| 29 মার্চ 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

রাষ্ট্রহীন রাষ্ট্রের মানুষের আখ্যান । হামিরউদ্দিন মিদ্যা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পেরিয়ে গেলেও,দুই বাংলাতেই এমন কিছু মৌজা, এমন কিছু ভূখণ্ড ছিল, যাদের কোনো দেশ ছিল না।ছিল না স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, জেলা, মহকুমা, ব্লক, থানা। সেই গ্রামের মানুষদের না ছিল ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, নাগরিক পরিচয়পত্র। না ছিল পুলিশ, প্রশাসন, নারীদের নিরাপত্তা- তা হলো ছিটমহল। ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ভিতরে ভারত।

কী করে তৈরি হয়েছিল এমন অলীক ভূখণ্ড? এর উত্তরে মিশে আছে অনেক লোককাহিনী, মিথ, ইতিহাস। কেউ কেউ বলেন, কোচবিহারের রাজা আর রংপুরের নবাব নিজেদের কিছু পরগণা বাজি রেখে পাশা খেলে একে অপরের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কোচবিহারের রাজা জিতেছিলেন বাংলাদেশের ১১১টি মৌজা, আর রংপুরের নবাব ভারতের ৫৩টি মৌজা। এভাবেই ছিটমহলের জন্ম। দেশভাগের পর র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদের খামখেয়ালীভাবে দুই দেশের ওপর সীমান্তরেখা টানার ফলে ছিটমহলের মানুষ খাঁচায় বন্দী হয়ে যায়।

মানুষ মুক্তি খুঁজছিল। অনেক সংগ্রাম করে, রক্ত ঝরিয়ে ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ছিটমহল দহগ্রাম ও অঙ্গারপোতা ১৯৯২ সালে ২৬ জুন করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাটগ্রাম থানার পানিগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাকি মৌজাগুলির কোনো সুরাহা হয়নি। তিনটি খণ্ডে লেখা ৩০৪ পৃষ্ঠার অমর মিত্রের ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ উপন্যাসটি সেই ছিটমহলের মানুষেরই ইতিবৃত্ত। বাংলা সাহিত্যে, বা বলা যায় ভারতীয় সাহিত্যেও ছিটমহল নিয়ে লেখা উপন্যাস এটিই প্রথম।

প্রথম খণ্ড ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটের কথা উঠে এসেছে। মশালডাঙা ছিটের একশো বছর উত্তীর্ণ সাগির আলি ও আজগার আলি যেন একই সত্তার দুটি ভিন্ন নাম। যারা বেঁচে আছেন ছিটমহলের স্বাধীনতা দেখার জন্য তারা চান ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ যেন ভারত হয়ে যায়। তাদের স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমেই উঠে এসেছে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, দাঙ্গা, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। সাগির আলির ছেলে হাফিজুর এখনো রাজাকারের স্মৃতির মধ্যে আচ্ছন্ন। তার বিশ্বাস আবার একদিন পাকিস্তান ফিরে আসবে। সারা দুনিয়া পাকিস্তান হয়ে যাবে। নিজের দলে টেনেছেনও কয়েকজনকে। হাফিজুরের ছেলে নয়িম, নয়িমের বউ সায়মা ওরা হাফিজুরের কথা মানতে পারে না। ওরা চায় ভারত।

বেচুন মুখুজ্জে ছিটের বারোশ বিঘা জমি দখল করে এখনো রাজত্ব করছে। সে চায় ছিট বিনিময় যেন না হয়। ছিট ছিটই থাক। না হলে জমিগুলো চলে যাবে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ছিট বিনিময় হবে না- ‘ভারত দশ হাজার একর জমি বাংলাদেশকে বেশি ছাড়বে কেন?’

ছিটমহলের নারীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। তাদের নির্যাতন ও  জীবনযন্ত্রণার কথা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ষোলো বছরের শিক্ষিত তরুণী জিন্নত ছিটের মেয়ে বলে মাধ্যমিকে বসতে পাবে না। বংশী আর সিরাজুল নামে দুই শয়তান ছিটের মেয়ে বলে তার মোবাইলে খারাপ ম্যাসেজ দিয়ে তাকে হুমকি দেয়। জিন্নত তাই খালুর বাড়িতে চলে এসেছে। কোথায় অভিযোগ করবে? তাদের কোনো প্রতিবাদের ভাষা নেই। ভারতের থানায় গেলে বলবে-তোমরা তো বাংলাদেশী, ফরেন। আবার বাংলাদেশে যাবারও উপায় নেই, কাঁটাতারে ঘেরা।

ছিটের মেয়ে সন্তান প্রসব করতে গেলে হাসপাতালে ভর্তি নেয় না। টাকার বিনিময়ে কোনো ভারতীয় পুরুষ নাগরিককে স্বামী পরিচয় দিয়ে হাসপাতালের খাতায় ভর্তি হতে হয়। পড়তে পড়তে এমন ছিটমহলের নারীদের প্রতি নানান লাঞ্চনা, বঞ্চনার কথা জানতে পারি।

লেখক বলেছেন, ‘নিজে যদি অনুভব না করি ভিতর থেকে, উপন্যাস লেখা হয় না। উপন্যাস শুধুই বাস্তবতার চর্চা নয়।’  বিমলেশ (বিমলেশ যে লেখক স্বয়ং অমর মিত্র, তার কোনো সন্দেহ থাকে না) একজন সাংবাদিক ও লেখক। ছিটমহলে ঘুরতে এসেছেন, তাদের কথা লিখবেন বলে। বিমলেশের কাজে বাধা দেয় বেচুন মুখুজ্জের মতো কিছু স্বার্থবাজ মানুষ।

দ্বিতীয় পর্ব ‘চোখ আর নদীর জল’ বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ১১১টি ছিটের ইতিবৃত্ত। ছিটমহল আন্দোলনের নেতা ভুবন সেন প্রতিটি ছিটের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন। তার সঙ্গে আলাপ হয় বিমলেশের। ভুবন সেনের সঙ্গে বিমলেশ ঘুরতে আসেন বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিটগুলিতে। বিমলেশ তার মায়ের কাছে দেশভাগের আখ্যান শুনেছিলেন। বাংলাদেশ তার পিতৃভূমি। বাংলাদেশের ভিতর ভারতীয় ছিটমহল দশিয়ার ছড়ার নিয়তি রায় নামে এক মেয়ে চিঠি লিখেছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। কেননা ইন্ডিয়ার মন্ত্রী, জেলাশাসক সে বহুদূর। কাঁটাতারের ওপারে। বিমলেশ খোঁজ করে তার সঙ্গে দেখা করেন। নিয়তি আর নির্মলা দুই বোন। নিয়তি চাই বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিট বাংলাদেশ হয়ে যাক, নির্মলা চাই ভারতের সঙ্গে যুক্ত হোক।

নির্মলা বাংলাদেশের নাগরিক নামচন্দ্র রায়কে বাবা পরিচয় দিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তার জন্য নামচন্দ্র নির্মলার আসল বাবা রামচন্দ্রের কাছে টাকা নেয়। শেষমেশ নির্মলা ফাঁদে জড়িয়ে যায়। ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বংশী আর সিরাজুল নামের দুই শয়তানের হাতে তুলে দেয় নামচন্দ্র। নির্মলার ধর্ষণের জন্য দায়ী সে। এমনই ভয়ঙ্কর জীবন ছিটমহলবাসীদের।

ছিটমহলের ধাই হেরাতুন বেওয়া ছেলে জামিলের স্বার্থের কাছে কত যে নারীকে বলি দিয়েছে! যখন নিজের গর্ভের কন্যাকে হারায়, তখন হেরাতুনের জীবন শূন্য হয়ে যায়। জামিলের কথা না শুনে বিনা স্বার্থে ছিটমহলের নারীদের সন্তান প্রসব করে চলে। না হলে ছিটের নারীদের হাসপাতালে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। তৃতীয় পর্ব ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ ছিটমহলবাসীর বন্দিজীবন থেকে মুক্তির আখ্যান। স্বাধীনতার পর্ব। বেচুন মুখুজ্জে, হাফিজুররা চেয়েছিল ছিটরোধ করতে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। উপন্যাসের শেষের দিকে হাফিজুরের মধ্যে যে অনুশোচনা, অর্ন্তদ্বন্দ্ব, সেখানে কোথাও যেন পাঠকের মনে তার প্রতি করুণা জেগে উঠবে। মিথ, ইতিহাস, অলিখিত ইতিহাস, রূপকথা সব মিলেমিশে ছিটমহলবাসীর যে করুন জীবনযন্ত্রণার, অসহায়তার আখ্যান শুনিয়েছেন লেখক, তা যুগসন্ধির চিহ্নবাহী, সামাজিক ইতিহাসের অবিস্মরণীয় দলিল। লেখক ছিটমহলের ইতিহাস সম্বন্ধে বলেছেন: ‘ছিটমহল কথাটা দুইরকম। একটা নাকি ইতিহাস। অন্যটা ইতিহাস থেকে লুকিয়ে রাখা এক কাহিনী। রাজা-নবাবের ইতিহাস তো সমস্তটা লেখা হয় না। রাজা-নবাব যেমন বলবেন,ইতিহাস লেখা হবে তেমন করে। তাই সেই ইতিহাসের ভিতরে যা লুকিয়ে থাকে, তার কিছুটা আন্দাজ করে নিতে হয়। পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা কথা ও কাহিনি সেই আন্দাজটা দিতে পারে। আর তা থেকে ইতিহাস তৈরি হতে পারে। ইতিহাস তো নির্মাণ, যে যেমন ভাবে তার আভাস পায় ছড়িয়ে থাকা জীবন থেকে।’

এই উপন্যাসে ছিটমহলবাসীর করুণ যন্ত্রণার পাশাপাশি বিমলেশের (লেখকের) শিকড় সন্ধানের টান ও হাহাকার স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। ছিটমহল আন্দোলনের নেতা ভুবন সেনের স্বপ্ন সার্থক হয়। ২০১৫ সালে ১ আগস্ট ছিটমহল স্বাধীনতা অর্জন করে। দেশের পরিচয় পেয়ে স্বাধীনতার নতুন সূর্য দেখেছে ছিটমহলবাসী। ছিটমহল নিয়ে লেখা অমর মিত্রের এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে একটা আলাদা জায়গা করে নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

উপন্যাস: কুমারী মেঘের দেশ চাই

লেখক: অমর মিত্র

প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং

মূল্য: ৩৫০ টাকা

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত