদের দেবতা পাহাড়কে ফাটিয়ে মূল্যবান অ্যালুমিনিয়াম আকরিক তোলার জন্য বহুজাতিক কোম্পানিকে লিজ দেয়া হবে। ওদিকে ছত্রিশগড়ের মাটির নিচের খনিজের জন্য আদীবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কেউ রুখে দাঁড়ালেই তাকে মাওবাদী বলা হচ্ছে। সরকার পোষিত সংগঠন সালোয়া জুড়ুম আদিবাসী গ্রামগুলোকে তছনছ করছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। জোয়ান পুরুষ আর মেয়েদের তুলে নিচ্ছে। এভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেরাষ্ট্রযন্ত্রের হাতেই প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির সন্তানেরা। বহ্নিলতা সকলকে তাই বিপ্লবের পথে ডাকেমিছিলে পা মেলাতে বলে। যদিও বহ্নিলতার বিপ্লবের সঞ্চারপথ রুখে দিতে নানা অপশক্তি দাঁড়িয়ে যায়।

বহ্নিলতা কি শেষ পর্যন্ত পারেপারুক আর না পারুক, ‘বহ্নিলতা’ যে সম্ভাবনার কথা বলেযে প্রতিরোধের কথা বলে তা আমাদের আশার পিলসুজ নিভতে দেয় না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত